‘পশ্চিমবঙ্গ সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর’

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তসুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
Published : 13 June 2017, 03:59 PM
Updated : 13 June 2017, 03:59 PM

পরিস্থিতি দেখে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গ এখন সন্ত্রাসবাদের আঁতুরঘর হয়ে উঠেছে। এমন দিন যাচ্ছে না, কোনো না কোনো জেলায়, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের সীমান্ত এলাকায় চোরাকারবার থেকে শুরু করে গরু পাচার– স্পর্শকাতর ব্যাপারগুলোয় যারা জড়িত তাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দল তৃণমূলের প্রত্যক্ষ মদদে এসব করছে; খুন, লুট, জমি দখল, জাল নোট– কী নেই অপকর্ম-অন্যায়ের তালিকায়।

এটা শুরু হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার তিন বছর পর খাগড়াগড়ে বোমা বিস্ফোরণ কেন্দ্র করে। ভারতের জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) তদন্ত করতে গিয়ে যেসব তথ্য উদ্ধার করেছে, তাতে এটা স্পষ্ট, সব রকমের মৌলবাদ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আছে। এমন দিন যাচ্ছে না, বীরভূম জেলায়– যার একদিকে সীমান্ত বাংলাদেশ, অপরদিকে ঝাড়খন্ড– বোমা ও অস্ত্র তৈরির কারখানায় হদিস পাওয়া যায়নি।

নারী নির্যাতনে, ধর্ষণে প্রতিদিন সীমান্ত জেলাগুলিতে ঘটে চলেছে। তার অনেক খবরই সংবাদমাধ্যমে বা পুলিশ প্রশাসন পর্যন্ত পৌঁছায় না। আর চলছে পরস্পর দোষারোপ। বিভাজনকারী এবং নাশকতামূলক সংগঠংনগুলি ধীরে ধীরে তাদের ডালপালা ছড়াতে শুরু করেছে। ভারতের সামনে বর্তমানে দুটি ইস্যু– একটি হল গোমাংস বন্ধ করা, অপরটি হল চোরাকারবারকে মদদ দেওয়া।

সরকারি সূত্রে যেসব খবর আসছে তাতে দেখা যাচ্ছে বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। বিজেপি বলছে ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু পাচারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তৃণমূলের স্থানীয় লোকেরাই শুধু নন, মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে বিধায়ক সবাই আছেন। তৃণমূলের বক্তব্য হল, যেসব গবাদি পশু উত্তর ভারত থেকে ট্রেনে-লরিতে করে আসছে, তার মালিক কারা?

বিজেপিশাসিত হিন্দু বলয়ের সব রাজ্যের ব্যবসায়ীরাই এই ব্যবসায় কোটি কোটি টাকা আয় করছে। বিজেপির পাল্টা অভিযোগ, উত্তর ২৪ পরগণা, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুরে তৃণমূল নেতারা উভয় দেশের সীমান্ত রক্ষীদের সঙ্গে আঁতাত করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা চালাচ্ছেন। তৃণমূলের নেতারা এই ব্যবসায় ভাগ পেয়ে থাকেন।

যারা গোমাংস নিষিদ্ধ করার জন্য দিল্লিতে বসে লম্বা-চওড়া নির্দেশ জারি করছেন, তাদেরও এটা অজানা নয় যে, তাদেরই দলের হিন্দি বলয়ের ব্যবসায়ীরা এই অপকর্ম করছে। তাদেরও ব্যবসার একটা অংশ যাচ্ছে নেতাদের হাতে।

এদিকে কলকাতার বিভিন্ন কাগজে খবর প্রকাশিত হচ্ছে যে, বাংলাদেশ থেকে নিয়ে এসে কলকাতা হয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাশ্মীর সীমান্তে। কাজের টোপ দেখিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে গরিব কিশোরদের। অভিযোগ উঠেছে, জেহাদি কার্যকলাপের জন্য তাদের কাশ্মীরে নিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানের হরকত-উল জিহাদ আল ইসলামি জঙ্গি সংগঠন। সেই কাজে সাহায্য করছে বাংলাদেশের জামাত-উল-মুজাহিদিন। বাংলাদেশ থেকে আসা ঐ যুবকদের যাবতীয় প্রশিক্ষণ চলছে চেন্নাই, হায়দারাবাদ ও ব্যাঙ্গালুরুতে। পুরো প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছে আইএসআইয়ের মদদপুষ্ট দুই হুজি নেতা।

সম্প্রতি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের কাছে এমনই বিস্ফোরক তথ্য উঠে এসেছে। একটি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা হুজির ঐ দুই জঙ্গি নেতার গতিবিধি নিয়ে দেশজুড়ে কড়া নজরদারি শুরু করেছে। জঙ্গি নিয়োগের উদ্দেশ্যে কলকাতা দিয়ে তারা নিয়মিত বাংলাদেশে যাতায়াতও করছে বলে খবর রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকার গরিব ঘরের ছেলেরাই এই জঙ্গি নেতাদের প্রধান টার্গেট। গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, এই দুই নেতা বৈধ পাসপোর্ট নিয়েই একাধিকবার কলকাতা হয়ে বাংলাদেশে গিয়েছে। সেখানে গিয়ে তারা জামাত-উল-মুজাহিদিনের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। তাদের পাশে রেখেই গরিব মানুষদের সঙ্গে বেকারত্ব নিয়ে আলোচনা করছে। সরাসরি প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে ভারতে কাজ পাইয়ে দেওয়ার। চাকরির লোভে ভারতে আসতে রাজি হয়ে যাচ্ছে অনেকেই।

তারপর দালাল ধরে উত্তর ২৪ পরগণা, মালদহ, নদীয়াসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে চোরাপথে ভারতে ঢুকছে। হুজির লোকরা ভারতের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে তাদের দিন দুয়েক রাখছে। ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ভুয়া ভোটার কার্ড তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। তারপর শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশন হয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন শহরে।

পশ্চিমবঙ্গে আইএসকে হাতে ধরে নিয়ে এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূলেরই এক রাজ্যসভার সাংসদের হাত ধরে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস তাদের জাল বিস্তার করা শুরু করেছিল বর্ধমান জেলার খাগড়াগড় থেকে। মমতা বন্দোপাধ্যায় সরকার ক্ষমতায় আসার তিন বছরের মাথায় খাগড়াগড়ে একটি মাদ্রাসা সংলগ্ন বাড়িতে তৈরি করা হয়েছিল জেহাদিদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। সেখানেই তৈরি ও মজুত করা হচ্ছিল বোমা ও অন্যান্য অস্ত্র। হঠাৎ এককদিন বিস্ফোরণ ঘটার পর জানাজানি হয়, কতদিন ধরে এই ধরনের নাশকতামূলক কাজের ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করা হচ্ছিল।

তদন্তে নামে ভারতের জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। সেই তদন্তে উঠে আসে ভারতে আইএসয়ের কার্যকলাপের কথা। গ্রেপ্তারও করা হয় ভারতে আইএসয়ের মূল এজেন্টকে। এনআইএ সে সময় ঢাকায় গিয়েও তাদের তদন্ত চালিয়েছিল। ভারত সরকারের গোয়েন্দা সূত্রে অভিযোগ করা হয় যে, বাংলাদেশ থেকে বেআইনিভাবে যেসব মৌলবাদী সংগঠনের নেতা ও কর্মীরা পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ করছে, তারা ভারতের সব রকম পরিচয়পত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পেয়ে যাচ্ছে।

অভিযোগ: মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও উত্তর ২৪ পরগণায় বেশকিছু লোক মোটা টাকার বিনিময়ে জাল নথি তৈরির কাজ করছে। আগামী বছরের গোড়ায় পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন। এক বছর বাদে লোকসভা নির্বাচন। এই দুটি নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে দ্রুত এই অনুপ্রবেশকারীদের পরিচয়পত্র তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে– এ ব্যাপারে বাম ও কংগ্রেস নেতাদের অভিযোগ, মুসলমানদের টেনে নিচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। আর বাংলাদেশের একশ্রেণির হিন্দুদের টেনে নিচ্ছে বিজেপি।

বর্তমানে সংকটজনক এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গ কোন পথে যাবে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ভবিষ্যতে এর ফলটাই বা কী দাঁড়াবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহল এখন তোলপাড়।