এসকে সিনহার ফিরে আসা

কবির য়াহমদ
Published : 25 Sept 2018, 01:25 PM
Updated : 25 Sept 2018, 01:25 PM

সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহাকে নিয়ে আলোচনা শেষ হয়নি। দেশত্যাগের এক বছরের মাথায় তিনি ফিরেছেন, এবং আগের মত আরও সরব আলোচনায়; সে আলোচনা নতুন ভূমিকায়, নতুন আঙ্গিকে। তার এই ফিরে আসার রাজনৈতিক-সামাজিক ও বৈশ্বিক প্রভাব কেমন হতে পারে সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না; এরজন্যে আমাদের আরও কিছুদিন হয়ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।

সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এবার আত্মজীবনী লিখেছেন। তার সে আত্মজীবনীতে ওঠে এসেছে প্রধান বিচারপতি থাকাকালে তার বহুল আলোচিত ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার ভূমিকাও। সেখানে তিনি লিখেছেন এর আগেরও বিভিন্ন ঘটনা কথা যেখানে ছিল তার উপস্থিতি। ফলে স্বভাবতই এটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠবে আগামীর রাজনীতি ও বিচার ব্যবস্থার বিশ্লেষকদের কাছে।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নেওয়ার আপিলের রায় নিয়ে মূলত সরকারের সঙ্গে তার দূরত্বের সূত্রপাত। গত বছরের ১ অগাস্ট আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে প্রধান বিচারপতির কিছু পর্যবেক্ষণকে ভালোভাবে নেয়নি সরকার। সরকারি দল ও জোটের নেতা, সাংসদ ও মন্ত্রীরা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখান। জাতীয় সংসদ ও এর বাইরে প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে আক্রমণাত্মক বক্তব্যও দেওয়া হয়। সরকারি দলের অনেক নেতা তখন প্রধান বিচারপতিকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হবে বলেও হুমকি দেন।

এমন পরিস্থিতিতে ছুটি নিয়ে দেশ ছাড়েন প্রধান বিচারপতি। আপিল বিভাগের বিচারপতিরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে এসকে সিনহার বিরুদ্ধে নালিশও করেন। এরপর জানা যায় তারা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে একই বেঞ্চে বসে বিচার কাজ করতে আগ্রহী নন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি করা হয় আবদুল ওয়াহহাব মিঞাকে। আওয়ামী লীগের কজন মন্ত্রী প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেন। মন্ত্রীদের বক্তব্যের পর দুদকের বক্তব্যও শোনা যায়।

এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়ার পর তার পদত্যাগের খবর জানায় সরকার। পুরো ব্যাপারটা রহস্যময় হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রীদের একের পর এক বাক-আক্রমণের সময়ে প্রধান বিচারপতির রহস্যজনক ছুটি ও এরপরের পদত্যাগ নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা হয়। আবদুল ওয়াহহাব মিঞা ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি থাকাকালে সরকার নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির বিধিমালা ও আচরণবিধি প্রণয়ন করে এবং সেটা আদালতে গৃহীত হয়। অথচ এই বিধিমালা ও আচরণবিধি নিয়ে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা ও সরকারের মধ্যে অনেক দেনদরবার চলছিল। সরকারের প্রস্তাব বারবার আদালত থেকে ফিরে এসেছে। বারবার সংশোধনী এনেছেন এসকে সিনহা। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ না করার জন্যে তিনি সংশোধনী দিয়ে যাচ্ছেন, এটা ছিল তার দাবি। কিন্তু এসকে সিনহার বিদায়ের পর আবদুল ওয়াহহাব মিঞা সরকারের দেওয়া সেই বিধিমালা ও আচরণবিধি গ্রহণ করেন, অথচ এসকে সিনহার সময়ে এই গ্রহণ না করার দলে তিনিও ছিলেন।

এসকে সিনহার বিদায়ের পর আবদুল ওয়াহহাব মিঞাকে ভারপ্রাপ্ত থেকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেননি রাষ্ট্রপতি। এরপর ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন আবদুল ওয়াহহাব মিঞা। এসকে সিনহার পদত্যাগের পরেও তার স্বাভাবিক মেয়াদকাল শেষ হওয়ার পর নতুন প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সময় নেওয়াটা নতুন প্রধান বিচারপতিকে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রাখার সরকারের চেষ্টা হয়ত ছিল, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কারণ সরকার জানত এসকে সিনহার বিদায় স্বাভাবিক কোন বিদায় ছিল না, এবং দেশ-বিদেশে এই বিদায় ছিল ব্যাপক আলোচনায়।

নতুন প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণের পর এসকে সিনহা আলোচনার বাইরে চলে যান। এরপর কেটে যায় নয়মাসের মত সময়। তারপর সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখে অ্যামাজনে প্রকাশ পায় তার আত্মজীবনী 'অ্যা ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল', হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি'।

আত্মজীবনীর প্রারম্ভিক বক্তব্য যা অ্যামাজনে শুরুতেই প্রকাশ পায় তাতে এসকে সিনহা লিখেন, '২০১৭ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের কারণে বর্তমান সরকার তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে। ওই রায়ের মাধ্যমে তিনি বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে যাওয়াকে অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন।

তার দাবি,  '২০১৭ সালে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পক্ষে একটি ঐতিহাসিক রায় দেওয়ার পর বর্তমান সরকার আমাকে পদত্যাগে এবং নির্বাসনে যেতে বাধ্য করে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারকদের সর্বসম্মত ওই রায়ে রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রবণতা নিয়ে আমি যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছি, সেটি দেশের মানুষ ও সুশীল সমাজ ভালোভাবে গ্রহণ করেছে এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ভালো গুরুত্ব পায়।' তার সরকারি বাসভবনে বন্দি অবস্থান ছিলেন এমন দাবি করে এসকে সিনহা লিখেন, 'আমি আমার সরকারি বাসভবনে বন্দি ছিলাম। আইনজীবী এবং বিচারপতিরা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন; মিডিয়াকে বলা হয়েছে আমি অসুস্থ এবং আমার চিকিৎসা ছুটি চেয়েছি। কয়েকজন মন্ত্রী বলেছেন আমি চিকিৎসা ছুটিতে বিদেশে যাব।'

সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার এই আত্মজীবনী ইতোমধ্যে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত এ বই নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এই আলোচনা-সমালোচনাকারীদের মধ্যে সাধারণ ফেইসবুক ব্যবহারকারী থেকে শুরু করে আছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক থেকে শুরু করে শাসক দল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী।

ওবায়দুল কাদের বই প্রকাশকে শুরুতে গুরুত্ব না দিতে বললেও ২১ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের এক অনুষ্ঠানে বই প্রকাশকে 'সরকারের বিরুদ্ধে উসকানি' হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন,  'তাঁর (এসকে সিনহা) লেখা বই তিনি প্রকাশ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে আমার শুধু একটাই প্রশ্ন, তা বিদেশের মাটিতে বসে কেন? আর নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন? বইটি আরও দুই-তিন মাস পরেও প্রকাশ করা যেত। বইটি এ সময়ে প্রকাশ করে সরকারবিরোধি অপপ্রচারের উসকানি এ সময় তিনি না দিলেও পারতেন।'

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এ বইকে 'পরাজিত মানুষের হা-হুতাশ মাত্র' বিশেষণ দিয়ে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, 'এসকে সিনহা একজন দুর্নীতিবাজ। সাবেক হওয়ায় এখন অন্তর্জ্বালায় ভুগছেন তিনি। বিদেশের মাটিতে বসে মনগড়া কথা দিয়ে বই লিখে জনগণকে বিভ্রান্ত করার পায়তারা চালাচ্ছেন।'

এদিকে, সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ সরকার দাঁড় করাতে পারেনি; নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করতে চাওয়ায় তাকে চাপ প্রয়োগ করে পদত্যাগ করানো হয়েছে, এক সংবাদ সম্মেলনে এমনটাই দাবি করেছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। কমিটির সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন সংবাদ সম্মেলনে সরকারের কাছে জানতে চান, 'কোথায় সেই দুর্নীতির অভিযোগ। তার বিরুদ্ধের একটি বাস্তবভিত্তিক দুর্নীতির অভিযোগ দাঁড় করাতে পারেন নাই। এর অর্থই হচ্ছে শুধু ষোড়শ সংশোধনী এবং মাজদার হোসেন মামলায় নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা করতে চেয়েছিলেন, তাই তাকে (এসকে সিনহা) চাপ প্রয়োগ করে পদত্যাগ করানো হয়েছে।'

ফলে ধারণা করাই যায় আগের মত এখনও এসকে সিনহার ইস্যুটি রাজনীতির মাঠে মেঠো বক্তৃতার উপকরণ যোগাবে অনেকটাই। তবে এই রাজনীতিকরণের বাইরে যা উল্লেখের সেটা হচ্ছে এই বইটি ক্রমে আলোচনার খোরাক হয়ে ওঠেছে, এবং সাবেক প্রধান বিচারপতির কথাগুলো আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাইরের সাধারণ মানুষের কাছে অনেকটাই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। এর প্রধান কারণ তার ছুটি-পদত্যাগ এবং পদত্যাগের আগে সরকারি দল আওয়ামী লীগের ভূমিকা ও নেতা-মন্ত্রীদের বক্তব্য। এক বছর আগে ঠিক এই সময়ে শাসক দল আওয়ামী লীগের বক্তব্যে পরিষ্কার ছিল তার দেশত্যাগে বাধ্য করানোর কথা, এবং শেষ পর্যন্ত তাকে দেশই ছাড়তে হয়েছিল। অন্য কারণ হলো দলনিরপেক্ষ মানুষদের কাছে সরকারবিরোধী যেকোনো বক্তব্য কিংবা ভূমিকাই কিছুটা হলেও মনোযোগ আকর্ষণ এবং সমর্থন পায়। এসকে সিনহা যে পরিস্থিতিতে দেশ ছাড়েন, যে পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করেন সেসব ঘটনা কোনোভাবেই সরকারকে সন্দেহের বাইরে রাখেনি, উলটো বিভিন্নভাবে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

'অ্যা ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল', হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি' শীর্ষক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে এসকে সিনহা সত্য লিখেছেন নাকি মিথ্যা লিখেছেন সেটা নিরূপণ অসম্ভব। তিনি তার অবস্থান থেকে লিখেছেন, আমরা আমাদের অবস্থান থেকে সেটাকে বিচার করছি। এই 'আমরা'র মধ্যে আবার কেউ কেউ আওয়ামী লীগপন্থী যারা পড়ার আগেই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছেন সে গ্রন্থ, বলছেন সর্বৈব মিথ্যা কথা, আবার কেউ কেউ আওয়ামী লীগবিরোধী হিসেবে পড়ার আগেই সরকারের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধারে নেমেছেন। তবে এই দুই শ্রেণির বাইরে যে শ্রেণি তারা পূর্বাপর বিশ্লেষণের পর সিদ্ধান্ত নেবে, এবং সেই সময়টা একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির কলম থেকেই জানবে। ফলে এটা আগামীর একটা রেফারেন্স হতে যাচ্ছে।

এসকে সিনহার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সর্বশক্তি নিয়োগ, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বাক-আক্রমণ, তার পদত্যাগসহ সবকিছুই ইতিহাসের একটা ঘটনা হিসেবে পরিগণিত হবে, কিন্তু এর বিপরীতে বিদেশে দীর্ঘদিন নির্বাসিত জীবনের একটা সময়ে এসে আত্মজীবনীমূলক একটা বই লিখার কারণে সবকিছু ছাপিয়ে এ বইটা রেফারেন্স হিসেবে নির্ণিত হবে। এখানেই সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্যে একটা বড় আঘাত। আর এ বইটাই দৃশ্যমান বিজিত থেকেও এসকে সিনহার বিজয়ী হয়ে যাওয়া হয়ত। এ বই তাকে ফিরিয়ে এনেছে এই সময়ে, সব সময়ের জন্যেও।