স্টুডেন্টস কেবিনেট নির্বাচন ও কিছু কথা

Published : 4 April 2017, 03:59 AM
Updated : 4 April 2017, 03:59 AM

৩০ মার্চ সারা দেশে একযোগে অনুষ্ঠিত হল অন্যরকম এক নির্বাচন। এর নাম দেওয়া হয়েছে 'স্টুডেন্টস কেবিনেট নির্বাচন'।

সারা দেশে এ নির্বাচনে এক লাখ ৮৩ হাজার ২৭২টি পদে দুই লাখ ৭১ হাজার ২৯৯ জন শিক্ষার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। মোট ভোটার সংখ্যা এক কোটি তিন লাখ ৯৮ হাজার ৫৫১ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ৫৪ লাখ ৬১ হাজার ১৯ জন।

এ বছর ৪৮৭টি উপজেলা ও নয়টি মহানগরের ২২ হাজার ৯০৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৫০৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ছয় হাজার ৪০২টি দাখিল মাদ্রাসা রয়েছে।

গেল বছর এক লাখ ৮৩ হাজার ৯২৮টি পদের জন্য প্রায় পাঁচ লাখ প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল।। তখন মোট ভোটার ছিল ৯৭ লাখ ৪৪ হাজার ৪৯৫ জন।

এ নির্বাচনের বিধি হল নির্বাচন কমিশনার, প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার এবং শৃঙ্খলার দায়িত্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিজেরাই পালন করবে। ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি ও অভিভাবকরা কেবল সার্বিক সহযোগিতা করবেন।

বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রী ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। ভোটার তালিকাভুক্ত যে কোনো শিক্ষার্থী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারে। প্রত্যেক ভোটার প্রত্যেক শ্রেণিতে একটি, সর্বোচ্চ তিন শ্রেণিতে দুটি করে মোট আটটি ভোট দিতে পারে। প্রত্যেক শ্রেণি থেকে একজন করে পাঁচ শ্রেণি (ষষ্ঠ থেকে দশম) থেকে পাঁচজন ও পরবর্তী সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত তিন শ্রেণির তিনজন মোট আটজন নিয়ে 'স্টুডেন্টস ক্যাবিনেট' গঠিত হয়। ক্যাবিনেট প্রতি মাসে কমপক্ষে একটি সভা করবে। শিক্ষকরা সিদ্ধান্তগ্রহণ ও বাস্তবায়নে সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রদান করবেন। প্রতি ছয় মাস অন্তর সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিতে ক্যাবিনেটের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। এটাই এই নির্বাচনের বিধি বলা যায়।

ক্যাবিনেটের কর্মপরিধিতে যা আছে তা হল পরিবেশ সংরক্ষণ, পুস্তক ও শিক্ষাসামগ্রী, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি, পানিসম্পদ, বৃক্ষরোপণ ও বাগান তৈরি দিবস পালন ও অনুষ্ঠান সম্পাদন, অভ্যর্থনা ও আপ্যায়ন এবং আইসিটি।

এ বছর আমি একটি কেন্দ্রে গিয়েছিলাম। রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে দেখা গেছে শিক্ষার্থীরা বিপুল আনন্দ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ভোটদানে অংশ নিচ্ছে। কেউ ভোট দিচ্ছে, কেউ দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবে বলে। অনেকে নির্বাচনের মানে বোঝে না কিন্তু ভোট দিতে মরিয়া হয়ে অপেক্ষা করছে লাইনে দাঁড়িয়ে। যেন কোনো উৎসব চলছে। নির্বাচন কমিশনার, প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার এবং শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষার্থীরা গলায় পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে সবাই যার যার দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত।

কৈশোর থেকে গণতন্ত্রের চর্চা, অন্যের মতামতের প্রতি সহিষ্ণুতা এবং শ্রদ্ধা, শিক্ষকদের সহায়তা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছাড়াও ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই হচ্ছে এ নির্বাচনের উদ্দেশ্য।

মাধ্যমিক স্টুডেন্টস কেবিনেট নির্বাচনের উদ্দেশ্য খুবই ভালো, তবে এই স্তরের শিক্ষার্থীদের জীবনে এবং মননশীলতার উপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনাও কম নয়। এই বয়সের ছাত্রছাত্রীদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ শেখাতে গিয়ে তারা যেন পুরোপুরিভাবে রাজনীতির দিকে ঝুকে না পড়ে। এমন হলে পরে নিজেকে গড়ে তোলার পরিবর্তে উল্টো নিজেকে অধঃপতনের দিকে ঠেলে দেবে!

রাজনীতির চর্চা মানে তো আসলেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা, অন্যের মতামতকে মূল্যায়ন করার শিক্ষা লাভ করা, আত্ম ও মনোবিকাশের চর্চা করা। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতির নামে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এর থেকে উদারতার সেই শিক্ষা লাভ করা মুশকিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র রাজনীতির নামে যে অপ্রত্যাশিত ধারা সৃষ্টি হয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক থেকে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত, সেই রাজনীতি থেকে অনুকরণীয় তেমন কিছু নেই বললেই চলে।

আমার কলেজ জীবনের একটি ঘটনার কথা বলি। শিক্ষক তখন ক্লাসে গুরুত্বসহকারে পড়াচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পরে এক ছাত্রনেতা এল তার দলবল নিয়ে। মনে হল তারা কোন জায়গা দখল নিতে এসেছে। আসার কারণ হল নতুন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। পাঠদান থামিয়ে শিক্ষক বাইরে গিয়ে এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। নেতা করমর্দন করছে আর নিজের ঢোল নিজে বাজিয়ে চলেছে। স্যার বোধহয় এই অসম্মান থেকে বাঁচতে অনেকটা আগে থেকে পালিয়ে গেছেন!

সাঙ্গপাঙ্গ আরও যারা সঙ্গে এসেছে তাদের দেখে মনে হল না যে তারা আদৌ কোনো ছাত্র। আমার কাছে আসার আগেই কক্ষ থেকে আমিও বেরিয়ে পড়লাম। নেতা ইচ্ছেমতো ফাঁকাবুলি আওড়িয়ে তারপর আরেক কক্ষে ঢুকল। আমাদের কক্ষের শিক্ষক পড়ানোর আর সময় পেলেন না। সময় সব নেতা খরচ করে ফেলল!

শ্রদ্ধেয় এবং সম্মানিত শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যেত হয় ছাত্রনেতা এল বলে। অধ্যক্ষের অফিসকক্ষে বসিয়ে তাদের আপ্যায়নও করতে হয়। তাদের শিক্ষকদের স্বয়ং বসার চেয়ার এনে দিতে হয়। তারা যা-ই বলে তা-ই করতে হবে। অনেক ছাত্র শিক্ষকের গায়ে পর্যন্ত হাত তুলে বসে। শিক্ষককে তাঁর প্রাপ্য নূন্যতম সম্মানটুকুও দেয় না। ধিক্কার! এমন ছাত্র রাজনীতিকে!

এমন অপ-ছাত্র রাজনীতি দেখেই তো ছোটরা বড় হচ্ছে। তারা দেখছে ছাত্র রাজনীতি করলে এবং নেতা বনে যেতে পারলে স্বয়ং শিক্ষকও সমীহ করেন, ভয় পান। শিক্ষাঙ্গনে দাপট দেখানো যায়। অনেক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। এসবের মোহে ও লোভে পড়ে যে ছাত্র রাজনীতিতে আসে সেই ছাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাজনীতি, দেশ এবং নিজের কী বা উপকার করবে? তার নিজের মধ্যেই তো পচঁন ধরেছে। ছাত্রনেতার নামে, ছাত্র রাজনীতির নামে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, গলাবাজি এবং ভাড়ায় খাটা অনেকের ক্ষেত্রে এমন অনাচারই তো আমরা দেখছি।

আমাদের আশাবাদী শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় চান, শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং শৃঙ্খলা চর্চা ছোটবেলা থেকেই শুরু হোক। তাই তিনি গত তিন বছর ধরে মাধ্যমিক স্তর থেকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রথা চালু করেছেন। আমরাও তা-ই চাই। আমাদের প্রজন্ম গণতান্ত্রিক এবং সুশৃঙ্খল মনোভাবাপন্ন হয়ে গড়ে উঠুক। ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আরও সমৃদ্ধ করুক। বাংলাভাষা, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ছাত্র রাজনীতির যে অবদান তা হৃদয়ে ধারণ করে দেশপ্রেম পুঁজি করে তারা এক একজন বড়মাপের নেতা হবে– এমন পবিত্র আশা আমাদের সবার।

জয়তু বাংলাদেশ।