খালেদা জিয়া বিদেশ যাচ্ছেন: আসছে নতুন চমক?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 3 April 2018, 01:24 PM
Updated : 3 April 2018, 01:24 PM

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে চাইলে লন্ডনকেই বেছে নেবেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তবে সৌদি আরবেও যেতে পারেন বলে রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন রয়েছে। দলীয় সূত্র জানায়, বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া লন্ডন, সৌদি আরব এবং সিঙ্গাপুরেও চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। সর্বশেষ গত ১৫ জুলাই লন্ডন সফর করেন খালেদা জিয়া। সে সময় তার পায়ের ও চোখের চিকিৎসার কথা জানিয়েছিল বিএনপি। আর এর আগেও তিনি লন্ডনে চোখের অপারেশন করিয়েছিলেন। অপর এক সূত্রের দাবি, উন্নত চিকিৎসার জন্য সৌদি আরবে যাবার প্রস্তাব রয়েছে খালেদা জিয়ার সামনে। সরকারও এ বিষয়ে উদার। সৌদি আরবে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট মানসুর হাদি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ, তিউনেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট জয়নাল আবেদীন আলীসহ অনেকেই অবস্থান করছেন এই মুহূর্তে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন খান মোহন বলেন, সরকার যে গোলটা করতে চাচ্ছে সেই গোলটির জন্য ডি বক্সে বল ঠেলে দিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এখন সরকারের স্ট্রাইকাররা টোকা মারলে বলটা গোল হয়ে যাবে। মহিউদ্দিন খান মোহন এক সময় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা এবং বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সহকারী প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন।

বল আসলেই গড়াচ্ছে। খালেদা জিয়া জেলে পচে মরবেন এটা ঠিক মানা যায় না। এদিকে সরকার বা দুদক কেউই তাঁকে ছাড় দেবে বলে মনে হয় না। কোনোদিন কেউ শুনেছেন একটা সাজার মেয়াদ পূর্ণ হবার আগেই কর্তারা আগ বাড়িয়ে বলছে, কেন আরো সাজা হবে না? এই সাজা বা বিচারের যথার্থতা যাই হোক একটা বিষয় পরিষ্কার ম্যাডাম জিয়ার ইমেজ বা ক্যারিশমা আর কাজে আসছে না। সেটা আমরা আগেই বুঝে গিয়েছিলাম। যেসব বিএনপি কর্মী বা জাতীয়তবাদীরা কথা শুনলেই রেগে যান কিংবা হৈ চৈ করে ওঠেন তাদের বলি, ভালো করে ভেবে দেখুন আপনারাই তাঁর ইমেজ, ভাবমূর্তিকে কতটা ডুবিয়েছেন। খালেদা জিয়া গোড়া থেকেই বিতর্কিত। তাঁর ব্যক্তি জীবন নিয়ে যেসব নোংরা বিতর্ক তা কোনদিন আমাকে টানেনি। আমি সেগুলো নিয়ে আগ্রহীও নই। তাঁর রাজনীতি পছন্দ না করলেও এটা জানি তিনি ব্যক্তি জীবনে আধুনিক বা অনেক বিষয়ে সংস্কারমুক্ত ছিলেন। হয়তো সে কারণেই তাঁকে নিয়ে এত গল্প। কিন্তু অাশ্চর্যজনকভাবে তাঁর রাজনীতি পুরোই উল্টো। মৌলবাদী মানসিকতার ব্যক্তি ও দলের মাথার ওপর ছায়া হয়ে তিনি ছিলেন এবং এখনো আছেন। যে জামায়াত সারাজীবন নারী বিদ্বেষী আর নারী নেত্রীত্ব হারাম বলে ফতোয়া দিলো অথচ তাদের পূর্ববর্তী নেতারা খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব মানতে বরাবরই একপায়ে খাড়া ছিল। শুধু তাই নয়, অতীতের ছবিগুলোতে চোখ বুলালে দেখতে পাবেন গোলাম আজম, নিজামী, সালাউদ্দীন কাদেরের সাথে কী আন্তরিক পরিবেশে তার সখ্যতাময় সম্পর্ক ছিল। এই বৈপরীত্যই তাঁকে আস্তে আস্তে ডুবিয়েছে। এই যে এখন কাদের সিদ্দিকী যাকে আমি ওয়াহিদুল হকের ভাষায়  বলি, কা'দের সিদ্দিকী? ঠিক বোঝা যায় না তিনি কা'দের আসলে? সেই তিনিও নতুন ফতোয়া দিচ্ছেন নারী নিয়ে। অথচ মনে মনে এখন তার নেত্রী খালেদা জিয়া। শেখ হাসিনাকে নারী, মহিলা বা অচ্ছুৎ ভাবা নেতারা খালেদা জিয়াকে কোন জেন্ডারে ফেলেন বোঝা মুশকিল। কিন্তু তাঁকেই মানেন মনেপ্রাণে। আর সে মোতাবেক মানানসই হতে গিয়ে কবেই তিনি ছিটকে পড়েছেন দৃশ্যপট থেকে। যার কারণে আজ তিনি জেলে। আর মাঠের নেতাদের মুখে বিগলিত হাসি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্টভাষী। অনুচিত হলেও বলে ফেলেন অনেক কিছু। এই যে তিনি ঠাকুরগাঁও গিয়ে মীর্জা ফখরুলকে একহাত নিলেন সেটার কি খুব বেশি দরকার ছিল? থাক বা না থাক তিনি তাঁকে মিথ্যাবাদী বলেছেন। এতে রুষ্ট হবার পরিবর্তে একগাল হাসি নিয়ে মীর্জা সাহেব বলেছেন, তিনি মিষ্টি পাঠাবেন প্রধানমন্ত্রীকে। কারণ এতে নাকি তাঁর ভোট বাড়বে। ভোটের রাজনীতিবিমুখ বিএনপি নেতা হঠাৎ করে ভোটের কথা বলছে। সাথে সেই মওদুদ আহমেদ যিনি ডিগবাজীর মাস্টার। যাঁর নামে বাজারে নানা গুজব। যার মধ্যে একটি হলো স্বয়ং খালেদা জিয়াই নাকি চান মওদুদ সাহেব যেন তাঁর হয়ে না লড়েন। কারণ তাতে ভেজাল থাকতে পারে। এতসব গুজবের একাংশও যদি সত্য হয় তাহলে বুঝে নিতে হবে সুতোয় জট পাকাচ্ছে। সেই সুতোর নাটাই আসলে কোথায় তারই একটা বার্তা পাওয়া গেলো বেগম জিয়ার চিকিৎসা ও বাইরে যাবার খবরে।

শোনা গিয়েছিল, তিনি যখন লন্ডনে ছিলেন তখনই তাঁকে মেসেজ দেয়া হয়েছিল না ফিরতে। কারণ সরকার অকারণে তাঁকে নিয়ে মাঠ গরম করতে চায়নি। নিয়মমাফিক আইনের পথে বিচার হলেও তাঁর সামনে যে দুর্যোগ সেটা বুঝিয়ে তাঁকে সেখানে থেকে যাবার পরামর্শ দেয়া হলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। এর দুটো কারণ হতে পারে। একটি তাঁর সুপুত্র তারেক। যার ধারণা তিনি ফিরলেই সব ফকফকা হয়ে যাবে বা এখনো তার কথাতেই সব চলে। আর একটি হয়তো মনে মনে বিশ্বাস করেছিলেন বিএনপির যে সাইলেন্ট মেজরিটি দেশে রয়েছে তার কারণে এমন কিছু হয়তো হবে না। বেগম জিয়াও যেটি বুঝতে পারেননি। সাইলেন্ট আর ভাইব্রেন্ট বিষয়গুলো তো সবসময় এমনই, গোপনে থাকে। সামনে আসে না, আসতে পারে না। সেইসব সমর্থনের মাজেজায় আর যাই হোক তাতে আন্দোলন হয় না। সে বিষয়টা কেউ তাঁকে বুঝিয়ে দেয়নি। এটাও জানেননি তাঁর দলের নেতারা এখন অফিস আর মাইক্রোফোন নির্ভর। ফলে তাঁকে বিচারের মুখোমুখি হয়ে জেলে যেতে হয়েছে।

তাঁকে খুব বেশী দিন জেলে রাখার ঝুঁকি নেবে না কেউ। এই বাস্তবতা থেকে মুক্তির পথ ঐ একটাই। দেশত্যাগ। কি আশ্চর্য সে খবরটাই বেরিয়ে আসছে এখন। নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া দেশ ছাড়লে বিএনপি কী করবে ? সে প্রশ্নের উত্তরও মোহন মিয়া দিয়ে দিয়েছেন। মীর্জা ফখরুল সাহেবরা যখন বুঝে যাবেন আর কোনও পথ নাই তখন তারাও নাজমুল হুদার পথ ধরবেন। মওদুদসহ বাকিরা তো রেডি বলেই গুজব আছে। তৈরি হবে নতুন এক জাতীয়তাবাদী দল। যারা হয়তো নির্বাচনে যাবে, আসনও পাবে। টেবিল চাপড়িয়ে বেগম জিয়াকে দেশে ফিরিয়ে আনার শপথে পার করে দেবে পুরো টার্ম। এই নকশাটা কি আসলেই খুব অচেনা? পাকিস্তানের রাজনীতিতে তো হরহামেশাই হয় এরকমটা। বেচারা নওয়াজ শরীফ দফায় দফায় যান আর আসেন। একবার শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকেও ভোটে হারার পর যেতে হয়েছিল লন্ডনে। তাঁর মনোবল আর দলের শক্তি তাঁকে আবারো গদীতে ফিরিয়ে আনে। অন্যদিকে বেনজীরের ভাগ্যে দেশে ফেরা হলেও বাঁচাটা জোটেনি। সেভাবে মৃত্যুর চাইতে বিদেশে বেঁচে থাকাটা মন্দ না। বুঝতে হবে খালেদা জিয়ার বয়স হয়েছে। মুখে তিনি যাই বলুন তাঁর এক পুত্র দুনিয়ায় নেই, আরেকটি থেকেও নেই। তিনি আর কতটা নিতে পারবেন আসলে? মানুষের জন্য রাজনীতি বা জনগণের জন্য রাজনীতির যে দিক তাও আর নেই দেশে। নেই তাঁর সেই সব মিত্ররাও। বয়সী মিত্রদের হারিয়ে ডানাভাঙা পাখির মতো উড়তে গিয়ে পড়ে যাবার বিকল্প কোথায়? ফলে চিকিৎসার জন্য বিদেশ গিয়ে ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পনের বাইরে আর কী পথ খোলা আছে তাঁর জন্যে?

এ সবই স্পেকুলেশান। তারপরও যা রটে তার কিছুটাতো বটেই। খালেদা জিয়া যে আইনী লড়াইয়ে সহজে মুক্তি পাবেন এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই। তাঁর দলের অনুগত নেতাদের মধ্যে এখন হতাশা। তাঁকে জেলে রেখে এরা সভা-সমিতি করলেও মুখের হাসি বা প্রসন্নতা বলে দেয় সংগ্রাম বলে আসলে আর কোনোকিছু অবশিষ্ট নেই রাজনীতিতে। তারা নিজেদের স্বার্থ, জীবন বা পরিবার ভুলে জেলে গিয়ে পচবেন এমন ধারণা করাটা এখন বোকামী। ফলে বাকি রইলো সেই হিসেবটাই। যেখানে নতুন বিএনপির নামে মাইনাস হবেন খালেদা জিয়া আর তারেক জিয়া। এমন সময় কি আসন্ন? খালেদা জিয়া কি সত্যিই চিকিৎসার নামে দেশ ছাড়ছেন? ছাড়লে নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি কি হবে তা বোঝার  জন্য একটু সময় লাগবে বৈকি। এদিকে আওয়ামী লীগের প্রগলভ সাধারণ সম্পাদক আগ বাড়িয়ে বলে দিয়েছেন, সরকারই তৈরি আছে বেগম জিয়াকে বিদেশ পাঠাতে। যার মানে সবাই জানেন আর বুঝতে পারছেন এমনই কিছু একটা হতে চলেছে।

কার ভাগ্যে কী আছে বা হতে পারে জানলে রাজনীতিবিদরা আগেই সাবধান হতেন। জানেন না আর জানলেও মানেন না বলেই এমন হয়। খালেদা জিয়ার ভাগ্যে আর কী কী আছে, এই দেশ, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর আত্না ও শহিদদের ইচ্ছাকৃত অপমানের আর কী কী শাস্তি আছে সময়ই তা বলতে পারে। ব্যাড লাক খালেদা জিয়া।