প্রসঙ্গ আলোকচিত্রী শহিদুল আলম

আনিসুর রহমান
Published : 7 Sept 2018, 03:27 PM
Updated : 7 Sept 2018, 03:27 PM

অভিযোগ রয়েছে, ২০০৭-২০০৮ সালের দিকে ঢাকা শহরের 'অভিজাত একদল 'সংস্কৃতিসেবী' ধনী লোকের সঙ্গে ফ্রান্সের কর্তৃপক্ষের গোপন বোঝাপড়ার ফলে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান জাদুঘরের অনন্য সব নিদর্শন প্যারিসের গিমে জাদুঘরে প্রদর্শনীর নামে পাচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এর পক্ষের কুশীলবরা যুক্তি খাড়া করিয়েছিলেন তাতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। মোট কথা আমাদের দেশের জাদুঘরের সম্পদ ফরাসি দেশে প্রদর্শনীর নামে পাচার করা।

আর মূল নিদর্শনগুলোর নকল নমুনা আমাদের দেশে ফেরৎ পাঠানোই ছিল আসল উদ্দেশ্য। এজন্য এদেশের গণমাধ্যমের কতিপয় কর্তাব্যাক্তি থেকে শুরু করে সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রভাবশালী মহলের এক বড় অংশ এই প্রক্রিয়ার পক্ষে নেমেছিলেন। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের দুয়েকজন কর্মকর্তা এই পুরো দুই নম্বরী প্রক্রিয়া ফাঁস করে দিলে চিত্রশিল্পী নিসার হোসেনের নেতৃত্বে আস্তে আস্তে এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে ওঠে।

সেই আন্দোলনে আমার মতো অল্প বয়সী কয়েকজন যারা সেই সময়ে ঢাকার বিভিন্ন কাগজে কাজ করতাম বিশেষ করে সমকালের বেলাল হোসেন, যায়যায় দিনের আমিন আল রশীদসহ বেশ কয়েকজন ধারাবাহিক প্রতিবেদন ছাপতে থাকি। সেই আন্দোলনে দৃক গ্যালারির শহিদুল আলম ভাইয়ের বড় রকম অবদান ছিল। এই আন্দোলন চলাকালে আমি অনেকবার তার সাইকেলের পেছনে চড়েছি। উনার বাসায় গিয়েছি। উনার বাসায় দুয়েকবার দুপুরের খাবার খেয়েছি। মোট কথা প্রত্নসম্পদ পাচার-বিরোধী আন্দোলনে উনার অবদানে আমি দারুণভাবে মুগ্ধ। সেই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন উপদেষ্টা আইয়ুব কাদেরী পদত্যাগ করলেন, সংস্কৃতি সচিব ওএসডি হলেন, আর পরে প্যারিসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন।অনেকের বড় সাধের সেই প্রদর্শনী আর হল না।

আমাদের প্রত্নসম্পদ পাচারও ঠেকানো গেল। এরপর ফখরুদ্দিন জামানার শেষ হল। শেখ হাসিনার জামানা শুরু হল। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম প্রত্নসম্পদের নিরাপত্তায় যারা সোচ্চার ছিলেন তাদের অনেকেই দেশের জাদুঘরকে ভাঙ্গিয়ে নানা অজুহাতে নানা কর্মসূচি বা প্রকল্পের নাম করে অযাচিত সুবিধা বাগিয়ে নিতে ব্যতিব্যস্ত। এদের মধ্যে দৃকের প্রতিষ্ঠাতা শহিদুল আলমও অন্যতম। যতদূর জানি এই সরকারের আমলে তিনি ভালই সুবিধা করে নিয়েছেন। এই খবরগুলো জানার পর আমি অনেকটা অবাক হলাম এবং মনে মনে একটা ধাক্কা খেলাম।

তখনও জানি না আমাদের শহিদুল আলম ভাই 'আগে খান, পিছে খান'- খান আবদুস সবুর খানের বংশধর। স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক আমাদের প্রিয় আনোয়ার স্যার এভাবেই কনভেনশন মুসলিম লীগের সবুর খানের কথা বলতেন।

এবার আসি অন্য একটি প্রসঙ্গে। আমি গভীর মনোযোগের সঙ্গে খেয়াল করেছি- কতিপয় ব্যক্তি নাই বিষয়কে কেন্দ্র করে বড় ঘটনা ঘটাবার পায়তারা করছে, তার একটা কোটা আন্দোলন, অন্যটা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। এবার এই সব আন্দোলনে একদল ওঁত পেতে থাকা মানুষের পোয়াবারো। একবার খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বলেছিলেন 'পাগল' আর 'শিশু' ছাড়া নিরপেক্ষ কেউ নাই। কথাটা বেমালুম ভুল। আদতে যারা স্বাধীনতা বিরোধী, কিন্তু প্রকাশ্যে তা বলতে নারাজ। আবার স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেও বলতে দ্বিধান্বিত, তারা একটা সুবিধাজনক অবস্থানে চলে যান। উনারা 'নিরপেক্ষ'। এর গূঢ় অর্থ হল সুবিধাজনক পক্ষ। এই অবস্থান থেকে সবদিকে সুবিধা নেওয়া সহজ হয়। আর আমাদের দেশের সুশীল নামের 'ইভিল'রা এই কাজটিই করেন আর রাতবিরেতে ষড়যন্ত্রে মেতে থাকেন।

এবার আসি শহিদুল আলম প্রসঙ্গে। উনি নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে ঘিরে যে ভূমিকা নিয়েছেন সেটা একটু বিশ্লেষণ করা যাক। তিনি আন্দোলনে আলোকচিত্র নিতে গেছেন, সেখানে তাঁকে তো কেউ বাধা দেয় নি। তারপর উনি আল জাজিরার ফাঁদে পা দিয়েছেন অথবা নিজেই এই ফাঁদ তৈরি করেছেন। অপ্রাসঙ্গিকভাবে সরকারের বিরুদ্ধে সত্য আর অসত্য মিলিয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। উনি দেশে-বিদেশে বহুল পরিচিত মেধাবী একজন মানুষ।

বাংলাদেশে আলোকচিত্রীর পেশাকে প্রতিষ্ঠানিক রূপদানের অন্যতম পথিকৃত তিনি। একঝাঁক তরুণ আলোকচিত্রী তাঁর হাতে গড়া, যারা দেশের সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে কাজ করছে। তাঁর কারণেই অনেক নারী এই পেশায় এসেছেন এবং সফল হয়েছেন। পৃথিবীর বড় বড় সব আলোকচিত্রীর মেলা, আয়োজন ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শহিদুল আলমের দারুণ সখ্য। তার সুনাম পর্বত সমান। বাংলাদেশে 'ছবিমেলা'র প্রবর্তক তিনি। বিদেশের নানা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের অনুদানে নানা প্রকল্প তিনি বাস্তবায়ন করেছেন। অনেক বিখ্যাত লোক তাঁর বন্ধু এবং শুভাকাঙ্খী। তাঁর মানে এই নয় তিনি সরকারকে বিপদে ফেলার জন্যে তৎপরতা চালাবেন আর সরকার তা মেনে নেবে।

দেশে এবং বিদেশে আমার অনেক সহকর্মী ও বন্ধুরা শহিদুল আলমের গ্রেপ্তার বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে। আমি সাফ সাফ বলেছি- যে উপায়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। আর শহিদুল আলমও যে সব কর্মকাণ্ড করেছেন তাও মেনে নেবার কারণ নাই। উনি এমনকি ড. কামাল হোসেনের মেয়ের জামাই ডেভিড বার্গমেনের পক্ষে নেমে আদালতের বিরাগভাজন হয়েছেন।

একটি কথা বলে লেখাটি শেষ করতে চাই- সরকারকে বিপদে ফেলার তৎপরতা চালানো আর মত প্রকাশের স্বাধীনতা এক জিনিস না। শহিদুল আলম ভাইরা এটা জানেন। উনারা জেনেশুনেই ক্ষমতার রাজনীতিতে খেলতে নামেন। সেই খেলায় শেখ হাসিনা উনাদেরকে ছাড় দেবেন, তাকে এতটা বোকা ভাবার কোন কারণ নেই। বিদেশি বক্তৃতা-বিবৃতিতে যে লাভ হবে না, সেটাও প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন। আইনি প্রক্রিয়াতেই শহিদুল আলমের মুক্তি সম্ভব। আমি এমনটাই আশা করি।

একইসঙ্গে এখন আমাদের ভাবনা ও আলোচনার সময় মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে আমরা কতদূর পর্যন্ত যেতে পারি। দায়িত্বহীন স্বাধীনতা কোনো স্বাধীনতাই না, তা উচ্ছৃঙ্খলতা। এটা আমাদের মনে থাকলে ঝামেলা একটু কম হতে পারে। শহিদুল আলম ভাইরা কথাটা জানেন। জেনেশুনেই উনারা বিষ করেছেন পান।

দেশ বা বিদেশের কোনও চাপের কাছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের নতি স্বীকার করে নয়, বরং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়াতেই শহিদুল আলম মুক্তি লাভ করবেন বলে কামনা করি। তাহলেই সমূহ সকলের জন্যও মঙ্গল। ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন শহিদুল আলম ভাই!