একটি প্রতিবেদন, ‘৯৬৯’ তত্ত্ব এবং কিছু কথা

Published : 3 May 2017, 05:02 AM
Updated : 3 May 2017, 05:02 AM

'জনকণ্ঠ' পত্রিকায় গত ২৪ এপ্রিল প্রকাশিত 'পার্বত্য এলাকায় নতুন অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টায় ভাবনাকেন্দ্র' শিরোনামের একটি প্রতিবেদনকে ঘিরে বৌদ্ধদের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। এই প্রতিবেদনের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধরা সমাবেশ ও মানববন্ধন অব্যাহত রেখেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে চলছে তোলপাড়, যদিও বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে তেমন কোনো গুরুত্ব পাচ্ছে না।

প্রতিবেদনটি আমি বেশ কয়েকবার মনযোগ দিয়ে পড়েছি। প্রতিবেদনটি পড়লে সহজেই বোঝা যায় প্রতিবেদক তার ক্ষোভ ঢেলেছেন এই প্রতিবেদনে; বৌদ্ধ ভিক্ষু, বৌদ্ধধর্ম ও এর প্রবর্তক মহামতি গৌতম বুদ্ধের উপর তার এত ক্ষোভ!

আমার এ লেখাটি সেই প্রতিবেদনের আলোকে। তবে দুঃখজনক হল যাদের উপর সাধারণ মানুষ সত্য উদঘাটন এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার মতো গুরুদায়িত্ব অর্পিত বলে বিশ্বাস করে, সত্যসন্ধানী ও জনগণের শেষ ভরসাস্থল মহান পেশার বাহক-ধারক সেই সাংবাদিক সমাজের এক ভাইয়ের বিরুদ্ধে আমাদের লিখতে হবে, প্রতিবাদ জানাতে হবে, মানববন্ধন করতে হবে, সংবাদ সম্মেলন করতে হবে এবং তার শাস্তি দাবি করতে হবে– এটা কখনও ভাবিনি। এটা আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত।

২০১২ সালে রামু সহিংসতা-পরবর্তী দেশের সংবাদমাধ্যম ব্যাপক তৎপরতা দেখিয়েছে; ক্ষতিগ্রস্তদেরসহ সব বৌদ্ধের যে অতুলনীয় উপকার করেছে তা বর্ণনাতীত। ওই সময় আমি মুখপাত্র হিসেবে মিডিয়ার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম বলেই বিষয়টা আমি খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করেছি। এ উপকারের কথা কখনও ভোলার নয়। দেশি-বিদেশি সাংবাদিক মহলের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

পার্বত্য চট্রগ্রামের বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিসহ সারা দেশের বৌদ্ধ বিহার এবং ভাবনাকেন্দ্রসমূহ নিয়ে 'জনকণ্ঠ' পত্রিকায় যে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে তার যদি বিন্দুমাত্রও সত্যতা থেকে থাকে তাহলে তথ্যউপাত্তের ভিত্তিতে তা প্রচার করা যেতে পারে। এটা একজন সাংবাদিকের অধিকার এবং পেশাগত দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কার্যকলাপে লিপ্ত হলে তথ্যউপাত্ত ও প্রমাণের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ও সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, করতে হবে।

কিন্তু কোনোভাবেই মহামতি বুদ্ধকে 'সন্ত্রাসী' বলতে পারেন না একজন সাংবাদিক। কেননা কোনো ধর্মের অনুসারী যদি বিপদগামী হয় এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত হয় সে জন্য তার ধর্মের প্রবর্তককে দায়ী করা যায় না এবং ঢালাওভাবে সব প্রতিষ্ঠানসহ সমগোত্রীয় ব্যক্তিদের দোষারোপ করা যায় না।

কারণ কোনো ধর্ম এবং ধর্ম প্রবর্তকই মানুষকে সন্ত্রাসী হওয়ার শিক্ষা দেননি। জন্মের অনেক পরে মানুষের সঙ্গে ধর্মের পরিচয় ঘটে। কিন্তু মানুষ লোভ, হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতার মতো অনেক বিকার নিয়ে জন্মে। মানুষ যাতে এই বিকারসমূহের বশিভূত হয়ে বিপদগামী না হয় এবং এই বিকারগুলো থেকে মুক্ত হওয়ার শিক্ষা দিয়ে থাকে ধর্ম। কিন্তু বিভিন্ন কারণে কোনো অনুসারী যদি তার ধর্মের নীতি-নৈতিকতার উল্টোপথে চলে এবং বিপদগামী হয় কিংবা ধর্মের অপব্যাখ্যা করে এর দায় ধর্মের নয়, ধর্ম প্রবর্তকেরও নয়। আর না হলে বিশ্বময় আজ সন্ত্রাস ও জঙ্গিপনার যে উন্মাদনা চলছে (অনেক ক্ষেত্রে ধর্মের নামে) সেই বিচারে সব ধর্ম ও ধর্ম প্রবর্তকগণ দায়ী হবেন।

প্রতিবেদক ফিরোজ মান্না তার প্রতিবেদনে বুদ্ধ, বৌদ্ধ ধর্ম ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নিয়ে মানহানিকর ও অবমাননাকর বিভিন্ন কথা লিখেছেন। কিসের ভিত্তিতে তিনি এমন সব ভয়ংকর অভিযোগ তুললেন– এটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। তিনি 'ইউকিপিডিয়া'র বরাত দিয়ে বুদ্ধকে 'সন্ত্রাসী' আখ্যা দিয়ে দিলেন। 'ইউকিপিডিয়া'য় তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছি কোথাও তো বুদ্ধকে সন্ত্রাসী বলা হয়নি! বরং বুদ্ধের আত্মজীবনী, ধর্মপ্রচার, বৌদ্ধধর্ম, পৃথিবীর নানা দেশে বৌদ্ধধর্মের অবস্থা নিয়ে এমন চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা এককথায় অসাধারণ।

সম্প্রতি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারাধীন কোনো ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করার আগপর্যন্ত 'রাজাকার' বলা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। তাহলে বিশ্ব মানবতার প্রতীক বুদ্ধ কোন অপরাধে সন্ত্রাসী হলেন? আজকে এই কথা যদি তিনি বা অন্য কেউ মাননীয় মহানবীকে (সা.) কটাক্ষ করে লিখতেন তাহলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অপরাধে দেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হত, তাতে রাষ্ট্র ও সরকার এখনও কি মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারত? জনাব ফিরোজ মান্না কি এখনও বহাল তবিয়তে থাকতে পারতেন? পত্রিকার কর্তৃপক্ষ কি এখনও পার পেয়ে যেতেন?

রাষ্ট্র, সংবিধান ও সরকার যতই "সংখ্যালঘু বলতে কিছুই নেই" বলুক না কেন সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু তত্ত্ব রাষ্ট্র্র ও সরকার বরাবরই সমীহ করে চলে– এটা এখন লুকোচুরির কোনো বিষয় নয়। তবে এটা আমি সংখ্যাগুরুতে সম্মান রেখেই বলছি।

পৃথিবীর দেশে দেশে একই চরিত্র। কোনো বিষয়ে যতক্ষণ না জনগণের চাপ তৈরি হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টা যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন রাষ্ট্র ও সরকার এড়িয়ে যাবে– এটা যদি স্বাভাবিক বিষয় হয় তাহলে সংখ্যালঘুরা গুরুত্ব পাওয়ার কথা নয়। তাদের যেন কোনো ধর্মানুভূতি থাকতে নেই। এটা কোনো রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্র হতে পারে না।

প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে:

"সবুজে ঘেরা পার্বত্য এলাকায় নতুন দাবানলের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এখানে মিয়ানমারের উগ্রপন্থী একটি গ্রুপ তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। সরকারের খাস জমি দখল করে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তুলছে 'ভাবনা কেন্দ্র' বা কিয়াং। ভাবনা কেন্দ্রে বসেই মিয়ানমারের উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ৯৬৯ উপজাতিদের নানা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।"

যে তথ্য গোয়েন্দা সংস্থার কাছে রয়েছে তা তারা সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছেন কি? জানালে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হল না কেন? সরকার তো এই বিষয়ে 'জিরো টলারেন্স' নীতি গ্রহণ করেছে।

মূলত পর্যটকদের বিরুদ্ধে ভিক্ষুদের সঙ্গে অসদাচরণ, মন্দিরের পবিত্রতা নষ্ট, বুদ্ধমূর্তির অবমাননাকর ছবি তোলাসহ নানা অভিযোগ ওঠার পর গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের স্বর্ণমন্দিরে পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কর্তৃপক্ষ। পরে ১৬ নভেম্বর পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর এমপিসহ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আশ্বাসে দর্শনীয় এ মন্দিরটি খুলে দেওয়া হয়।

দেশের সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে এমন খবর-ই তো আমরা জেনেছিলাম। সেখানে যদি বেআইনি কোনো কার্যকলাপ চালানোর ইচ্ছা থাকে তাহলে মন্দির কর্তৃপক্ষ প্রশাসনের সার্বক্ষণিক নজরদারি দাবি করলেন কেন? বান্দরবান জেলার ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীসহ ১৪টি সম্প্রদায়ের লোকজনের কাছেও এ 'বুদ্ধ ধাতুজাদি' তথা স্বর্ণ মন্দির একটি পবিত্র স্থান। দেশ বিদেশের অসংখ্য পর্যটকের পদভারে প্রতিনিয়ত মূখরিত থাকে যে মন্দির তার বিরুদ্ধে আনীত এমন অভিযোগ প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে এবং আমরা এতে বিচলিত না হয়ে পারছি না।

রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারের অধ্যক্ষ প্রয়াত শ্রদ্ধেয় ভদন্ত সাধনানন্দ মহাথের প্রকাশ বনভান্তের শবদেহ এখনও বিহারে সংরক্ষিত আছে। যার কারণে রাঙ্গামাটি পুণ্যতীর্থধামে রূপ নিয়েছে, বহির্বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। যিনি আজীবন শান্তি আর মানবতার কথা বলে গেছেন, বিশ্বে স্বনামধন্য এমন এক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন মিথ্যাচার কেন?

পাহাড়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ হয় এটা তো মিথ্যে নয়, এর দায়ভার বৌদ্ধ বিহার এবং ভাবনাকেন্দ্রগুলোর উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে কেন? পাহাড়ে আজ শান্তি যেটুকু প্রতিষ্ঠা হয়েছে তার পেছনে প্রয়াত বনভান্তেরও অবদান রয়েছে। একথা অস্বীকার করার কোন জো নেই। উনাকে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সবাই শ্রদ্ধা করতেন। তিনি সারা জীবন ভাবনা বা সাধনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং নিজের শিষ্য ও অনুসারীদেরও একই শিক্ষা দিয়ে গেছেন। মৃত্যুর আগে যেদিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সেদিন সেনাবাহিনী নিজস্ব হেলিকপ্টার করে তাঁকে ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিল। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে বহু মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছে একবার তাঁর আশীর্বাদ নেওয়ার জন্য। তাঁর প্রয়াণের পরও আজও সেই জনস্রোত এতটুকু কমেনি। প্রয়াত বনভান্তে ও রাজবন বিহার সম্পর্কে জানেন এমন অনেক অবৌদ্ধ মানুষকেও এই প্রতিবেদন আহত করেছে নিঃসন্দেহে।

'জনকণ্ঠে'র মতো একটি পত্রিকা কোনো ধর্মের প্রতি এমন অবমাননাকর প্রতিবেদন কোনো ধরনের সম্পাদনা ছাড়া-ই প্রকাশ করল! নাকি কর্তৃপক্ষ জনাব ফিরোজ মান্নানের এই প্রতিবেদনের দায়িত্ব নিয়ে এমন গর্হিত প্রতিবেদনটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছাপল? একটি জাতীয় দৈনিকের কাছে আমরা এটা প্রত্যাশা করিনি।

আড়াই হাজার বছরের বেশি সময় আগে জীব ও জগতের কল্যাণে জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন মহামতি গৌতম বুদ্ধ। ভারতবর্ষে জন্ম নেওয়া এই মহাপুরুষের সর্বজনীন বাণী বিশ্বময় ছড়িয়েছে। বাংলাদেশের মাটি খনন করলে আজও হাজার হাজার বছরের পুরানো বৌদ্ধ পুরাকীর্তি পাওয়া যায়। চর্যাপদকে বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন বলা হয়। সেই চর্যাপদের প্রাণপুরুষ স্বয়ং তথাগত গৌতম বুদ্ধ। বাংলার আদি সভ্যতা, কৃষ্টি এবং সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সঙ্গে গৌতম বুদ্ধের যে নাড়ির সম্পর্ক আছে তা ইতিহাস সচেতন ব্যক্তি মাত্রই অবগত আছেন। যিনি আজীবন শান্তি আর সম্প্রীতির কথা বলে গেছেন আজ তাঁকে 'সন্ত্রাসী' আখ্যা দেওয়া কোনো সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন মানুষের কাজ হতে পারে না।

প্রতিবেদনের আরেক অংশে লেখা হয়েছে:

"৯৬৯ এর সদস্যরা শুধু মিয়ানমার নয়, বাংলাদেশসহ সকল বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চলে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে যার মূল টার্গেট হলো মুসলমান। প্রতি মাসে থানচি ও মিজোরামের অরক্ষিত বর্ডার দিয়ে ১৫-২০ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মিয়ানমারে প্রশিক্ষণ নিতে যায়। পার্বত্য চট্রগ্রামের উপজাতি বৌদ্ধ সন্ত্রাসী যুবকরা বর্ডার ক্রস করে মিয়ানমারে যায় এবং ৯৬৯ এর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেয়। পার্বত্য চট্রগ্রামের ভান্তেরা সন্ত্রাসী আসিন ওয়ারাথু এর সঙ্গে সাক্ষাত করেছে। চরমপন্থী বাংলাদেশী সন্ন্যাসী প্রায় এক বছর আগে মিয়ানমারে আশ্রয় নেন এবং ৯৬৯ সদস্যদের কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তা প্রশিক্ষণ নেয়।"

যতদূর জানা গেছে, আসিন ওয়ারাথু একজন বার্মিজ বৌদ্ধ ভিক্ষু। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তিনি সরাসরি কথা বলেন এবং আন্দোলনও গড়ে তোলেন। তার মতে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, তারা বাংলাদেশি। তাদের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা এই আন্দোলনের নাম দেওয়া হয় '৯৬৯'। একপর্যায়ে বিশ্বগণমাধ্যমে তিনি রোহিঙ্গাবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিতি পান। তার এই আন্দোলনে তার মতাদর্শের আরও কিছু ভিক্ষু এবং গৃহি আছেন যারা আসিন ওয়ারাথুর সুরে কথা বলেন, এবং তার আন্দোলন সরাসরি সমর্থন করেন।

'টাইম' ম্যাগাজিনে তাকে নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদনও ছাপা হয়। ওই প্রতিবেদনে তার সম্পর্কে কঠোর সমালোচনা করা হয়। সমালোচনা ও নিন্দা তার প্রাপ্য বলে মনে করি। কারণ একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে তিনি এই কাজ করতে পারেন না। তা-ও আবার তিনি যে অর্থে এই আন্দেলনের নাম '৯৬৯' রেখেছেন সেটাও বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে যায় না।

'৯৬৯' এই তিন সংখ্যার নামের মধ্যে এক গভীর মর্মার্থ রয়েছে। বৌদ্ধধর্মে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ এই তিন রত্নের নাম হল ত্রিরত্ন। অর্থ্যাৎ বুদ্ধরত্ন, ধর্মরত্ন এবং সংঘরত্ন। বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ বলতে এখানে গুণাবলির গুণকীর্তন করা হয়েছে। ত্রিপিটকে অনন্ত গুণাধার বুদ্ধের প্রধান নয়টি গুণ, ধর্মের ছয়গুণ এবং সংঘের নয়গুণের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।

বুদ্ধের নয়গুণ: অরহং, সম্মাসম্বুদ্ধো, বিজ্জাচরণ সম্পন্নো, সুগতো, লোকবিদু, অনুত্তরো, পুরিসদম্ম সারথি, সত্থা দেবমনুস্সানং, বুদ্ধো ভগবা। অর্থাৎ বুদ্ধ হলেন অরহত, সম্যকসম্বুদ্ধ, বিদ্যা ও সুআচরণ সম্পন্ন, সুপথে গমনকারী, সমস্ত জড়-অজড় জগৎ জ্ঞাতা, দেব-ব্রক্ষ-নর-যক্ষ প্রভৃতি অদম্য পুরুষ দমনকারী সারথি, দেব-মনুষ্যদের শিক্ষক, বুদ্ধ ভগবান।

ধর্মের ছয়গুণ: স্বাক্খাতো, সন্ধিট্ঠিকো, অকালিকো, এহিপস্সিকো, ওপনায়িকো, পচ্চত্তং বেদিতব্বো বিঞঞহীতি। অর্থাৎ ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত ধর্ম উত্তমরূপে ব্যাখাত, স্বয়ং দর্শনীয়, ফল প্রদানে কালাকাল বিরহিত, এসে দেখে বিচার-বিশ্লেষণপূর্বক গ্রহণযোগ্য, নির্বাণ প্রাপক এবং বিজ্ঞ কর্তৃক প্রত্যক্ষ জ্ঞাতব্য।

সংঘের নয়গুণ: সুপটিপন্নো, উজুপটিপন্নো, ঞায়পটিপন্নো, সমীচিপটিপন্নো, য়দিদং চত্তারি পুরিসয়ুগানি অট্ঠ পুরিস পুগ্গলা, আহুণেয়্যো, পাহুণেয়্যো, দক্খিণেয়্যো অঞ্জলি করনীয়্যো, অনুত্তরং পুঞঞক্খেত্তং। অর্থাৎ বুদ্ধের ভিক্ষুসংঘ সুপথে প্রতিপন্ন, আর্য্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ প্রতিপন্ন, ন্যায় বা নির্বাণ পথ প্রতিপন্ন, যথার্থ, উত্তম ও উপযুক্ত পথ প্রতিপন্ন, আহবানের যোগ্য, সেবা পাওয়ার যোগ্য, অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে বন্দনা করার যোগ্য, শ্রেষ্ট পুণ্যক্ষেত্র।

তথাগত বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ এমন সব দুর্লভ গুণের বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।

এখন '৯৬৯' নাম দিয়ে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি কোনো অপরাধ করে এর জের ধরে কোনো সম্প্রদায়ের পূজ্য ব্যক্তি কিংবা ধর্মের প্রবর্তককে সন্ত্রাসী বলা গর্হিত অপরাধ নয় কি? পবিত্র ইসলাম ধমের্র অনেকে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম'-এর 'বা', 'আলিফ', 'সিন' এ বর্ণমালাগুলোর মান বসিয়ে তার বের করেছেন '৭৮৬', আবার '৯২' দিয়ে বোঝান মুহাম্মদ (সা.), এভাবে আরও অনেককিছু। তবে এমন ব্যবহার কুরআন বা সহি হাদিসের কোথাও পাওয়া যায় না বলে অনেক ইসলামি পণ্ডিত মত দিয়েছেন।

পশ্চিমা সমাজে '১৩' সংখ্যাটিকে অপয়া ভাবা হয়। তারা বলে 'আনলাকি থার্টিন'। আবার তারা '৬৬৬' দ্বারা বোঝায় শয়তান। ভারতীয় উপমহাদেশে চোর, বাটপার, ফটকাবাজদের '৪২০' বলা হয়। এর অবশ্য কারণ আছে, ভারতীয় উপমহাদেশের সবদেশেই যদি কোনো চোর-বাটপার ধরা হয় তাহলে তাকে যে ধারায় শাস্তি দেওয়া হয় সেটি পেনাল কোডের ৪২০ নং ধারায় বর্ণীত আছে।

ধর্মের নামে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে যে জঙ্গি হামলাগুলো হচ্ছে এর জন্য ধর্ম বা ধর্ম প্রবর্তক কোনোমতেই দায়ী নয়। এছাড়াও রোহিঙ্গা বা অবহেলিত, নির্যাতিত এক শ্রেণির মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করায় বার্মিজ ভিক্ষু আসিন ওয়ারাথুকে আমি ঘোর সাম্প্রদায়িক ও জাতিবিদ্বেষী বলতে পারি, কিন্তু সন্ত্রাসী বা জঙ্গি বলব কোন প্রমাণের ভিত্তিতে? পৃথিবীর কোনো কোনো স্থানে ওই বার্মিজ ভিক্ষু আসিন ওয়ারাথু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন এবং জঙ্গি হামলা করেছেন জনাব ফিরোজ মান্না বলতে পারেন কি?

আমরা লক্ষ করছি যে, এক শ্রেণির মানুষ বুদ্ধ বিহার, বৌদ্ধ ভিক্ষু, বৌদ্ধধর্মের চরিত্র হনন করার জন্য এবং বৌদ্ধ ভিক্ষু মাত্রেই আসলে খারাপ, বৌদ্ধ বিহারেও সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তৎপরতা আছে– এটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। কেউ বৌদ্ধ ভিক্ষু সেজে কিংবা কোনো ভিক্ষু এমন গর্হিত কাজ করে থাকলে তাকে টেনে বের করুন। তাকে জাতির সামনে হাজির করুন, তার বিচার করুন। সন্দেহের ভিত্তিতে ঢালাওভাবে সবার বিরুদ্ধে এভাবে বিষোদগার করতে পারেন না।

বাংলাদেশি পাহাড়ি-বাঙালি কোনো বৌদ্ধ মিয়ানমারে বৈধ পন্থায় যাওয়া-আসা করা দোষের কিছু নয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের জনগণের উপর বর্বর অত্যাচার করেছে তাই বলে তো পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়নি? রোহিঙ্গা ইস্যুতে কিংবা অন্য কোনো কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে তো বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় যোগাযোগ নিষিদ্ধ হয়নি! তাহলে এদেশের বৌদ্ধরা মিয়ানমারে গেলে সমস্যা কোথায়?

বাংলাদেশের কোন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, কোন বৌদ্ধ যুবক মিয়ানমারে গিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিচ্ছে? তারা কারা? তাদের পাকড়াও করতে বাধা কোথায়? কিন্তু যে প্রতিবেদন করা হয়েছে তাতে বৌদ্ধ ভিক্ষু, বিহার এবং ভাবনাকেন্দ্র মানে সন্ত্রাসী, বাজে, জঙ্গি তৈরির কারখানা ভাবা ছাড়া আর কোনো কাজে আসবে কি?

এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সব বৌদ্ধ বিহার ও ভাবনাকেন্দ্রগুলোতে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীবিরোধী সাড়াঁশি অভিযান চালানো দরকার। যারা ভাবনাকেন্দ্র গড়ে তোলার নামে পাহাড়ে এত এত সরকারি জায়গা দখল করছে তাদের উপর স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা দরকার। প্রতিষ্ঠিত সব ভাবনাকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া দরকার। উনি বোধহয় এটাই চান। তাতে আমার তরফে কোনো আপত্তি নেই।