সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড ও রক্তপাতহীন আরেকটি ‘খুনের’ কথা

শওগাত আলী সাগর
Published : 13 Feb 2012, 03:37 PM
Updated : 13 Feb 2012, 03:37 PM

সাংবাদিক সাগর সারোয়ার আর মেহেরুন রুনির হত্যাকাণ্ড দেশে-বিদেশে আলোড়ন তুলেছে। নিজের বাসায় এই দম্পতির মর্মান্তিক ঘটনায় সারা দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ, শোকাহত, হতবিহ্বল। সবারই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে যেন একটি প্রশ্ন- কারা খুন করলো সাগর-রুনিকে, কেন করলো? আর এমনতর হতবিহ্বল, শোককাতর সময়েই আরো একটি মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। সেই 'খুনের' ঘটনাটি ঘটছে একেবারে প্রকাশ্যে, কিন্তু যারা 'খুন' করছেন কিংবা যাদের সামনে 'হত্যাকাণ্ডটি' সংঘটিত হচ্ছে তারা নিজেরাও হয়তো বুঝে উঠতে পারছেন না কী হচ্ছে । তৃতীয় এই হত্যাকাণ্ডের শিকার সারোয়ার-রুনির একমাত্র সন্তান মেঘ। না, শারীরিকভাবে 'খুন' হয়ে যাচ্ছে না মেঘ। কিন্তু ছোট্ট এই অবুঝ শিশুটিকে নিয়ে বেদম টানা-হ্যাঁচড়ায় তার শিশুতোষ পৃথিবী নৃশংসভাবেই খুন হয়ে যাচ্ছে! তার অনুভূতিকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে 'খুন' করা হচ্ছে, কোনো পেশাদার খুনীচক্র নয়, খুন করছেন তার বাবা-মার অসচেতন সহকর্মীরা।

ভয়াবহ, চরম দু:খজনক এক ঝড়ো হাওয়া এখন মেঘের জীবন, তার মানসিক জগতের বুঝ-ব্যবস্থা, ভাঙচুর কতোটাই বা চোখে পড়ে!ঘুম ভেঙেই যখন একটি শিশু ঘরের মেঝেতে বাবা মার রক্তাক্ত লাশ দেখে, তখন সেই শিশুটির মনের অবস্থা কী হয় তা বোঝার মতো অবস্থা আমাদের কারোরই কি আছে? আবার বিবেচনাহীন মানুষওতো আমরা নই। অথচ কি বিবেচনাহীন আচরনই না আমরা করছি এই অবুঝ শিশুটির সঙ্গে! প্রতিমুহূর্তে পত্র-পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে দেখতে পাচ্ছি কিভাবে সকলে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই শিশুটির উপর। কিভাবে নানা এ্যাঙ্গেলে তার বর্তমান ছবি তোলা এবং ছাপা হচ্ছে! ভাবগতিকে মনে হচ্ছে সকলে হৃদয়হীনের মতো ঝাঁক বেধে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মেঘ এর উপর। যেন মেঘকে উপর্যুপরি রক্তাক্ত না করলে তাদের 'পারফরমেন্স' পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ পাচ্ছে না!

২."শনিবার ভোর ছোট্ট এই শিশুটির কাছে হাজির হয়েছে চরম বীভৎসতা নিয়ে। শোবার ঘরে মা-বাবার রক্তাক্ত দেহ, অশ্রুসজল নানির ছুটে আসা, মার সহকর্মীদের, বাবার সাংবাদিক বন্ধুদের ভিড়, কান্না, র‌্যাব- পুলিশ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, অসংখ্য ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ- হতবিহ্বল আতংকগ্রস্থ মেঘ।

এক ফাঁকে মেঘকে এ পরিস্থিতি থেকে বলতে গেলে উদ্ধার করেন রুনির মামারা। পশ্চিম রাজাবাজারের বাসা থেকে তাকে নিয়ে আসেন মেহেরুন রুনির নানাবাড়ি বউবাজারের মির্জা হাউসে। এ বাড়িতে লোকের ভিড় কম। আছে শুধু দীর্ঘশ্বাস, মাঝেমধ্যে গোঙানির শব্দ। দোতলায় একটানা বিলাপ করছেন রুনির সত্তরোর্ধ্ব নানি তৈয়েবুন মির্জা। তিনতলায় মেঘ স্বজনদের সঙ্গে সোফায় আধশোয়া।" (সূত্র: প্রথম আলো) ।

কী আশ্চর্য! এত মানুষের ভীড়ে, এত স্বজন-শুভাকাংখীদের ভীড়ে 'একটি অসহায় শিশুর প্রতি সংবেদনশীলতা' নিয়ে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো কোনো মানুষই যেন সেখানে ছিল না। তার মামারা তাকে উদ্ধার করে তাদের বিবেচনায় 'নিরাপদ' একটি জায়গায় নিয়ে গিয়েও তাকে স্বস্তি দিতে পারে নি। সদ্য বাবা-মা হারানো এই শিশুটি কিছু বুঝে উঠার আগে, কোথাও মুখ গুঁজে তার বেদনাটুকু ঝেড়ে ফেলার (আদৌ এই বেদনা কতদিন ঝেড়ে ফেলতে পারবে কে জানে!) সুযোগ পাবার আগেই তাকে ধাওয়া করার মূর্তমান আতংক তার মনের ভেতরে বাসা বেঁধে ফেলছে! কারো বুকে মুখ লুকিয়ে নির্ভরতা খুজেঁ পাওয়ার সুযোগ পাওয়ার আগেই তাকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে নানা মিডিয়ার। পাশাপাশি সে দেখতে পাচ্ছে, তার চারপাশের লোকজন কাঁদছে, বিবৃতি দিচ্ছে, ছবি নেয়া হচ্ছে, বাবা-মায়ের প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে আলোচিত হচ্ছে। কী হয়েছে, কী দেখেছে, কিভাবে মেরেছে, কখন দরজা খুলে দিলো – ছোট্ট এই শিশুটিকে কিছুতেই যেন ভুলতে দেয়া চলবে না! ছোট্ট মগজটির উপর চাপ দিয়ে দিয়ে বারবারই তাকে আতংকের স্মৃতির মধ্যে ফেলে দেওয়া! মেঘের মামারা তাকে কয়েক ঘন্টার জন্য রেখে এসেছিলেন একই ফ্লাটের একটি বাসায়। সেখানেও ওই ভদ্র মহিলা তাকে একই প্রশ্ন করেছেন। এবং তারপর পিছু নিয়েছে সাংবাদিকরা।
কালের কণ্ঠ থেকে উদ্ধৃতি দেই।"…এর আগে আমেনা বেগম ও স্বজনদের কাছে অস্পষ্ট বর্ণনা শুনে সংবাদকর্মীরা দিনভর খুঁজে বেড়ান শিশু মেঘকে। সে কোথায় এবং কেমন আছে? একই সঙ্গে মেঘের বর্ণনা কী- এসব জানতে চাইলে স্বজনরা জানায়, 'ও এখন ভালো নেই। ওর সঙ্গে কথা বলা যাবে না।' পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেঘকে রুনির নানার বাসায় রাখা হয়েছে। ইন্দিরা রোডের বৌবাজার গলির ৪৪/এফ মির্জা ভিলায় কথা হয় মেঘের সঙ্গে। সেখানেও মেঘের সঙ্গে সংবাদকর্মীদের কথা বলতে আপত্তি জানায় স্বজনরা। পরে বিশেষ অনুরোধে মেঘের দেখা মেলে। অস্পষ্ট করে হলেও সব প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছে মেঘ।"অর্থ্যাৎ মিডিয়া হন্যে হয়ে খুজেঁ বেড়িয়েছে মেঘকে। আত্মীয় স্বজনের আপত্তি, মেঘের শারীরিক অবস্থা ভালো না, কোনো কিছুই তাদের বিরত রাখতে পারে নি। মেঘকে কথা বলতে দিতে বাধ্য করা হয়েছে। এতে কি চরম নিষ্ঠুরতা প্রদর্শিত হচ্ছে না শিশুটির প্রতি? অথচ সর্বপ্রথম পদক্ষেপ হিসেবেই সব লোকচক্ষুর আড়ালে, সকল বেদনা-বিহ্বলতার আড়ালে সরিয়ে নেয়া দরকার ছিলো শিশুটিকে। সকলে মিলে মেঘের ভুবনটিকে, মেঘের ভবিষ্যতকে নিরাপদ করার দায়িত্ব ছিলো সবার আগে।

আর এইখানেই মিডিয়ার সংবেদনশীলতা নিয়ে, মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সাগর- রুনির হত্যাকাণ্ডের খবরের ক্ষেত্রে অবোধ শিশুটির বক্তব্য কতোটা জরুরী? তদন্তের স্বার্থে যদি জরুরি হয়েও থাকে, সে দায়িত্বটুকু যথাযথ তদন্তকারী সংস্থা মেঘের অভিভাবকের উপস্থিতিতে, শিশুটিকে যথোপযুক্ত পরিবেশ দিয়ে গ্রহণ করতে পারতো না? মেঘ কি দেখেছে-না দেখেছে তার চেয়েও মিডিয়ার উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা ছিলো শিশুটির নিরাপত্তা, তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে । সাংবাদিকতা একটি সংবেদনশীল পেশা। মিডিয়াকর্মীদের অনেক বিষয়েই সংবেদনশীল হতে হয়। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সিংহভাগই 'সংবেদনশীলতা' শব্দটির সঙ্গেই পরিচিত নন। এ হত্যাকাণ্ডটি তা আবারো প্রমাণ করলো।

উন্নত বিশ্বে কোনো পরিবারে খুন তো অনেক পরের কথা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটলেও পুলিশ প্রথমে ওই বাসার বাচ্চাদের সরিয়ে নেয় পিতামাতার মুখোমুখি হবার আগে । কোনো ধরনের সহিংস পরিস্থিতি যেন বাচ্চার মনে কোনো ধরনের বিরুপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে না পারে, সে জন্যেই এই পদক্ষেপ নেওয়া । আর খুনোখুনির ঘটনা ঘটলে তো কথা নেই! শিশুটিকে রাষ্ট্র তার দায়িত্বে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে প্রথমে তার মানসিক চিকিৎসা নিশ্চিত করে । এই ঘটনাটা ঢাকার না হয়ে পশ্চিমা কোনো দেশে ঘটলে স্বাভাবিক ভাবেই মেঘের প্রথম যাবার কথা ডাক্তারের কাছে। তার মনের উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তা থেকে পরিত্রান দিতে, তাকে স্বাভাবিক করে তুলতে মানসিক চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানেই তাকে থাকতে হতো। মিডিয়া কেন, পুলিশও অন্তত সপ্তাহখানেক তার কাছেই ভীড়তো না। পুলিশের উপস্থিতিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিশুবিষয়ক সমাজকর্মীরা হয়তো জানার চেষ্টা করতো ঘটনা। সেটাও অনেক পরে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য মেঘ-এর, তার চারপাশের মানুষের কাছ থেকে তার প্রাপ্য সহমর্মী আচরণ সে পায়নি। তার শিশুমনে হয়তো হত্যাকারীদের প্রতি বিতৃষ্ণার পরিমাণ আর তাকে ইন্টারভিউ করতে আসা সহমর্মীরা একই অবয়বে ধরা পরছে, কে বলতে পারে!