‘মেরুদণ্ডহীন’ হিন্দু সম্প্রদায় ও ‘সাম্প্রদায়িক’ বাংলাদেশ

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 21 Nov 2017, 05:48 PM
Updated : 21 Nov 2017, 05:48 PM

তিনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ফোনে যখন আলাপ হচ্ছিল, তখন ঝাঁজালো কণ্ঠে বললেন, "কী-যে সব প্যানপ্যানানি লেখা লেখেন। এসব বাদ দ্যান। পারলে শক্ত করে লেখেন। না হলে লেখালেখি বাদ দেন। আর লিখেই-বা কী লাভ? রাস্তায় নামতে পারেন না? অস্তিত্ব হুমকির মুখে, আর আপনারা চুপচাপ বসে আছেন। আপনাদের পরিণতিও একসময় রোহিঙ্গাদের মতো হবে।"

উনি এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন। আমি শুনলাম। এই কথাগুলো যে আমি বুঝি না বা দেশের হিন্দুরা বোঝে না, তা তো নয়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কী-ই-বা বলার বা করার আছে? এদেশে হিন্দুদের যা পরিস্থিতি– যেভাবে অপমান-নির্যাতন-হামলা চালানো হচ্ছে– রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যে আচরণ করছে– তাতে হিন্দুদের মার খাওয়া ছাড়া, মেনে নেওয়া ছাড়া, বিলাপ ও চোখের জল ফেলা ছাড়া, দগ্ধ হওয়া ছাড়া, 'গোপনে দেশত্যাগ' ছাড়া আর কী-ই-বা করার আছে?

হ্যাঁ, হিন্দুরা যা করতে পারে, যা করতে পারত, যা করা উচিত ছিল তা হল, 'প্রতিরোধ' গড়ে তোলা। কিন্তু এদেশে বসবাসকারী হিন্দুরা, আমাদের পূর্বপ্রজন্মের নেতারা (হিন্দু-নেতারা, 'হিন্দু-নেতা' শব্দটি ব্যবহার করতে বিবেকে বাধছে, কিন্তু উপায় কী) সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তারা একটু করে পরাজয় স্বীকার করেছেন। লেজ গুটিয়ে পিছু হটেছেন। রুখে দাঁড়ানোর ব্যাপারে যারা নেতৃত্ব দিতে পারতেন, তারা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে শেখেননি। তাই অন্যকেও শেখাতে পারেননি। তাদের অনেকে দেশ থেকে ভেগেছেন। আবার অনেকে বড় দলগুলোর 'লেজনাড়া' প্রাণিবিশেষ হয়ে, তাদের দেওয়া একটু 'খুদকুড়ো' পেয়েই সন্তুষ্ট থেকেছেন। কেউ কেউ হিন্দুদের স্বার্থরক্ষার নামে 'সাইনবোর্ড-সর্বস্ব দোকান' একটা খুলেছেন বটে, কিন্তু পূজা-আয়োজন আর জন্মাষ্টমিতে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে 'দেখা' করা ছাড়া তাদের আর কোনো ভূমিকা নেই।

পরিণতিতে বাঘা যতীন, সূর্যসেন, প্রীতিলতার উত্তরসূরীরা এখন শ্যামল কান্তি-রসরাজ-টিটু রায়ে পরিণত হয়েছেন।

অবশ্য শুধু নেতাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, আমরা এদেশে বসবাসকারী হিন্দুরা সবাই আসলে মেরুদণ্ডহীন। 'মেরে মরা', দশটা খেলে অন্তত একটা পাল্টা থাপ্পড় দেওয়ার চিন্তা আমাদের মাথায় কোনোদিনই আসেনি। মার খেয়েছি। অপমান সয়েছি। তারপর একদিন 'জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী' বলে চোখের জল ফেলতে ফেলতে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছি। যাদের সুযোগ বা প্রবল ইচ্ছেশক্তির জোর আছে, তারা দেশত্যাগ করেছে। আর যাদের সেটুকুও নেই, তারা বেশিরভাগই কোনোমতে টিকে আছে– নারায়ণগঞ্জের শ্যামল কান্তির মতো, কান ধরে– অথবা টিটু রায়ের মতো রাষ্ট্রীয় পুলিশের রিমান্ডে।

না, কারও প্রতি কোনো আস্থা নেই। শ্রদ্ধা নেই। না সংখ্যালঘু না সংখ্যাগুরু। এমনকি নিজের প্রতিও কোনো শ্রদ্ধা নেই। আমিই কি পেরেছি প্রয়োজনীয় সময়ে সঠিকভাবে 'রিঅ্যাক্ট' করতে? মুখ বুজে থেকেছি। সব মেনে নিয়েছি। কোনো একজন শামীম ওসমান কিংবা এমন 'হোমড়া-চোমড়া' কেউ যদি কান ধরে ওঠবস করতে বলে, আমিও নিশ্চয়ই করব। 'মান-অপমান' নয়, 'বাচাঁ'টাই যে আমাদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যে বাঁচতে ভালোবাসি, জীবন ভালোবাসি!

হিন্দুরা এদেশে আক্রান্ত, উৎপীড়িত। কিন্তু তাদের মধ্যে প্রতিবাদের চেতনা নেই। ঐক্য নেই, ঐক্যবোধও নেই। একটা প্রতিবাদ সমাবেশ তো দূরের কথা সামান্য একটা মানববন্ধন করতে চাইলেও একজন হিন্দুকে খুঁজে পাওয়া যায় না। গুগলে খুঁজলে যেখানে পাকিস্তানি হিন্দুদের প্রতিবাদের ছবি পাওয়া যায় সেখানে বাংলাদেশি হিন্দুদের কেবল বাড়ির উঠানে কান্নাকাটির ছবি মেলে। বেশিরভাগ হিন্দু অন্য হিন্দুর উপর হামলা-নির্যাতনের সময় নীরবতার নীতি গ্রহণ করে। কেউ যদি হিন্দুদের উপর হামলা প্রতিবাদ করে, তবে তাকে 'সাম্প্রদায়িকতা' ভাবে।

হিন্দুদের উপর হামলাটা এদের কাছে 'অসাম্প্রদায়িকতা' (তাই তখন চুপ থাকে), আর নির্যাতিত হিন্দুর গলা টিপে ধরা যাতে হিন্দুরা বিচার চাইতে না পারে–, এটাও ওদের কাছে 'অসাম্প্রদায়িকতা'। তখন কোনো হিন্দু যেন প্রতিবাদ করতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে মাঠে নামে। এমনই 'আত্মঘাতী' এরা! এমন 'উদার' 'মহৎ' জনগোষ্ঠী মার খাবে না তো খাবে কে?

আসলে আমাদের কী করা উচিত ছিল, কী করা দরকার– এ ব্যাপারে কেউ কি কিছু বলবেন? আমি, আমরা আজ বিভ্রান্ত, বড় বেশি কনফিউসড! এদেশের হিন্দুদেরও কি এলটিটিই (লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম)-জিএনএলএফ (গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট)-হামাস(ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন, ফিলিস্তিন)এর মতো সংগঠন গড়ে তোলা উচিত? অথবা 'আত্মঘাতী' হওয়া উচিত? কিন্তু এগুলো করেই-বা কি হয়েছে? অস্ত্র তুলে নিলেই কি সফল হওয়া যায়? সফল হওয়া গেছে? সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশে তেমন 'মেরুদণ্ডসম্পন্ন' হিন্দু কোথায়?

এই দেশে আদৌ কি আমাদের বসবাসের কোনো সুযোগ আছে? রংপুরের গঙ্গচড়ায় একটা ফেইক আইডি খুলে টিটু রায়ের নামে 'ধর্মীয় অবমাননাকর' পোস্ট দেওয়া হয়েছে। টানা কয়েকদিন ধরে আক্রমণের উস্কানি দিয়ে প্রকাশ্যে প্রচার সমাবেশ করা হয়েছে। এরপর এই সাজানো অপরাধে টিটু রায়ের এবং তার প্রতিবেশি হিন্দুদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে হাজার হাজার 'নামহীন-গোত্রহীন' জনতা। সেই টিটু রায় পুলিশের হাতে আটক হয়েছে, আদালত রিমান্ডের অনুমতি দিয়েছে। একজন আইনজীবীও তার জামিন চায়নি। এই হল সংক্ষেপে আমাদের সাধের 'গণতান্ত্রিক,' 'অসাম্প্রদায়িক', 'সভ্য' রাষ্ট্রের একটি ছোট্ট নমুনা।

আমাদের বিভিন্ন খেতাবে অভিষিক্ত জাতীয় নেতানেত্রীরা ভিন দেশে আক্রান্ত-অত্যাচারিত বিতাড়িত মানুষজনের দুঃখে দুঃখী হন, তাদের জড়িয়ে ধরে কাঁদেন, আর দেশের মধ্যে অন্যায়ভাবে হিংসা ও হিংস্রতার শিকার মানুষকে 'রিমান্ড' এবং 'আইন' দেখান। রসরাজ-শ্যামল কান্তি-টিটু রায়রা সহানুভূতি ও সমর্থন পান না। সাঁওতাল পল্লী জ্বলে পুলিশের দেওয়া আগুনে। চাকমা পল্লী, হিন্দু পল্লী পুড়ে ছাড়খাড় হয় 'নামহীন-গোত্রহীন' 'ষড়যন্ত্রী' জনতার আগুনে।

এ ব্যাপারে বলা হয়, তাদের তো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। অনেকেই 'টাকা'র অংকে মাপেন সংখ্যালঘুদের 'ক্ষতি'। এই হল আমাদের দেশে বর্তমানে প্রচলিত হিউম্যানিটির চেহারা।

ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন আমাদের দেশে একটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কারণে-অকারণেই তাদের উপর হামলা, আক্রমণ হয়। তাদের জীবন অনিরাপদ করে তোলা হয়। তাদের সম্পদ লুটপাট করা হয়। জায়গাজমি জবরদখল হয়ে যায়। আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার মধ্যে বেঁচে থাকতে হয়। এটা মানুষের জীবন নয়। অনেকে কথায় কথায় ভারতের উদাহরণ টেনে আনেন। ভারতে মুসলিমদের উপর অত্যাচার হয়, সেটা বাংলাদেশি হিন্দুদের অপরাধ? এই অপরাধে কি 'হিন্দুশূন্য বাংলাদেশ' গড়ে তোলা হবে?

এখন মনে হয়, জন্মই যেন আমার, আমাদের আজন্মের পাপ। প্রশ্ন হল, এর থেকে নিষ্কৃতির উপায় কী? সমাধানের পথ কী? হিন্দুদের আপাতত একটাই করণীয় হতে পারে; তা হল, প্রশাসন, রাষ্ট্র, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রী, পাড়াপ্রতিবেশিসহ সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর কাছে নিরাপত্তা চাওয়া। সবার কাছে সহিষ্ণুতা প্রার্থনা করা। প্রয়োজনে এ জন্য সংশ্লিষ্টদের হাতে-পায়ে ধরা। শতকরার হিসেবে যারা প্রায় নব্বই ভাগ, তাদের ঔদার্য, সহানুভূতি আর শুভবুদ্ধি জাগিয়ে তোলা ছাড়া হিন্দুদের বাঁচবার আর কোনো উপায় আছে কি?

কিন্তু এটাও কী সম্ভব? এদেশের প্রশাসন, রাষ্ট্র, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রী, পাড়াপ্রতিবেশিসহ সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী কি আদৌ অসাম্প্রদায়িক? নিকট অতীতে আমরা কি কখনও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত ছিলাম?

এই দেশে আমরা যুগ যুগ ধরেই বিশুদ্ধ অক্সিজেনের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প গ্রহণ করেই বেঁচে আছি। মুখে আমরা সবাই 'মুক্তমনা' 'আসাম্প্রদায়িক' হিসেবে নিজেকে জাহির করি বটে, কিন্তু আসলেই কি আমরা তাই? 'ধর্ম হল বীজ এবং দারিদ্র্য-অশিক্ষা-কুশিক্ষা বীজ বোনার উপযোগী পরিবেশ। এই বীজ আর অনুকুল পরিবেশ সহজেই আমাদেরকে একেকটা সাম্প্রদায়িক হিউম্যান বোমা হিসেবে তৈরি করেছে। কেউ সামান্য স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে দিতে পারলেই হল– বুম করে ফেটে যাই।

সাম্প্রদায়িকতার বিষ যদি রক্তে না থাকত তাহলে মুহূর্তের মধ্যে ধর্মের নামে এমন 'অধর্ম' করা সম্ভব হত না। যখন ইন্টারনেট ছিল না, তখনও আমরা গুজবে মত্ত হয়ে হাজার মাইল দূরে সংঘটিত কোনো ঘটনার খবর কানে আসামাত্র ধর্মযুদ্ধের নামে ধ্বংসের নেশায় মত্ত হতে সামান্য বিলম্ব করিনি। এখনও করছি না।

মূল কথা হচ্ছে, হিন্দুরা এ দেশে মোটেও নিরাপদ নয়। তার কারণ 'রাজনীতি'। দখলের রাজনীতি, অসহিষ্ণুতার রাজনীতি। কমিউনাল মাইন্ডসেটের রাজনীতি। শুধু জামায়াত, বিএনপি বা জাতীয় পার্টি কিংবা শুধু আওয়ামী লীগকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, হিন্দু নিধন-বিতাড়ন-সম্পত্তি দখলের ব্যাপারে কমবেশি সব রসুনেরই 'কোয়া' এক। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, যারা সব সময় ধোয়া তুলসী পাতা সেজে বসে থাকেন, তাদের মনমানসিকতার খবর কী? যখন হিন্দুবাড়িতে, গাড়িতে, নারীতে হামলা হয় তখন তো দেখি অধিকাংশই তথাকথিত 'মুসলিম' সেজে যান। সংখ্যালঘুর সম্পত্তি লুটেপুটে ভোগ করার ব্যাপারে কারও আগ্রহ পনের আনা দেখিনি, আঠারো আনা ছাড়া।

কাজেই কাকে কী বলব? আবারও বলছি, জন্মই যে আমাদের আজন্মের পাপ।

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, বাংলাদেশটা আসলে কার। শুধু মুসলমানের? নাকি এদেশে বসবাসকারী মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্মপরিচয়নির্বিশেষে সকল নাগরিকের, সব মানুষের?