ঘুষ খাইবো, থাকবো সুখে, কি আনন্দ লাগছে বুকে !

আলমগীর স্বপন
Published : 21 August 2018, 02:51 PM
Updated : 21 August 2018, 02:51 PM

নিশ্চয়ই আফসোস করছেন এরইমধ্যে দুদকের ফাদেঁ পড়ে মান সম্মান খোয়ানো প্রায় অর্ধশতাধিক ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। পাচঁ পাচঁ ১০ লাখ টাকা ঘুষসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার হওয়া নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের সাবেক দুই প্রধান প্রকৌশলী হয়তো মাথা চাপড়াচ্ছেন- কেন আরও আগে অনুমোদন পেলো না এমন সুন্দর আইন ? হাতেনাতে ঘুষসহ আটক হয়ে, মান সম্মান খুইয়ে, জেল খেটে মুখ দেখানো দায় হয়ে গিয়েছিলো যাদের তারা এখন এই আফসোস ও হতাশা কোথায় লুকাবেন ?

দীর্ঘদিন ঝুলতে থাকা 'সরকারি চাকরি আইন'টি আরো আগে পাস হলে কী এমন ক্ষতি হতো? জানা যাচ্ছে সেই ২০০৬ সালে 'সিভিল সার্ভিস আইন' নামে এর অঙ্কুরোদগম হয়েছিলো। এরপর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইনটির খসড়া করেছিলো। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করতে মহাজোট সরকার কমিটি করে দিয়েছিলো। ২০১৫ সালে মন্ত্রিসভা খসড়ার নীতিগত অনুমোদনও দিয়েছিলো। অথচ সেই আইনই কিনা মন্ত্রিসভার চূড়ান্ত অনুমোদন পেলো ২০১৮ এর অগাস্টে এসে। আরো আগে খসড়া চূড়ান্ত করা গেলে এতোদিনে নিশ্চয়ই আইনটি পাস হয়ে যেতো সংসদে। আর তাহলে উপরের ভুক্তভোগী ঘুষখোর কর্তাদের ঝট করে ফাদঁ পেতে ধরতে পারতো না দুদক। কারণ ধরতে গেলে অনুমোদন লাগতো সরকারের।

সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদন প্রাপ্ত প্রস্তাবিত 'সরকারি চাকরি আইন' অনুযায়ী ফৌজদারি মামলায় কোনও সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে চার্জশিট আদালতে গ্রহণ না হওয়া পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। এর আগে প্রয়োজন হলে সরকারের অনুমোদন লাগবে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত খবরে আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাটি নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের কাছে প্রশ্ন ছিলো, 'এই আইন পাস হলে দুদক ফাদঁ পেতে কোনো সরকারি কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করতে পারবে কি না!'  এর জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, 'চার্জশিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। চার্জশিট হওয়ার আগে গ্রেপ্তার করতে হলে আগে অনুমতি নিতে হবে।'

(https://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1531609.bdnews)

রিপোর্ট অনুযায়ী প্রস্তাবিত আইনটি যদি শেষ পর্যন্ত সংসদে পাস হয় তাহলে ঘুষখোরদের পোয়াবারো। ফাদঁ পেতে ঘুষখোর ধরা কঠিন হবে দুদকের জন্য। দুদক বিধিমালা, ২০০৭ এর পঞ্চম অধ্যায়ের ১৬ (১) ও (২)অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'দুর্নীতি প্রতিরোধের নিমিত্তে আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধে জড়িত কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে হাতেনাতে ধৃত করিবার উদ্দেশ্যে তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশনারের অনুমোদনক্রমে তৎকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফাঁদ মামলা প্রস্তুত করিতে বা পরিচালনা করিতে পারিবেন।' সে অনুযায়ী পরিচালক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার অধীনে ফাঁদ টিম পরিচালিত হয়।

প্রস্তাবিত 'সরকারি চাকরি আইন' দুদক বিধিমালার সাথে সাংঘর্ষিক। যদি চার্জশিটের আগে কোনও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেপ্তারে অনুমতি লাগে তাহলে ফাদঁ পেতে ঘুষখোর ধরা কতটা সম্ভব হবে ? এক্ষেত্রে আগেই তথ্য ফাসেঁর ঝুঁকির পাশাপাশি আইনি জটিলতায় পড়বে দুদক। কেউ যদি ঘুষের অভিযোগ নিযে দুদকে আসেন, কমিশনের অনুমতি নিয়েই সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ফাদঁ পাতেন। এক্ষেত্রে গ্রেপ্তারের পর মামলা হয়। আর প্রস্তাবিত আইনে বলা হচ্ছে চার্জশিটের আগে গ্রেপ্তারই করা যাবে না, অনুমোদন লাগবে।

শুধু ফাদঁ পেতে ঘুষখোর ধরাই নয় অনেক সময় মামলার পরপরই গ্রেপ্তার অভিযান চালায় দুদক। বর্তমান চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেয়ার পর প্রায় চার শতাধিক আসামীকে গ্রেপ্তার করেছে দুদক। এর মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা কম নয়। মামলার পরপরই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো সুষ্ঠু তদন্ত ও দলিল দস্তাবেজ সংগ্রহের প্রয়োজনে। কিন্তু চার্জশিটের আগে গ্রেপ্তারের অনুমোদনের প্রয়োজন হলে এক্ষেত্রেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে দুদক।

এতে স্বাধীন ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান দুদকের ক্ষমতা খর্ব হবে বলে বিবৃতি দিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি। তারা বলছে, 'অনুমতি গ্রহণের যে বিধান রাখা হয়েছে তা বৈষম্যমূলক ও সাংবিধানিক চেতনার পরিপন্থী। বিশেষ করে সরকারি খাতে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার সরকারি অঙ্গীকারের সাথে ধারাটি সাংঘর্ষিক, অন্যদিকে এর মাধ্যমে দুদকের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে খর্ব করার ঝুঁকি সৃষ্টি হবে।'

প্রস্তাবিত আইনটি নিয়ে সংশয় ও হতাশায় আছেন দুদকের আইনবিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শেষ পর্যন্ত সরকার গঠিত কমিটি তাদের আশ্বস্ত করেছিলো এমন আইন হলেও দুদক আইন ও বিধিমালার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রকাশিত খবর বলছে, এক্ষেত্রে দুদকের সুপারিশ মানা হয়নি। এর আগে ২০১৪ এর নির্বাচনের আগেও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলার আগে সরকারের অনুমোদন নেয়ার বিধান রেখে আইন পাস হয়েছিলো। তবে পরে উচ্চ আদালতে তা খারিজ হয়ে গেছে।

আবারও যখন নির্বাচন কাছাকাছি তখন প্রায় একই ধরনের আইন চূড়ান্ত হলো মন্ত্রিসভায়। নিশ্চয়ই এ নিয়ে মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন আমলারা। নির্বাচন সামনে রেখে তাই সুযোগ নিতে আর কসুর করলেন না।তবে আইনসভায় পাসের আগে সংসদীয় কমিটির যাচাই বাছাইয়ের সুযোগ রয়েছে। নিশ্চয়ই সংসদ সদস্যরা এ নিয়ে তাদের যৌক্তিক মত দেবেন, যদি তাদের মত দেয়ার সুযোগ হয় !

ফৌজদারী মামলায় অনেক সময় সরকারি কাজ বাধাগ্রস্ত হয়, আমলারা ঝুকিঁর মুখে পড়েন। তাদের হয়রানি যেন না হয়, দ্রুত যেন কাজ এগোয়-প্রস্তাবিত আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার স্পিরিট এমন। কিন্তু এর ফাকঁফোকর গলে যদি দুর্নীতিবাজদের পার পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয় তাহলেই সর্বনাশ।নিশ্চয়ই রাজনৈতিক সরকারের সেই বিবেচনাবোধ আছে। কেননা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার জিরো টলারেন্স নীতির কথাই বলেছেন।