বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চার হাল

ড. জামাল নজরুল ইসলাম
Published : 29 Jan 2012, 04:37 PM
Updated : 29 Jan 2012, 04:37 PM

শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্বেই সাধারণ শিক্ষার দুরবস্থা চলছে। বিজ্ঞান শিক্ষাতো আরও পরের কথা। করপোরেট কালচারের কারণে সবকিছুরই অতিমাত্রায় বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। সাধারণ প্রতিষ্ঠানের বাইরে চলছে শিক্ষার বেসরকারিকরণ। এ পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ জরুরি। শিক্ষার দুরবস্থার জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীরা দায়ি নয়। এর মধ্য দিয়েও আমাদের দেশে বিজ্ঞান চর্চা এগিয়ে যাচ্ছে। যেমন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই ধরা যাক। এখানে বিজ্ঞানের ছাত্ররা গবেষণা করছেন। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে বড় বড় আর্ন্তজাতিক বিজ্ঞান বিষয়ক সেমিনার হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীরা অংশ নিয়েছেন। তারা বাংলাদেশে বিজ্ঞানের চর্চা এবং এর প্রতি আগ্রহ দেখে অবাক এবং উৎসাহিত হয়েছেন। এবং তারাও এদেশের বিজ্ঞানচর্চা একটি মাত্রায় পৌঁছাবে বলে মনে করেন।

বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে শিক্ষা পরিস্থিতির চেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির নেতিবাচক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা দরকার।
এছাড়া বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে সরকারের বরাদ্দ কম। তারপরেও বাংলাদেশে বিজ্ঞান গবেষণা অনেকটাই ঠিক পথে আছে বলে মনে করি।

বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চা
বাংলায় বিজ্ঞানের অনেক ভাল বই রয়েছে। আমি নিজেও বিজ্ঞানের অনেক প্রবন্ধ লিখেছি বাংলায়। এদেশে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা  করেন এমন অনেকেই বাংলায় বই লিখেছেন এবং লিখছেন। তাদের বই পড়তে তেমন কারও অসুবিধা হয়েছে বলে মনে হয় না। সুতরাং বাংলায় বিজ্ঞানচর্চাটা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও আমরা যোগাযোগের স্বার্থে আন্তর্জাতিক পাঠকগোষ্ঠির কথা মাথায় রেখে প্রধান রচনাগুলো ইংরেজিতে লিখছি।

আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি স্তর পর্যন্ত বাংলায় বিজ্ঞানের বই লেখা আছে। যারা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বাংলায় বিজ্ঞান পড়ছেন তারা বিজ্ঞানের গুরুত্বপুর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনে গেছেন। সুতরাং তাদের ­স্নাতক ও ­স্নাতকোত্তর মাধ্যমে ইংরেজিতে পড়তে সমস্যা কোথায়। এক্ষেত্রে মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা বাধাগ্রস্ত হবে না বলে আমি মনে করি। ওই দুটি পর্যায়ে বাংলায় পড়ার ততোটা দরকার নেই বলেও মনে করি আমি। বিজ্ঞানচর্চায় মাধ্যম কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণায় দুটো ভাষা জানা থাকলে সুবিধা।

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন বিজ্ঞান চর্চা বাংলা ভাষায় ঠিক মত এগুচ্ছে কিনা। আমি মনে করি সঠিক পথেই এগুচ্ছে। তবে বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমছে– এটা খানিকটা আশংকার কথা। এ প্রবণতা অনেকটা বিশ্বব্যাপীই। করপোরেট কালচারের কারণে তা অনেকটা হচ্ছে। তবে আমাদের দেশে কমলেও যাদের আগ্রহ আছে এবং পড়ছে তা হেলাফেলার মতো নয়। আমাদের দেশের অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী তাদের একাডেমিক বই বাংলায় লিখছেন এবং তা সুপাঠ্য হিসেবেই বিবেচিত।

জাপান-জার্মানির দিকে তাকালে দেখতে পাবো বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন বই তাদের নিজস্ব ভাষায় রয়েছে। সুতরাং বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা যথাযথভাবে হতে সমস্যা নেই।

বিজ্ঞান সবাইকে জানতে হবে কারণ বিজ্ঞান ছাড়া সবই গুরুত্বহীন। অনেকের ধারণা ভাল ইংরেজি না জানলে বিজ্ঞানচর্চা করা যাবে না। এটি ভুল ধারণা। মাতৃভাষায়ও ভাল বিজ্ঞান চর্চা ও উচ্চতর গবেষণা হতে পারে।

কেউ কেউ মনে করেন বাংলায় বিজ্ঞান পরিভাষা যথেষ্ঠ এবং প্রয়োজনোপযোগী নয়। এই সীমাবদ্ধ ও পুরোনো পরিভাষা দিয়ে কীভাবে অর্থপূর্ণ বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব?

আমি মনে করি যতটুকু আছে তা দিয়েই করা সম্ভব। তবে বাংলায় বিজ্ঞানের বই লিখতে গিয়ে অনেক শব্দের সঠিক পরিভাষা না পাওয়া গেলে সরাসরি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে সমস্যা কি।

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চায় বাংলা একাডেমী যথেষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। তাদের প্রকাশিত বিভিন্ন বই দেশে বিজ্ঞান চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা করতে বাংলা একাডেমীর পরিভাষা পুরোপুরি না হলেও তুলনামূলক ভাল বলে মনে করি আমি।

বিজ্ঞান গ্রন্থের অনুবাদ
বাংলায় বিজ্ঞানের বইয়ের ঢালাও অনুবাদ একটি সামাজিক পরিস্থিতির প্রতিফলন। অতি মুনাফার লোভে অনেকেই তা করলেও কখনোই তা ভাল ফল আনবে না। তবে আমাদের দেশে বিজ্ঞানের ইংরেজি ভাষার বই বাংলায় ভালো অনুবাদ করতে পারবেন এমন অনেকেই আছেন। তারা এসব কাজে হাত দিলে বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার জন্য ভাল হতো। তবে সামাজিকভাবে এবং রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে উদ্যোগী হলে বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা অনেকটাই এগুবে।

বাংলায় বিজ্ঞান বিষয়ক ভালো বই লিখতে হলে প্রথমে ভাল বিজ্ঞানী হতে হবে। এরপর সহজ, সাবলীল এবং সহজবোধ্য শব্দে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই লেখা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করা বড় বড় বিজ্ঞানীদের সম্পৃক্ত করে লেখাতে হবে।

দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক ও গবেষকদের বিদেশমুখীতা বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে একটা নেতিবাচক দিক-এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এদের সংখ্যা অনেক কম। দেশে বসেও বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা সম্ভব বলে মনে করি। অনেকে দেশেই গবেষণা করছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ও ভৌত গবেষণা কেন্দ্রের কথাই ধরা যাক। এখানে অনেকেই গবেষণা করছেন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বমানের গবেষণা করছেন বলে আমি মনে করি।

সুতরাং আমি বিশ্বাস করি বাংলা ভাষায় এবং বাংলাদেশে বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে কোন বাধা নেই।

ড. জামাল নজরুল ইসলাম
: গণিতবিদ, গবেষক ও পদার্থবিজ্ঞানী।