জেল গেইটে মির্জা ফখরুলেরা: রাজনীতির দীনতা

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 25 August 2018, 12:36 PM
Updated : 25 August 2018, 12:36 PM

পবিত্র ঈদ উল আজহার দিনেও শান্তি মেলেনি বিএনপি নেতাদের। সারাদেশ যখন ঈদ আনন্দে মশগুল, ঘরে ঘরে কোরাবানির রান্নার প্রস্তুতি তখন নিয়মমাফিক জেল গেটে গিয়েছিলেন মির্জা ফখরুল ও তাঁর দলের কিছু নেতা । বেগম জিয়া ধীরে ধীরে স্মৃতির অন্তরালে চলে যাচ্ছেন।

একজন ব্যক্তিগত মানুষ হিসেবে আমি কারো কারাগার গমনে উল্লাসিত হতে চাইনা। তবে এবার কোরবানির ঠিক আগে যখন একুশে অগাস্ট তারিখটি সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল সত্যি কথা বলতে কি  আমার মনে হয়েছে নিয়তি বা প্রকৃতি আসলে কাউকে ছাড় দেয়না।  যার যা প্রাপ্য তা বুঝিয়ে দিতে সময় কখনো পিছিয়ে থাকেনা।

আজ খালেদা জিয়ার এই পরিণতি ও কারাবাস একদা স্বপ্নেও কল্পনা করা যায়নি। কিন্তু পাপ তো কাউকে ছেড়ে কথা বলেনা। একুশে অগাস্টে টার্গেট শেখ হাসিনা বেঁচে গিয়ে দেশের শাসনভারে এমন এক ভূমিকায় আছেন যা আজ বিশ্বস্বীকৃত। অথচ তাঁর বেঁচে থাকারই কথা ছিলনা। আর তিনি যদি না থাকতেন এদেশে কখনো রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি হতো না। যেভাবেই আমরা দেখিনা কেন বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা কিন্তু বাস্তব, সে বাস্তবতাও হয়তো দেখা যেত না। একুশে অগাস্টে তারেক রহমানের ভূমিকা কি বা কেন তা করা হয়েছিল তা একজন শিশুও বোঝে। জজ মিয়ার ফালতু নাটক আর ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার অপচেষ্টা কাজে আসেনি। উল্টো প্রকৃতির প্রতিশোধে খালেদা জিয়া একা নি:সঙ্গ কারাবাসে দিন কাটাচ্ছেন।

বহু আগেই একটা লেখায় লিখেছিলাম বিএনপি মূলত একটি গাড়ির মতো। পাওয়ার গেইমের এই গাড়িটি আসলে না কোনও আদর্শের, না কোন ত্যাগের বাহন। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতাকে হত্যার পর যে শূন্যতা তার ভরাটে নানা সমীকরণে একজন নামমাত্র মুক্তিযোদ্ধাকে প্রয়োজন ছিলো। সে মুক্তিযোদ্ধার নাম জিয়াউর রহমান। তখন তাঁকে ঘিরে ভাসানী ন্যাপ মুসলিম লীগের নেতারা আর নেপথ্যে জামাতের সমর্থন মিলে মিশে একাকার। সে কারণেই বিএনপিকে মনে হতো শক্তিশালী। যেমনটা আমরা যৌবনে জাসদের বেলায় দেখেছিলাম। জলিল-রব-সিরাজ এসে দাঁড়ালে অনেকেই ভাবতেন মার্কস লেনিন এঙ্গেলস এসে দাঁড়িয়েছে। আজ একবার পেছনে তাকিয়ে দেখুন। সে জলিল সাহেব কীভাবে পথ হারিয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে মারা গিয়েছিলেন! রব আর সিরাজ এখন ফসিল। আসম রব তো সঙ তূল্য! বিএনপিও তেমনই। সে ট্রেনে যারা পাওয়ারের ভাগ গদির লোভে উঠেন তারা যখন সামনে অন্ধকার দেখেন তখনই নেমে পড়েন। এভাবে যেতে যেতে শেষমেষ ঢাকায় এসে খালেদা জিয়া দেখলেন তারঁ ছেলে তারেকও আর নাই। একা তিনি এসে থামলেন নাজুমুদ্দিন রোডের লাল দালানে।

কথাগুলো নির্মমভাবে করুণ হলেও সত্য।  এই যে ঈদের দিন মির্জা ফখরুলরা কয়েকজন মিলে গেলেন দেখা করতে তাঁরা কি আসলেই সিরিয়াস ছিলেন? যদি সিরিয়াসই থাকেন তাহলে টিভিতে যা দেখলাম তা কি মিথ্যা? তিনি বা তারা কি করে বুঝে নিয়েছিলেন যে তাদের দেখা করতে না দিলে তারা সেখানে দাঁড়িয়ে ভালো পোশাকে নিজেদের সবকিছু বজায় রেখে হাতে মাইক্রোফোন তুলে ভাষণ দেবেন? কোথা থেকে আসলো এত সব? আর একটা মজার ব্যাপার ছিলো ফখরুল সাহেব কাগজ দেখে দেখে পড়ছিলেন। যার মানে পয়েন্টগুলো নোট করা ছিলো। এজন্যেই মানুষ বলে যে মাঝে মাঝে এগুলো পাতানো খেলা। পাতানো খেলার আরেকটা নকশা মনে হয় এই সে কারণেই মওদুদ আহমেদের মতো নেতাদের সেদিন দেখা গেলনা।

খালেদা জিয়াকে কেন বাড়ির রান্না খেতে দেয়া হলোনা সেটা নিয়ে আবেগ আর দু:খে মির্জা সাহেব অনেক কথা বললেও তাঁরা সবাই বাড়ির সুস্বাদু রান্না বর্জন করেননি। এই যে স্বার্থপরতা আর দ্বিমুখী রাজনীতি এটাই বিএনপিকে শেষ করা আনছে। তারা সবসময় বলেন তাদের ভোট বেশি। যেকোনও মূহুর্তে নির্বাচন হলে তারা সংখ্যাধিক্য আসনে জয়ী হবেন। হয়তো হবেন।

কিন্তু তার মানে কী এই মানুষ তাদের সমর্থন করে? না মানুষ সরকারী দলের নানা অনাচার আর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ভোট দেবে? নেগেটিভ ভোট পেতে পেতে তাদের হাল এমন হয়েছে যে তারা ভাবে মানুষ ভারত বিরোধী হবার কারণে, সাম্প্রদায়িকতার জন্য এমনকি রাষ্ট্রীয় অনাচারের কারণে রেগে গেলেও তাদেরকেই ভোট দিতে বাধ্য হবে। এমন ভরসা দলটিকে কতটা ক্লীব আর পঙ্গু করেছে সেটাই দেখলাম ঈদের দিন।

আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আওয়ামী লীগ যদি তাদের জায়গায় থাকতো দৃশ্যপট আরেক ধরনের হতো। কারণ তাদের যেমন বাহিনী আছে, তেমনি ত্যাগী নেতাকর্মীরও অভাব নাই। তা যদি না থাকতো শেখ হাসিনা বেঁচে থাকার কথা ছিলোনা আজ। একুশে অগাস্টে গ্রেনেড হামলার সময় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মীসহ যে সব নেতারা তাঁকে আগলে নিজেদের জানের ঝুঁকি নিয়েছিলেন তাদের দেখেও শেখেনি বিএনপি।

কারাগারে যাবার দিন খালেদা জিয়াকে নিয়ে যাওয়া গাড়ির পেছনে পেছনে থাকা নেতাদের ভেতর একমাত্র মির্জা ফখরুলের ছবিটাতেই ছিল আবেগ আর ভেঙে পড়া। মওদুদ আহমেদসহ বাকি কয়েকজনের চেহারা মোবারক দেখে মনে হয়েছিল তারা এমন ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন । বরং এমনটা না হলেই তারা হয়তো অবাক হতেন। কারাগারে নেতাদের  আসা যাওয়া নতুন কিছুনা। রাজনীতি করলে জেলে যেতে হয় এটাই নিয়ম। খালেদা জিয়া যে কারণে জেলে আছেন সেটাও প্রীতিকর কিছুনা। এতিমের টাকা মারার অভিযোগে জেলখাটা আসামী আর রাজনৈতিক কারণে বন্দি আসামীর ভেতর অনেক তফাৎ। সেটা জানার পরও মির্জা ফখরুলেরা প্রমাণ দূরে থাক মানুষকে বিশ্বাস করাতে পারেনি কোনটা সত্য আর কোনটা বানোয়াট। মুখে মুখে তারা যাই বলুক না কেন মূলত খালেদা জিয়ার দশা সহজে কাটবে বলে মনে হয়না।

আন্তরিকতা আর ভালোবাসার রাজনীতিকে বিসর্জনে পাঠিয়েছিল বিএনপি। কোন কারণ ছাড়া যুবরাজের যেসব কাহিনী আর আস্ফালন সেটা তারা কেন মনে রাখেন না? আজও কি দলটির লেজ সোজা হয়েছে? নানা কারণে যখন দেশের ভেতর সংকট তৈরি হয় তখন তারা সঠিক ভূমিকা পালনের পরিবর্তে অপকৌশলের আশ্রয় নেয়। এই সেদিন বাচ্চাদের আন্দোলন যখন নিরাপদ সড়কের দাবিতে ফুঁসে উঠেছিল তাদের সিনিয়র নেতার কণ্ঠে যে হতাশা আর যে অরাজকতার ডাক সেটা কি দেশের জন্য মঙ্গলের কিছু? এভাবে কোন পরিবর্তন মানুষ চায়না। মানুষ এও চায় না চোরের বদলে ডাকাত এসে গদিতে বসুক।

তাদের রাগ অভিমান বা হতাশার কারণগুলো মূলত অশান্তি অনিরাপত্তা আর অর্থনৈতিক লুটপাট। সেখানে তারা এখনো শেখ হাসিনার ওপর ই আস্থাশীল। বিএনপির নেতাদের চেহারা দেখলেই বোঝা যায় তারা এখন ক্লান্ত। আর দিকনির্দেশহীন। খালি আপসহীন আর তিন- তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বললেই কি সমস্যা গলে যাবে? খালেদা জিয়া কোনদিন কোথায় কখন আসলে নেতৃত্ব দিয়ে ঘটনা বা পরিবেশ পাল্টে দিয়েছিলেন? গদিতে থাকার সময় জামাতের সহযোগিতা তাদের সিনিয়র নেতাদের পরামর্শ ও বুদ্ধিতে চলে পার পেলেও আখেরে নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছিলেন। যা এখন তিনি সবার চেয়ে ভালো বুঝতে পারেন বা বুঝলেও বলার আর জায়গা নাই তাঁর।

জেল গেইটে মির্জা ফখরুলদের পুলিশ নিষেধ করলো আর তারা সুবোধ বালকের মত তাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে না খাইয়ে না দেখে চলে এলো এমন চমৎকার রাজনীতি কবে থকে চালু হলো দেশে? তারা স্বীকার করুক বা না করুক এগুলো আসলে প্রহসন। আর নিয়তি বা সময়ের চাপে পিষ্ঠ বিএনপি আমাদের দেশের রাজনীতির যে বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেছে তার ফল তাদেরই ভোগ করতে হচ্ছে এখন। তাদের নেতা জিয়াউর রহমান আমাদের যৌবনে গর্ব করে বলতেন: আই উইল মেক দ্য পলিটিক্স ডিফিকাল্ট। সেই ডিফিকাল্ট পলিটিক্স আমাদের ভবিষ্যতকে এমন বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে ন্যায্য কথা বলা ন্যায্য দাবি আদায় করা এমনকি মানুষের জন্য বলারও কেউ নাই। তাই জেল গেটে দাঁড়ানো মির্জা ফখরুল বা মির্জা আব্বাসসহ এককালের বাঘা নামে পরিচিতদের মূষিকে পরিণত হতে দেখে অবাক হইনি।

হায়রে সময়।