বিএনপি ‘শয়তানের সঙ্গে ঐক্য’ করবে!

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 1 Oct 2018, 11:09 AM
Updated : 1 Oct 2018, 11:09 AM

প্রকৃতিতে চলছে শরৎকাল। নিকট অতীতেও শরৎ ছিল অবকাশ যাপন, তালের পিঠা ও পাগলা হাওয়ার ঢেউ খেলানো কাশবনের ঋতু। তালপাকা গরম আর মোলায়েম সফেদ কাশফুল এ ঋতুর সমার্থক। এর চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য কালিমাখা মেঘ নীল আকাশের সীমানা থেকে পালাই পালাই করে। পানিহারা পেঁজা পেঁজা মেঘের টুকরো ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। অবিরাম বর্ষণের ঝম্ ঝম্ শব্দ থাকে না। সূর্য রশ্মির খরতায় অসহনীয় গরম বিরাজ করে সর্বত্র। বৃক্ষমুণ্ডের তালগুলো পেকে কালচে লাল রং ধারণ করে। জর্দা রঙ্গা শিউলি ফুল ফোটে দেহে স্নিগ্ধতার আমেজ মেখে। নদীর কূলে কূলে কাশবনের মায়াবী আমন্ত্রণ। দুরন্ত শিশু-কিশোরের দল সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে দস্যিপনায় মেতে ওঠে। তবে এবার বর্ষা পুরোমাত্রায় না হওয়ায় কাশবনও যেনো অন্যরকম অভিমান করেছে!

অসহনীয় ভ্যাঁপসা গরম এবার শরতের চরিত্রে যেন স্থায়ী কালিমা লেপন করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রতি বিএনপির যেমন অভিযোগের কোনো শেষ নেই, এবারের শরৎকে নিয়ে আমাদেরও অভিযোগের কোনো শেষ নেই। ভাদ্র গিয়ে আশ্বিন পড়লেও প্রকৃতির তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। প্রচণ্ড গরমে জনজীবন প্রায় ওষ্ঠাগত। প্রখর রৌদ্রের উত্তাপ দেশবাসীকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতে লোডশেডিং।

ভাদ্র এবং আশ্বিনের গরম প্রাচীনকাল থেকেই সুবিখ্যাত। এই গরমে মানুষ তো বটেই, কুকুর পর্যন্ত বেতাল হয়ে পড়ে। কুকুরের আচরণে বিরাট পরিবর্তন আসে। এ মাসে কুকুর সমাজের একটা বড় অংশই গরমে দিশেহারা হয়ে যায়। মানুষ সতর্ক হয়। গ্রামগঞ্জে এখনো কুকুর দেখে গরমের তীব্রতা অনুমান করা হয়। মাঝেমাঝে দেখা যায়, কোনো জলাশয়ে কুকুর নেমে পড়লে ছেলে-মেয়েরা সেই জলাশয়ে গোসল করতে নামতে ভয় পায়। তখন দুষ্টু বালক-বালিকার দল ঢিল ছুঁড়ে মেরে কুকুরটাকে দূরে সরাতে চেষ্টা করে। কিন্তু কুকুর অনমনীয়। নড়াচড়ার কোনো নামই নেয় না! গরম বলে কথা!

আমাদের দেশের রাজনীতিও এই শরতের রৌদ্র-তাপে কিছুটা তেঁতে উঠেছে। নির্বাচনমুখী নানা জোট গঠনের হিরিক দেখা যাচ্ছে। কে কার সঙ্গে জোট করবে-এ নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। জোট গঠনের ক্ষেত্রে নীতি-আদর্শের কোনো বালাই দেখা যাচ্ছে না। কেবলই দল ভারী করার একটা নগ্ন প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে।

ক্ষমতার বৃত্ত থেকে অনেক দূরে সরে যাওয়া বিএনপিওয়ালারা এই গরমে সবচেয়ে বেশি পেরেশানের মধ্যে আছে। এই দলের বাক্যবাগীশ এক নেতা তো 'শয়তানের সঙ্গে ঐক্য' করার ঘোষণা দিয়েছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ৩০ সেপ্টেম্বর বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি আয়োজিত জনসভায় বলেছেন, 'রাজপথে যদি শয়তানও থাকে, তার সঙ্গে ঐক্য হবে।'

গয়েশ্বর রায়ের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী ঐক্য সম্পর্কে বিএনপির অভিপ্রায় আমরা জানতে পারলাম। তবে শয়তানের সঙ্গে বিএনপিকে কেন ঐক্য করতে হবে সেটা ঠিক বোঝা গেল না। তবে কি বর্তমান ক্ষমতাসীনরা গয়েশ্বর রায়দের চোখে শয়তানের চেয়েও অধম?

শয়তান সম্পর্কে আমাদের ধারণা কিন্তু মোটেও ভালো নয়। শয়তান বলতে আমরা সাধারণত ইবলিশকেই বুঝি। কিন্তু ব্যাকরণগতভাবে শয়তানের রয়েছে বহুরূপী অর্থ এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য। শয়তান শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল হিব্রু ভাষায় যার অর্থ শত্রু অথবা কুমন্ত্রণাদাতা। আরবি ভাষায় শয়তান অর্থ ছাই ফেলার পাত্র বা ছাইদানি, দূরবর্তী অস্পষ্ট কিছু, অশুভ আত্মা, নিষ্ঠুর ও ষড়যন্ত্রকারী ব্যক্তি। পাপাত্মাদের অধিপতি ইত্যাদি। এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে যদি বিএনপি সত্যি সত্যি জোট করে, তাহলে কি তেমন 'শয়তানের জোট'কে মানুষ ভোট দেবে? দেশের মানুষ কি তেমন 'শয়তান'কেই বেছে নেবে?

আমাদের জানা মতে, শয়তান কেনো দিন সরল চিন্তা করে না। কূটিলতা, অবিশ্বাস, সন্দেহ এবং অকৃজ্ঞতা হলো শয়তানের প্রধানতম অলংকার এবং পরিচ্ছদ। প্রত্যেক বিষয়ের মধ্যে মন্দ জিনিসের খোঁজ করা, প্রতিটি সৃষ্টির দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ানো এবং সেসব দোষত্রুটি দশমুখে প্রচার করার জন্য শয়তানি মন-শয়তানি বাকপটুতা এবং শয়তানি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বড্ড বেশি নড়াচড়া করে।

মানুষের সঙ্গে শয়তানের পার্থক্য হলো-মানুষ সব সময় বিনম্র, ভদ্র, সদালাপ ইত্যাদি মহৎ গুণাবলি চর্চার মাধ্যমে জন্মলাভের সার্থকতা খুঁজে ফেরে। সবাইকে সম্মান প্রদর্শন, মমত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা এবং স্নেহের পরশে আগলে রাখার জন্য নিজের পাঁচটি ইন্দ্রেয়কে সব সময় সজাগ, সচেতন এবং কর্মক্ষম রাখার জন্য মানুষ অনাদিকাল থেকে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে আসছে।

পক্ষান্তরে শয়তানেরা সব সময় রুক্ষ, রূঢ়, বদমেজাজি এবং অত্যাচারী মনোভাবের হয়ে থাকে। নিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে শতভাগ স্বার্থপর এবং অন্যের অধিকার হরণে তারচেয়েও বেশি তৎপরতা দেখানোর মাধ্যমে শয়তানেরা নিজেদের শয়তানি জীবনের সার্থকতা খুঁজে ফেরে।

মানুষেরা মিথ্যাচার, ব্যভিচার, অনৈতিক বিষয়-আশয়, চুরি চামারি, ঘুষ-দুর্নীতি, লোক ঠকানো এবং অন্ধকারের নিষিদ্ধ কর্মসমূহকে প্রবলভাবে ঘৃণা করে। অপর পক্ষে, শয়তানেরা ওসব কর্মের মধ্যেই নিজেদের সফলতা, সার্থকতা এবং আনন্দ খুঁজে বেড়ায়। মানুষ বেশির ভাগ সময় স্থির থাকে। অতীতকে মূল্যায়ন করে এবং বর্তমানকে কাজে লাগায়। শয়তানেরা অতীত নিয়ে আপসোস অথবা অহংকারের মাধ্যমে বর্তমানকে মাটি করে দেয় এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে অলীক কল্পনায় শূন্যের ওপর তাসের ঘর নির্মাণে ব্যস্ত থাকে।

এমন 'শয়তানের' সঙ্গে বিএনপি যদি সত্যি সত্যি ঐক্য করে, তাহলে দেশের মানুষকে সেই 'শয়তানের জোট'কেই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে?

পুনশ্চ: কথায় আছে ঈমানদারকে বেঈমানও বিশ্বাস করে, কিন্ত বেঈমান, বেঈমানকেও বিশ্বাস করেনা। আবার শয়তান শয়তানকে বিশ্বাস করে। শয়তানের সঙ্গে ঐক্য করে। কিন্তু ঈশ্বরও অনেক সময় শয়তানকে ঘাটাতে চায় না। এ ব্যাপারে একটি পুরনো কাহিনি সংক্ষিপ্তাকারে বলা যাক।

স্বর্গ আর নরক, দুটি পাশাপাশি জায়গা। দু'জায়গার মধ্যে একটা বহু পুরনো পাঁচিল রয়েছে, তার অতিশয় ভগ্নদশা। সেই কবে সত্যযুগে সে প্রাচীর নির্মিত হয়েছিলো, অযুত-নিযুত বছর পরে আজ সে দেয়াল কোনো কাজে লাগছে না। মাঝে-মাঝেই নরকের দু-চারজন দুর্দান্ত অধিবাসী শান্তির স্বর্গে ঢুকে সেখানকার পবিত্র পরিবেশ তছনছ করে দিচ্ছে।

ঈশ্বর অবশেষে বাধ্য হয়ে শয়তানের সঙ্গে দেখা করলেন। শয়তান তো শয়তানই; সে বললো দেয়াল ভেঙে গেছে তাতে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। যদি তোমার অসুবিধা হয় তুমি সারিয়ে নাও।

ঈশ্বর অনেক বোঝালেন শয়তানকে; কিন্তু শয়তান নাছোড়বান্দা। সে কিছুতেই রাজি হলো না দেয়াল সারাতে। সে ঈশ্বরের অনুরোধে মোটেও কর্ণপাত করলো না।

মহামহিম ঈশ্বর আর কী করেন, নিজের খরচেই দেয়াল সারালেন। তবে সারানোর সময় শয়তানকে বললেন, দেখো এবার আমি সারালাম বটে, কিন্তু ভুলে যেও না এটা দু'জায়গার মধ্যে কমন ওয়াল। তোমার দায়িত্ব ফিফটি-ফিফটি, সমান-সমান। এর পরের বার সারানোর দায় তোমার।

এদিকে কিন্তু দেয়াল বানানোর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে দুর্দান্ত নারকীরা আবার দেয়াল ভেঙে ফেলল। যারা স্বর্গের কিন্নরী আর সোমরসের আস্বাদ পেয়েছে, তারা আবার স্বর্গে যথেচ্ছাচার শুরু করে দিলো।

ঈশ্বর এবার মরিয়া হয়ে অনেক দেন-দরবার করে শয়তানকে গিয়ে ধরলেন। সবাই বললো শয়তানকে, আগেরবার ঈশ্বর দেয়াল সারিয়েছে, এবার তুমি সারাবে। আর দেখবে যেন এ-রকম আর না হয়। তোমার লোকেরা যেনো স্বর্গে ট্রেসপাস না করে।

সবার চাপে পড়ে শয়তান বললো, এখন তার হাতে টাকা নেই। দেয়াল সে সারাতে পারছে না, তবে ঈশ্বর যদি দেয়াল সারিয়ে নেয় আর আবার যদি কখনো দেয়াল ভেঙে যায়, সে তখন দেখবে। তাছাড়া নরকের দু'চারজন যদি মাঝে-মধ্যে স্বর্গে যায়, তাতে আপত্তির কী থাকতে পারে!

ঈশ্বর যদি স্বর্গের দু'চারজনকে নরকে বেড়াতে পাঠান, সে তাতে মোটেও আপত্তি করবে না। শয়তানের শয়তানি ধরতে কারো কোনো কষ্ট হলো না। বেশি আলোচনার মধ্যে না গিয়ে শয়তানের সঙ্গে ঈশ্বর রফা করলেন যে, এবারো তিনি দেয়াল সারিয়ে নেবেন তবে এরপর দেয়াল ভাঙ্গলে শয়তানকে তা সারাতে হবে।

শয়তানের মুখের কথার বিশ্বাস নেই। তাই ঈশ্বর শয়তানের সঙ্গে রীতিমত লিখিত চুক্তি করলেন এবং সেই চুক্তিপত্রে দুজনেরই স্বাক্ষর রইলো।

বলা বাহুল্য, অল্পদিনের মধ্যেই নরকের সেই পাজি অধিবাসীরা আবার দেয়াল ভেঙে স্বর্গে ঢুকে গোলমাল করতে লাগলো। এবার ঈশ্বর গিয়ে শয়তারকে ধরলেন, চুক্তির কথা মনে আছে তো, এবার তোমাকে সারাতে হবে।

শয়তার বললো, চুক্তি! কিসের চুক্তি? ঈশ্বর স্বর্গের দপ্তর থেকে সেই চুক্তিনামা নিয়ে এলেন, এনে শয়তানকে দেখালেন। এই দেখো চুক্তি। এই সেদিন তুমি সই করে চুক্তি করলে, আর এখন বলছো কিসের চুক্তি?

শয়তান নির্বিকারভাবে বললো, কবে কী করেছিলাম জানি না। এসব চুক্তি আমি মানি না।

ঈশ্বর রেগে গিয়ে বললেন, ঠিক আছে। তা-ই যদি বলো, আমি এই দলিল নিয়ে আদালতে যাচ্ছি, তোমার নামে মামলা করবো।

শয়তান মুচকি হেসে বললো, তা যাও আদালতে সেখানে কোনো সুবিধা হবে না। ঈশ্বর থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, কেন?

শয়তান বললো, মামলা যে করবে উকিল পাবে কোথায়? তুমি কি মনে করো তাদের কেউ তোমার পক্ষ নেবে? তোমার ওখানে কি তেমন কেউ আছে?

ঈশ্বর অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তিনি সবই বুঝলেন এবং শয়তানের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করলেন না।

স্বর্গ এখন অবারিত-দ্বার, ভাঙ্গা দেয়াল আরো ভেঙ্গেছে। আর সেই দেয়ালের ফাঁক দিয়ে নরকের অধিবাসীরা নিয়ত স্বর্গে যাতায়াত করছে, নন্দন-কাননে গিয়ে ফূর্তি পর্যন্ত করছে!