ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতির পিতার অমর্যাদা প্রতিকারহীন কেন?

জহিরুল হক মজুমদার
Published : 29 Dec 2017, 01:05 PM
Updated : 29 Dec 2017, 01:05 PM

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতির পিতা। বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে তিনি গোটা জাতির হৃদয় জুড়ে আছেন সবসময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কাছে তিনি আরও কিছু বেশিভাবে হৃদয় জুড়ে থাকবেন সবসময়। কারণ তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই সাবেক ছাত্র। এই অসাধারণ গৌরব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশাল অর্জন। জাতির পিতা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এই গৌরবের কোন তুলনা হয়না।

বঙ্গবন্ধু তাঁর উচ্চশিক্ষার এক পর্ব কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তৎকালীন ইসলামিয়া কলেজে ছেড়ে এসেছিলেন। ১৯৪৭ সালে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন আইন বিভাগে। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন এবং নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ১৯৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে বহিস্কার করে।

বহিষ্কৃত অন্যরা মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফেরত পেলেও, বঙ্গবন্ধু মুচলেকা দিতে রাজি হননি। তাই তিনি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি গ্রহণ করেন নি। একাডেমিক ডিগ্রির চেয়ে আত্মসম্মান আর মানুষের জন্য সংগ্রামকে বড় করে দেখেছেন বলেই তিনি জাতির পিতা হয়ে উঠতে পেরেছেন।

কিন্তু এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি ধারাবাহিকভাবে বঙ্গবন্ধুর মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে পারছে? দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই প্রশ্নের জবাব হচ্ছে 'না'। এখানে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পক্ষের বিপুল সংখ্যক  শিক্ষক থাকার পরও এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি কেন? এর প্রধান কারণ সম্ভবত এই যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পক্ষের যে শিক্ষক জোট এখানে ক্রিয়াশীল তাদের সচেতনতা এবং মনোযোগের  অভাব।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁদের আবেগ এবং শ্রদ্ধার কোন ঘাটতি আছে বলে মনে করিনা। কিন্তু কখনো কখনো নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন সব ব্যক্তিকে সামনে এগিয়ে দেওয়া হয়েছে যারা জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং আবেগের জায়গা থেকে বঙ্গবন্ধুকে সঠিকভাবে ধারণ করার ক্ষমতা রাখেন না। এ ধরণের ব্যক্তি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের  প্রশাসনিক নেতৃত্বে আসেন তখন জাতির পিতার  মর্যাদার জায়গাটি সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ মনোযোগী থাকেন না। নিকট অতীতে এই ধরণের ব্যক্তিকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক নেতৃত্বে দেখা গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারী এবং সাবেক ছাত্র-ছাত্রী মিলে এক  বিশাল পরিবার। তারা ক্ষোভ, হতাশা এবং দুঃখে প্রবলভাবে আক্রান্ত হয়েছে যখন ২০১৬ সালের পহেলা জুলাই "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস" এর  স্মরণিকায় জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে লেখা হয়। বাংলাদেশের অতি সাধারণ মানুষও জানেন যে, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাসের কী নিদারুণ বিকৃতি! বঙ্গবন্ধুর প্রতি কী ভয়ানক অসম্মান!

টিএসসি এর হল রুমে  উপস্থিত অতিথিরা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। পরিস্থিতি সামাল দিতে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক পুস্তিকাটি বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেন। কিন্তু উত্তেজিত ছাত্র জনতা উপাচার্যের বাসার সামনে অবস্থান নিয়ে তাঁর পদত্যাগ দাবি করতে থাকেন।

উপাচার্য এই বলে দায়িত্ব এড়াতে চান যে, বিবিধ  আবাসিক হলের পরিচিতিমূলক যে  লেখাটিতে জিয়াউর রহমানকে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি লেখা হয়েছে তা ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রেজাউর রহমানের লেখা। তিনি আরও বলেন যে লেখাটির বাই-লাইনে রেজাউর রহমানের নাম রয়েছে।

এই ধরণের ব্যাখ্যা যে অত্যন্ত ঠুনকো, দায়সারা এবং গা বাঁচানো তা বুঝতে কষ্ট হয়না। পহেলা জুলাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানের মূল আয়োজক বা হোস্ট হচ্ছেন উপাচার্য। ছাত্র, শিক্ষক এবং কর্মচারীদের নিয়ে র‍্যালিতে নেতৃত্ব  দেওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং আলোচনা অনুষ্ঠানের মূল আয়োজক তিনিই। সুতরাং সেই অনুষ্ঠানের একটি প্রকাশনায় যখন জাতীয় ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো হয়, বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করা হয়, তার দায় উপাচার্য এড়াতে পারেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের স্মরণিকা পুস্তিকাটি কোন একাডেমিক জার্নাল নয় কিংবা পত্রিকার কলাম নয় যে এখানে ব্যক্তি নামে লেখা ছাপা হতে হবে। রেজাউর রহমান নিজের কৃতিত্ব জাহির করার জন্য লেখক হিসেবে নিজের নাম ছেপেছেন হয়তো। কিন্তু অনুষ্ঠানের প্রধান আয়োজক হিসেবে উপাচার্য তাঁর দায় এড়াতে পারেন না।

এ ধরনের একটি ছোট পুস্তিকা প্রকাশের পর উপাচার্য যদি একবারও খুলে দেখার সময় না পান, কিংবা দেখার প্রয়োজন জরুরি মনে না করেন, তাহলে এটাও তাঁর দিক থেকে এক ধরনের দায়িত্ব অবহেলা। এটা কি অনিচ্ছাকৃত ভুল, না কি ভুলের আবরণে বিকৃত ইতিহাস প্রতিষ্ঠার মহড়া ছিল?এই প্রশ্নের মীমাংসা অত্যন্ত জরুরী। উপাচার্যের উচিৎ ছিল নৈতিক দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করা।

সেই বিকৃত ইতিহাস কলঙ্কিত প্রতিষ্ঠা দিবসের এক বছর পর আরও একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পার হয়ে গেছে। কিন্তু সেসময় অভিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রেজাউর রহমানকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও তার বিরুদ্ধে পরে আর কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি। এ রকম একটি প্রকাশ্য অপরাধের তদন্তে এত দীর্ঘ সময়ও লাগার কথা নয়। উপাচার্যের দিক থেকে মনোযোগ এবং তাগাদা থাকলে অভিযুক্তের শাস্তি বিধানে এত দীর্ঘ সময় লাগার কোন কারণ নেই।

এখানে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসনের দিক থেকে কোন দ্বিধা-সংশয় ছিল? দীর্ঘ সময় পাওয়ার পরও এই অপরাধের কোন প্রকার প্রতিকার না করেই অধ্যাপক আরেফিন তাঁর উপাচার্যের মেয়াদ শেষ করলেন। শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারী এবং বৃহৎ জন সমাজের কাছে নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখে গেলেন। সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আরেফিন আদৌ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক কি না, এই ধরনের সংশয়  নাগরিক সমাজের  মনে দোলা দেওয়াও অস্বাভাবিক নয়।

সবচেয়ে সংশয় জাগানিয়া পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, লন্ডনের একটি ঘরোয়া রাজনৈতিক সভায় বিএনপি নেতা তারেক রহমান জেনারেল জিয়াকে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলে উল্লেখ করেন। তাঁর এই উদ্ভট বিকৃত ইতিহাস বয়ানের পর যখন গোটা দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী  এবং গণমাধ্যম সমালোচনা এবং ধিক্কারে মুখর, ঠিক তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের একটি প্রকাশনায় একই বিকৃত ইতিহাস ঠাঁই পাবে, এটা নেহায়েতই কাকতালীয় নয়। এটি কোনো অনিচ্ছাকৃত ভুল, ছাপাখানার ভুল কিংবা কোন সম্পাদনা ত্রুটি মনে করার কোন কারণ আছে বলে মনে করিনা। এটি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে হয়। এই অপচেষ্টার পেছনে লেখক রেজাউর রহমান ছাড়াও অন্য কারো দায় রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা উচিৎ।

এই ধরণের ন্যাক্কারজনক জনক ঘটনার শাস্তিবিধানে যেকোনো প্রকার দীর্ঘসূত্রিতা অবিশ্বাস এবং সংশয়কে আরও বাড়িয়ে তুলবে। আর এতে করে মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাই এর দ্রুত প্রতিকার জরুরি।

১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুর আসার কথা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঘাতকের নির্মম বুলেট তাঁকে আমাদের মাঝে আসতে দেয়নি। সব আয়োজন শোকের ভার হিসেবে চেপে বসেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর। চেপে আছে আজকের দিন পর্যন্ত। তাই বঙ্গবন্ধুর এই অকাল প্রয়াণের বেদনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটু বেশিই বহন করে।

বঙ্গবন্ধুর বেদনা বিধুর প্রয়াণের ক্ষত বহন করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের একজন হিসেবে আরও অধিক ক্ষত বিক্ষত এবং দুঃখ ভারাক্রান্ত বোধ করি এই ভেবে যে, বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান এর ঘটনা এখানে দায়হীন এবং প্রতিকারহীন থেকে যাচ্ছে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আরেফিন এর প্রশাসনের সময় বঙ্গবন্ধুর মর্যাদার উপর আঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এ দায় তিনি এড়াতে পারেন না।

জাতির পিতার মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার পক্ষে কোনো প্রকার ছাড় নয়, কোনো প্রকার শিথিলতা বা অবহেলা নয়, এই হোক আমাদের প্রত্যয়।আমাদের প্রতি মুহূর্তের বেঁচে থাকার মধ্যে বেঁচে থাকুন বঙ্গবন্ধু।