ভোরের পাখি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত

নূহ-উল-আলম লেনিন
Published : 7 Nov 2017, 04:44 PM
Updated : 7 Nov 2017, 04:44 PM

You cannot love your country
unless you love mankind.

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ভোরের পাখি। নিশাবসানে একটি নতুন দিনের আগমনী সংবাদে আমাদের ঘুম ভাঙে ভোরের পাখির কলতানে-গানে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সেই জাগর মন্ত্রে বাঙালি জাতিকে সচকিত করে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের মদিরা পানে আচ্ছন্ন বাঙালি জাতির মনের তন্ত্রীতে প্রথম টংকার তুলে তাদের জাগরণের সাগ্নিক হয়ে আছেন তিনি। যার কাছে 'সবার উপরে মানুষ সত্য' মানুষের প্রতি ভালোবাসাই যার কাছে দেশকে ভালোবাসার নামান্তর, তিনি আধুনিক বাঙালি জাতিসত্তা নির্মাণের অন্যতম পথিকৃৎ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন এবং তাঁর আত্মত্যাগের বিস্তারিত বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। এ কথা আমরা সবাই জানি, ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সংবিধান সভায় পাকিস্তানের ভাষা বিতর্কের সূচনা করেন কংগ্রেস পরিষদীয় দলের ডেপুটি নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। পাকিস্তানের সংবিধান সভা ((Constituant Assembly) গণপরিষদে কোন ভাষা ব্যবহার হবে, এই প্রসঙ্গে সরকারি মুসলিম লীগ দলের প্রস্তাব ছিল উর্দু ও ইংরেজি। মুসলিম লীগের এই প্রস্তাবের ওপর ধীরেন্দ্রনাথ দত্তর সংশোধনী ছিল:

That in sub-rule (I) of rule 29, after the word 'English' in line 2, the words 'or Bengalee' be inserted.

[১]

দৃশ্যত সংশোধনীতে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর প্রস্তাবের পক্ষে গণপরিষদে যে ভাষণ দেন তাতে তিনি দৃঢ়ভাবে বাংলাকে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ভাষা হিসেবে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের দাবি জানান। পাকিস্তানের তৎকালীন মোট জনসংখ্যা ৬ কোটির মধ্যে বাংলাভাষী জনসংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৪০ লাখ। স্বভাবতই এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মুখের ভাষাই হতে পারে পাকিস্তান রাষ্ট্রের লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা বা রাষ্ট্রভাষা। বক্তৃতায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কোনো দ্ব্যর্থবোধকতা না রেখে বাংলাভাষী জনসংখ্যার উল্লেখ করে প্রশ্ন করেন:

So sir, What should be the state language of state?

তিনিই এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন:

The state language of the state should be the language which is used by the majority of the people of the State, and for that, Sir, I consider that Bengalee language is a lingua franca of our state.

[২]

তাঁর বক্তৃতায় তিনি আরও বিস্তারিতভাবে বাংলা ভাষার পক্ষে নানান যুক্তি তুলে ধরেন। সে প্রসঙ্গ পুনরুল্লেখ না করে আমরা কেবল তাঁর একটি মন্তব্যই উল্লেখ করতে চাই। তিনি যুক্তি তুলে ধরে বলেন:

The language of the state should be such which can be understood by the common man of the state. The common man of the state numbering four crores and forty millions… .

[৩]

বলাবাহুল্য, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তর এই প্রস্তাব গণপরিষদের ভোটে বাতিল হয়ে যায়। কেবল পূর্ব বাংলা থেকে সাধারণ আসনে নির্বাচিত সদস্য প্রেমহরি বর্মন এই প্রস্তাব সমর্থন করে বলেন:

Sir, I whole heartedly support the amendment moved by my Hon'ble and esteemed friend, Mr. Dhirendranath Datta… .

[৪]

প্রেমহরি ছাড়া পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত মুসলিম লীগ দলীয় উর্দুভাষী খাজা নাজিমউদ্দিন অথবা বাংলাভাষী তমিজউদ্দিন খাঁ-সহ কেউই এই সংশোধনী প্রস্তাব সমর্থন জানায়নি। বরং খাজা নাজিমউদ্দিন মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনোভাব এই যে, তারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দেখতে চায়। আর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝতে পেরে তার বক্তৃতায় ধর্ম ও ভাষার সমীকরণ করে পাকিস্তান সৃষ্টির ভাবাদর্শগত ভিত্তি যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ অর্থাৎ দ্বিজাতিতত্ত্ব তার পুনরুল্লেখ করেন। তিনি 'উর্দুকে মুসলমানের ভাষা' হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং বলেন, পাকিস্তান যেহেতু ভারতীয় মুসলমানদের দাবির প্রেক্ষিতে সৃষ্ট রাষ্ট্র, সে কারণে স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু।

Pakistan is a Muslim state and it must have as its lingua franca (urdu) of the Muslim nation.

[৫]

লিয়াকত আলী খাঁর যুক্তি ও তথ্য দুটিই সত্যের অপলাপ। তিনি ভারতের ১০ কোটি মুসলমানের ভাষা উর্দু বলে যে তথ্য দিয়েছেন সেটি ডাহা মিথ্যা। অবিভক্ত ভারতের ১০ কোটি মুসলমান যেমন এক ভাষাভাষী ছিলেন না, তেমনি তাদের নৃ-জাতিগত পরিচয়ও এক নয়। ভারতীয় মুসলমানদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভাষা ছিল বাংলা। জাতিসত্তাগত বৈশিষ্ট্য, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত বৈচিত্র্য, ভাষাগত পার্থক্য, ভৌগোলিক এবং জীবনাচারের মধ্যকার পার্থক্যকে কৃত্রিমভাবে ধর্মের নামে সমসত্ত্ব বা Homogeneous হিসেবে দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়। যে মুসলিম 'জাতীয়তা' ও ধর্মভিত্তিক 'জাতীয়তাবাদের' ধারণা ছিল পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনের মূল প্রেরণা, ইতিহাসের বিচারে তা-যে কতটা ঠুনকো ও ভঙ্গুর সেটি একাত্তরেই প্রমাণ হয়ে গেছে।

তবে এ কথা তো সত্য, সে সময় এই ধর্ম সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ মুসলমান মানসকে প্রবলভাবে প্রভাবিত ও সাময়িক হলেও আচ্ছন্ন করেছিল। এখানে একটা তথ্যের পুনরুল্লেখের লোভ সামলাতে পারছি না।

দেশভাগের প্রাগ মুহূর্তে এসে যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন যুক্ত বাংলার পক্ষে এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবক্তা, সেই তিনিই জিন্নাহ মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত 'ছাত্রমিছিলে গুলিবর্ষণের নিন্দা করে বিবৃতি দিলেও পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দু হওয়া উচিত বলে মত প্রকাশ করেছিলেন।' পরে অবশ্য বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে সোহরাওয়ার্দী তাঁর মত পরিবর্তন করেন।

[৬]

১৯৪৮ সালের গণপরিষদের সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই ঐতিহাসিক ভাষণটিকে আমরা কীভাবে দেখব?

আমি শুরুতেই বলেছি, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন ভোরের পাখি। এ কথা এখন সর্বজনস্বীকৃত যে, সংবিধান সভায় ধীরেন দত্তের ঐ ঐতিহাসিক ভাষণই আমাদের ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ইন্ধন জুগিয়েছে। এ কথা সত্য, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক পাকিস্তান সৃষ্টির আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। গণপরিষদে আনুষ্ঠানিক বিতর্কের পূর্বে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকেই ভাষা-বিতর্ক চলছিল। ১৯৩৭ সালে লক্ষ্মৌতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সর্বভারতীয় অধিবেশনে উর্দুকে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা করার প্রস্তাব উঠলে, বাংলার প্রতিনিধিরা সে প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।

এছাড়া দেশভাগের আগের দুই দশকজুড়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত লাঙ্গল, নাছিরউদ্দিন সম্পাদিত সওগাত এবং মওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত মাসিক মহম্মদী, দৈনিক আজাদ, স্টার অব ইন্ডিয়া ও মর্নিং নিউজ প্রভৃতি সাময়িকী ও সংবাদপত্রে বাংলার পক্ষে অনেকেই জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেন। রেঁনেসা সোসাইটি প্রভৃতি সংগঠন এমনকি বাঙালি মুসলমান আলেম সমাজও বাংলা ভাষার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন।

বাংলার পক্ষে এতসব একাডেমিক আলোচনা ও জনমত সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানালে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তার বিরোধিতা করেন। তিনি ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে এ প্রসঙ্গে লিখেন:

"উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষারূপে গণ্য হইলে তাহা শুধু পশ্চাদগমনই হইবে।"

তিনি ঐ লেখায় আরও বললেন:

"ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতার নামান্তর হইবে।"

আর ১৪ আগস্টের কয়েকদিন পর (১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর) ড. কাজী মোতাহার হোসেন লিখলেন:

"শীঘ্রই তাহলে পূর্ব ও পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশঙ্কা আছে।"

১৯৪৭ সালের নভেম্বরে আরও স্পষ্ট করে ড. এনামুল হক লিখলেন:

"বাংলাকে ছাড়িয়া উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা রূপে পাকিস্তানবাসী গ্রহণ করলে তাহাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মৃত্যু অনিবার্য।"

[৭]

১৯৪৭ সালে করাচিতে পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার প্রস্তাব পাস হয়। তাৎক্ষণিকভাবে পূর্ব বাংলায় তার প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ থেকেও উর্দুর বিরোধিতা এবং বাংলাকে পূর্ব বাংলার শিক্ষার মাধ্যম করার দাবি উপত্থাপিত হয়।

কিন্তু ১৯৪৮ সালে গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশোধনী প্রস্তাব বাতিল এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজিকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিক্রিয়া হয় সূদূরপ্রসারী। বস্তুত পাকিস্তান সংবিধান সভা তথা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সরকারিভাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবের প্রতি অস্বীকৃতি জানায়। ফলে শান্তিপূর্ণ এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভাষা প্রশ্নের মীমাংসার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। সূচিত হয় ভাষার মর্যাদা এবং জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। ২৫ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব বাতিল করার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' তে লিখেছেন:

"কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করলেন, বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ, পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হল বাংলা। মুসলিম লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আমরা দেখলাম বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিশ এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিশ যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করে।… সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে 'বাংলা ভাষা দাবি' দিবস ঘোষণা করা হল।"

[৮]

এভাবেই ভাষা আন্দোলনের বীজ রোপিত হল। সেই বীজ থেকে অঙ্কুরিত হল বাঙালির জাতীয় চেতনার পুষ্পপল্লব। কাকতালীয় বটে, ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রধান উপাদান বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবি উপত্থাপন করলেন, আর তার মাত্র চার বছরের মাথায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের আত্মদানের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রভাষার দাবিটি যেমন অপ্রতিরোধ্য জনদাবিতে পরিণত হল, তেমনি রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষার দাবি শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মেনে নিতে বাধ্য হল।

তবে ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক ফলাফল হল বাঙালি মুসলমানের আত্মআবিষ্কার, সেকুলার জাতীয়তাবোধের উজ্জীবন, পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসা। সর্বোপরি বাঙালি জাতিকে ক্রমশ স্বাধিকার চেতনায় সংঘবদ্ধ করা এবং '৭১এর মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় অনিবার্য করে তোলা।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সাহস ও প্রজ্ঞার সঙ্গে সংবিধান সভায় এই দাবি তুলে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা, মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার বংশীবাদকের ভূমিকা পালন করলেন। ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই গৌরবোজ্জ্বল অভিযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়ে তাকে যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে নিলেন। আমরা পেলাম বাঙালির ইতিহাসের প্রথম জাতি-রাষ্ট্র, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের রাজনৈতিক ভাবাদর্শগত অবস্থান ও চিন্তা

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে তরুণ আইনজীবী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯২১ সালে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে পরিচালিত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক অভিষেক সম্পন্ন হয়। অতঃপর ১৯৭১ পর্যন্ত অবিরাম পথচলা। ব্রিটিশ আমলে ও পাকিস্তান আমলে বহুবার কারানির্যাতন, মামলা-হামলার শিকার হলেও তার এই পথচলা মুহূর্তের জন্যও থামেনি।

দলগতভাবে জাতীয় কংগ্রেস ছিল ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী এবং শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে অঙ্গীকারাবদ্ধ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির কারসাজি, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম লীগের 'মুসলমানের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি' পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ধর্ম-সাম্প্রদায়িক জাতীয়তার উত্থান, জাতীয় কংগ্রেসের একাংশের অনুদার, অসহিষ্নু এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদী ভাবাদর্শগত অবস্থান এবং উপর্যুপরি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিণাম হল ভারত-ভাগ এবং খণ্ডিত স্বাধীনতা। মুসলিম লীগ কোনো রাখ-ঢাক না করেই সাম্প্রদায়িক বিভাজন চেয়েছে।

পক্ষান্তরে যে বেঙ্গল কংগ্রেস ১৯০৫ সালে 'বাংলা-ভাগের' বিরুদ্ধে বীরোচিত গণসংগ্রাম গড়ে তুলেছিল, ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস সেই বেঙ্গল কংগ্রেসই ১৯৪৭ সালের এপ্রিলে সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা-ভাগের প্রস্তাব পাস করে।

[৯]

আর ১৯৪৭ সালের ৩ জুন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির পার্টিশন পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়। এর ফলে শরৎ বোস-কিরণশঙ্কর রায় এবং সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমদের বিলম্বিত উদ্যোগ, যুক্ত বাংলার (মে, ১৯৪৭) প্রস্তাব চূড়ান্তভাবে অকার্যকর হয়ে যায় এবং বাংলা-ভাগ অনিবার্য হয়ে পড়ে।

আমাদের কৌতূহলের বিষয় হল, এ সময় বেঙ্গল কংগ্রেসের পরিষদীয় দলের উপনেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ভূমিকা কী ছিল? ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের 'আত্মকথা' গ্রন্থে, তাঁর জবানিতে এ কথা সুস্পষ্ট যে, তিনি ভারত-ভাগ ও বাংলা-ভাগের বিরোধী ছিলেন। শরৎ বোস ও কিরণশঙ্করের যুক্তবাংলার উদ্যোগ এবং দেশভাগ সম্পর্কে একাধিক গবেষণা গ্রন্থে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ রায়ের নেতৃত্বে বেঙ্গল কংগ্রেসের স্বল্পসংখ্যক ছাড়া আর সবাই বাংলা-ভাগের পক্ষে ছিলেন। বেঙ্গল কংগ্রেসের একদার একচ্ছত্র নেতা শরৎ বসু দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন; তাঁর মাত্র '৫-৬ জন অনুসারীই' তাঁকে সমর্থন করেছেন।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ 'আত্মকথা' য় ১৯৪৬-৪৭ সালের ঘটনাবহুল রাজনৈতিক ডামাডোলের তেমন কোনো বিবরণ দেননি। তবে তিনি যে বাংলা-ভাগের কট্টর বিরোধী ছিলেন, তা তাঁর পরবর্তী সিদ্ধান্তেই প্রমাণিত। আমাদের ধারণা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দেশভাগ না করার প্রশ্নে শরৎবসু ও কিরণশঙ্কর রায়ের কথিত স্বল্পসংখ্যক অনুসারীর অন্যতম ছিলেন।

দেশভাগ অনিবার্য হয়ে গেলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথমত জন্মভিটা তথা পূর্ববঙ্গ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি লিখেছেন:

"পাকিস্তান হওয়ার পর আমার বহু রাজনৈতিক বন্ধু পাকিস্তান ত্যাগ করিয়া ভারতবর্ষে চলিয়া যান। ত্রিপুরা জেলার বহু কংগ্রেস কর্মী ও বহু লোক পশ্চিমবঙ্গে চলিয়া যান। অভয় আশ্রমের বহু কর্মী পূর্ববঙ্গ ছাড়িয়া পশ্চিমবঙ্গে তাঁহাদের কর্মস্থান ঠিক করিলেন, তাহাতে আমি বহু রাজনৈতিক বন্ধু হারাইলাম, বেদনায় মন ক্লিষ্ট হইয়া গেল। কিন্তু পূর্ববঙ্গে থাকিব এই সংকল্প করিয়াছি, সেই জন্য পশ্চিমবঙ্গের বন্ধুবান্ধবের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করিয়া পূর্ববঙ্গে রহিয়া গেলাম।"

[১০]

পাকিস্তানি জজবা, সাম্প্রদায়িক আবহ এবং লক্ষ লক্ষ বাঙালি হিন্দুর পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করে চলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে জন্মভূমির মাটি আঁকড়ে থাকার এই সিদ্ধান্ত খুব সহজ ছিল না। তিনি পশ্চিমবঙ্গে চলে গেলে বরং কংগ্রেস পরিষদীয় দলের উপনেতা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ অথবা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় অতি সহজেই স্থান করে নিতে পারতেন। কিন্তু নির্লোভ চরিত্রের এই মানুষ তাঁর দেশপ্রেমের অঙ্গীকার রক্ষায় পাকহানাদার বাহিনীর হাতে জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন তিনি কত বড় মাপের অগ্নিশুদ্ধ মানুষ ছিলেন।

তাঁর মতোই এ দেশে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন 'যুক্ত বাংলার' অন্যতম প্রবক্তা প্রখ্যাত কিরণশঙ্কর রায়। পাকিস্তান গণপরিষদে ১২ সদস্যবিশিষ্ট কংগ্রেসদলীয় নেতার পদে বৃত হয়েছিলেন কিরণশঙ্কর রায়। কিন্তু এ দেশে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তে তিনি বেশিদিন অটল থাকতে পারেননি।

১৯৫০ সালের দাঙ্গার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কোপানলে পড়তে পারেন আশঙ্কায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং তফসিলি নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ভারতে চলে যান। ধীরেন্দ্রনাথ বিষয়টি সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেননি; বলেছেন, "ইহা একটি দুঃখময় ঘটনা।"

কিন্তু অকুতোভয় এই দেশপ্রাণ মানুষটি সেই দুঃখের তিমিরেই রয়ে গেলেন।

আমাদের মনে হয়েছে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও দেশপ্রেমের পাশাপাশি এক ধরনের 'সারল্য'ও ছিল। রাজনীতির কুটিলতা এবং ষড়যন্ত্রের খেলা সম্ভবত তিনি খুব একটা বুঝতেন না।

পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তিনি কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা হিসেবে পাকিস্তান সংবিধান সভার (Pakistan Constituant Assembly) করাচিতে অনুষ্ঠিত প্রথম সভায় যোগদান করেন। সেটি ছিল ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট। পাকিস্তান সংবিধান সভার প্রথম অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও হবু গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে উদ্বোধনী ভাষণ দিয়েছিলেন, সে ভাষণে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। জিন্নাহ তার সেই ভাষণে বলেছিলেন:

You may belong to any religion or caste or creed that has nothing to do with the business of the state… We are starting with this fundamental principle that we are all citizens and equal citizens of one state. …'
Now, we should keep that in front of us as our ideal and you will find that in the course of time Hindus would cease to be Hindus and Muslim would cease to be Muslims, not in the religious sense, because that is the personal faith of each individual, but in the political sense as citizens of the state.

[১১]

নিঃসন্দেহে জিন্নাহর এই ভাষণে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সকল প্রকার বৈষম্যলোপ এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে রাষ্ট্রের কোনো সম্পর্ক নেই বলে যে ঘোষণা তিনি দিয়েছেন, তার প্রতি যে কোনো মানুষের প্রতীতি জন্মানো স্বাভাবিক। ভাষণে জিন্নাহ কার্যত পাকিস্তানকে একটি সেকুলার রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এই ভাষণ শোনার পর আদ্যোপান্ত সেকুলার রাজনীতি ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, আমরা তাঁর জবানিতেই তা শুনব। 'আত্মকথা' য় তিনি লিখেছেন:

"এই ভাষণে আশ্বাস স্থাপন করিয়া সংকল্প করিলাম, পাকিস্তান ছাড়িয়া যাইব না। ইহা ছাড়া আমার মন আজও বিশ্বাস করে, You cannot love your country, unless you love mankind. পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ত্রিপুরা জেলার হিন্দু-মুসলমান খ্যাত-অখ্যাত বহুকর্মী পল্লী অঞ্চলে ছড়াইয়া রহিয়াছে। তাহারা প্রকৃত প্রস্তাবে আমার পরিবারভুক্ত। তাহাদিগকে ছাড়িয়া আমি যাইতে পারিব না। সমস্ত বিপর্যয়ের ভিতর এই বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুর প্রাক্কালে এই মনোভাব প্রতিষ্ঠিত। আরও সংকল্প করিলাম, আমি বাক্যে, কার্যে ও মনে নিজেকে পাকিস্তানি ভাবিয়া পাকিস্তানের সর্বপ্রকার উন্নয়নের চেষ্টা করিব, আর যদি দেশের জনগণের সেবা করিতে পারি, তাহাই হইবে আমার জীবনে বিশ্বমানবের সেবা।"

[১২]

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর কথা রেখেছেন। কথায়, কাজে ও চিন্তায় জীবনের প্রতি পলে, প্রতি মুহূর্তে 'দেশের জনগণের সেবা' করে তিনি 'বিশ্বমানবের সেবা' করে গেছেন।

অথচ যে জিন্নাহর মনোহারী ভাষণে তিনি আস্থা স্থাপন করে জীবনের উল্লিখিত ব্রত গ্রহণ করেছিলেন, সেই জিন্নাহ কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে তার 'ঐতিহাসিক' অবস্থান ত্যাগ করেন। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এবং ২৪ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের ভাষণে পাকিস্তান যে 'মুসলমানের রাষ্ট্র' এবং রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে উর্দুকে মুসলমানের ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিয়ে তিনি কেবল ১১ আগস্ট (১৯৪৭)এর ভাষণের অঙ্গীকার থেকে সরে আসলেন না, রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই বলে যে মন্তব্য করেছিলেন, অবলীলাক্রমে সেই রাজনৈতিক-ভাবাদর্শগত অবস্থান পদদলিত করলেন।

প্রকারান্তরে জিন্নাহ পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৃত্যু-পরোয়ানা জারি করলেন। কেবল সেকুলার দেশপ্রেমিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই নন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতা লালকৃষ্ণ আদবানী-সহ অনেক ভারতীয় বুদ্ধিজীবী-গবেষক জিন্নাহকে 'সেকুলার' হিসেবে চিহ্নিত করে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করছেন।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর বিশ্বাসের প্রতি, রাজনৈতিক মতাদর্শগত অবস্থানের প্রতি আমৃত্যু বিশ্বস্ত ছিলেন। তথাকথিত 'সংখ্যালঘু' হওয়া সত্ত্বেও তিনি সংবিধান সভা বা গণপরিষদে যুক্ত নির্বাচনের প্রস্তাব উত্থাপণ করেন। পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে (১৯৫৬) যুক্তনির্বাচনের বিধান অন্তর্ভুক্ত হয়। কেবল তা-ই নয়, আজীবন জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য ও নেতা হওয়া সত্ত্বেও, তিনি উপলব্ধি করেন নবজাত পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠী, কংগ্রেসকে হিন্দুদের দল মনে করবে এবং হিন্দু-মুসলমানের মিলিত আস্থাশীল সেকুলার দলের মর্যাদা পাবে না।

এই উপলব্ধি থেকেই তিনি ১৯৪৮ সালের ১৮ জুলাই কুমিল্লায় কংগ্রেস কর্মীদের নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান রাজনৈতিক কনভেনশন নামে একটি সম্মেলন করে 'গণসমিতি' বা People's Party নামে একটি নতুন দল গঠন করলেন। তাঁর ভাষায়, "কিন্তু সেই চেষ্টা ফলবতী হয় নাই।"

ফলবতী না হলেও ১৯৫৪এর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে তাঁর দল যুক্তফ্রন্টের সমর্থনে সংরক্ষিত হিন্দু আসনের ৬টিতে জয়লাভ করেন। আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভায় তিনি গণসমিতির পরিবর্তিত নাম Pakistan Peoples Assosiationএর প্রতিনিধি হিসেবে মন্ত্রিত্বের শপথ গ্রহণ করেন।

মন্ত্রিত্বকে তিনি ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা লাভের উপায় হিসেবে দেখেননি। মন্ত্রিত্বকে তিনি সন্ন্যাসব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। আজকের দিনে আমাদের পক্ষে এ কথা কল্পনা করাও প্রায় অসম্ভব। এ প্রসঙ্গে 'আত্মকথা' য় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন:

"… শপথ গ্রহণ করিবার সময়ে আমার মন দায়িত্ববোধে অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল। যখন আমাকে আহ্বান করা হয় তখন গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ের শ্লোকটি আমার মনে আসে। 'অনাশ্রিতঃ কর্ম্মফলং কার্যণং কম্ম করোতি যঃ।/স সন্ন্যাসী চ যোগী চ নিরগ্নির্ণ চাক্রিয় ॥' এই শ্লোকটি তিনবার পাঠ করিয়া শপথ গ্রহণ করি। আমি সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করিলাম। বস্তুত, যে কোনো দেশের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করা, বিশেষ করিয়া অনুন্নত দেশের, সন্ন্যাসব্রত ছাড়া কিছুই নহে। ফলের আকাঙ্ক্ষা না করিয়া কর্তব্য করিয়া যাইতে হইবে এই সংকল্প গ্রহণ করিলাম।"

[১৩]

যতদিন তিনি মন্ত্রিত্ব করেছেন, ততদিন তিনি তাঁর এই সন্ন্যাসব্রতের ব্যত্যয় ঘটাননি। লোভ-লালসা, বিলাস-ব্যসনের ঊর্ধ্বে উঠে জনগণের একজন প্রকৃত সেবক হিসেবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সততা, নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগের এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। রাজনীতি ও মন্ত্রিত্ব যে আজকের মতো অর্থ-বিত্ত উপার্জন, বৈধ-অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার উপায় নয়, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রকৃত সন্ন্যাসীর মতোই তা প্রমাণ করেছেন। সেই যুগে ঢাকার ধানমণ্ডির অভিজাত এলাকায় এক বিঘার মতো প্লট নেওয়ার বৈধ সুযোগও তিনি গ্রহণ করেননি। তাঁর জীবনচর্যায় বা যাপিত জীবনে কোনো কলুষ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি।

আইউব খাঁ ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর, অ্যাবডো আইনে বহুসংখ্যক রাজনীতিবিদের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেন। ১৯৬০ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বিরুদ্ধেও অ্যাবডো আইনে ৬-দফা কারণ দর্শানোর অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। সামরিক ট্রাইব্যুনাল প্রহসনমূলক শুনানিতে অ্যাবডো আইনে তাঁর রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে বটে; কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ সামরিক শাসকরা উত্থাপন করতে ব্যর্থ হয়।

ধর্ম-দর্শন

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কেবল বাঙালির ধর্মসহিষ্ণুতার ঐতিহ্যের ধারকই ছিলেন না। তিনি বাঙালির বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সারাৎসারও আত্মস্থ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন:

"আমি জেলে বসিয়া গীতা ও কোরান পাঠ করিয়াছি। পাঠ করিয়া কোরান ও গীতার মূলতত্ত্ব একই উপলব্ধি করিয়াছি।"

[১৪]

তাঁর 'আত্মকথা' য় একাধিক অধ্যায়ে তিনি গীতা ও কোরানের উদ্ধৃতি দিয়ে এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তা হলেও তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধ অপরিহার্য মনে করেছেন। কিন্তু ধর্মের নামে কোনো সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণতা, গোঁড়ামি এবং আচারনিষ্ঠতাকে তিনি স্থান দেননি। চণ্ডিদাসের মতো সবার উপরে মানুষ সত্য এবং মানবধর্ম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মতো এক অখণ্ড চৈতন্য তাঁকে মানবিকতার উচ্চতর আসনে সমাসীন করেছিল। হিন্দু-মুসলমান, জাত-পাত, উঁচু-নিচু, ধনী-দরিদ্র ভেদ-বৈষম্য তাঁর মন স্পর্শ করতে পারেনি। তারঁ ধর্মবোধে ছিল হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের মিলন তথা ধর্ম-সমন্বয়ের ধারা।

আমাদের জাতিসত্তার গঠন প্রকৃতি যে যৌগিক (Syncretec) এবং ধর্ম যে একান্তই ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণের বিষয়, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর জীবনচর্যায় তা কেবল তত্ত্বের পর্যায়ে না রেখে জীবনভর ধর্মপরিচয়ের ঊর্ধ্বে মানুষে মানুষে সেতুবন্ধ রচনা করার নিরলস কর্মযজ্ঞ চালিয়েছেন। তাঁর মধ্যে সচেতনভাবে কার্যকর ছিল বাঙালি সংস্কৃতির সংশ্লেষণের ধারা। তিনি ছিলেন মনুষ্যত্ব এবং বাঙালিত্বের সাধনার এক মহত্তম সিদ্ধ পুরুষ।

১৯৭১-এ পুত্রসহ এই অশীতিপর বিশুদ্ধ মানুষটিকে পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী কুমিল্লা সেনানিবাসে দিনের পর দিন নিষ্ঠুরতম নির্যাতন করে হত্যা করে। বস্তুত এভাবেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সালের প্রতিশোধ গ্রহণ করে। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদাররা শারীরিকভাবে এই বরেণ্য মনীষীকে হত্যা করতে সক্ষম হলেও তাঁর কালজয়ী আদর্শ হত্যা করতে পারেনি। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাঙালির স্বাধীনতা, অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্র এবং একটি ভেদ-বৈষম্যহীন সমৃদ্ধ মানবিক সমাজ গড়ার সংগ্রামে অনাগতকাল ধরে ধ্রুবতারা হয়ে আমাদের পথ দেখাবেন।

তথ্যসূত্র:

১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৫৪

২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ৫৪

৩. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ৫৪

৪. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ৫৫

৫. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ৫৫

৬. জিল্লুর রহমান, ভাষা আন্দোলন ও মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ : গৌরবের ৫৫ বছর,
পৃষ্ঠা- ৫৩

৭. ড. মোস্তফা নূর-উল ইসলাম : ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারক গ্রন্থ, পৃষ্ঠা- ১২৪

৮. শেখ মুজিবুর রহমান : অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা- ৯২

৯. জয়া চাটার্জি : বাংলা ভাগ হল, পৃষ্ঠা- ২৯৬, ৩০৮

১০. ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আত্মকথা, পৃষ্ঠা- ৯৪-৯৫

১১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : প্রথম খণ্ড : পৃষ্ঠা- ৪২

১২. ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আত্মকথা, পৃষ্ঠা- ৯২-৯৩

১৩. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ১১২-১১৩

১৪. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ১৪৬।

[শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ১৩১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে, বাংলা একাডেমি আয়োজিত সভার স্মারক বক্তৃতা]