বাঘ সংরক্ষণের গুরুত্ব ও আমাদের করণীয়

তপন কুমার দে
Published : 29 July 2017, 08:19 AM
Updated : 29 July 2017, 08:19 AM

সারা বিশ্বে বন উজাড় ও শিকারি কর্তৃক বাঘ হত্যার ফলে বর্তমানে এই প্রাণীটি মহাবিপন্ন (Critically Endangered) প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বাঘ পৃথিবীর মাত্র ১৩টি দেশে এখন অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, বার্মা, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, ভুটান, নেপাল ও রাশিয়া অন্যতম।

বাঘের আটটি উপ-প্রজাতির মধ্যে ইতোমধ্যে বালিনিজ টাইগার, জাভানিজ টাইগার ও কাম্পিয়ান টাইগার বিশ্ব থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে বাঘের (Penthera tigris) পাঁচটি উপ-প্রজাতি (sub-species) কোনোরকমে টিকে আছে। এগুলো হল বেঙ্গল টাইগার, সাইবেরিয়ান টাইগার, সুমাত্রান টাইগার, সাউথ চায়না টাইগার এবং ইন্দো-চায়না টাইগার।

১৯০০ সালে বাঘের সংখ্যা ছিল ১,০০,০০০টি এবং বর্তমানে বাঘের সংখ্যা প্রায় ৩,৯০০টি, এর প্রায় অর্ধেকের বেশি বাঘ রয়েছে ভারতে। বাঘ বিশেষজ্ঞগণের মতে, বাঘের সংখ্যা দ্রুত কমে যাওয়ার এই প্রবণতা চলমান থাকলে আগামী কয়েক দশকে পৃথিবী থেকে এ সুন্দর প্রাণীটি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার ঘোষণা ছিল। কিন্তু সেই লক্ষ্য অর্জনে শুধুমাত্র ভারত, রাশিয়া, নেপাল ও ভুটান আংশিকভাবে সক্ষম হয়েছে। ২০১৫ সালের জরিপে উল্লেখিত ৪টি দেশে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে। নিচে সমীক্ষা প্রদান করা হল:

২০১৫ সালে IUCN (International Union for Conservation of Nature and Natural Resources) এবং WWF (World Wildlife Fund)-এর জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায় কম্বোডিয়ায় কোনো বাঘ নেই। বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা ৪৪০টি থেকে ১০৩টি, চীনে ৪৫টি থেকে ৭টি, লাউসে ১৭ থেকে ২টি, ইন্দোনেশিয়ায় ৫০০ থেকে ৩৭১টি, মালোয়েশিয়ায় ৫০০ থেকে ২৫০টি, থাইল্যান্ডে ২৫২ থেকে ১৮৯টি এবং ভিয়েতনামে ২০টি থেকে ৫টিতে নেমে এসেছে। মিয়ানমার বাঘ জরিপের কোনো হালনাগাদ তথ্য পাওয়া য়ায়নি।

বাঘের সংখ্যা হ্রাসের কারণসমূহ
যদিও পৃথিবীর প্রায় সব দেশে বাঘের চামড়া, হাড় ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হতে তৈরি পণ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আইন প্রণয়ন করেছে, কিন্তু তবু চোরাপথে বাঘের চামড়া পাচার ও কালো বাজারে বিক্রি হচ্ছে। বাঘ ও শিকার প্রাণী (হরিণ, বুনো মহিষ, সাম্বার, শুকর ইত্যাদি) গোপনে নিধন ও পাচার হচ্ছে। বাঘসমৃদ্ধ বনাঞ্চল ধ্বংস করে গড়ে উঠছে ভারী শিল্প, কলকারখানা, রাস্তাঘাট, জনবসতি, হাট-বাজার ইত্যাদি। বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এখনও সনাতনী ওষুধ (Traditional Medicine), স্যাম্পু ও টনিকের জন্য বিশাল বাজার আছে চীনে। এ বাজার চাহিদা না কমাতে পারলে বাঘ সংরক্ষণ আরও সংকটে নিমজ্জিত হবে। বাঘ বিশেষজ্ঞগণ সারা বিশ্বে বাঘের সংখ্যা হ্রাসের জন্য নিম্নলিখিত কারণসমূহ প্রধানত দায়ী বলে মনে করেছেন:

১। বাঘ শিকার ও দেহাবশেষ (চামড়া, হাড় ইত্যাদি) পাচার;
২। বাঘসমৃদ্ধ বনাঞ্চল ধ্বংস করে রাস্তাঘাট নির্মাণ, খনিজদ্রব্য আহরণ, জবরদখল, জনবসতি ও হাট-বাজার স্থাপন;
৩। বাঘের আবাস্থলে ও আশপাশে শিল্পকারখানা স্থাপন করে পরিবেশ দূষণ;
৪। বাঘ শিকার ও নিধনের জন্য ফাঁদ, বিষটোপ ইত্যাদি ব্যবহার;
৫। বাঘের খাদ্য শিকার প্রাণী নিধন ও মাংস বাজারজাতকরণ;
৬। বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি এবং
৭। বাঘসমৃদ্ধ বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে যানবাহন ও নৌচলাচল বৃদ্ধি।

বাঘ সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ
প্রকৃতি হতে বাঘ বিলুপ্তি রোধকল্পে ১৯৯৪ সনের মার্চ মাসে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে Global Tiger Forum (GTF) প্রতিষ্ঠিত হয়। GTF হচ্ছে বাঘ অধ্যুষিত এবং বাঘ সংরক্ষণ বিষয়ে সহায়তাদানকারী দেশসমূহের আন্তর্জাতিক সংস্থা। বাংলাদেশ এর সদস্য।

সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাপী বাঘ ও বাঘসমৃদ্ধ বনাঞ্চলসমূহ সংরক্ষণে সম্মিলিত উদ্যোগের সহায়তাদান করছে বিশ্বব্যাংক, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ইউএসএইড, GTI (Global Tiger Initiative) ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থা। ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত Tiger Summit-এ বাঘসমৃদ্ধ ১৩টি দেশের (Tiger Range Country) রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনে বাঘ সংরক্ষণকে বেগবান করার জন্য ঘোষণাপত্র তৈরি হয়।

বাঘ একটি বনের জীববৈচিত্র্যের অবস্থা নিরূপনের ইন্ডিকেটর (Indicator) প্রজাতি। যে বনের অবস্থা ভালো সেখানে বাঘের সংখ্যা বেশি থাকে। বাঘ কমে যাওয়ার অর্থ বনাঞ্চলের অবস্থা/বাঘের আবাসস্থল বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন। তাই মহা বিপদাপন্ন প্রজাতির বাঘ রক্ষার জন্য বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা স্বোচ্চার হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে বাঘের আবাসস্থল হিসেবে বিবেচিত ১৩টি টাইগার রেঞ্জ দেশ বাঘ সংরক্ষণের জন্য National Tiger Recovery Program (NTRP) ও Global Tiger Recovery Program (GTRP) বাস্তবায়নের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন।

বাঘ সংরক্ষণের গুরুত্ব
বাঘ বনের Flagship species হিসেবে কাজ করছে। বাঘ বনের খাদ্যশৃঙ্খলের শীর্ষে অবস্থান করছে এবং এর উপর নির্ভর করছে ঐ বনের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য। সেজন্য বাঘ সংরক্ষণের অর্থ কেবলমাত্র একক প্রজাতি ব্যবস্থাপনা নয়, এর সঙ্গে অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে তাদের আবাস, খাদ্য নিরাপত্তা ও প্রজনন নিয়ন্ত্রন করা।

২০১০ সালে থাইল্যান্ডের হুয়া হিন এ মন্ত্রীপর্যায়ের নীতিনির্ধারণী সভা 1st Asian Ministerial Conference on Tiger Conservation (1st AMC) অনুষ্ঠিত হয়। এই কনফারেন্সের ঘোষণাকে সংক্ষেপে Hua Hin Declaration on Tiger Conservation নামে অভিহিত করা হয়। এই যৌথ ঘোষণায় প্রতিটি দেশে মহাবিপন্ন বাঘ ও বাঘের আবাস্থল সংরক্ষণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে পরিবর্তিত উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য টেকসই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সিদ্ধান্তস গৃহীত হয়।

Tiger Summit ঘোষণাপত্র
২০১০ সালের ২০-২৪ নভেম্বর রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে Tiger Summit অনুষ্ঠিত হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উক্ত সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৩টি বাঘসমৃদ্ধ দেশের সরকারপ্রধানগণ উপস্থিত ছিলেন এবং উক্ত ঘোষণার মূল বিষয়গুলো হল:

১. আগামী ২০২২ সালে বাঘের সংখ্যা বর্তমান সংখ্যা থেকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করতে হবে;
২. বাঘ ও বাঘের আবাসস্থল হিসেবে চিহ্নিত বনাঞ্চলসমূহকে সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করতে হবে;
৩. বাঘের আবাসস্থলসমূহকে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের মূল আধার হিসেবে চিহ্নিত করে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে;
৪. বাঘসমৃদ্ধ বনাঞ্চলে কোনো শিল্পকারখানা স্থাপন, খনিজ পদার্থ উত্তোলন বা পরিবেশ দূষণের মতো কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যাবে না;
৫. বনাঞ্চলের চলমান টহল ব্যবস্থা উন্নত করে বাঘ ও বাঘের শিকার প্রাণীর নিধন বন্ধ করতে হবে;
৬. বাঘ সংরক্ষণের মাধ্যমে ইকোট্যুরিজম সম্প্রসারিত করে উক্ত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করতে হবে;
৭. বাঘ ও মানুষের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত নিরসনের জন্য গণসচেতনতা সৃষ্টি, প্রশিক্ষণ প্রদান ও সময়োপযোগী বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে;
৮. দুই দেশের সীমান্তসংলগ্ন বাঘসমৃদ্ধ বনাঞ্চলে বাঘের চলাচল যাতে ব্যাহত না হয় তার জন্য ট্রান্সবাউন্ডারি ইস্যু নিয়ে যৌথ প্রটোকল স্বাক্ষর করতে হবে;
৯. বাঘ, বাঘের দেহাবশেষ ও চামড়া পাচার রোধ করার জন্য CITES, INTERPOL, ASIAN-WEN ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থার সহয়তা গ্রহণ করতে হবে;
১০. বাঘ ও বাঘের শিকার প্রাণী নিধনের জন্য চলমান বন্যপ্রাণী আইনসমূহে শাস্তির বিধান বৃদ্ধি করে আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে;
১১. বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় উপজাতীয় জনগোষ্ঠী ও জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করতে হবে;
১২. বনাঞ্চলে বাঘ ও শিকার উপযোগী প্রাণীর অবস্থা ও সংখ্যা নির্ধারণের জন্য নিয়মিতভাবে তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ ও উন্নত বৈজ্ঞানিক কৌশল প্রয়োগ করতে হবে;
১৩. বাঘসমৃদ্ধ বনাঞ্চলে বনজদ্রব্য আহরণ সীমিত ও হ্রাস করতে হবে এবং এর বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে Forest Carbon Financing যেমন REDD+, PES GER ইত্যাদি সহায়তা গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে;
১৪. প্রতিটি দেশকে বাঘ সংরক্ষণে কর্মপরিকল্পনা (Tiger Action Plan) প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে;
১৫. সরকার অনুমোদিত জাতীয় বাঘ সংরক্ষণ কর্মসূচি ((National Tiger Recovery Programme) বাস্তবায়ন করতে হবে এবং
১৬. প্রতি বছর ২৯ জুলাই 'বিশ্ব বাঘ দিবস' উদ্‌যাপন করে বাঘ সংরক্ষণে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

ঢাকা ঘোষণাপত্র (Dhaka Recommendations)
২০১৪ সালের ১৪-১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বাঘসমৃদ্ধ দেশ, আন্তর্জাতিক সংস্থা, বাঘ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে নিবেদিত প্রতিষ্ঠান ও এনজিওসমূহের সন্মিলিত প্রয়াসে Second Stocktaking Conference of Global Tiger Recovery Programme (GTRP) অনুষ্ঠিত হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উক্ত সন্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন এবং বাঘ সংরক্ষণে ঢাকা ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়।

বাঘ সংরক্ষণে দিল্লি ঘোষণা ২০১৬
গত ১৪ এপ্রিল ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বাঘ সংরক্ষণ সন্মেলনে বাঘসমৃদ্ধ ১৩টি দেশের মন্ত্রী, বাঘ বিশেষজ্ঞ ও ঊর্দ্ধতন সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনের উদ্বোধন করেন ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব
বিভিন্ন তথ্যউপাত্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় গত এক দশক আগে প্রতিবছর বাংলাদেশে গড়ে ৩০-৫০ জন মানুষ বাঘের আক্রমনে মারা যায়। এদের অধিকাংশ বাওয়ালী, জেলে, মৌয়ালী ও জ্বালানি কাঠ আহরণকারী। সুন্দরবনের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাংশে বিশেষ করে সাতক্ষীরা রেঞ্জ সংলগ্ন লোকালয়ে মাঝে মাঝে গবাদিপশু বাঘ দ্বারা নিহত হয়ে থাকে। গড়ে বছরে ২-৩টি বাঘ লোকালয়ে মানুষ দ্বারা নিধন হয়। বিশেষজ্ঞদের ধারণা সুন্দরবনের প্রতিবেশ চক্রের পরিবর্তন, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, হরিণ পাচার ও শিকার এবং খাদ্য সংকটসহ বিবিধ কারণে বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।

সাম্প্রতিককালে বন বিভাগ ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সন্মিলিত কর্মতৎপরতা বৃদ্ধির ফলে বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্বে জীবনহানির ঘটনা হ্রাস পেয়েছে। বিশেষ করে ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে লোকালয়ে চলে আসা কোনো বাঘ মারা যায়নি এবং বাঘের আক্রমনে মানুষ মারা যাওয়ার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। তবে চোরা শিকারির উৎপাত বৃদ্ধি পাওয়ায় র‌্যাব ও পুলিশের হাতে বাঘের চামড়া ধরা পড়েছে।

বাঘ বিশেষজ্ঞদের ধারণা সুন্দরবনে বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব কমে যাওয়ার অর্থ বাঘের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাওয়া। ১০ বছর আগেও যে বনে ২০-২৫ জন মানুষ বাঘের আক্রমনে নিহত হত আজ সেখানে মাত্র ১-২ জন মানুষ বাঘের আক্রমনে মারা যাচ্ছে। বনের মধ্যে গোলপাতা, মধু ও মাছের আহরণে আগের মতোই মানুষের আগাগোনা থাকলেও হতাহতের সংখ্যা আগের মতো নয়। এ বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলেছে।

সুন্দরবনের বাঘ জরিপে সমস্যা
সুন্দরবনের অবস্থা বাঘসমৃদ্ধ অন্যান্য বনাঞ্চল হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে বাঘ চলাচলে কোনো নির্দিষ্ট পথ (Track) নেই, ফলে Camera Trapping পদ্ধতি ব্যবহারে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। ২০০৪ সালের আগে Camera Trapping পদ্ধতির প্রচলন ছিল না। তাই ২০০৪ সালে ইউএনডিপির অর্থায়নে ভারতীয় বাঘ বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় বাংলাদেশ সুন্দরবনে প্রথম পদচিহ্ন জরিপ (Pugmark Method) পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

তখন আমাদের হাতে গ্রহণযোগ্য কোনো বিকল্প পদ্ধতি ছিল না বলে উভয় সুন্দরবনে Pugmark Method-এর ফলাফলের উপর নির্ভর করে বাঘের সংখ্যা ঘোষণা করা হয়। এ পদ্ধতি ব্যবহারে ভারতীয় সুন্দরবনে ২৫০টি বাঘ এবং বাংলাদেশ সুন্দরবনে ৪৪০টি বাঘ পাওয়া যায়।

বাঘ জরিপে Camera Trapping ব্যবহার
সুন্দরবনে বাঘ চলাচলে কোনো নির্দিষ্ট পথ না থাকায় Camera Trapping পদ্ধতি ব্যবহারে বিতর্ক রয়েছে। তবে ঢাকা ঘোষণাপত্রের আলোকে সব বাঘসমৃদ্ধ দেশকে Camera Trapping পদ্ধতিতে বাঘ জরিপে পরামর্শ প্রদান করা হয়।

বিশ্ব ব্যাংকের সাহায্যপুষ্ট 'স্ট্রেংদেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ওয়াইল্ডলাইফ প্রটেকশন' প্রকল্পের অর্থায়নে Wildlife Institute of India-এর সহায়তায় বন বিভাগ Camera Trapping ব্যবহার করে সুন্দরবনের বাঘ গণনার কাজ ২০১৩ সালের নভেম্বরে শুরু করে এবং ওই জরিপ ২০১৫ সালের এপ্রিলে শেষ হয়। এই যৌথ জরিপের কাজ একই সময় ভারতীয় সুন্দরবনেও সম্পন্ন হয়।

ক্যামেরাবন্দি ছবি জরিপ পদ্ধতি নিয়ে ভারতীয় সুন্দরবন ও বাংলাদেশ সুন্দরবনের কর্মকর্তাদের আপত্তি ছিল। তাই এ পদ্ধতিটিকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য Wildlife Institute of India (WII)-এর বাঘ বিশেষজ্ঞ ডঃ রাজভেন্দর ঝালার নেতৃত্বে উভয় সুন্দরবনে Piloting করা হয়। বিশ্ব ব্যাংক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের অর্থায়নে বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল এবং বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের (খুলনা) যৌথ প্রয়াসে মাঠ পর্যায়ের জরিপ দলকে প্রশিক্ষিত করে দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়।

নমুনা জরিপের জন্য সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কমপার্টমেন্ট নং ৩, ৪, ৫, ৬ ও ৭-এর মোট ৩০৯.১৮ বর্গ কিমি এলাকায় প্রতিটি গ্রিডের আয়তন ৫ বর্গ কিমি হিসেবে ধরা হয় এবং ৭১টি গ্রিড স্থাপন করা হয় ও বাঘের ছবি মূল্যায়ন করে ১৭টি বাঘ পাওয়া যায়।

অনুরূপভাবে সাতক্ষীরা রেঞ্জের কর্মপার্টমেন্ট নং ৪৬, ৪৭ ও ৫০ (বি)-এর ৩৬৬.৪৪ বর্গ কিমি এলাকায় ৭১টি গ্রিড স্থাপন করা হয় এবং বাঘের ছবি মূল্যায়ন করে ১৩টি বাঘ পাওয়া যায়। একই পদ্ধতিতে খুলনা রেঞ্জের কর্মপার্টমেন্ট নং ৪১, ৪২-এর ৫৮৮.২০৮ বর্গ কিমি এলাকায় ১২৪টি গ্রিড স্থাপন করা হয় এবং বাঘের ছবি মূল্যায়ন করে ৮টি বাঘ পাওয়া যায়।

প্রতিটি গ্রিডে দুটি করে সুবিধাজনক গাছে ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। ক্যামেরাসমূহ প্রতি দুদিন অন্তর চেক করে মেমরি কাডের ছবি রেকর্ড করা হয়। এখানে সার্বক্ষণিকভাবে ৩০ জনের একটি জরিপ দল নিরবচ্ছিন্নভাবে তথ্য সংগ্রহ করেন। প্রাপ্ত তথ্য হতে দেখা যায় সুন্দরবনে মোট ৩৮টি পূর্ণবয়স্ক ও ৪টি বাঘের বাচ্চার ছবি তুলতে পেরেছে বন বিভাগের জরিপ দল। বাকি ৬৮টি বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে খালে তাদের পায়ের ছাপ গুনে ও বিচরণের অন্যান্য তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে। ক্যামেরাবন্দি হওয়া ৩৮টি বাঘের ৩০ শতাংশ পুরুষ এবং বাকিগুলো মহিলা। জরিপের ফলাফল চূড়ান্তভাবে মূল্যায়ন করে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমবেশি ১০৬টি হবে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।

সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণের প্রধান হুমকি
১. বাঘ শিকার ও চামড়া পাচার;
২. বাঘের খাদ্য শিকার প্রাণী (হরিণ) শিকার ও লোকালয়ে মাংস বাজারকরণ;
৩. বনের মধ্যে অনিয়ন্ত্রিতভাবে নৌযান চলাচল;
৪. চোরা শিকারি ও ডাকাতের উপদ্রব;
৫. সুন্দরবনের পাশে ভারী শিল্প, কলকারখানা, বিদ্যুৎ প্রকল্প, সাইলো, মাছের ঘের ও রাস্তাঘাট নির্মাণ;
৬. সুন্দরবনের সর্বত্র যথেচ্ছভাবে মাছ ধরার জন্য মাছের পাস ইস্যু ও হাজার হাজার মানুষের অনুপ্রবেশ এবং
৭. বনাঞ্চলে বন বিভাগের নিয়মিত টহল ও জলযানের অভাব।

বাঘ সংরক্ষণে বন বিভাগের গৃহীত পদক্ষেপ
বন বিভাগ বাঘ সংরক্ষণে বিশেষ অগ্রাধিকার কর্মসূচি ও আন্তর্জাতিক স্বাক্ষরিত প্রটোকল অনুসারে সুন্দরবনের বাঘ রক্ষার জন্য বন বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। চলমান তথ্যউপাত্ত ও বাঘ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনার প্রেক্ষিতে জানা যায় বাংলাদেশ সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার কোনো সুযোগ নেই। তবে আন্তর্জাতিক ঘোষণা অনুসারে সুন্দরবনে বাঘ ও হরিণের সংখ্যা ধারণ ক্ষমতায় (Carrying capacity) রেখে অবৈধ হরিণ শিকার বন্ধ, আবাসস্থলের উন্নয়ন ও নিয়মিত টহল প্রদান করে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য যথোপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

১. বাঘ নিধন ও হরিণ শিকার বন্ধের জন্য অধিকতর শাস্তির বিধান রেখে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ বিগত জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। এ আইনের ৩৬ ধারায় বাঘ শিকারি বা হত্যাকারী জামিন-অযোগ্য হবেন এবং সর্বোচ্চ ৭ বছর সর্বনিম্ন ২ বছর কারাদণ্ড এবং জরিমানা এ লাখ থেকে ১০ দশ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

২. বন বিভাগ ইতোমধ্যে Bangladesh Tiger Action Plan (২০১৮-২০২৭) প্রণয়ন করেছে যা পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

৩. বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে সুন্দরবনসহ সারা দেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য সমাপ্তকৃত 'Strengthening Regional Co-operation for Wildlife Protection' প্রকল্পের ৫০ জন দক্ষ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। বন বিভাগের ওয়াইল্ডলাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিট (WCCU) RAB, Police, BGB, Coast Guard-এর যৌথ উদ্যোগে নিয়মিতভাবে মাঠপর্যায়ে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী পাচার, বিক্রি ও প্রদর্শন রোধপ্রকল্পে কাজ করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত অনেক বন্যপ্রাণী পাচারকারীর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় অসুস্থ বাঘকে সেবাদানের জন্য খুলনায় একটি Wildlife Rescue স্থাপন করা হয়েছে।

৪. সুন্দরবনের চারপাশের গ্রামগুলিতে বন বিভাগ, WildTeam ও স্থানীয় জনসাধারণের সমন্বয়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় একটি Tiger Response Team এবং সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রাম এলাকায় ৪৯টি Village Tiger Response Team (VTRT) গঠন করেছে। এর ফলে লোকালয়ে বাঘ আসামাত্র খবরাখবর আদানপ্রদান ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এই উদ্যোগটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। সাম্প্রতিককালে লোকালয়ে চলে আসা বাঘ মারার প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে।

৫. স্থানীয় জনসাধারণকে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত করার জন্য সুন্দরবনের আশেপাশের উপজেলায় ৪টি CMC (Co-Management Committee) গঠন করা হয়েছে। জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য আয়বর্ধক কর্মকাণ্ড এবং সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

৬. বন্যপ্রাণী দ্বারা নিহত বা আহত মানুষের ক্ষতিপূরণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে এবং এর আলোকে ২০১১ সাল থেকে নিয়মিতভাবে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হচ্ছে।

৭. বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উভয় সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণ, বাঘ ও শিকারি প্রাণী পাচার বন্ধ, দক্ষতা বৃদ্ধি, মনিটরিং ইত্যাদির জন্য একটি Protocol ও একটি MoU স্বাক্ষর করা হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত কর্তৃক স্বাক্ষরিত প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারকের আওতায় বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের বন কর্মকর্তাদের ভারতের ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউটে প্রেরণ করা হয়েছে। লোকালয়ে আসা বাঘ চেতনানাশক ‍ওষুধ প্রদান করে অন্যত্র স্থানান্তরকরণ ও সংরক্ষণের উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এবং

৮. উভয় দেশের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে নিয়মিত বৈঠক ও তথ্যাদি আদানপ্রদান।

বাঘ সংরক্ষণে আমাদের করণীয়
১। বাঘ ও হরিণ শিকারি এবং ডাকাতের উপদ্রব বন্ধের জন্য র‌্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড ও বন বিভাগ সমন্বয়ে সমগ্র সুন্দরবনে নিয়মিতভাবে যৌথ অভিযান পরিচালনা;
২। চিহ্নিত বাঘ ও হরিণ শিকারিদের ধরার জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি;
৩। প্রতিটি এলাকায় বন বিভাগের টহল জোরদার ও Smart Parolling পদ্ধতি ব্যবহার;
৪। সুন্দরবনের আশপাশে সব ধরনের ভারী শিল্প ও কলকারখানা নির্মাণ বন্ধ রাখা;
৫। সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে নৌযান চলাচল হ্রাস করে বিকল্প পথে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা করা এবং
৬। বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসন করা।

উপসংহার
বিশেষজ্ঞের ধারণা বাঘের অস্তিত্ব রক্ষায় বাঘের অন্যতম প্রধান হুমকি চোরা শিকারিদের বাঘ হত্যা ও পাচার, বনের ভেতর দিয়ে লাগামহীনভাবে নৌচলাচল, সুন্দরবনের পাশে বৃহৎ আকার শিল্প অবকাঠামো নির্মাণ, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লোকালয় সংলগ্ন খাল-নদী ভরাট এবং শিকার প্রাণী পাচার ইত্যাদি।

সুন্দরবনে বাঘের শিকার প্রাণীর মধ্যে চিত্রা হরিণ, শুকর ও বানর রয়েছে। বাঘের সংখ্যা বাড়াতে হলে শিকার প্রাণীর (হরিণ) সংখ্যা বাড়াতে হবে। এখনই সবাইকে আমাদের জাতীয় প্রাণী বাঘ সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় এ বিপন্ন প্রাণীটি আমাদের দেশ থেকে অচিরেই হারিয়ে যাবে।

Reference:
Dey, T.K; Kabir, M. J; Ahmed, M. M; Islam, M. M; Chowdhury, M.M R; Hasan, S; Roy, M.J; Qureshi, Q; Naha, D; Kumar, U. and Jhala, Y.V (2015): First Phase Tiger Status Report of Bangladesh Sundarbans. 37pp.

Dey, T.K; (2014) Second Golobal Tiger Stocking Conference and Sundarbans Tiger ‰onservation Landscape. Banbhaban, Agargaon, Dhaka. 44pp.

Dey, T.K. (2015). Guide Book on Wildlife Law Enforcement in Bangladesh. Banbhaban, Agargaon, Dhaka.80pp.

Khan. M.N.H.K (2004). Ecology and Conservation of the Bengal Tiger in the Sundarbans Mangrove Forest of Bangladesh. PhD Thesis, University of Cambridge, UK.

Jhala, Y.V; Qureshi, Q; Roy, M; Nahar, D; Gopal, R. and Dey, T.K. (2014). Field Guide Monitoring Tigers, Prey and their habitats in Sundarbans. Technical Publication of National Tiger Conservation Authority, India, Bangladesh Forest Department and Wildlife Institute of India. TR 2014/D10.

Barlow, A.C (2009) The Sundarbans Tiger adaptation , population status and conflict management. Ph.D. Thesis. University Minisota, US.