সমন্বিত বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা কেন নয় ?

নাদিম মাহমুদনাদিম মাহমুদ
Published : 22 May 2018, 06:39 PM
Updated : 22 May 2018, 06:39 PM

দেশে সবে মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ব্যবহারিক কিছু পরীক্ষা মাথায় রেখে হাজারো শিক্ষার্থী মফস্বল শহরগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংকে লক্ষ্য করে এইসব শিক্ষার্থী শহরগুলোতে ভিড় যেমন জমাচ্ছে তেমনি ভালো কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানোর জন্য উৎকষ্ঠায় রয়েছেন অভিভাবকরা। সন্তানদে কোচিং ফি, বিশ্ববিদ্যালয়েবর আবেদন ফরমের ফি আর যাতায়াত খরচের টাকা জোগাতে শঙ্কায় রয়েছে দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো।

প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার এই চিত্র গত কয়েক বছর ধরে চলে আসলেও সামীহীন দুর্ভোগ আর শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘব করতে বছর তিনেক ধরে 'ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে' আসছেন দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জাফর ইকবালসহ বেশ কিছু শিক্ষাবিদ।

বছর দুয়েক আগে আমিও সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে একটি পত্রিকায় আলোচনা করেছিলাম। পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনার মধ্যে এ বছরের শুরুতেই শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমসহ বেশ কিছু গণমাধ্যেমে'জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার' শীর্ষক একটা নিবন্ধতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে মাননীয় রাষ্ট্রপতি সম্মতিজ্ঞাপনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ নিয়ে লিখেন। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি কিছুদিন আলোচনা-সমালোচনা চললেও ভর্তি পরীক্ষার এই মৌসুম শুরুর আগ পর্যন্ত আমরা আর কোন সাড়া শব্দ পাচ্ছি না।

কমিলিটিভ এক্সামিনেশনের বিপক্ষে বেশ কিছু কথাবার্তা শুরু থেকে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলায় বিষয়টি নিয়ে জোরালো সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের গড়িমসি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

কেউ কেউ বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই নিজ নিজ সুবিধা অনুসারে ভর্তি পরীক্ষার সময়সূচি তৈরি করে। তবে একটির সঙ্গে অপরটি যাতে সাংঘর্ষিক না হয়, সে চেষ্টাও করে।

তবে এই ক্ষেত্রে কিছু বিষয় তুলে ধরা প্রয়োজন। প্রতি বছর ভর্তি পরীক্ষার সময় কোন না কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সাথে অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সময়সূচিতে মিলে যায়। যেমন ২০১৭-১৮ সেশনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইউনিটের লিখিত পরীক্ষা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) একটি ইউনিটের ব্যবহারিক পরীক্ষার দিনই ভর্তি পরীক্ষার সময় নির্ধারণ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৬-১৭ সেশনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সময়সূচি একই হওয়ার কারণে অনেক শিক্ষার্থীই উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। গত বছর রাবির কলা অনুষদের পরীক্ষা ২৬ অক্টোবর সকাল ৯টা থেকে ১০টা এবং সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টা দুই শিফটে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। অন্যদিকে চবির কলা অনুষদের ভর্তি পরীক্ষা ২৬ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১০টায় অনুষ্ঠিত হওয়ার সময়সূচি প্রকাশ হয়। ফলে এই বিষয়টি সমাধান করার জন্য সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা প্রয়োজন।

আবার অনেকে মনে করছেন, মফস্বল কেন্দ্রের অনেকগুলোতে নিরিবিলিতে নকলচর্চা চলে। তাদের নম্বর শহরের ভালো ভালো স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের থেকে কিছু ক্ষেত্রে বেশি।

বিষয়টির সাথে আমি একমত পোষণ করতে পারছি না। একজন গ্রামের শিক্ষার্থী যে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বেড়ে ওঠে একজন শহুরে শিক্ষার্থী সেভাবে বেড়ে ওঠে না। নকলের দায়ে গত কয়েক বছর ধরে বহিস্কারের ঘটনা নেই বললেই চলে। তবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের আপাদমস্তক সুবিধা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ভাল ফলাফল করছে উভয় অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা। আর এই ক্ষেত্রে শহরের শিক্ষার্থীরাই সব সময় এগিয়ে থেকেছে। গ্রামে সবার যে ইন্টারনেট সুবিধা শহরের মতো নয়। শহরের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে (সূত্র: ইত্তেফাক ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬)।

আমি সবচেয়ে লজ্জাবোধ করছি, একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে অনেকে দাবি করছে, গ্রামের পিছিয়ে পড়া কিংবা তুলনামূলক কম ফলাফলকারী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার সুযোগ পায়। সমালোচনাকে এগিয়ে নিতে তারা বলছেন, তুলনামূলকভাবে নিম্নমানের বেশ কিছু শিক্ষার্থী সুযোগ পেয়ে যাবে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার।

আচ্ছা যে শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায় তাকে নিম্নমানের শিক্ষার্থী হিসেবে গণ্য কেন করলেন? নিম্নমান বলতে কি বুঝায়? একজন শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষার নূন্যতম যোগ্যতা জিপিএ ৩.৫ নিয়ে চান্স পাবে আর জিপিএ ৫ নিয়ে চ্যান্স পাবে না তা কি করে হয়? এই ভাবধারায় বিশ্বাস থাকলে সত্যিই আমাদের উচ্চ শিক্ষা হবে জিপিএ ৫ ধারীদের। গরীব ও দারিদ্র জিপিএ ধারীরা পাসকোর্স পড়ে ঠেলে পাশ করে কোনমতে জাতির শিক্ষার দায় এড়া্বে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল ভাল ফলাফলকারী পড়ুক আর কোন কারণে একাডেমিক পরীক্ষায় খারাপ করারা ঝড়ে পড়ুক। ফলে তেলে মাথায় তেল দিয়ে  শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব নয়। গ্রামের কতজন শিক্ষার্থী ভাল ফলাফল করে আর শহুরের কতজন? একই রাষ্ট্রে পড়াশুনা করে মূলত শহুরের পিতা-মাতার আর্থিক বৈভবে হাউজ টিউটর, কোর্চিং, নোট, ইন্টারনেট সুবিধা নিয়ে ভাল ফলাফল আর গ্রামের কৃষক বাবার সাথে হাল চাষ করে স্কুল কলেজ করে ফলাফল তো আর বেশি হওয়ার কথা নয়। তাই বলে, জিপিএ দৌড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার আগেই ঝড়ে পড়ার মতে আমি  নই। উনার দাবি ভালরা ভাল করুক, খারাপরা খারাপ হোক। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যারা ভাল ফলাফল করছে তাদের আশি শতাংশ গ্রামের ওই নিম্নমানের ফলাফল করে আসে। বিভাগগুলোতে প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীরা গ্রাম থেকেই উঠে আসা। তাই তাদেরকে পিছনে রেখে শিক্ষার উদ্দেশ্য সাধন করা দুরুহ।

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিরোধীরা বলাবলি করছেন, ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কত ধরনের কোর্স!  শিক্ষার্থীদের জন্য এগুলোর উপযোগিতা হবে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। এটাকে সমন্বিত করতে গিয়ে জগাখিঁচুড়ি হয়ে যেতে পারে।

এই প্রশ্নের জবাবে আমরা বলতে চাই, ভর্তি পরীক্ষা মানেই কি প্রতিটি কোর্সের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষা নেয়া? নাকি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মেধাবীদের বের করে আনা? ভর্তি পরীক্ষার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কোর্সের সম্পর্ক কতটুকু? বিজ্ঞানের, বাণিজ্য আর কলা অনুষদের উপর ভিত্তি করে তো বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিট ভিত্তিক পরীক্ষা আগে থেকেই হচ্ছে। গড়পড়তা সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভাগের নাম প্রায় একই। তবে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবজেক্টের ভিন্নতা রয়েছে। আর এই ক্ষেত্রে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার মধ্যে  দোষের কি?

অনেকে বলছেন, কিভাবে  বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মারজিনাইজ করা হবে? দেশে যেমন সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ঠিক তেমনি, কিছু প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে।

আমরা জানি, দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই-তৃতীয়াংশ বিভাগ দেশের সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে মিশে গেছে, বাকি বিভাগগুলো মিলেছে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে। চাইলে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা এক সাথে নেয়া যেমন সম্ভব তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্যাটাগরাইজ করে পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে একটি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরেকটি, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আরেকটি সমন্বিত বিশ্ববিদ্যলয় ভর্তি পরীক্ষা তো অনায়াসে নেয়া যেতেই পারে।

যেখানে প্রতি বছর ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার জন্য অভিভাবকদের কাড়ি কাড়ি টাকা গুণতে হচ্ছে, পরিবহণ ভোগান্তি হচ্ছে, ভর্তি পরীক্ষা ও প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে সেখানে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা যাবতীয় দুর্ভোগ লাঘবের হাতিয়ার।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলে একজন শিক্ষার্থীকে কোচিং, গৃহশিক্ষকের সাহায্য নিতে হয়। বলতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছু শতকরা ৯৮ ভাগ শিক্ষার্থীই এই সুবিধা গ্রহণ করে। ফলে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবককে বেশ অর্থ খরচ করতে হয়। প্রচলিত একই নিয়মে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করায় পূর্ববতী প্রশ্নপত্র চর্চায় শতকরা ৬০ ভাগের বেশি প্রশ্ন সমাধানও করা যায়। দীর্ঘদিনের এই নিয়ম, বড্ড সেকেলে, কালক্ষেপণ ও শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের জন্য ভোগান্তিরও বটে।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম যেমন শর্ত ঠিক তেমনি শিক্ষালয়গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ থাকা বাঞ্ছনীয়। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলে সেশনজটের মিছিল যেমন দীর্ঘ হয় তেমনি আমার প্রস্তাবিত ভর্তি প্রক্রিয়ায়ও বাধাগ্রস্থ হবে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি বিপক্ষে নই, কিন্তু বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে, শিক্ষার ব্যবস্থাকে আরো বেশি গতিশীল করে তুলতে হলে ছাত্র রাজনীতি কিছুটা পরিবর্তন আনা জরুরি। সমন্বিত ভতি পরীক্ষার কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরছি

এক.

ভর্তি পরীক্ষা দুইবার নেয়া হোক। প্রথমবার ভর্তি পরীক্ষা যাকে আমি বলছি 'প্রি-আডমিশন টেস্ট' বা ভর্তি পূর্ববর্তী প্রাথমিক নির্বাচন পরীক্ষা বা সেন্ট্রাল ভর্তি পরীক্ষা। এই পরীক্ষার আওতায় সমগ্র দেশে একই প্রশ্নপত্রে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ করানো যেতে পারে। এই পরীক্ষার প্রাপ্ত স্কোরের উপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের পছন্দক্রম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করে দেয়া যেতে পারে। যেটা মেডিকেল কলেজগুলোর ভর্তি পরীক্ষার সময় আবেদন ফর্ম কলেজগুলোর নাম পছন্দানুযায়ী করতে হয়। এ থেকে আমরা দুই ধরনের সুবিধা পেতে পারি। প্রথমত, এই পরীক্ষার মাধ্যমে সবশ্রেণির শিক্ষার্থী এক সাথে বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করার সুযোগ পাবে। যার ফলে দ্বিতীয় ধাপে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক শিক্ষার্থীকে যাচাইয়ের সুযোগ পাবে। দ্বিতীয়ত জিপিএ কখনো মেধা যাচাইয়ের মানদণ্ড হতে পারে না। আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর একজন জিপিএ ৩ দশমিক ৫ পাওয়া শিক্ষার্থী একজন ডাবল জিপএ-৫ পাওয়ার চেয়ে অনেক ভাল করছে। অনেক সময় ক্লাসে প্রথম হওয়ার গৌরব ওরা ধরে রাখতে পারছে। তাছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় ডাবল জিপিএ-৫ অধিকারীদের ধরাশায়ী অকৃতকার্য হওয়া দেখে, আমার মনে হচ্ছে, এই কেবল জিপিএ-৫ প্রাপ্তরাই নয়, অন্যরাও দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনার যোগ্যতা রাখতে পারে। কেবল মাত্র, আবেদন যোগ্যতা অর্জন না করায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবে না, এমন যুক্তিতে বিশ্বাসী না হওয়াটা শ্রেয়। বিশ্বের সিংহভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই তাদের শিক্ষার্থীদের  একসেপ্টেন্স কেবল ভর্তি পরীক্ষার যোগ্যতার নিরিখে।

দুই .

সেন্ট্রাল পরীক্ষায় মেধাক্রম অনুসারে পাওয়া শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় ধাপে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়ার চুড়ান্ত যোগ্যতা নির্ণয় করবে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যায়য় কর্তৃপক্ষ। এই ক্ষেত্রে বর্তমান চালুকৃত ভর্তি পরীক্ষার ন্যায় স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই করবে। ফলে এই ভর্তি পরীক্ষায় যেমন আবেদন যোগ্যতার প্রয়োজন পড়বে না তেমনি, একজন জিপিএ ৩ দশমিক ৫ পাওয়া শিক্ষার্থী কিংবা জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী কেবল মাত্র মেধার জোরে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের চাপ কমবে। অন্যদিকে কেবলমাত্র প্রথম ধাপ বা সেন্ট্রাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের কাঙ্ক্ষিত  বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করা যাবে।

তিন.

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, সেন্ট্রাল পরীক্ষায় মেধাস্কোর অনুযায়ী প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা কতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় ধাপে করা স্বীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে পারবেন। এর সমাধান সহজ, যেমন ধরুন একজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ হাজার আসনের বিপরীতে সেন্ট্রাল পরীক্ষায় মেধাক্রম ও পছন্দক্রম অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৪০ হাজার শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করতে পারবে। সেই অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতাও থাকবে। ভর্তি পরীক্ষায় ৫ হাজার জন ভর্তি করানোর পর বাকি ৩৫ হাজার (এটা নির্ভর করবে কতজনকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা গ্রহণ করতে পারবে) শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ হাজার আসনের বিপরীতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করলো, এভাবে একজন শিক্ষার্থী ক্রমে ৩৭ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পাবে। এই পদ্ধতির একটি বড় সুবিধা হলো, প্রতি বছর ভর্তি পরীক্ষায় মেধাক্রমে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশই ভর্তি হতে চায় না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দ্বিতীয়, তৃতীয় অপেক্ষামাণ তালিকা থেকে আসন পূরণ করতে হয়। যেটা সময় সাপেক্ষ। তাছাড়া অনেক সময় দেখা যায়, একজন শিক্ষার্থী একই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাক্রম পাচ্ছে। অথচ এই শিক্ষার্থী ভর্তি হবে কেবল মাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে ওই শিক্ষার্থীর দরুন অন্যরা সেই স্থান দখল করতে পারছে না। এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে, একদিকে যেমন একজন শিক্ষার্থীকে অন্য কোনবিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য আবেদন ফি জমা দিতে হচ্ছে না, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ভর্তি প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করতে পারবে না। তবে ভর্তিচ্ছুদের উচিত হবে সে কোন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতে আগ্রহী।

চার.

বাইরের দেশগুলোতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংলিশ প্রোফিয়েন্সি টেস্ট স্কোর ভর্তি পরীক্ষার অন্যতম যোগ্যতা হিসেবে দেখা হয়। আমরা জাতিগত ভাবে ইংলিশের প্রতি কিছুটা হলেও বিমুখ। আমি বিশ্বাস করি, ইংরেজি জানা একজন শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষায় যতটা সফলতা পাবে ততটা ইংরেজিতে কম জানা শিক্ষার্থী তা পাবে না। কারণ, উচ্চ শিক্ষার ৯৮ ভাগ বই ইংরেজি ভাষায়। সেই ক্ষেত্রে বিশ্বের ইংলিশ প্রোফেয়েন্সি টেস্টগুলোর মধ্যে অন্যতম টোফেল, টোয়েক, আইইএলটিস স্কোর ভর্তি আবেদনের সাথে চাওয়া যেতে পারে। ফলে একজন শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক থেকে ইংলিশে যেমন প্রস্তুতি নিতে থাকবে, তেমনি স্নাতক/স্নাতকোত্তর পর উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে অবারিত সুযোগ সুবিধা পাবে। কারণ, দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অহরহ স্কলারশিপ পাওয়া যাচ্ছে কেবল মাত্র ইংরেজিতে দক্ষতার উপর নির্ভর করে। ভর্তি পরীক্ষার আগে কোর্চিং না করিয়ে ইংরেজির দক্ষতাও অন্যতম যোগ্যতা নিরূপনের মাপকাটি হতে পারে।

আমরা বলেছি, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা করতে গেলে আমরা কিছু পদক্ষেপ নিতে পারি। আলোচনাও হতে পারে। মূলত শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মেধাচর্চার স্বার্থে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই। বিশ্বের বহু দেশ আজ সেন্ট্রাল বা কেন্দ্রীয় পরীক্ষা নিচ্ছে। আমরা যদিও পাবলিক পরীক্ষাগুলো বেশ কিছু শিক্ষাবোর্ডের অধীনে নিচ্ছি। এছাড়াও চিকিৎসা বিদ্যার ভর্তি পরীক্ষাগুলো একযোগে হচ্ছে। বিসিএসের মতো চাকুরির পরীক্ষাগুলো একযোগে সারা দেশেই হচ্ছে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হতে সমস্যা কোথায়?

বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি বিষয় আলোচনা করার মতো পরিবেশ দরকার ছিলো। গত ছয় মাসেও যখন সরকারের কাছ থেকে ভালো কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি তখন আমরা ব্যথিত হই। দেশের হাজারও শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘবের ব্রতে যে কয়েকজন শিক্ষাবিদ সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কাজ করছেন, তাদের প্রস্তাবনা নিয়ে সরকার কতটুকু ভাবছে জানি না। তবে এইটুকু বিশ্বাস করছি, ভর্তি পরীক্ষার সীমাহীন ঝামেলা এড়াতে মাননীয় রাষ্ট্রপতি একটা ঘোষণা দিবেন।