তাহাদের কথা ২: নৈতিকতা বনাম ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 28 August 2018, 02:39 PM
Updated : 28 August 2018, 02:39 PM

একটা পুরনো ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনশন শুরু সকাল থেকে। বিকেলে তা ভাঙ্গানোর কথা ড. কামাল হোসেনের। ভোরের এক ফ্লাইটে ড. কামাল বিদেশে চলে যান। খবরটা ডা. বদরুদ্দোজা জানতে পারেন দুপুরের পর।

'ক্ষুধার্ত' ডা. বদরুদ্দোজা পড়েন বেকায়দায়। সাবেক রাষ্ট্রপতির অনশন কর্মসূচি যেন-তেন নেতাকে দিয়ে ভাঙালে দলের মর্যাদা থাকবে না। অনশনস্থলে টুপি পরে কোরান পাঠ শুরু করেন তিনি।

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হতেই মাদুর, টুপি, তসবিসহ অন্য জিনিস গুটিয়ে অনশনস্থল থেকে এক প্রকার পালিয়ে যান ডা. চৌধুরী, তাঁর অনশনের নেতাকর্মীরা। ঘটনাটি চার দলীয় জোট সরকারের আমলের। সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের প্রেস নোটস কলামে ঘটনাটির রসাত্মক বিশ্লেষণ ছাপা হয়েছিলো।

বাংলাদেশের অন্যতম প্রবীণ রাজনীতিবিদ ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। যিনি রাজনীতিতে বি চৌধুরী হিসেবে খ্যাত। তিনি ছিলেন বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তিনি উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯৬ সালে তিনি ছিলেন সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। এর কিছুদিন পর ২০০১ সালের নভেম্বর মাসে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক। এছাড়া তিনি একজন লেখক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, উপস্থাপক এবং সুবক্তা। ২০০২ সালে সৃষ্ট এক বিতর্কিত ঘটনার জের ধরে তিনি রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ও পরবর্তীকালে আরেকটি রাজনৈতিক দল বিকল্পধারা বাংলাদেশ গঠন করেন।

তার কাঁচাপাকা গোঁফের আড়ালে সারাক্ষণ ঝিলিক দেয় রহস্যময় হাসি! এক অজানা রহস্য! তিনি আপাত শান্ত স্থির। থেমে থেমে কথা বলেন। যে রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জিয়াউর রহমানকে ব্রাশ ফায়ারে ঝাঝড়া করে দেয়া হয়, পাশের আরেকটি রুমে তিনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকার 'দুর্লভ সুযোগ' পেয়েছিলেন। তিনি 'শহীদ' জিয়ার 'রাজনীতির লাশ'টি অনেকদিন বহন করেছেন। একসময় সেই 'লাশবাহী রাজনীতি' পরিত্যাগও করেছেন (পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন)। এখন তিনিই আবার আওয়ামী শাসনের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না, কাদের সিদ্দিকী, আসম আবদুর রবসহ রাজনীতিতে 'পরিত্যক্ত' কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে জোট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। সরকারের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়ছেন। শিগগিরই 'কিছু একটা করে ফেলবেন'-এমন একটা ভাব দেখাচ্ছেন।

কিন্তু বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে দিয়ে আদৌ কি কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন আনা সম্ভব? তিনি আজ যে বড় বড় কথা বলছেন, নীতি-নৈতিকতার সবক দিচ্ছেন, সেই তিনি কোন রাজনীতির পথ মাড়িয়ে এসেছেন? এক সময় তিনি যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক চরিত্র নিয়ে রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তার সেই রূপ আমরা ভুলব কেমন করে? আমরা কেমন করে ভুলব 'সাবাস বাংলাদেশ' নামক সেই চরম সাম্প্রদায়িক টিভি অনুষ্ঠানটির কথা?

বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মানসিকতা, দর্শন, রুচি ইত্যাদির চূড়ান্ত পরিচয় আমরা পাই ২০০১ সালের বিএনপির নির্বাচনী প্রচারণায়। প্রকাশ্যে এত বেশি সাম্প্রদায়িকতা, (বলা ভালো হিন্দু-বিদ্বেষ) বাংলাদেশে অন্য কোনো রাজনীতিবিদ কখনও ছড়িয়েছেন বলে মনে পড়েনা।

উল্লেখ্য, ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে টিভিতে বি চৌধুরীর উপস্থাপনায় 'সাবাস বাংলাদেশ' নামে ১১ পর্বের একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। একুশে টেলিভিশন ও বিটিভিতে একযোগে প্রচারিত মিথ্যে, বানানো তথ্য আর প্রপাগাণ্ডায় ঠাসা এই অনুষ্ঠানে বি চৌধুরী এক হাতে গীতা আর অন্য হাতে কোরান নিয়ে বলতেন, বাংলাদেশের মানুষকে ঠিক করতে হবে তারা কি গীতার (ভারত তথা আওয়ামী লীগ), নাকি কোরানের (বিএনপির) পক্ষে থাকবে। অনেকের ধারণা, ২০০১ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির পিছনে সেই অনুষ্ঠানের একটা বড় ভূমিকা ছিল।

যে বিএনপির জন্য তিনি এত কিছু করেছেন, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছেন, নীতি-নৈতিকতা-বিবেকবোধ বিসর্জন দিয়ে মিথ্যেকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়ার চেষ্টা করেছেন, সেই তিনিই শেষ পর্যন্ত বিএনপির গলাধাক্কার শিকার হয়েছেন!

২০০১ সালে বিএনপি জামাত জোট ক্ষমতায় আসার পর বি চৌধুরীকে বিএনপি রাষ্ট্রপতি পদে আসীন করে। কয়েক মাস না যেতেই আসে জেনারেল জিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি নিজেকে 'নিরপেক্ষ' প্রমাণ করতে তিনি জিয়ার কবরে ফুল দিতে যাননি। এতেই ক্ষেপে যায় দলের সব এমপি। একপর্যায়ে ২০০২ সালের ১৯ ও ২০ জুন বিএনপির সংসদীয় দলের সভায় রাষ্ট্রপতি পদ থেকে তাঁকে সরানোর জন্য `ইমপিচমেন্ট`-মানে গলাধাক্কা দেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়।

ওই প্রস্তাব সংসদে উত্থাপনের আগেই ২১ জুন রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন বি চৌধুরী। জিয়ার মাজারে না যাওয়ার চেয়ে বড় কারণ তখন আলোচিত ছিল অধ্যাপক চৌধুরীর পুত্র মাহী বি চৌধুরীর সঙ্গে জেনারেল জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের ভাগাভাগির দ্বন্দ্ব। নিজ যোগ্যতায় মাহী বি চৌধুরী খুব দ্রুতই মিডিয়া ও শোবিজ জগতের দখল নিয়ে নেন। গণমাধ্যম, প্রচারমাধ্যম, ও বিনোদন জগতের একচেটিয়া ব্যবসা মাহীর কব্জায় চলে আসে। বিষয়টি তারেক রহমানের গোচরে আনেন বিএনপিরই কোনো কোনো তরুণ নেতা।

তারেক রহমান বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেন। তিনি মাহিকে উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার মওকা খোঁজেন। সে মওকা পেয়েও যান। জিয়ার মাজারে না যাওয়াটাকে ইস্যু হিসেবে নিয়ে তারেক রহমানের ঈঙ্গিতে দলের তরুণ এমপিরা বিদ্রোহ করেছিলেন। একদিকে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র আরেক দিকে রাষ্ট্রপতির পুত্র। অনেকে মনে করেন, এই দ্বন্দ্বেই বি চৌধুরীকে হারাতে হয় রাষ্ট্রপতির পদ।

বিএনপিতে মাহী বি চৌধুরীর উত্থানও ধুমকেতুর মতো। বদরুদ্দোজা চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হলে তার ছেড়ে দেওয়া আসনে পুত্র মাহী বি চৌধুরী বিএনপির ব্যানারে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর বাগ্নিতা ও বুদ্ধি খাটিয়ে খুব দ্রুতই মাহী বিএনপির ভবিষ্যৎ কান্ডারি হওয়ার এবং নতুন বলয় সৃষ্টির আভাস দেখান। আর এখান থেকেই পতনের বীজটাও বপন হয়ে যায়।

বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বিএনপি অত্যন্ত অপমানজনকভাবে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে সেই বি চৌধুরীই কথায় কথায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চরম বিদ্বেষপূর্ণ সব মন্তব্য করছেন। বেগম জিয়াকে জেলে পাঠানোর বিরুদ্ধে, লন্ডনে খালেদার চিকিৎসার পক্ষে ওকালতি করছেন। এখন বদরুদ্দোজা চৌধুরীর চোখে বিএনপি অনেক ভালো দল। রাষ্ট্রপতির চেয়ার থেকে থেকে গলা-ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনাই তিনি শুধু ভুলে যাননি, ভুলে গেছেন পুত্র ও পুত্রবধূকে অপমানের কথাও!

পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার পর তিনি নতুন দল গঠন করে রাজধানীতে একটি মিছিল বের করলে তার উপর বিএনপি কর্মীরা মারাত্মক ভাবে হামলা চালায়। ঢাকায় তার বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মাহী বি চৌধুরী ও তার স্ত্রী লোপা এক সঙ্গে মিলে তখন বিটিভিতে একটি অনুষ্ঠান করতেন, তাদের স্বামী স্ত্রীকে ঐ অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হয়নি এবং বের করে দেওয়া হয় বিটিভি থেকে। বন্ধ হয়ে যায় সেই জনপ্রিয় অনুষ্ঠানটি।

এক সাক্ষাৎকারে সেই সময়ের ঘটনা সম্পর্কে তিনি স্বয়ং বলেছেন, তখন খুব দুঃসময় গেছে। পাথর মেরে মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। তাঁর কারখানার যেসব পণ্য রপ্তানির জন্য চট্টগ্রামে ছিল, জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাঁর বিভিন্ন কারখানায় আক্রমণ করা হয়েছে। মাহীর ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে দিয়েছে। আমার পেছনে পিস্তল দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে গেছে (কালের কণ্ঠে প্রকাশিত সাক্ষাৎকার, ৭ অক্টোবর, ২০১৬)।

এরপরও তিনি যখন বিএনপির প্রতি নরম সুরে আর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চরম সুরে কথা বলেন, তখন তার সুরের যথার্থতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।

বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অসংখ্য দোষ-ত্রুটি আছে মানি। কিন্তু দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন, গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক আচরণ নিয়ে যখন বদরুদ্দোজা চৌধুরী কথা বলেন, তখন কেমন যেন প্রহসনের মতো মনে হয়। এই দেশে ভোট নিয়ে খেলা এবং ভোট নিয়ে যতো অনিয়ম তা তো বদরুদ্দোজা চৌধুরীর হাতে গড়া দল বিএনপিরই সৃষ্টি। জিয়া সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় বিচারপতি সায়েমকে অস্ত্র ঠেকিয়ে যখন ক্ষমতা দখল তখন কি তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন? ১৯৮১ সালের নির্বাচন কেমন কেমন হয়েছিল? মাগুরার উপ-নির্বাচন কেমন হয়েছিল? ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনটাই বা কেমন হয়েছিল? বদরুদ্দোজা চৌধুরী কি তখন বিএনপির নেতা ছিলেন না?

ইতিহাসের পাঠ না নিয়ে, ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে বি চৌধুরী এখন আবার ড. কামাল হোসেন, কাদের সিদ্দিকী, আসম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীদের সঙ্গে নিয়ে জোট গঠন ও সরকার পতনের আওয়াজ দিচ্ছেন। বড় বড় বুলি আওড়াচ্ছেন।

কিন্তু ইতিহাস, দেশের মানুষ কি তাকে ক্ষমা করেছে? ক্ষমা করবে?

পুনশ্চ: ইতিহাসজ্ঞান না থাকলেও নকল করে কিংবা অন্যেরটা দেখে অনেক সময় পরীক্ষায় পাস করা যায়। কিন্তু তার ফলও হয় ভয়াবহ! এ বিষয়ে পাঠকদের জন্য একটা পুরনো কৌতুক।

ক্লাসের মেধাবী ছাত্র দুর্জয় লিখল 'যুদ্ধে হারিয়া হুমায়ুন ভাঙ্গিয়া পড়িলেন না। তিনি পিতা ও গুরু বাবরের কথা স্মরণ করিলেন। বাবর কি যুদ্ধে হারিয়া কখনও ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছেন? পড়েন নাই। বরং উল্লসিত হইয়া সহস্র সঙ্গী জোগাড় করিয়া আবার যুদ্ধ করিয়াছেন। যুদ্ধ-জয়ের জন্য ভালো সঙ্গী প্রয়োজন।'

পেছনে বসা আসিফ উঁকি দিয়ে এক ঝলক দেখে নিয়ে লিখল 'যুদ্ধে হারিয়া হুমায়ুন জাঙ্গিয়া পড়িলেন না। তিনি পিতা ও গরু বাবরের কথা স্মরণ করিলেন। বাবর কি যুদ্ধে হারিয়া কখনও জাঙ্গিয়া পড়িয়াছেন? পড়েন নাই। বরং উলঙ্গ হইয়া সহস্র লুঙ্গি জোগাড় করিয়া আবার যুদ্ধ করিয়াছেন। যুদ্ধ-জয়ের জন্য ভালো লুঙ্গি প্রয়োজন।'