ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, অসময়ে এক নক্ষত্রের পতন

অপূর্ব শর্মা
Published : 6 March 2018, 03:36 PM
Updated : 6 March 2018, 03:36 PM

আমরা মাঝে মধ্যেই নক্ষত্র পতনের কথা বলি! আজ সত্যি সত্যিই প্রত্যক্ষ করলাম এক নক্ষত্রের পতন। নক্ষত্র কিন্তু হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আঁধারে নিমজ্জিত হয়ে যায়! অথচ আমাদের চেতনার আকাশের যে নক্ষত্রটি আজ মহাকালের গর্ভে বিলীন হলো সেটি কিন্তু আঁধারে আবৃত হলো না, বরং আলো ছড়িয়ে, চিরকালের আলোর মশাল প্রজ্জলিত করে হারিয়ে গেলো! বলছিলাম ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কথা। সকলের প্রিয়, প্রিয়ভাষিণী আজ চলে গেছেন না ফেরার দেশে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই চিরপ্রস্থান হয়েছে তাঁর। তারপরও তাঁর মৃত্যুকে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে আমাদের।

কবি বলেছিলেন, 'জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?' সত্যিই তাই। মৃত্যু নামক চিরসত্যকে আমরা অস্বীকার করতে পারিনি আজ অবদি। ফেরদৌসীও পারলেন না! কিন্তু চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি যেটা পেরেছেন তা অনেকেই পারেন নি। তাঁর অকপটে সত্য বলার সাহস যেমন প্রেরণা যুগিয়েছে অসংখ্য বীরাঙ্গনাকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে, তেমনই শক্তি সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করেছে পথচলায়। দীর্ঘ অমানিশার কালেও নির্যাতিতা বলে কোনও অনুশোচনা ছিলো না তাঁর। বরং ছিলো যোদ্ধা হিসেবে গৌরব। বার বার বলেছেন, শরীর ছিলো তাঁর যোদ্ধাস্ত্র। সেই যুদ্ধে পরাজিত হননি তিনি। হয়েছেন বিজয়ী, বিজয়ীনি!

একাত্তর আর প্রিয়ভাষিণী শব্দ দুটি যেনো একাকার হয়ে গিয়েছিলো। তারই আভা ছড়িয়ে একাত্তর শব্দটিকে সঙ্গী করে চিরপ্রস্থান করেছেন তিনি ঠিক একাত্তর বছর বয়সে, তাও আবার মার্চ মাসে। এই যে মিল, এটা কি কাকতালীয়?

আমি বলবো- না। এটা মোটেই কাকতালীয় নয়। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে ঠিক এমনভাবে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন তিনি, যে তাঁর অস্থিমজ্জায় প্রোথিত হয়ে গিয়েছিলো একাত্তর শব্দটি। শুধু কি একাত্তর? না, ঐতিহাসিক নানা বাঁক বদলের সঙ্গেও জড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি, সেটা তাঁর অজান্তেই! আমরা যদি একটু সচেতনভাবে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাবো, তিনি যে সালে জন্মেছেন সেটি ছিলো পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির বছর।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের কিছুদিন পূর্বে ফেব্রুয়ারি মাসে পৃথিবীতে আগমন ঘটে প্রিয়ভাষিণীর। ফেব্রুয়ারি, যে ফেব্রুয়ারি চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলো আমাদের। দিয়েছিলো মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার। সেই ফেব্রুয়ারিতেই ভূমিষ্ট হলেন তিনি!

কয়েকমাসের ছোট্ট শিশুর পক্ষে দেশভাগ কী তা প্রত্যক্ষ বা অনুধাবন দু'টোই যদিও সম্ভব ছিলো না কিন্তু বেড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে দেশভাগের বেদনা ঠিকই বিক্ষত করেছে তাঁকে! পাকিদের দুঃসাশন প্রবল করেছে সেই বেদনাকে। মনোকষ্ট নিয়েই হয়তো লড়াই করেছেন পাকিদের ২৩ বছরের দুঃশাসনের অবসানে। সেই যুদ্ধ তাঁর জন্য ছিলো কঠিন, নির্মম আর ভয়াবহ। বিভিষীকাময় ভয়াল এই যুদ্ধে তাঁকে অবতীর্ন হতে হয়েছিলো সময়ের প্রয়োজনে। বাঙালি নারী যা কখনো কল্পনাও করতে চাননা সেই পরিস্থিতি অতিক্রম করতে হয়েছে তাঁকে অসীম সাহসিকতায়।

যুদ্ধদিনের করুন কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রদত্ত একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, "১৯৭১ সালে আমি খুলনা ছিলাম। অক্টোবরের শেষের দিকে আমাকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। …এমন কোনো নির্যাতন নেই, যা তারা করেনি। আমার জীবনে সে এক দুঃসহ স্মৃতি।"

সেই দুঃসহ স্মৃতিকে তিনি শক্তিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। লোকলজ্জাকে অগ্রাহ্য করে গৌরবের আখ্যান হিসেবেই তিনি জাতির সামনে তা তুলে ধরেছিলেন। জাতিও তাঁকে নিরাশ করেনি, কখনো দেখেনি ভিন্ন চোঁখে। ভালোবাসায় শ্রদ্ধায় তিনি ছিলেন সকলের মধ্যমনি।
জীবনের প্রয়োজনে অনেক কিছুই করেছেন তিনি। ১৯৭৭ সালে স্কুল শিক্ষকতা দিয়ে শুরু হয় তাঁর জীবন সংগ্রাম। দুই দশক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পালন করেছেন নানান দায়িত্ব। এরপর মনোনিবেশ করেন ভাস্কর্য্য নির্মাণে। ফেলে দেওয়া কাঠের টুকরা, শেকড়, গাছের গুড়িকে তুলে এনে শিল্পকর্মে ফুটিয়ে তোলে তৈরি করতে থাকেন গৃহসজ্জার উপকরণ।

শুধু নান্দনিকতায় নয়, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হওয়ার দীক্ষা দিয়েছেন তিনি আমাদের। স্বপ্ন দেখিয়েছেন সুন্দরের। প্রত্যয় যুগিয়েছেন সত্যের পথে পথচলায়। কিন্তু কখনো কারো করুনা, দয়া কিংবা অনুগ্রহের পাত্র হতে চাননি। নানাজন সরকারি নানা সুবিধে নিয়ে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করলেও এসবকে অপমান মনে করতেন তিনি। প্রবল আত্ম-অংহকার ছিলো তাঁর। দেশপ্রেম ছিলো মর্মমূলে। যখন গোড়ালিতে ব্যাথা পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন, নানা সমস্যায় প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলো উন্নত চিকিৎসার। যেটুকু জেনেছি, প্রধানমন্ত্রী চেয়েছিলেন তাঁকে বিদেশে পাঠাতে। তিনি বিদেশ যেতে চাননি। দেশের চিকিৎসায়ই খুশি ছিলেন। কারন একটাই, দেশের প্রতি অগাদ ভালোবাসা। কিন্তু দেশজননীর সন্তানেরা প্রিয় মা-কে ধরে রাখতে পারলো না!

আজ চলে যাওয়ার খবরটি শোনামাত্রই চোখের সামনে ভেসে উঠলো তাঁর হাসিমাখা মুখ। এ যাবৎ আমি তাঁর ঠিক যত ছবি দেখেছি প্রতিটিই ছিলো হাসিমাখা। কেউ ছবি ওঠাতে চাইলে কখনো মুখ গোমড়া করেননি তিনি, হাসিমাখা মুখে সাবলীলভাবে মিটিয়েছেন স্থীরচিত্রের দাবি। তাই তাঁর প্রয়ানের পর হাসিমাখা মুখে ভরে গেছে ফেসবুকের পাতা। হাসিকে অমলীন রেখে তিনি চিরবিদায় নিলেও তাঁর সেই হাসিমুখ কিন্তু আজ আমাদের হৃদয়কে ভরাক্রান্ত করে তুলেছে। প্রিয়ভাষিণীর প্রস্থানে স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর আমরা। জননী হারানোর বেদনায় কাঁদছে দেশবাসী।

বড্ড অসময়ে না ফেরার দেশে পারি জমালেন তিনি। কারণ অস্থিরতার এই সময়ে অনেক অনেক প্রয়োজন ছিলো তাঁর। যুদ্ধাপরাধীদের নিশ্চিহ্নকরণে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে, কুসংস্কারমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে খুব বেশি জরুরি ছিলো রক্তমাংসের ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর উপস্থিতি।

সেটাই যেনও প্রতিধ্বনিত হলো সাংবাদিক অঞ্জন রায়ের ফেসবুক স্টাটাসে। তিনি লিখেছেন, 'মা, এভাবে কেন চলে যাওয়া- এই প্রয়োজনের সময়ে? এখনো এই বাংলাদেশে আপনি অনেক জরুরী।'

সত্যিই তাই। তবে, আমি মনে করি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর প্রতি আমরা যদি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে চাই, তাহলে অবশ্যই তাঁর স্বপ্নগুলোকে বাস্তবায়ন করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন সেই বাংলাদেশ বিনির্মান করা সম্ভব হলে বাস্তবায়িত হবে ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীরস্বপ্ন। আর এতে করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের পথেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।