নেতাদের যাওয়া-আসা ও গণসংবর্ধনার অপসংস্কৃতি

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 19 Oct 2017, 06:54 AM
Updated : 19 Oct 2017, 06:54 AM

তিনি ফিরেছেন। তিনি কেন ফিরবেন না? বা ফিরতে আপত্তি কোথায়? বিএনপির যেসব উগ্র ও কট্টর লোকেরা এতদিন বলছিলেন তাঁকে ফিরতে দেওয়া হবে না, তারা এখন কী বলবেন? জানি তারা বলবেন, সরকার বাধ্য হয়েছে ফিরতে দিতে! এই এক স্বভাব আমাদের। সবসময় নিজের পাতে ঝোল টানা।

বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়া এদেশের গণমানুষের নেত্রী কি না এ নিয়ে আওয়ামী লীগাররা বাহাস করলেও মানতে হবে, তাঁর একটা ভালো শক্ত জায়গা আছে মানুষের মনে। এর পেছনে যত নেগেটিভ কারণই থাকুক না কেন, তিনি ছিলেন এদেশের কয়েক দফার প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে সামনে রেখে যারা দেশ চালিয়েছিল তারা কী কেন কোন উদ্দেশ্যে তা করেছিল আমরা জানি। তারপরও জেনারেল জিয়া আর খালেদা জিয়ার প্রতি সাধারণ জনতা বিশেষত ভারতবিরোধী বা পাকিপ্রেমী মানুষের মনে একটা ভালো শক্ত জায়গা রয়েছে।

শুধু তা বললে চলবে না, মধ্যবিত্ত বাংলাদেশিদের ককটেল নীতিতে বিশ্বাসী করে তোলা রাজনীতিতে তাঁর দলের অবদান অনেক বেশি। আমি নিশ্চিত, এই মূহূর্তে তাঁকে সুযোগ দেওয়া হলে তিনি প্রমাণ করতে পারবেন কতটা জনপ্রিয়তা আছে তাঁর। যারা মনে করেন আমরা ঢালাওভাবে তাঁর বিরোধী তাদের বলি– একটা দেশে বিরোধী দল না থাকলে কী হয় সেটা আমরা সবাই জানি। তাদের গঠনমূলক ভূমিকা না থাকলে কী হয় তাও আমরা দেখছি। ফলে তাঁর ফিরে আসার যৌক্তিকতা রয়েছে। কিন্তু আপনারা মানেন সরকার বা প্রশাসন আপনাদের কিছুই করতে দিচ্ছে না। অথচ কাল যে আপনারা দলে দলে হাজারে হাজরে লাখে গিয়ে তাঁকে সংবর্ধনা দিলেন সেটা কীভাবে সম্ভব হল? কে আটকাল আপনাদের? না আপনারা স্বাভাবিক জীবনযাপন আটকে দিলেন প্রিয় নেত্রীকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য?

এ এক অদ্ভুত সংস্কৃতি আমাদের! আমার বেলায় ঠিক আছে। অন্যের বেলায় নয়। মাত্র কদিন আগে একটা লেখার শিরোনাম দিয়েছিলাম, 'গণসংবর্ধনা চাই না শেখ হাসিনাকে চাই'– আজ যদি এমন কোনো কথা আপনাদের বলি, আপনারা তেড়ে আসবেন। আমার জন্মগত পরিচয় নিয়ে গালমন্দ করবেন। এটা মানি, বিএনপি অনেক দিন থেকে নানামুখী চাপে কিছু করতে পারছে না। তাদের ওপর সরকারি চাপ বা প্রশাসনের চাপ আছে। কিন্তু আপনারা এটা পারলে আন্দোলন পারেন না কেন? পারেন না, কারণ মানুষকে মাঠে নামানো সহজ নয়।

প্রশ্ন করবেন, খালেদা জিয়া ফেরার সময় কীভাবে হল তাহলে? সেটা একটা আলাদা অনুভূতি হয়তো। সঙ্গে তাঁকে দেখার বিষয়টাও থাকতে পারে। তাছাড়া কে না জানে শো-ডাউনের পেছনে থাকে অর্থ প্রলোভন বা প্রচার। সেটা আওয়ামী লীগের বেলায়ও শতভাগ সত্য। মানুষ কীভাবে কেন যায় সেটা আমরা কি কম জানি? আমার জীবনে প্রথম মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবার ঘটনা এমনই। স্কুল থেকে অভুক্ত ছা্ত্রদের দলে আমাকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আইয়ুব খান দর্শনে। জেনারেল আইয়ুব ও তার সফরসঙ্গী বা নেতারা তো খেয়েদেয়ে ভালো গাড়িতে চড়ে এলেন, আর আমরা? তপ্ত রোদে খালি রাস্তায় দাঁড়াতে দাঁড়াতে একসময় মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবার দশা। কে কার খবর রাখে বলুন!

আমরা ভেবেছিলাম এই পরিবেশ বা এই কালচার একসময় আর থাকবে না। আমরা যত সভ্য হচ্ছি দুনিয়া দেখছি তত দেখছি কোনো উন্নত দেশে এমনকি পাশের দেশেও এসবের চল নেই। তাদের প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী নেতারা কখন আসে কখন যায় মিডিয়াও বলে না। একজন মানুষের প্রাইভেসি বলেও একটা বিষয় থাকে। খালেদা ম্যাডাম ছিলেন অসুস্থ। ফিরে তিনি বলেছেন, এখন ভালো আছেন। তাঁর তো দরকার শান্তি আর নীরবতা। সেটা না করে তাঁকে এভাবে হৈ হৈ করে বরণ করার কারণ কী? তার চেয়ে কি ঢের ভালো না নিজেদের দল ও দলের নির্বাচনমুখী কাজগুলো ঠিক করা?

সাধারণত সংবর্ধনা বিষয়টা হয় কেউ বিজয়ী হয়ে ফিরলে। যেমন বঙ্গবন্ধু ফিরেছিলেন পাকিস্তান থেকে। যেমন নোবেল নিয়ে ফিরেছিলেন ডক্টর ইউনূস। কিন্তু বেগম জিয়ার অর্জন কী? এবার তো তিনি ব্যক্তিগত কাজে বিদেশে গিয়েছিলেন। বিলেতে থাকা পুত্র ও পরিবারের সঙ্গে একান্তে সময় কাটিয়ে ফিরলেন, সেখানে সংবর্ধনার যুক্তিটা কোথায়?

সরকারি দলের বেলায়ও একই কথা বলা যায়। নিজেদের পায়ের তলার মাটি ঠিক না করে এমন সংবর্ধনার নামে জনগণকে অশান্তিতে রাখার দায় কে নেবে? একটা কথা মনে রাখা দরকার, জনগণ মুখে কিছু না বললেও তারা জানে কখন কী করতে হয়। তাই সাধু সাবধান।

এই কালচার বা সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কী অসাধারণ মিল! জেনারেল এরশাদ, জেনারেলপত্নী খালেদা জিয়া, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা– সবার ব্যাপারে আমরা এ কাজে সমান উৎসাহী। যেসব বিএনপি সমর্থক ও দলের লোকেরা বলছেন যে, এতে মনোবল চাঙ্গা হয়েছে, তাদের কাছে জানতে চাই, আজ আপনারা কোথায়? আজ আবার আসবেন পথে অন্য কোন কারণে? আসবেন না। কারণ সুষ্ঠু রাজনীতি এভাবে হয় না। এভাবে কেউ তা করতে পারে না।

আবারও বলি, হয়তো আপনাদের ঝিমিয়ে পড়া মনোবলের জন্য এই কোরামিনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বহুবিধ প্রশ্ন রেখে যাওয়া যানজট ,মানুষের দুর্ভোগ, রোগীর অসহায় চেহারা, কারও কাজে যেতে না-পারা, কারও অসুস্থ হবার দায়, কোনো দিনও ছেড়ে কথা বলবে না। একটা বিষয় কিছুতেই মাথায় ঢোকে না। কোনো নেতা-নেত্রী কোনো দিন কেন বললেন না, 'এসব করবেন না, করলে আমি বিব্রত হই'? বরং দেখলাম সবাই কোনো না কোনো ভাবে এই সংবর্ধনা বিষয়টা উপভোগ করেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেক বিষফোঁড়া কথিত সুশীলরা। এদের কাণ্ড দেখুন। যখন শেখ হাসিনার জন্য এমন কিছু করা হয় তারা প্রতিবাদে আভিমানে দেশের মানুষের জন্য বুক ভাসিয়ে ফেলেন। অথচ এখন তারা চুপ। জানি এর উত্তর আছে কিন্তু বলা যাবে না। কারণ, মূলত এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এটাই আমাদের বাস্তবতা।

ওই যে বললাম, আমাদের ককটেল মন। সেখানে পুরো মুক্তিযুদ্ধ বা উদারতার জায়গা নাই। আছে এক মুঠো মুক্তিযুদ্ধ এক চিমটি প্রগতিশীলতা এক থাবা রাজাকারি আর বেশ কিছু অন্ধকার। তবেই না আমরা বাঙালি।

যাক ভালোর ভালো তিনি ফিরেছেন। এদিকে তাঁর মাথার ওপর ঝুলছে আইনের খড়্গ। আমরা চাই নৈতিক বিচার। আর এটা মনে রাখতে হবে, তাঁর বয়স হয়েছে, তাঁকে যেমন অকারণে অপমান না করা উচিত তেমনি কৃতকর্ম বা বিএনপির মারমুখী নৃশংস রাজনীতিরও বিহিত চাই বৈকি।

এ বিষয়ে সরকারি দলের নেতাদের বলি, আয়নায় আপন চেহারা দেখুন। তারপর আঙুল তুলুন। সে অধিকার আছে কেবল আমজনতার। যারা রাজপথে নৃশংসতার শিকার। যারা হরতাল আন্দোলনে মার খায়। যারা অফিস যেতে পারে না। যারা চোখ হারায়, প্রাণ হারায়। যারা মীর্জা ফখরুল বা কাদের ভাইয়ের কথা আর প্রতিশ্রুতি শুনতে শুনতে ক্লান্ত। কেবল তারাই বলবে এই গণসংবর্ধনার নামে হয়রানি কতটা জরুরি।

যতদিন স্তাবক ও মূর্খের হাতে রাজনীতি ততদিন নিস্তার নেই। দুভার্গ্য এই যে, এই দেশ এই মাটির বিজয়ী সন্তান তাজউদ্দীন বা সৈয়দ নজরুল কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ স্বাধীন দেশে গণসংবর্ধনা দেয়নি। তাদের সংবর্ধনা দিয়েছিল মা মাটি আর পতাকা। সে দেশে আজ রাজনীতির নামে নীতিহীনতা আর জনদুর্ভোগ বুঝতে না-পারা নেতানেত্রীরা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় স্তাবকতায় বন্দি। আমরা কি এ থেকে কোনো দিন মুক্তি পাব না?