রক্তাক্ত জাফর ইকবাল, দায় কার? শিরোনামটিকে পাশে রেখেই লেখাটি শুরু করতে চাই। এটাকে ঠিক লেখা বলা যাবে না। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার উদ্দেশ্যেই কি-বোর্ডে চালিয়েছি আঙুলগুলো। তাই ক্ষুব্ধতার আখ্যান বলা যেতে পারে শব্দগুলোকে। যেমনটা বলছিলাম শিরোনামে-দায়টা কার?
আসলেই তাঁকে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে না পারার ব্যর্থতাটা কার? জাফর ইকালের উপর প্রাণসংহারের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত এই যে হামলা হলো, এটা যে হতে পারে তাতো সকলেরই জানা। আর এই হামলা থেকে তাঁকে বাঁচানোর জন্য সরকার মোতায়েন করে রেখেছেন পুলিশ। অথচ নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যে থাকা জাফর ইকবাল পর্যন্ত ছুরি নিয়ে কি করে পৌঁছালো হামলাকারী এবং ছুরিকাঘাত করলো তাঁর উপর স্বভাবতই প্রশ্নটি এসে যায়। এর দায় কিন্তু কোনওভাবেই এড়াতে পারবেন না নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতরা? তা এড়ানোর সুযোগও নেই তাদের।
কেনও তারা জাফর ইকবালকে রক্ষা করতে পারলেন না? অন্য অনেকের মতো প্রশ্নটি আমার মনেও ঘুরপাক খাচ্ছে। মোটাদাগে যেমনটি বলা হয়, অথবা এই ঘটনায়ও বলা হবে, দায়িত্বে অবহেলা ছিলো পুলিশের? কেনও এই অবহেলা করলো পুলিশ? তাহলে কিসের জন্য নিয়োজিত ছিলো তারা? এটা বললে কি খুব একটা বাড়তি কিছু বলা হবে? নিশ্চয়ই না।
প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত শিক্ষার্থীর সামনে, পুলিশের উপস্থিতিতে হামলা চালানো হলো শাবি ক্যাম্পাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় এই শিক্ষকের উপর। ভাবতেই গা শিউরে উঠে। তাও একটি অনুষ্ঠান চলাকালে, যে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি নিজে। প্রিয় ক্যাম্পাসে এমন হামলার শিকার হবেন তা হয়তো নিজেও কোনওদিন ভাবেননি জাফর ইকবাল।
এর আগে বহুবার তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। জিহ্বা কেটে ফেলার হুমকি দিয়েছে শিবির; প্রকাশ্যে চাবুক দিয়ে পেটানোর কথা বলেছেন শাসক দলের এমপি। কিন্তু সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের পথে সর্বদাই অবিচল থেকেছেন তিনি। মৃত্যু ভয়ে ভীত হননি কখনো। তাকে দুর্বল করতে জীবনসঙ্গী ইয়াসমিন হককেও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। তারপরও প্রগতিশীলতার পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ থেকেছেন জাফর ইকবাল। অকপটে বলেছেন সত্য কথা। সর্বশেষ র্যাগিং নিয়ে অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার অবস্থান প্রশংসিত হয়েছে সর্বমহলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিয়ের দায়ে বহিষ্কৃত পাঁচ শিক্ষার্থীকে পুলিশে দেওয়া উচিত ছিলো বলে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, 'তাদের যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে তা আসলে খুবই কম। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, তাদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া দরকার ছিল এবং রাষ্ট্রীয় আইনে তাদের বিচার করার দরকার ছিল।'
তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেছিলেন, 'আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে পড়াই; সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই কাজ করেছে। আমি খুবই লজ্জিত। আমি জাতির কাছে ক্ষমা চাইছি; কারণ আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই কাজ করেছে।'
নবাগত ছয় শিক্ষার্থীকে র্যাগিং ও মারধরের পর নগ্ন ছবি তুলে তা তাদেরকে দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করার অপরাধে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দুই ছাত্রকে আজীবন বহিষ্কারসহ পাঁচ ছাত্রকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এছাড়া আরও ১৬ জন ছাত্রকে বিভিন্ন মেয়াদে জরিমানা ও সতর্ক করা হয়। এ ঘটনায় অভিযুক্ত এবং তাদের পক্ষ নিয়ে কিছু শিক্ষার্থী আন্দোলন শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুধু তাই নয় তারা শিক্ষকদের সাথে খারাপ আচরণ করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। 'বিশ্বদ্যিালয় কর্তৃপক্ষ যেন এই ধরনের কুৎসিত আন্দোলনে মাথা না নোয়ায় এবং শাস্তি বহাল রাখে', এমন অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেন জাফর ইকবাল।
এই বক্তব্য প্রদানের একদিন তাঁর উপর হামলার ঘটনায় স্বভাবতভাবেই এ বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। তবে হামলার ধরন দেখে এটা যে পরিকল্পিত আক্রমণ ছিলো তা নিশ্চিত করেই বলা যাচ্ছে। যেসব স্থানে আঘাত করলে মানুষের মৃত্যু ঘটে সেসব স্থানেই আঘাত করেছে আক্রমণকারী। তবে ঘাড়ের আঘাতটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে উপরে লেগেছে। তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্ররা হামলাকারীকে আটক করে গণধোলাই দেওয়ার পর পুলিশ তাকে আটক করেছে। বর্তমানে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে আছে সে। তবে এ পর্যন্ত তার পরিচয় পাওয়া যায়নি।
হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইরত জাফর ইকবাল বরাবরই আইনের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। যখনই তাঁকে হুমকী দেওয়া হয়েছে তখনই আইনের সহায়তা চেয়েছেন তিনি। নিয়ম মেনে জিডি করেছেন থানায়। কিন্তু আস্থার প্রতিদান দিতে পারেনি প্রশাসন। একজন হুমকিদাতাকেও ধরা তো দূরের কথা ঠিক সেভাবে তাদের সনাক্ত করতে পারেনি তারা। এসব হুমকীকে কি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হয়নি? এই প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই এসে যাচ্ছে।
যদি হুমকির ঘটনাগুলো যথাযথভাবে অসনুন্ধান করে এর নেপথ্যের খলনায়কদের আটক করা যেতো তাহলে হয়তো আজকের দিনটি দেখতে হতো না। রক্তাক্ত হতে হতো না জাফর ইকবালের মতো জ্ঞানতাপসকে। তবে আশার কথা হচ্ছে, সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তাররা ক্ষত স্থানে সেলাইয়ের পর জানিয়েছেন, ড. জাফর ইকবাল এখন শঙ্কামুক্ত। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী কোনও রিক্স নিতে চান না। হামলার খবর অবগত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি নির্দেশ দিয়েছেন উন্নত চিকিৎসার জন্য রাতেই তাঁকে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য।
সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ওপর হামলায় জড়িতদেরকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসারও নির্দেশ দিয়েছেন। এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন তিনি। বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। ড.জাফর ইকবালের চিকিৎসায় যেনো কোনও ধরনের অবহেলা না হয় সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগ আমাদেরকে আশার আলো দেখাচ্ছে।
তবে, উন্নত চিকিৎসার মধ্যেই আমাদেরকে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। এই হামলার পেছনে কারা জড়িত তাদের খোঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। এ ব্যাপারে যেন কোনও অবহেলা না করা হয় সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। যেহেতু হামালাকারীকে আটক করা গেছে, তাই এ ঘটনার নেপথ্যের ভীলেনদের খোঁজে বের করা খুব একটা কঠিন হবে না। আইওয়াশের মধ্যে অনুসন্ধান প্রকিয়াকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। মূলে পৌঁছতে হবে। যথাযথ তদন্তের মধ্য দিয়ে পরিকল্পনাকারীদের যদি সনাক্ত করা যায় তাহলে জাফর ইকবালদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা যাবে। অন্যসব ঘটনার মতো প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হবে সেই দায়িত্ব। কারণ তিনি ছাড়া যে অভয় দেওয়ার আর তেমন কেউ নেই আমাদের?