মোদীর তিন বছরে কী পেল ভারতবাসী?

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তসুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
Published : 30 May 2017, 04:41 AM
Updated : 30 May 2017, 04:41 AM

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শাসনকাল তিন বছর কেটে গেল। আর দেড় বছরের মাথায় পরবর্তী নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয়ে যাবে। এই তিন বছরে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের ১৩০ কোটি মানুষ কী পেল আর কী পেল না, সে নিয়েই আমার বিশ্লেষণ।

পূর্ববর্তী ইউপিএ সরকারের ১০ বছরের শাসনকালে তারা ছয়টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল– (১) বিজলি, (২) সড়ক, (৩) পানি, (৪) রুটি, (৫) কাপড় এবং (৬) মকাম।

জোট সরকার থাকা সত্ত্বেও ইউপিএ-১ এবং ইউপিএ-২ এই ৬ দফা রূপায়নের জন্য ২১ দফা কর্মসূচি নিয়েছিল। তা কার্যত সফল হয়েছে। যদিও মনমোহন সিং সরকার পদে পদে জোট শরিকদের কাছে বাধা পেয়েছে। আর মোদি পেয়েছে একদলীয় শাসন।

এখন ১৩০ কোটি লোক কী খাবে কী পরবে, তা-ও ঠিক করে দেবে সরকার। অর্থাৎ ব্যক্তিস্বাধীনতায় পুরোপুরি হস্তক্ষেপ। এই তিন বছরের মাথায় এসে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি একেকটি ফরমান জারি করছে। যদিও সেগুলি আইনের চোখে টিকছে না। তবু তারা চালিয়েই যাচ্ছে। যেমন ধরা যাক গোমাংস ভক্ষণ।

ভারতের বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশে এক যোগী সন্ন্যাসীকে মুখ্যমন্ত্রী করেছে আরএসএস। এই সন্ন্যাসী মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসেই ফরমান জারি করেছেন:

"উত্তরপ্রদেশে কেউ গোমাংস খেতে বা বিক্রি করতে পারবেন না। তাহলেই তাঁকে জেলে যেতে হবে।"

শুধু উত্তরপ্রদেশ নয়, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থান, ছত্তিশগড়েও একই ফরমান জারি করা হয়েছে। ফলে এই রাজ্যগুলিতে গোমাংস উৎপাদন ও রপ্তানিতে যে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হত, তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

এই শিল্পে জড়িত ছিলেন লাখ লাখ শ্রমিক। তারাও কর্মহীন হয়ে গিয়েছেন। একদলীয় শাসনব্যবস্থা হলেই ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে যা ইচ্ছা করা যায় না। কিন্তু মোদী ও তাঁর দল তা-ই করে দেখাচ্ছে।

সম্প্রতি মোদীর এই গেয়ার্তুমির বিরুদ্ধে এলাহাবাদ হাইকোর্টে একটি মামলা হয়। এলাহাবাদ হাইকোর্ট উত্তরপ্রদেশ সরকারকে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে:

"রাজ্যে গোমাংস বিক্রির আইনসিদ্ধ ব্যবস্থা করতে হবে। এবং গোমাংস যারা খেতে চান তারা যাতে তা পেতে পারেন, তার ব্যবস্থা করতে হবে। রাজ্যের সর্বত্র গোমাংস বিক্রি বন্ধ করা চলবে না।"

একটি অন্তবর্তীকালীন রায়ে একথা জানিয়েছে এলাহাবাদ হাইকোর্ট। এর অর্থ হল, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশে গোমাংস নিষিদ্ধ করার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা তাঁকে প্রত্যাহার করে নিতে হবে। সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে রাজ্যে সরকারিভাবে গোমাংস বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি অনুমিতপ্রাপ্ত কসাইখানাগুলিকেও সুষ্ঠুভাবে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিতে হবে।

আদালত জানিয়েছে, প্রাণীর মাংস ভক্ষণ করা বর্তমান দৈনদিন জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইসঙ্গে তা প্রয়োজনীয়ও বটে। রজ্যের মানুষের তাদের পছন্দমতো মাংস খাওয়ার অধিকারও রয়েছে। মানুষ কী খাবে, কীভাবে খাবে তা ঠিক করার সাংবিধানিক অধিকার তার রয়েছে।

এলাহাবাদ হাইকোর্টও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বহু মানুষের জীবন-জীবিকা স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। তবে যোগী আদিত্যনাথ সরকার বৈধ এবং অবৈধ কসাইখানার ধুঁয়ো তুলে এখনও সেরাজ্যে গোমাংস সরবরাহ স্বাভাবিক হতে দেয়নি।

মোদীর তিন বছর পুরোটাই ব্যর্থতায় ভরা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতকে এক চরম সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে মোদী সরকার। একে তো তিনি পুরনো ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে জনজীবন অতিষ্ঠ করে দিয়েছেন। সে অস্থিরতায় ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশবাসী। কয়েক লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন।

সাাধারণভাবে কোনো অঞ্চলের অর্থনৈতিক বিন্যাস বলতে যে জিনিসটা গড়ে ওঠে সেটা দেশের অনেক প্রান্তেই ভেঙে গিয়েছে। এই ক্ষোভ চাপা দিতে প্রচলিত হিসাবে বদরদল ঘটিয়ে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন ৭ শতাংশ দেখিয়েছেন মোদি সরকারের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। সেই হিসাব নিয়েও প্রচুর সংশয় রয়েছে দেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে। তবে সাধারণ মানুষ এই ৭ শতাংশের কোনো সুফলই বুঝতে পারছেন না। একদিকে কাজের বাজারে ক্রমশ নেমে এসেছে অস্থিরতা এবং পাশাপাশি হু হু করে বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম।

গত তিন বছরে কৃষিক্ষেত্রেও চরম অব্যবস্থার পরিচয় দিয়েছে মোদী সরকার। নির্বাচনের আগে মোদির প্রতিশ্রুতি ছিল কৃষকরা যাতে বিনিয়োগের ৫০ শতাংশের বেশি আয় করতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। উল্টো এই সরকারই সংসদ ভবনে দাঁড়িয়ে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, বছরে গড়ে ১২ হাজার করে কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন গত তিন বছরে।

বিশিষ্ট কৃষি অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, কৃষকদের ৫০ শতাংশ বেশি ফসলের দাম পাইয়ে দেওয়া সম্ভব হত, তাহলে মনমোহন সিং সরকারই তা করতে পারত। সদিচ্ছা থাকলেও মাঝে বিরাট ফড়েদের দাপটে সারা দেশেই কৃষক তার ন্যায্য ফসলের মূল্য পান না। মোদি সরকারের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। উল্টো তাঁর আমলে কৃষিপণ্য বাজারে দালাল এবং ফড়েদের ব্যবসার আরও রমরমা হয়েছে। বিশিষ্ট কৃষি বিশেষজ্ঞ তথা পূর্বতন ভারতের যোজনা কমিশনের সদস্য আশোক গুলাটি মন্তব্য করেছেন, এখন মোদি সরকার গ্রাম-ভারতের কৃষিজীবীদের নতুন ধাপ্পা দিতে শুরু করেছেন। তিনি বলেছেন, আগামী পাঁচ বছরে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করে দেওয়া হবে। গত বাজেটে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি সেচ প্রকল্পগুলিতে কিছু বরাদ্দ বাড়িয়েছেন। আর তারপরে কৃষকদের ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছে তারা যেন কৃষি বীমার সুযোগ নেন। কিন্তু সরকারের নতুন এই প্রকল্পে এখনও তেমন ফল দেখতে পাওয়া যায়নি। প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনায় সারা দেশেই আগ্রহ দেখাননি কৃষকরা। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চলতি বছরে যদি স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়, সেক্ষেত্রে কৃষকরা একটু লাভের মুখ দেখলেও দেখতে পারেন।

নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও মোদি সরকারের মেয়াদে বলার মতো কিছু নেই। বরং দেশের ভেতরে অশান্তির মাত্রা আরও বেড়েছে। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হিসাবই বলছে, ২০১৩ সালে যেখানে পাকিস্তান-সীমান্তে সন্ত্রাসবাদী হামলার ১৭০টি ঘটনা ঘটেছে, সেখানে ২০১৬ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত ঘটেছে ৩০৫টি। এই সন্ত্রাসের ঘটনায় ৭১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ২০৮ জন।

সাম্প্রতিক কালে এত হতাহতের ঘটনা আর ঘটেনি। পাঠানকোট, পাম্পোরে, উরি সেক্টর এবং নাগরোটায় পরপর সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনা ঘটেছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যেই রণহুঙ্কার ছাড়লেও একটা হামলাও সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারেনি নরেন্দ্র মোদীর সরকার। বরং একটা 'সার্জিকাল স্ট্রাইক' ঘটিয়ে বিশ্ববাসীর বিরক্তি উদ্রেক করেছে। দেশের ভেতরেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি বিজেপি সরকার।

মাঝে মাঝে খানিক বিরতি দিলেও ছত্তিশগড়, সুকনার মতো ঘন অরণ্য সঙ্কুল জায়গায় প্রায় সারা বছরই মাওবাদীদের তৎপরতা তুঙ্গে ছিল। ছত্তিশগড়ে একটা হামলাতেই ২৫ জন সিআরপিএফ জত্তয়ানকে প্রাণ দিতে হয়েছে।

ভারত নামক বিশ্বের অন্যতম গণতন্ত্রে যে সুদিনের স্বপ্ন দেখিয়ে মোদী এসেছিলেন, তা ক্রমেই দুর্দিনে পরিণত হয়েছে। মানুষ হা-পিত্যেশ করছে। তাদের বলা হয়েছিল: সুদিন আসছে।

কিন্তু পরের দিনটা দেখা যাবে কি না, সেই সংশয়ে পড়েছেন। আগামী ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে নরেন্দ্র মোদী অসমের রাজধানী গুয়াহাটিতে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলন ডেকেছেন। সেখানে তিনি নির্দেশ দেবেন, কী করে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারে তারা। কিন্তু পারবেন কি?

ইতোমধ্যে আরএসএসের স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের নেতারা গুয়াহাটিতে এক বৈঠক করেন। এই সংগঠন বিজেপির একটি তাত্ত্বিক সংগঠন। সেখানে সংঘের নেতারা কার্যত নরেন্দ্র মোাদীর প্রচারের ফানুস ফটিয়ে দিয়েছেন। তারা স্পষ্টভাষায় বলেছেন, দেশে চাকরি নেই, রোজগার নেই। ভারতের আর্থিক পরিস্থিতি খুব ভালো নয়। ওই নেতারা বলেন, হিসাবে কারচুপি করে মোট জাতীয় উৎপাদনের হার ৭.১ শতাংশ বলে দেখানো হলেও বাস্তবে দেশের উপার্জন বেড়েছে ১ শতাংশ।

উল্লেখ্য, অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ও সরকারের নানা ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে প্রকাশ্যেই সমালোচনা করত স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনোয়োগের দরজা খুলে দেওয়াসহ আরও কয়েকটি বিষয় নিয়ে মোদী সরকারের ওপর খুশি নয় তারা। মোদি সরকারের তিন বছর পূর্তি উৎসবের আগেই তাই মোদি সরকার সম্পর্কে নিজেদের মূল্যায়ন সামনে এনেছে স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ।

ক্ষমতায় আসার আগে বিজেপির তিনটি প্রধান কর্মসূচি ছিল– (১) রামমন্দির, (২) অভিন্ন দেওয়ানি বিধি এবং (৩) কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করা।

এরমধ্যে কাশ্মীর নিয়ে মোদী একটু অসুবিধার মধ্যে আছেন। কারণ, সেখানে ক্ষমতায় আছে বিজেপিরই শরিক দল পিডিপি।

ওই পিডিপিকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে বিজেপিই। বাকি দুটি বিষয় নিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে বিজেপি। কাশ্মীরে 'সার্জিকাল স্ট্রাইক'-এর পরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। জম্মু-কাশ্মীরের যুবসমাজের ক্ষোভ কমার বদলে ক্রমশই বাড়ছে। এরই মধ্যে আরও কয়েকটি পাকিস্তান সেনাঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালিয়েছে বলে দাবি করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। এখন দেশের সব প্রান্তেই প্রশ্ন উঠেছে, নরেন্দ্র মোদী কি আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগেই পাকিস্তানের সঙ্গে ছোটখাটো একটা যুদ্ধে নামছেন? যাতে ভোটের বাক্সে তার প্রতিফলন ঘটাতে পারেন?