কেন কর্মবান্ধব শিক্ষা?

কাজী ছাইদুল হালিম
Published : 24 July 2017, 02:52 PM
Updated : 24 July 2017, 02:52 PM

কথায় আছে, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। তবে দক্ষতাবিহীন, সনদভিত্তিক শিক্ষা ব্যক্তি, পরিবার ও জাতির জন্য বোঝা তৈরি করে। একইভাবে দক্ষতাবিহীন শিক্ষক অদক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করে যা দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। তাই দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টিতে কর্মবান্ধব শিক্ষাপদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই।

একটা জাতির উন্নয়নে এবং দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টিতে কর্মবান্ধব শিক্ষাপদ্ধতির রূপরেখা কেমন হওয়া দরকার তা নিয়ে বিজ্ঞজনদের মধ্যে মতভেদ থাকতে পারে। তবে ব্যবহারিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। গুরুজনেরা বলে গেছেন:

"পুঁথিগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন
নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন।"

তাই শিক্ষাকে বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে একে প্রায়োগিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। আর শিক্ষাকে প্রায়োগিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হলে দক্ষ ও সৃজনশীল শিক্ষকের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দেশে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে:

"যেমন গুরু তেমন শিষ্য।"

তাই এটা অনস্বীকার্য যে দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির পূর্বশর্ত হচ্ছে দক্ষ ও সৃজনশীল শিক্ষক সমাজ সৃষ্টি করা।

শিক্ষাব্যবস্থাকে কর্মবান্ধব ও প্রায়োগিক করার জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া অতি অবশ্যক, তার মধ্যে প্রথমেই হচ্ছে তত্ত্ব ও অনুশীলনের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো। তত্ত্ব ও অনুশীলনের মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর অর্থ হচ্ছে এই যে, একজন শিক্ষার্থী একটা বিষয় সম্পর্কে শুধু জানবেই না, বরং বাস্তব ক্ষেত্রে সেই বিষয়টার প্রয়োগ করতেও শিখবে। আর এই তত্ত্ব ও অনুশীলনের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো শিখতে হবে শিক্ষাজীবনের প্রথম স্তর থেকে বা শিশুশ্রেণি থেকে।

অধিকন্তু, শিক্ষাকে অনুশীলন বা প্রায়োগিক করতে হলে যে কাজটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থাকে শুধু শ্রেণিকক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে একে শ্রেণিকক্ষের বাইরেও বিস্তৃত করতে হবে। যেমন: শিক্ষার্থীরা নিত্যদিনের শিক্ষার একটি অংশ শিখবে শ্রেণিকক্ষে আর বাকিটা শ্রেণিকক্ষের বাইরে।

শিক্ষার্থীদের কৌতূহলী ও উদ্যোগী করতে হলে এবং বাস্তবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হলে শ্রেণিকক্ষের বাইরের শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীরা যতই উপরের শ্রেণিতে উঠবে, শ্রেণিকক্ষের বাইরের শিক্ষাকে ততই গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, বাস্তব জীবনে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষের বাইরের শিক্ষা মানুষকে অনুভূতিপ্রবণ, দায়িত্ববান, দক্ষ ও কর্মবান্ধব করে তোলে।

এই বিশ্বায়নের যুগে শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মক্ষেত্রের পরিধি জাতীয় পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে প্রতিদিন। এমতাবস্থায় প্রায়শই আমরা দেখতে পাই একজন ব্যক্তি এক দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন, অন্য আরেকটা দেশে পড়াশোনা করেছেন, আবার তৃতীয় একটা দেশে চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন।

তাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যাতে জাতীয় পর্যায়ে অর্জিত শিক্ষা ও কর্মদক্ষতা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ব্যবহারের সুযোগ থাকে। আর এ জন্য আমাদের দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আগ্রহী করে তুলতে হবে বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বিনিময় প্রথার প্রচলন করতে, যাতে উভয়ে উভয়ের দক্ষতা ও জ্ঞান দ্বারা লাভবান হতে পারে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বিনিময়ের পাশাপাশি সন্মিলিতভাবে পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা এবং সন্মিলিতভাবে কিছু কিছু বিষয় বা কোর্স পড়ানো যেতে পারে। অধিকন্তু, বিদেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডাবল ডিগ্রি প্রথারও প্রচলন করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে কর্মবান্ধব শিক্ষাপদ্ধতি সৃষ্টির জন্য আরেকটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সহযোগিতা ও অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান। এ রকম সহযোগিতা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলিতে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় 'win-win situation', যা আমাদের দেশে অনুপস্থিত।

ঢাকা শহরের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। কিন্তু বাস্তবে আমরা এই তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান দেখি না। অন্যদিকে আমার বর্তমান আবাসস্থল ফিনল্যান্ডের তামপেরে শহরে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যকার পারস্পরিক সহযোগিতা এবং অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান এতই নিবিড় যে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইচ্ছা করলেই অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে খুব সহজেই তার পছন্দের বিষয় বা কোর্স সম্পন্ন করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে University of Tampere, সংক্ষেপে 'UTA', Tampere University of Technology, সংক্ষেপে 'TUT' এবং Tampere University of Applied Sciences, সংক্ষেপে 'TAMK'।

একুশ শতকের এই বিশ্বায়নের যুগে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য যেটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (Information and Communication Technology বা আইসিটি) ওপর দক্ষতা অর্জন করা। দৈনন্দিন জীবনে অফিস-আদালত থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে আইসিটির ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর এ জন্য শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটা স্তরে যতটা সম্ভব আইসিটির সংযোজন ঘটানো উচিত যাতে শিক্ষাজীবন থেকেই প্রতিটা শিক্ষার্থী আইসিটি ব্যবহারে পারদর্শী হয়ে ওঠে।

শিক্ষাব্যবস্থায় আইসিটির সংযোজন বিভিন্ন উপায়ে হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ইমেইল (Email) আর বাড়ির কাজ (Home work) বা অন্যান্য কাজ (Assignment) জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে অথবা শিক্ষকের বিভিন্ন ক্লাসের নোট, উপস্থাপনাপত্র (Presentation), গবেষণাপত্র (Research paper) সরবরাহ এসব ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করা যেতে পারে যা ইন্টারনেট সুবিধাপ্রাপ্তি সাপেক্ষে যে কোনো সময় যে কোনো জায়গা থেকে নেওয়া বা দেওয়া যাবে।

অধিকন্তু, শ্রেণিকক্ষ শিক্ষার পাশাপাশি কিছু কিছু বিষয় বা কোর্স সম্পূর্ণ বা আংশিক অনলাইনে পড়ানো যেতে পারে। শিক্ষা ক্ষেত্রে আইসিটির ব্যাপক ব্যবহার বাংলাদেশে ই-বিজনেসের (e-business) দ্রুত প্রসার ঘটাতে সহায়ক হতে পারে। ই-বিজনেস হবে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যবসা-রূপগুলোর (Business model) মধ্যে অন্যতম।

প্রত্যেক অভিভাবকই তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করতে পাঠান ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে প্রবেশের যোগ্যতা অর্জন করার জন্য। ভবিষ্যৎ সব সময়ই পরিবর্তনশীল আর তাই ভবিষ্যতের কর্মসম্পাদন করতে যে যোগ্যতা লাগবে তাও পরিবর্তন হতে পারে। সে জন্য আজকের অর্জিত যোগ্যতা ভবিষ্যতের কর্মসম্পাদনের জন্য অনেকটা সেকেলে হয়ে যেতে পারে। তাই বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে তাদের পঠ্যসূচি প্রণয়নের সময় ভবিষ্যতের কর্মদক্ষতা চাহিদার দিকে নজর দিতে হবে।

অধিকন্তু, উচ্চশিক্ষাকে কর্মবান্ধব করার জন্য পাঠ্যসূচির একটা অংশ সম্পন্ন করা যেতে পারে কোনো প্রতিষ্ঠানে, যা গণ্য হতে পারে শিক্ষানবিশ-অভিজ্ঞতা (Internship experience) হিসেবে। বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টার্নশিপের প্রচলন থাকলেও এর ব্যপক ব্যবহার নেই।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর অন্যতম বর্ধনশীল দেশগুলোর মধ্যে একটি। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নকে টেকসই রূপ দিতে হলে কর্মবান্ধব শিক্ষাপদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই। আর এই কর্মবান্ধব শিক্ষাপদ্ধতির প্রচলনে সরকারি ও বেসরকারি উভয়পক্ষ থেকেই সমভাবে উদ্যোগ আসতে হবে। তবু বলব সরকারকেই প্রথম ও প্রধান উদ্যোগ নিতে হবে।