শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত: এক দেশপ্রেমিক নেতা

শামসুজ্জামান খান
Published : 1 Nov 2017, 03:56 PM
Updated : 1 Nov 2017, 03:56 PM

১.

'বাংলার বাণী' দৈনিকে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ধারাবাহিক আত্মজীবনীর বেশ কটি কিস্তি পড়ে মানুষটির চিন্তা-চেতনা ও জীবনবোধের মূলধারাটি আমার কাছে বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলা একডেমীর গ্রন্থাগারে বসে এই লেখাটি তৈরি করার জন্য আমি খুবই আগ্রহ ও কৌতূহল নিয়ে ওই পত্রিকার চলতি বছরের বেশ কয়েক মাসের সাময়িকী ঘাঁটতে থাকি। সাময়িকীর সব সংখ্যা নেই– দায়িত্ব ও যত্ন নিয়ে সংগ্রহ করে রাখা হয়নি। এটা আমাকে কিছুটা হতাশ করেছে। তবু যা পেয়েছি তাতে দত্ত মহাশয়ের জীবন আমি আমার মতো করে নির্মাণ করে নিতে পারি।

ওই ক'টি সংখ্যা পড়ে মনে হয়েছে, তিনি ছিলেন মূলত একজন দেশপ্রেমিক, গণতন্ত্রকামী ও সামাজিক শ্রেয়বোধসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা। সামাজিক সংস্কার চেতনার নৈতিকবোধ ও ভাবনা তাঁর চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থিত ছিল বলে তাঁর আত্মজৈবনিক রচনাটি পড়ে মনে হয়। পারিবারিক ঐতিহ্য ও পূর্বপুরুষের চিন্তাধারা তাঁর জীবনে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। এতে উদারনৈতিকতা, এমনকি বহুত্বের (Pluralism) বোধও লক্ষ্য করা যায়। গীতা, কুরআন, দর্শনের নানা সত্য ও সাহিত্যিক-মনীষীদের ভাবনার সারাৎসার তিনি তাঁর জীবনে গ্রহণ করেছিলেন।

সততা, বলিষ্ঠ সরলতা এবং গণতন্ত্রের প্রতি নিষ্ঠাই তাঁর জীবনের মূল সত্য বলে মনে হয়। পঞ্চাশের দশকের পূর্ব বাংলা ও পাকিস্তানের রাজনীতির নিখাঁদ ভেতর-চিত্র কেউ যদি পেতে চান তাহলে তিনি ধীরেন দত্তের আত্মজীবনী পাঠে উপকৃত হবেন। মন্ত্রিসভার ভেতরের কিছু অকথিত বিষয় তিনি প্রকাশ্যে এনেছেন– কোনো কোনো মন্ত্রীর একগুঁয়েমি ও জেদ কীভাবে গণতন্ত্রের ভিত্তি ধসিয়ে দিয়েছে তা-ও তিনি অনুত্তেজিত ভাষায় তুলে ধরেছেন। স্পিকারের অন্যায় প্রভাব খাটানোর প্রয়াস, বিশেষ গ্রুপের ডেপুটি স্পিকারের ওপর বিনাশী আক্রমণ, এই সব বিষয়ও একবারে ভেতর থেকে দেখার যে সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন তার সংক্ষিপ্ত কিন্তু বিশ্বস্ত বিবরণ আছে তাঁর ওই আত্মজীবনীতে।

২.

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মজীবনী এখনও প্রকাাশিত হয়নি। অতএব তাঁর জীবনের বহু কথাই এখনও আমাদের সামনে নেই। তবে যে বিষয়ের জন্যে তিনি জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তানের সম্মানে ভূষিত এবং ব্যাপকভাবে পরিচিত আমরা সেই দুটি বিষয়ের ওপরেই প্রথমে কিছুটা আলো ফেলে নিতে চাই।

এ-কথা বলা যায় যে, তিনিই প্রথম পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক একটি মৌলিক দাবিক আইন সভার মাধ্যমে জনসম্মুখে নিয়ে এসেছিলেন। এতে ঝুঁকি ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভটতা এবং চরম সাম্প্রদায়িক দর্শনের জন্যে একজন অমুসলিম নাগরিক হিসেবে তাঁর জন্যে ঝুঁকিটি একটু বেশিই ছিল। তবু তিনি এবং অন্য কজন অমুসলিম গণপরিষদ সদস্য যে যুক্তিনিষ্ঠ ও সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন তা আজ ইতিহাসের বিচারে সম্মুখমুখী দৃষ্টিভঙ্গির এক অনন্য নজির হিসেবে স্বীকৃত।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র সাত মাসের মধ্যেই গণপরিষদে তাঁকে এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করতে হয়। ইতিহাসে লেখা হয়েছে যে, এটি তিনি তাঁর দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী করেননি, ব্যক্তিগতভাবে করেছিলেন। যদি তাই হয়, তাহলে তাঁর সাহসিকতার সঙ্গে যুক্ত হয় দীপ্র ইতিহাস ও জাতীয় চেতনা, ঔচিত্যবোধ এবং গণতন্ত্র-মনস্কতা।

বিষয়টি ছিল, গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে বাংলার অন্তর্ভুক্তি। এই বিষয়ে তিনি একটি সংশোধনী এনেছিলেন। সংশোধনী উপস্থাপন করতে গিয়ে তিনি খুবই যুক্তিসঙ্গত ও গণতান্ত্রিক রীতিসম্মত একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। ওই ভাষণে তিনি বলেন:

Sir, that Bengalee is a Provincial language, but so far our state is concerned, it is the language of the majority of the people of the state.

তিনি আরও যা বলেছিলেন তা তাঁর চিন্তার স্বচ্ছতা ও যুক্তির অমোঘতাই পোক্ত করে। তাঁর বক্তব্য বাংলায় এভাবে বিন্যস্ত করা যায়:

"তাই একটি প্রাদেশিক ভাষা হলেও বাংলা যেহেতু দেশের অধিকাংশ জনগণের ভাষা, তাই তা ভিন্ন ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে যায়। দেশের ছয় কোটি নব্বই লক্ষ মানুষের মধ্যে চার কোটি চল্লিশ লক্ষ লোকই বাংলাভাষী।"

তিনি বলেন:

"দেশের রাষ্ট্রভাষাও হওয়া উচিত সেই ভাষা, যে ভাষায় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কথা বলে।"

বাংলায় সরকারি ও রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম পরিচালিত না হলে সাধারণ মানুষের কী কী অসুবিধা ও কষ্ট হবে তিনি তার কিছু উদাহরণ দেন এবং তাঁর সংশোধনীর ভূমিকা হিসাবে বলেন:

So sir, I know I am voicing the sentiments of the vast millions of our state and therefore Bengali should not be treated as provincial language. It should be treated as the language of the state.

[পাকিস্তান গণপরিষদের বিতর্ক, ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮]

সেকালে এই উক্ত ছিল উন্মোচনমূলক, দিকনির্দেশক।

ধীরেন দত্তের এই সব অসাধারণ বক্তব্যের পর তৎকালীন পরিষদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান যে সব অন্যায়, অবিবেচনাপ্রসূত ও স্থূল উক্তিতে তার উত্তর দেন তা তাঁর নিম্নরুচি, গণবিরোধী মনোভাব ও সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনাই তুলে ধরে। লিয়াকত আলীর ওই সব বক্তব্য আমাদের প্রায় সকলেই জানা। তবু তার গণতন্ত্রবিরোধী ও সাধারণ মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে এমন দুএকটি উক্তি উদ্ধৃত করি।

(১)

… It is wrong for him now to try and create the situation that as the majority of the people of Pakistan belongs to one part of Pakistan, therefore the language which is spoken there should become the state language of Pakistan.

(২)

লিয়াকত আলীর ইংরেজি ভাষণের অন্য একটি অংশের বাংলা করে দিলেই তাঁর মনোভাব ভালো ফুটবে মনে হয়:

"আসলে যখন সংশোধনী নোটিশটি দেওয়া হয় তখন ভেবেছিলাম এর উদ্দেশ্যটা নির্দোষ। 'কিছু লোক' যদি গণপরিষদে ইংরেজি বা উর্দুতে দক্ষতার সঙ্গে নিজেদের প্রকাশ করতে না পারে তাহলে তারা ওই ভাষায় বক্তব্য পেশ করতে পারে। কিন্তু এখন দেখছি আগে যা ভাবছিলাম এই সংশোধনীর উদ্দেশ্য তো তেমন নির্দোষ নয়।"

লিয়াকত আলী খানও যতটা ভাবা হয় ততটা নির্বোধ ছিলেন না। তিনি একটা জিনিস তো ঠিকই বুঝেছিলেন যে– he has raised indeed a very important question.

আসলেও তাই ধীরেন দত্ত পূর্ব বাংলার জীবন-মরণের প্রশ্নটাই তুলে ধরেছিলেন। রাষ্ট্রীয় আইন সভায় ওই প্রশ্নের অমন তীক্ষ্ণ উপস্থাপনা করে তিনি জাতীয় কর্তব্যই পালন করেছিলেন। পূর্ব বাংলার সচেতন নাগরিক ও তরুণ সমাজ, বিশেষ করে ছাত্রদের জন্য তাঁর ওই সংশোধনী প্রস্তাব ও সংশ্লিষ্ট ভাষণ ছিল এক সময়োপযোাগী দিকনির্দেশনা। ছাত্ররা তাঁর ওই বক্তৃতার পর বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে যে অভূতপূর্ব আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তা ছিল ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। প্রাজ্ঞ ও বিবেকি শিক্ষক এবং আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নেতার মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি যে রুখে দাঁড়িয়েছেন তাঁর জন্যে ছাত্ররা পাকিস্তানি-আচ্ছন্নতার ওই যুগেও তাঁকে যোগ্য শ্রদ্ধা জানাতে ভুল করেননি।

রশীদ হায়দার সম্পাদিত 'স্মৃতি ১৯৭১ তৃতীয় খণ্ড' (বাংলা একাডেমী)এ ধীরেন দত্তের নাতনী আরমা গুণ তাঁর লেখা থেকে এর এক সুন্দর চিত্র এঁকেছেন। তাঁর ওই লেখার কিছু অংশ:

"প্রথম গণপরিষদ অধিবেশন শেষে করাচি থেকে নেমে দেখলাম, প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ জন যুবক এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। তাদের প্রত্যেকের গায়ে চাদর। আমার ধারণা হল, গণপরিষদে বাংলার সপক্ষে কথা বলার দরুণ এরা বিক্ষোভ জানাতে এসেছে। এদের চাদরের আড়ালে অস্ত্রও থাকতে পারে। সংশয় নিয়ে এগিয়ে গেলাম। যখন ওদের একেবারে নাগালের মধ্যে চলে গেছি তখন হঠাৎ প্রত্যেকের চাদরের তলা থেকে রাশ রাশ ফুল বের করে আমার ওপর বর্ষণ করতে লাগল। ওরা সবাই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।"

[পৃষ্ঠা: ২৩]

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে ওই সংশোধনী প্রস্তাব এনেই তাঁর দায়িত্ব শেষ করেননি। বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে বাংলাকে আমাদের জাতীয় জীবনে যোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য লড়াকু যোদ্ধার মতো সংগ্রাম করে গেছেন। সে সব বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যে বিস্তারিত লেখালেখি হযেছে। তাই আমরা আর ওই প্রসঙ্গে বিশেষ কিছু বলব না। তাঁর অন্য ভূমিকার কথা বলেই আমরা এই লেখার ইতি টানব।

৩.

শরৎচন্দ্রের 'পথের দাবি' ছিল তাঁর প্রিয় বই। এ বই থেকে তিনি বুঝি জীবন দর্শনও গড়ে নিয়েছিলেন। আত্মজীবনীতে এ বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলছেন:

"আমরা সবাই পথিক। মানুষের মনুষ্যত্বের পক্ষে চলবার সর্বপ্রকার দাবি অঙ্গীকার করে আমরা সকল বাধা ভেঙেচুরে যাব– আমাদের পরে যারা আসবে, তারা যেন নিরুপদ্রবে হাঁটতে পারে। তাদের অবাধ মুক্তগতিকে কেউ যেন রোধ করতে না পারে।"

ধীরেন দত্তের আত্মজীবনী পড়ে তাঁর মানসিক গঠন ও চিন্তা-চেতনার একটা সুষ্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, তিনি আমাদের এই দেশকে একটি গণতান্ত্রিক জাতীয় রাষ্ট্রে (nation state) পরিণত করার জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। এই সৎ সরল সহজ মানুষটি কল্যাণ-ভাবনা ও দেশপ্রেমিকতার অনন্য নজির রেখে গেছেন। তাঁর এই জীবন-সাধনা দুটি ধারায় বিন্যস্ত। এক, সামাজিক ধারা। এর উদাহরণ তাঁর ওই আত্মজীবনী থেকেই তুলে ধরি। তিনি লিখছেন:

"আমি মনে করি অন্তত প্রতি এক হাজার লোক অধ্যুষিত এলাকায় একটি করিয়া প্রাইমারি বিদ্যালয় থাকা দরকার ও তাহার সঙ্গে কুটির শিল্প ও কারিগরি কাজের শিক্ষার ব্যবস্থা দরকার এবং সব বিষয়ে সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করা দরকার।"

দ্বিতীয়টি তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা। ১৯৪৮এ যে চিন্তাধারার তিনি প্রকাশ্য রূপ দিয়েছিলেন তার পূর্বাপর সম্পর্ক নিশ্চয় আছে। আত্মজীবনীতে তার প্রমাণও মিলে। তাই দেখি ১৯৪৮-৫৬ পর্যন্ত যেমন, তেমনি পাকিস্তানের সামরিক শাসনের (১৯৫৮-৬৪) দুঃসহ দিনগুলোতে তিনি তাঁর লক্ষ্যে স্থির– গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজে প্রায় এককভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশের নানা জায়গায়। মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ, মনোরঞ্জন ধরসহ বহু নেতা-কর্মীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আলাপ-আলোচনা করেছেন। আইয়ুবী মৌলিক গণতন্ত্রের ভাঁওতা ও মতলব তিনি বুঝে ফেলেছেন। তাই আইয়ুবের বিরুদ্ধে মিস ফাতেমা জিন্নার নির্বাাচনে বৃদ্ধ বয়সেও তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আশায় কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে। এজন্য আইয়ুব সরকার তাঁকে কারারুদ্ধও করেছে (২৮ ডিসেম্বর ১৯৬৪)। তবু তিনি সান্তনা পেয়েছিলেন এ জন্য যে, ওই নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহ হেরে গেলেও ধীরেন দত্তের এলাকায় আইয়ুব খান তাঁর চেয়ে কম ভোট পেয়েছিলেন।

আমরা কিছু আগে গণতান্ত্রিক জাতীয় রাষ্ট্রের কথা বলেছি। এই গণতান্ত্রিক জাতীয় রাষ্ট্র কিন্তু আমাদের এই অঞ্চলে এখনও গড়ে ওঠেনি। কারণ প্রকৃত, নির্ভেজাল ও জবাবদিহিতামূলক ও স্বচ্ছ গণতন্ত্র এবং সত্যিকার ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া কোনো রাষ্ট্র জাতীয় রাষ্ট্র (nation state) হয় না। ভারত ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হলেও ভারতীয় সাধারণতন্ত্রে গণতন্ত্রের দীর্ঘ অনুশীলনের ফলে আশা দেখা দিয়েছিল যে, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তারিত হবে। তা হয়নি। সেখানেও এখন রাম রাজ্যবাদীরা প্রবল। পাকিস্তান তো ইসলামি প্রজাতন্ত্র হয়েই অনড়ভাবে স্থিত আছে। গণতন্ত্র এই আসে তো ওই চলে যায়।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এখানে প্রকৃতই একটি জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে এবং চরম বর্বরতায় জেলহত্যার মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতার মূল নেতাদের নিশ্চিহ্ন করে ওই ধারার মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে সংবিধানে 'বিসমিল্লাহের রাহমানের রাহিম' এবং আরও পরে মিথ্যাচারী, ভণ্ড ও স্বৈরশাসক এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে যুক্ত করে জাতি-রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে দিয়েছে। অথচ লক্ষ লক্ষ লোক 'জয় বাংলা' বলে নিজেদের 'বাঙালি' হিসাবে পরিচয় দিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন।

বাংলাদেশের জাতীয়তার ভিত্তি সেই বাঙালিত্ব। এই বাঙালিত্বের, ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তার অন্যতম অগ্রচারী প্রবক্তা পুরুষদের প্রথম সারিতে ছিলেন ধীরেন দত্ত। আরমা গুণের ভাষায়,

"তাঁর জাতীয়তা ছিল এটাই– বাঙালি এবং ধর্মও ছিল একটাই– বাঙালি।"

আরমার লেখায় আরও আছে:

"দাদু বার বার বলতেন, যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ব্রিটিশরা এই দেশে বুনে দিয়ে গেছে মৃত্যুশেল হিসেবে, তার থেকে মুক্তি পাওয়ার একটিমাত্র পথ আছে। আর তা হল, এই দেশে 'ইন্টার-ম্যারেজ' হওয়া।"

জাতীয়তা গঠনে তাঁর এই চিন্তাও বেশ সাহসী।

এই সরল মানুষটি সত্যি খুব সাহসী ছিলেন। তিনি যখন পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলার দাবি নিয়ে লড়াই করেন তখন বাঙালি মুসলিম সদস্যরা টুঁ শব্দটি করেনটি। প্রাচীন অভিজাত ও জমিদার জোতদার বাঙালিদের কথা বাদ দিলাম। তমিজউদ্দীন খানের আত্মজীবনী পড়ে জেনেছি তিনি এক সাধারণ দুঃখকষ্ট সহ্য করা বাঙালি ঘরের সন্তান। কিন্তু তিনি পর্যন্ত ধীরেন দত্তের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। দলীয় নির্দেশ ও চোখরাঙানির ভয় থাকলে অন্তত চুপ তো থাকতে পারতেন।

১৯৪৮ তো কঠিন সময়– ১৯৫২এর ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৫৪এ পূর্ব বাংলা থেকে মুসলিম লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার পরও বাঙালি মুসলমান সদস্যদের ভয় কাটেনি। এর এক কৌতুকময় সরস বর্ণনা পাওয়া যায় 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ: অধ্যাপক রাজ্জাকএর আলাপচারিতা' বইয়ে (পৃষ্ঠা: ৯৮-১০৫)। এর একটু অংশ এরকম:

প্রশ্নের আকারে জাতীয় অধ্যাপক রাজ্জাক সাহেবকে সরদার ফজলুল করিম বলছেন,

আমিও স্যারকে বল্লাম, "এটা কি সাহসের অভাব?"

অধ্যাপক রাজ্জাক বললেন, "তখন নানা গণ্ডগোল চলছে। তারপর মিটিংয়ে পাকিস্তানের Prime minister অমুক নবাব, তমুক জাঁদরেল বক্তা এদের সামনে মানে বাঙালি লিডাররা Inferiority Complex থেকে সাহস বোধ করে নাই।"

অধ্যাপক রাজ্জাক স্বীকার করলেন, "তা কি অস্বীকার করা যায়? ওদের হালচালই আলাদা ব্যাপার। একটা অ্যাসেম্বলি মেম্বারের দশ পনেরটা গাড়ি। বেয়ানে এক কাপড় পইরা আসে, বিকালে আর এক কাপড় পইরা আসে। আর আপনাগো কাপড়-চোপড় হইল একটা ছেঁড়া কোর্তা।"

[পৃষ্ঠা: ১০২]

তাই মোহন মিয়া প্রমুখ অধ্যাপক রাজ্জাক, আতোয়ার হোসেন প্রমুখ বিশেষজ্ঞকে করাচিতে নিয়েও তাদের পরামর্শমতো পূর্ব বাংলার দাবি-দাওয়া গণপরিষদে দূরে থাক পার্টিসভায়ই তুলতে সাহস করেননি।

এই পটভূমিকায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ভূমিকা কী অসামান্য!

তাঁর আত্মজীবনীতে আরও একটা তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য আছে। ১৯৫৮ সালে East Pakistan State Acquisition of Tenancy act নিয়ে আইন পরিষদের সদস্য ও মন্ত্রিসভার বিরোধে কোনো কোনো সদস্য ১০০ বিঘার পরিবর্তে ২০০ বিঘা সিলিং নির্ধারণ করার কথা বলেন।এ নিয়ে মন্ত্রিসভায় বিরোধ দেখা দেয়।

উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রচণ্ড ক্ষমতাধর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাধ্যতামূলক সমবায় গড়ে তোলার লক্ষ্যে জমির সর্বোচ্চ সীমা ১০০ বিঘায় নির্ধারণ করেন, তখনও পটুয়াখালি ও দিনাজপুরের বৃহৎ জোতদার আওয়ামী লীগ এমপিরা পার্টিসভায় এর তীব্র বিরোধিতা করেন।

ধীরেন দত্ত শহীদ হয়েছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শহীদ। পাকিস্তানি মিলিটারির নিষ্ঠুর অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে তিনি এদেশের মাটিকে তাঁর পবিত্র রক্তে সিক্ত করেছেন। তিনি এই সব কিছুই যেন শহীদ হবার আগে দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছিলেন। বলেছেনও সেসব কথা। আরমাকে বলা তাঁর কথার একটা অংশ:

"'দাদু, গীতাটা আন'– আমি এনে দিলাম। দাদু বল্লেন, 'এবার শোন'– তারপর গীতার একটা অংশ খুলে লাল পেন্সিল দিয়ে দাগ দিয়ে পড়ে শোনালেন। যার অর্থ, দেশের জন্য যুদ্ধেক্ষেত্রে প্রাণ দিলে সে মরে না, সে শহীদ হয় এবং সে অবিনশ্বর– তাঁর আত্মা কখনও মরে না।"