বাংলাদেশ পানি আইন ২০১২ পর্যালোচনা

জাহিদুল ইসলাম
Published : 29 Sept 2013, 06:27 PM
Updated : 21 May 2012, 01:29 PM

১) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি প্রস্তাবিত বাংলাদেশ পানি আইন ২০১২ প্রকাশ করেছে। মূলত দেশের পানিসম্পদের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন, দক্ষ ও কারিগরি ব্যবহার, সুরক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য জাতীয় পানি নীতি ১৯৯৯ এর আলোকে এই আইন প্রণিত হয়েছে যা অবিলম্বে কার্যকর করা হবে। প্রস্তাবিত আইনটি নয়টি অধ্যায়ে মোট ৩৯ টি ধারার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।এর মধ্যে প্রথম অধ্যায়টিতে আইনে উল্লেখিত বিভিন্ন বিষয়ের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে এবং বাকী আটটি অধ্যায়ে আইনের মূল বিষয়বস্তু আলোচনা করা হয়েছে। এই নিবন্ধে এই প্রস্তাবিত পানি আইন ২০১২ এর একটি সার্বিক পর্যালোচনা থাকবে। ২) সামগ্রিক ভাবে পুরো পানি আইনটি পর্যালোচনা করলে বেশ কয়েকটি বিষয়ে সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ বা কার্যক্রম উঠে আসে।

প্রথমেই আসে একটি পানি সম্পদ পরিষদ গঠন করার প্রসংগ যা রাষ্ট্রের পানিসম্পদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। এছাড়া নদী অববাহিকা ভিত্তিক পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা, খরা ও পানি দূষণের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে তথ্য বিনিময় ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার উদ্যোগের নেবার প্রসংগ গুরুত্ত্বপূর্ন সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হবে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য অন্তর্ভুক্তি হচ্ছে পানি ব্যবহারের জন্য অনুমতিপত্র প্রদান ও পানি সম্পর্কিত ট্রাইব্যুনাল স্থাপন, এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ব্যতিরেকে পানি সম্পদের বণ্টন, ব্যবহার, আহরণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ, সুরক্ষা ও প্রবহমান পানির উপর অবকাঠামো নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ রহিত করন। রাষ্ট্রের সার্বিক পানিসম্পদের (ভূপরিস্থ, ভূগর্ভস্থ ও সমুদ্র সীমার পানি) বণ্টনের অগ্রাধিকারের ক্রম নির্ধারণ প্রস্তাবিত পানি আইনের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

এই ক্রম নিম্নরূপঃ পানীয় জল > গৃহস্থালি > কৃষি > মৎস্য চাষ > পরিবেশ > বন্য প্রাণী > নৌচলাচল > নদীতে প্রবাহ অক্ষুণ্ণ রাখা > শিল্প > লবনাক্ততা নিয়ন্ত্রণ > শক্তি উৎপাদন > বিনোদন > অন্যান্য। উল্লেখ্য যে, একমাত্র পানীয় জল এবং ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজনীয় পানিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং বাকীগুলোর অবস্থান সেক্ষেত্রে গৌণ। দেশের পানিসম্পদের সংরক্ষণ ও সুরক্ষা প্রসঙ্গে সেচ ও নগরে পানি সরবরাহ পরিকল্পনায় ভূপরিস্থ, ভূগর্ভস্থ ও বৃষ্টির পানির সমন্বিত ব্যবহার বিবেচনায় আনার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা একটি কার্যকরী পদক্ষেপ। উদাহরণ সরূপ ঢাকার প্রসঙ্গ এক্ষেত্রে বিবেচ্য। ঢাকার বার্ষিক বৃষ্টিপাত প্রায় ২০০০ মিমি যার শতকরা ৮০ ভাগই হয় বর্ষা মৌসুমে অন্তত এই সময়ের জন্য ঢাকা সহ অন্যান্য নগরগুলিতে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও বিশোধন করে ব্যবহারের উপযোগী করলে পানির চাহিদার একটি বড় অংশ মেটানো সম্ভব। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে যেসব জলাশয় অভিবাসী পাখির চারণভূমি হিসেবে চিহ্নিত সেগুলোতে কোন রকম নিষ্কাশন প্রকল্প পরিহার করা।

এছাড়া প্রাকৃতিক নিষ্কাশনকে বিবেচনায় না এনে যেকোন ধরনের পানিসম্পদ বিষয়ক প্রকল্প গ্রহণ বা বাস্তবায়ন রহিত করন ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ। দেশের নদ-নদী, প্লাবন ভূমি ও জলাশয় সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের প্রসঙ্গে এই আইনে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সকল নদ-নদীর ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় অনুমতি ব্যতিরেকে নদ-নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তিত হয় বা হতে পারে এমন স্থাপনা নির্মাণ রহিত করা হয়েছে। তবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অনুমতিক্রমে কয়েকটি বিষয়ের উপর এই আইন শিথিল করা হয়েছে: এক, নদীর নাব্যতা ও পানিপ্রবাহ বজায় রাখার জন্য ড্রেজিং, দুই, নদী তীরের ভাঙন রোধ বা ভূমি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে নদীর এক বা একাধিক শাখানদী বন্ধ বা ভরাট করা, ও তিন, বন্যা ব্যবস্থাপনা অবকাঠামো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ। অংশগ্রহণমূলক পানি ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার কর্তৃক অনুমোদিত পানি ব্যবস্থাপনা সংগঠন গঠন এবং তার নিয়মাবলী নির্ধারণের উদ্যোগ একটি গুরুত্ত্বপূর্ন পদক্ষেপ। সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে স্টেকহোল্ডার বা যাদের জন্য প্রকল্প করা হবে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

পানিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পে স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে সরকার কর্তৃক অনুমোদিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন গড়ে তোলা নিঃসন্দেহে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ। তবে এই বিধি, গঠন প্রকৃতি ও কার্যাবলী এমন ভাবে নির্ধারণ করতে হবে যাতে তাতে সত্যিকার অর্থেই সাধারণ জনগণের মতামত ও অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত হয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে অপরিকল্পিত ভাবে বা স্টেকহোল্ডারদের সাথে মতবিনিময় না করে গৃহীত প্রকল্প পরিশেষে ব্যর্থ হয়েছে। উদাহরণ সরূপ বলা যেতে পারে সাম্প্রতিক কালে পঞ্চগড় সদর উপজেলায় করুম নদের ওপর পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি করা স্লুইসগেট উইয়ার (এক ধরনের পানি নিয়ন্ত্রন অবকাঠামো) এর কথা যার লক্ষ্য ছিল পানি সংরক্ষণ করে শুষ্ক মৌসুমে সেচ সুবিধা। ৭৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো এক বছরেই পরিত্যক্ত হয়েছে কারণ এর কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে প্রায় ৬০০ একর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। প্রকল্পটি করার আগে স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে কোনরূপ মতামত বা পরামর্শ নেওয়া হয়নি এবং স্থানীয় কৃষকদের দাবির মুখে সেই বাঁধ কেটে দিতে হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনকে (দৈনিক প্রথম আলো, ২৩ জুন ২০১২)। পানি সম্পদের অর্থনৈতিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছেঃ এক, পানি ব্যবহারের মূল্য নীতি প্রণয়ন এবং পানি শুল্ক নির্ধারণ। পানি ব্যবহারের মূল্য নীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হয়েছে পানির অপচয় রোধ ও সমন্বিত ব্যবহার নিশ্চিত করা। পানির মূল্য নির্ধারণে যেসব বিষয় বিবেচনা করা হবে তা হচ্ছেঃ পানি সরবরাহের প্রকৃত খরচ, পরিবেশ সংরক্ষণের খরচ, জনগোষ্ঠীর আর্থিক অবস্থান (দরিদ্র-অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য মূল্য কম), পানির ব্যবহারের ধরণ (মৌলিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে মূল্য কম, শিল্প ও বাণিজ্যিক ব্যবহারে মূল্য বেশী), ইত্যাদি নিয়ামক। আরেকটি গুরুত্ত্বপূর্ন পদক্ষেপ হচ্ছে পানি আইন ২০১২ অনুযায়ী দণ্ড যোগ্য অপরাধসমূহ, শাস্তি ও জরিমানা নির্ধারন করা। এই আইন অনুযায়ী নির্ধারিত দণ্ড যোগ্য ১৬ টি অপরাধের তালিকা এর ৩৫(১) ধারাতে উল্লেখ করা হয়েছে। এই অপরাধসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ অনুমোদিত ক্ষেত্র ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে পানি ব্যবহার করা বা অনুমোদিত ক্ষেত্র সমূহের জন্য প্রযোজ্য শর্ত পালনে অস্বীকৃতি, জারিকৃত নির্দেশ অমান্য করা, পানি পরিমাপ যন্ত্রে হস্তক্ষেপ করলে, প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত প্রদানে ব্যর্থ বা বিভ্রান্তমূলক তথ্য প্রদান করলে, যেসব ক্ষেত্রে পানি ব্যবহারে জন্য নিবন্ধন প্রয়োজন সেসব ক্ষেত্রে নিবন্ধন না করলে, পানি ব্যবহারের মানদণ্ড অবহেলা করলে, পানির সদ্ব্যবহার বিঘ্ন করে কোন নির্মাণ কাজ করলে, উন্মুক্ত জলপ্রবাহ থেকে অবৈধভাবে পানি গ্রহণ বা প্রবাহের দিক পরিবর্তন করলে, প্রাকৃতিক জলাধারে কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে, পানিসম্পদের অবৈধ দখল বা দূষণ করলে ইত্যাদি। এইসব অপরাধের জন্য বা পানি আইনের যেকোন ধারা লঙ্ঘনের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি রাখা হয়েছে পাঁচ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা পঞ্চাশ লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড যা দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করা যেতে পারবে।

এখানে উল্লেখ্য যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে (ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি) দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উভয়ই অপরাধের জন্য দায়ী হবেন আর সরকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রধান বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দায়ী হবেন। ৩) বাংলাদেশ পানি আইন ২০১২ পর্যালোচনা করলে কিছু কিছু বিষয়ে অসংগতি লক্ষ্য করা যায়। উদাহরন সরূপ বলা যায়, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে অভিন্ন নদী অববাহিকা নিয়ে চলমান বা আসন্ন সংকট নিরসন নিয়ে কোন দিক নির্দেশনা বা নীতি এখানে উল্লেখ করা হয় নাই যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রস্তাবিত পানি আইনে রাষ্ট্রের সকল পানিসম্পদের অধিকার দেয়া হয়েছে সরকারকে যাতে ব্যক্তি মালিকানাধীন জলাশয়ও পড়ে। যেহেতু কোন ব্যক্তিকে শুধুমাত্র গৃহস্থালি কাজে ও সাধারণ কৃষিকাজে প্রাকৃতিক জলাধার বা জলাশয়ের পানি সীমিত ব্যবহারের অধিকার দেয়া হয়েছে সেক্ষেত্রে ব্যক্তিগত জলাশয়ের অন্যান্য ব্যবহার যেমন মৎস্য চাষ প্রকল্প ইত্যাদির বৈধতা কি এক্ষেত্রে নাকচ হয়ে যাবে কিনা সে বিষয়ে কোন স্বচ্ছ ধারনা পাওয়া যায়না। এছাড়া গৃহস্থালি কাজে ও সাধারণ কৃষিকাজে প্রাকৃতিক জলাধার বা জলাশয়ের পানি সীমিত ব্যবহারের মাত্রা কতটুকু সেটি সম্পর্কেও স্বচ্ছ ধারনা অনুপস্থিত। আমরা লক্ষ্য করেছি ক্রমবর্ধমান শহরের (যেমন বিভাগীয় শহর, বিশেষত ঢাকা) ক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানাধীন বহুতল ভবনগুলো তাদের নিজেদের ব্যাবহারের জন্য গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভ থেকে পানি আহরণ করে থাকে যা প্রকারান্তরে এই শহরগুলির ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাবার প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করছে, বিশেষত ঢাকার ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাবার হার (বছরে তিন মিটার) আশঙ্কাজনক । এই আইনে ব্যক্তিগত কাজে পানি উত্তোলনের পরিমাণ 'সীমিত' রাখার পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ করে দিলে তা ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাবার রোধে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হতে পারত।অবশ্য একটি ধারা রাখা হয়েছে যাতে সরকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে টেকসই পর্যায়ে রাখার জন্য যেকোন অঞ্চলকে পানির সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে ঘোষণা দিতে পারবে এবং সেই এলাকায় পানির সদ্ব্যবহার কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

দেশের পানিসম্পদের সংরক্ষণ ও সুরক্ষা প্রসঙ্গে যদিও ভূপরিস্থ, ভূগর্ভস্থ ও বৃষ্টির পানির সমন্বিত ব্যবহার বিবেচনায় আনার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা হয়েছে তবে এ বিষয়ে বিশদ দিক নির্দেশনার বিষয়টি এখানে উহ্য রয়ে গিয়েছে। প্রাকৃতিক নিষ্কাশনকে বিবেচনায় না এনে যেকোন ধরনের পানিসম্পদ বিষয়ক প্রকল্প গ্রহণ বা বাস্তবায়ন রহিত করন করা হলেও এক্ষেত্রে শুধু 'পানিসম্পদ বিষয়ক প্রকল্প' এর পরিবর্তে 'যেকোন উন্নয়ন প্রকল্প' উল্লেখ থাকলে সেটি অধিক ফলপ্রসূ হত কারণ দ্রুত নগরায়নের ফলে অসংখ্য বেসরকারি আবাসন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে বা হচ্ছে যাতে প্রাকৃতিক নিষ্কাশন প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ ভাবে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। হলে আমরা দেখেছি বন্যা প্রবাহ অঞ্চলেও যত্রতত্র বেসরকারি এমনকি সরকারী আবাসন প্রকল্প ( উদাহরণ সরূপঃ পূর্বাচল বা ঝিলমিল প্রকল্প) গড়ে উঠেছে। অপরিকল্পিত ড্রেজিং বা শাখানদীর গতিপথ বন্ধের ক্ষেত্রে যথাযথ পরিবেশগত প্রভাব যাচাই (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট এসেসমেন্ট বা 'ই আই এ')এর প্রয়োজনীয়তা এই আইনে উল্লেখ করা হয়নাই। অবশ্য শাখা নদী বন্ধের ক্ষেত্রে 'যথাযথ সমীক্ষার ভিত্তিতে' কথাটি উল্লেখ আছে তবে এক্ষেত্রে 'যথাযথ পরিবেশগত প্রভাব যাচাই এর ভিত্তিতে' উল্লেখ থাকলে তা অধিক অর্থবহ হতো। সেই সাথে ড্রেজিং এর ক্ষেত্রেও এরূপ একটি যাচাই এর কথা উল্লেখ থাকা উচিৎ। একই ভাবে বন্যা ব্যবস্থাপনার জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের বৈধতা দেয়া হলেও তা নির্মাণের আগে পরিবেশগত প্রভাব যাচাই বা অকাঠামোগত বন্যা ব্যবস্থাপনা বা 'লিভিং উইথ ফ্লাড' এর দিকে অধিক নজর দেয়া এরকম কোন আলোচনা বা নীতিমালা এখানে আসেনি।

পানি সম্পদের অর্থনৈতিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার উপর দুইটি ধারাতে আপাতদৃষ্টিতে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য রয়েছেঃ ধারা ৩০ (১) এর 'চ' তে উল্লেখ আছে যে, 'গৃহস্থালি ও সাধারণ কৃষিকাজে ব্যবহৃত পানির মূল্য-অব্যাহতি থাকবে,' অন্যদিকে একই ধারার 'জ' তে উল্লেখ আছে, 'পানির মৌলিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম মূল্য ও বাণিজ্যিক ও শিল্প ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশী মূল্য ধারণ করা হবে।' এখানে উল্লেখ্য যে পানির এই আইন অনুযায়ী পানির মৌলিক ব্যবহারের সংজ্ঞা হচ্ছে সুপেয় পানি এবং ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজনীয় পানি [ধারা ১৬(১)] অর্থাৎ গৃহস্থালির জন্য ব্যবহৃত পানি। একই ধারার 'চ' তে এই পানিকে মূল্য-অব্যাহতি প্রদান করার পর 'জ' তে তুলনামূলক কম মূল্য নির্ধারণ এর বিষয়টি ঠিক স্পষ্ট নয়। অবশ্য দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সেবা মূল্যের কথা বলা হয়ে থাকলে (আপাত দৃষ্টিতে সেটি মনে হচ্ছেনা কারণ উল্লেখ নেই) সেটি ভিন্ন কথা কারণ একই ধারার 'চ' তে উল্লেখ করা হয়েছে যে গৃহস্থালি ও সাধারণ কৃষিকাজে সরবরাহকৃত পানির ক্ষেত্রে তার সেবা মূল্যমান সরবরাহকৃত সরকারী বা বেসরকারি সংস্থা বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করতে পারবে। প্রস্তাবিত আইনে সেচ প্রকল্পের জন্য পানির শুল্ক ও সেবা মূল্য নির্ধারণের অধিকার সরকারকে প্রদান করা হয়েছে। সেই সাথে পানি সরবরাহ, উন্নয়ন, নিয়ন্ত্রণ, সংরক্ষণ, উত্তোলন, প্রশমন, পয়ঃনিষ্কাশন এবং পানি নিষ্কাশনের জন্য শুল্ক ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে দেবার অধিকার সরকার সংরক্ষণ করে।

এখানে 'কর্তৃপক্ষ' বলতে ঠিক কি বোঝাচ্ছে তা বোধগম্য নয়। এই আইনের প্রথম অধ্যায়ে সংজ্ঞায়নে 'উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ' এর বিষয়টি উল্লেখ আছে যা মূলত সরকার কর্তৃক গঠিত কোন কমিটি বা সংস্থাকে বোঝায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে শুল্ক ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা কি সরকার কর্তৃক গঠিত কোন কমিটি বা সংস্থার উপর ন্যস্ত হবে নাকি সেটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উপরও ন্যস্ত হতে পারে সেই বিষয়টি এখানে পরিষ্কার করা হয়নি। তবে এই আইনের সবচেয়ে আলোচিত বা বিতর্কিত অন্তর্ভুক্তি সম্ভবত ধারা ৩৯ (সরল বিশ্বাসে সম্পাদিত কার্য) যাতে উল্লেখ আছে, "এই আইনের আওতায় সরল বিশ্বাসে সম্পাদিত কার্যের ফলে কোন ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠান অথবা গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হইলে অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হইবার সম্ভাবনা থাকিলে তজ্জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়/ পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা/ কোন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা/ কর্তৃপক্ষ/ সরকারের কোন কর্মকর্তা অথবা কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোন আইনগত কার্যক্রম (Any Legal Proceedings) গ্রহণ করা যাইবে না।" এখানে একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ্য, যেহেতু এই আইনের দারা ২৬ (১) অনুযায়ী উল্লেখ আছে যে "…বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সকল নদ-নদীর ব্যবস্থাপনা/নিয়ন্ত্রণ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপর ন্যস্ত থাকিবে" তাই ধরেই নেয়া যায় যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এর অধীনে গৃহীত পানিসম্পদ বিষয়ক কোন উন্নয়ন কার্যক্রম (যা সম্ভবত সরল বিশ্বাসে সম্পাদিত কার্য বলে গণ্য হবে) এর ফলে যদি এর স্টেকহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হয় ( যেমনটা হয়েছে সাম্প্রতিক কালে পঞ্চগড়ে) সেক্ষেত্রে এই প্রকল্পের পরিকল্পনাকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবেনা। কিন্তু সত্যিকার অর্থে উচিত ছিল পানি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষগুলোকে আইনের আওতায় আনার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আসা সেক্ষেত্রে তারা হয়ত জনগণের বিষয় মাথায় রেখে সঠিক প্রকল্প গ্রহণ করার বিষয়ে আরও সচেষ্ট হত (ডঃ জহির উদ্দিন চৌধুরী ১১ জানুয়ারি ২০১১, দৈনিক প্রথম আলো)। ৪) পরিশেষে একটি গুরুত্ত্বপূর্ন বিষয় উল্লেখ করতে চাই যা পানি আইনে উঠে আসার কথা ছিল কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে আসেনি, সেটি হচ্ছে এক অববাহিকা থেকে অন্য অববাহিকায় পানি স্থানান্তরের বিষয়টি। আন্তঃঅববাহিকা পানি স্থানান্তর রহিতকরন বর্তমান বিশ্বের একটি গুরুত্ত্বপূর্ন আলোচিত বিষয়। উদাহরন সরূপ বলা যেতে পারতে কানাডার কথা। এখানে আলবার্টা অংগরাজ্যে ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য পানিসংকটের কারনে আন্তঃঅববাহিকা পানি স্থানান্তর রহিত করণ করা হয়েছে। বর্তমান কালে ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প যা মূলত একট আন্তঃঅববাহিকা পানি স্থানান্তর প্রকল্পের বাংলাদেশে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশদ আলোচনা। এছাড়া ব্রহ্মপুত্র নদীর চীনের অংশ ইয়ারলুং সাংপুর পানি দক্ষিণ চীন থেকে উত্তর চীনে স্তানান্তরও পরিকল্পনাধীন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিজস্ব পানি আইনে এই আন্তঃঅববাহিকা পানি স্থানান্তর রহিত করণ করা হলে ভারত ও চীনের ঐসব প্রকল্পের বিপরীতে বাংলাদেশের একটি শক্ত অবস্থান তৈরী হতো বলে আমার বিশ্বাস।

জাহিদুল ইসলাম : পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অফ আলবার্টা, কানাডা। প্রাক্তন শিক্ষক, পানিসম্পদ কৌশল বিভাগ, বুয়েট