দুই-এক গোলে জয় ও প্রশ্নের পাহাড় ডিঙানো

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 31 July 2018, 02:35 PM
Updated : 31 July 2018, 02:35 PM

তিন সিটি কর্পোরেশানের নির্বাচন শেষ। ফলাফলও জেনে গেছি আমরা। দুই এক গোলে জয়ী হলেও আওয়ামী লীগের এই জয় নিয়ে জনমনে সংশয় আছে। এর কারণ তৈরি করেছে তারা। নির্বাচন হবার আগে যে আগাম জরিপ আর তার ভিত্তিতে যে বাণী- তা এভাবে সত্য প্রমাণিত হলে মানুষতো একটু সন্দেহ করতেই পারে।

গোড়াতেই ধন্যবাদ দেই এইজন্যে এই নির্বাচনে হতাহতের কোনও খবর মেলেনি। সাধারণত ভোট মানেই সহিংসতা। সে জায়গায় প্রাণ না যাওয়ার ঘটনা আশাপ্রদ। কিন্তু প্রশ্ন থেকে গেছে।

প্রশ্ন এক.

বরিশালে এবার যেসব প্রার্থী দাঁড়িয়েছিলেন তাদের ভেতর মনীষা চক্রবর্ত্তী ভোট কতো পেলেন আর পেলেন না- সেটা জরুরি না; জরুরি ছিল তাঁকে আঘাত না করা। তাঁকে কারা আঘাত করেছে আমরা জানিনা। তবে সাধারণ নিয়ম কী বলে? বিএনপি কেন তাঁকে আঘাত করতে যাবে? তারা তো জানেই মনীষা ভোট পাক বা না পাক, তার কার্যক্রম আর পপুলারিটি মূলত সরকারের জন্য ভয়ের। এই মেয়েটিকে আমি চিনিনা। কিন্তু পোড়ার সমাজে সে ভালো হতে চায়। এখন কী সেসব ভালোর কোনও মূল্য আছে আদৌ? তারপর ও কেউ কেউ চায়। কারণ তারা ব্যতিক্রম। ডাক্তার মেয়েটি অনায়াসে একটি স্বচছল ও সুন্দর জীবন কাটাতে পারে। সরকারি চাকরিও জুটেছিল তার। করেনি। কারণ দেশ সেবা করবে। এ নিয়ে কি বলার আছে বলুন! এখন কেউ দেশসেবা করে?

দেশের সেবার নামে যারা সামনের সারিতে তাদের চেহারা কাজ আর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দেখলে মনে হয় যে তারা সেবা করতে নেমেছেন? এই মেয়ে একটা পরিবর্তন চেয়েছিল। সবাই জানে বাসদ এর শক্তি কতটা। আর সে ধর্মীয় পরিচয়ে একজন সংখ্যালঘু। কোথায় লেজ গুটিয়ে পালাবে কিংবা ঘরে বসে থাকবে, তা না করে সুন্দর সুন্দর কথা আর প্রতিশ্রুতি নিয়ে মাঠে নেমেছিল মনীষা।

বলে কি, মেথররা বেতন না পাওয়া পর্যন্ত আমি বেতন নেবোনা! শুনেই তো নেতাদের গায়ে গন্ধ এসে লেগেছিল। তারপর যা হয়। বরদাশত করা এখন আমাদের সহ্যের বাইরে। ফের? ঐ একটাই দাওয়াই। সেটাই দেয়া হলো মনীষাকে। মেয়ে হয়েছে তো কি হয়েছে? কথায় বলেনা হাত ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেব? তাই করেছে । ছবি দেখুন হাতে প্লাস্টার লাগিয়ে ঘুরছে। চেহারা দেখে মনে হব দু:খী এক রাজকন্যা। আচ্ছা তাকে মারার কি আসলে কোনও কারণ ছিলো? আর তাকে মেরে কী ভোট বেড়েছে কারো? কারা মেরেছে সবাই জানে। কিন্তু বলেনা। আর না বলতে বলতে বরিশালের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলো এক স্লোগানে- 'বরিশালের নির্বাচন, ভোট দিচ্ছে প্রশাসন'

কেন এই দুর্মতি?

প্রশ্ন দুই.

সিলেটে বিএনপি জিতেছে। বিএনপি জেতায় বদর উদ্দীন কামরানের কোনও লোকসান হয়নি। কারণ তিনিই এখন টক অভ দ্য টাউন। বা তিনিই গণতন্ত্রের প্রতীক। কেন? কারণ বিএনপি কোথাও জেতেনা। বা জিততে পারেনা। তারা বলে তাদের দমিয়ে রাখা হয়। আবার হারলে বলে কারচুপি হয়েছে। সিলেটে তো জিতেছে। তাহলে প্রশ্নবিদ্ধ হবে কেন? নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ না। প্রশ্ন হচ্ছে বরিশালে বিএনপি প্রার্থী দিনের শুরুতেই বলে দিয়েছেন- তিনি মানেন না। কারণ, তিনি জানেন তাকে হারানো হবে। সিলেটের প্রার্থী ও বলেছে বৈকি। সাথে এও বলেছে- আমি শেষ দেখবো। কেন? শেষে কী হবে বা কী হতে যাচ্ছে তিনি কী টের পেয়েছিলেন! না, এই আশাবাদের আর কোন ভিত্তি আছে? আমি তাঁকে সাধুবাদ জানাই যে তিনি জায়গা ছাড়েননি। শুধু একটাই জিজ্ঞাসা কেন? দেশের আনুষের মনে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার নিয়ে যে তর্ক আর সন্দেহ সেটার নিরসনে কামরান বলি হলেন কি ? এ কথা আমরা না বললেও আওয়ামী লীগের লোকজনই বলাবলি করছেন।

প্রশ্ন তিন.

বাংলাদেশে স্থানীয় নির্বাচনে আমাদের যে আগ্রহ তা জাতীয় নির্বাচনে নাই কেন? বিষয়টা ভালো করে ভাবা দরকার। তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে যে আমেজ উন্মাদনা বা উত্তেজনা সেটা জাতীয় রাজনীতিতে নাই। কেন নাই? এই সব নির্বাচনে বাংলাদেশের দুই বড় দল আওয়ামী লীগ আর বিএনপি মাঠে। অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনকে ম্যাড়ম্যাড়ে করে তুলেছে বিএনপির বিরোধিতা। সিটি কর্পোরেশানের নির্বাচনে নৌকা জিতলে বলা হবে কারচুপি । আর বিএনপি জিতলেও কিন্তু কোনও সাধুবাদ বা অভিনন্দন পাবার আশা করবেন না। বলা হবে, চেষ্টা করেছিল, জনগণ প্রতিহত করে দিয়েছে। ভালো কথা। এটাইতো আমরা চাই, তাই না? অন্যায় হলে যেন জনগণ প্রতিরোধ করে।

তাহলে আপনারা স্থানীয় নির্বাচনে তা যদি পেয়ে থাকেন জাতীয় নির্বাচনে কেন পাবেন না? জাতীয় নির্বাচনে মাঠে নেমে আসুন দেখুন জনগণ কি করে? সে বিশ্বাস বা আস্থা হারিয়ে বিএনপি এখন আসলে দুর্বল একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে বলেই শিশুদের মত খালি কান্নাকাটি আর অভিযোগে ব্যস্ত। এবার কি তাদের হুঁশ ফিরবে?

আওয়ামী লীগ বা সরকারের ঘরে যে ফসল উঠলো নির্বাচনে তারা যেভাবে দুটো  মেয়র পেলেন তাতে তাদের সন্তুষ্টি থাকলেও আমাদের নাই। কারণ অনেক।  এরমধ্যে গত কদিনের যে ঘটনা দেশ ও দেশের বাইরের মানুষকে কাঁদিয়ে গেছে তার কথা বলা দরকার। সবদেশে দুর্ঘটনা ঘটে। কোথাও বেশি, কোথাও কম। কিন্তু একজন দায়িত্ববান মন্ত্রী তা নিয়ে মশকরা করতে পারেন না।

মশকরা তো মশকরা, পাশের দেশ ভারতের উদাহরণ টেনে যেসব কথা বললেন তাতে অবাক হবার বিকল্প ছিলো না! তা ছাড়া যে বিষয়টি দল ও সরকারের জন্য ভয়াবহ হতে বাধ্য সেটা তার বিকৃত হাসি। বিকৃত আমরা মনে করলেও তিনি করেননি। অবলীলায় হেসে যাচ্ছিলেন। এটা একজন সুস্থ সবল মানুষের দ্বারা অসম্ভব। যারা প্রাণ হারিয়েছে তারা সবাই আমাদের সন্তানতূল্য । আমাদের তো নাতি-নাতনিও হতে পারতো এই বয়সের। তাদের মত মাসুম বাচ্চাদের জীবন কেড়ে নেয়া ঘাতকদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়িয়ে সাফাই গাওয়া কোন ধরনের অভব্যতা? প্রশ্ন জাগে এরা কি স্বাভাবিক মানুষ? আর যদি স্বাভাবিক হয়তো এমন অট্টহাসি দিলো কী করে? আর যদি যদি অস্বাভাবিক হয় তো এদের হাতে দেশ কীভাবে নিরাপদ?

এই  ঘটনায় সরকারের অর্জন, বিসর্জনে পরিণত হয়ে যেতে পারে। শুধু ধমক আর শাসানিতে কাজ হবেনা। কারণ মানুষের মনে প্রশ্ন এখন বিশাল আকার ধারণ করেছে। দেশ, সরকার বা রাষ্ট্রের প্রয়োজন কেন? নিরাপত্তা আর শান্তির জন্যে। উড়াল সেতু, ট্রেন  বা মেট্রো সেতু এগুলো উপাদান মাত্র। মৌল বিষয় মানুষ। সে মানুষ যদি এভাবে তাদের সন্তানদের জীবন বিপন্ন হতে দেখে, আর সে বিপন্নতায় কাউকে হাসতে দেখে- তবে কী হতে পারে সেটা সোশ্যাল মিডিয়াতে চোখ রাখলেই বোঝা সম্ভব। কে বলেছে এর প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বেনা? আলবৎপড়বে। মানুষের পুঞ্জিভুত ক্রোধ আর অভিমান কখন বাঁধ ভেঙে ফেলে বলা মুশকিল। তাই সিটি কর্পোরেশানে দুই এক গোলে জিতলেও খেলা অনেক বাকি।

সে খেলায় প্রশ্ন যত বাড়বে বিপদ তত ঘনীভুত হবে। উত্তরণের পথ দুটো।

ক. মানুষের কাছে ফিরে যাওয়া। মানুষকে মানুষের মত করে বাঁচতে দেয়া।

খ. আত্মতুষ্টি আর আত্মপ্রসাদের বিকৃত কথা ও হাসি বন্ধ করা।

বাংলাদেশ শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে যতটা এগোচ্ছে, এসব কারণে ততোটাই পিছিয়ে পড়্ছে। বিপদের আগুন ঘরে পৌঁছানোর আগে কী সাবধান হবেন আপনারা?