মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 20 Feb 2017, 04:20 AM
Updated : 20 Feb 2017, 04:20 AM

একজন অভিভাবক ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, "বাংলাদেশে যত শিক্ষামন্ত্রী এসেছেন, তার মধ্যে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদই হচ্ছেন সবচেয়ে খারাপ। তাঁর হাত দিয়েই দেশের শিক্ষার ১২টা বাজানো হচ্ছে। আর তিনি কেবল বড় বড় বুলি আওড়াচ্ছেন!"

জিজ্ঞেস করলাম, "কেন আপনার মনে হচ্ছে যে, তিনিই সবচেয়ে খারাপ?"

ভদ্রলোকের ঝাঁঝালো জবাব, "দেখছেন না, নিয়মিত প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে? অথচ তিনি একই কথা বলে যাচ্ছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি, সব গুজব, তথ্যপ্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেব! বিভিন্ন গণমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর তথ্যপ্রমাণসহ প্রকাশিত হচ্ছে, আর ভদ্রলোক কি না তথ্যপ্রমাণ খুঁজে পান না! পাবেন কীভাবে? উনারা তো চোর ধরতে চান না। চোর ধরলে তো তার বিচার করতে হবে। কেচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে যাবে। সেই মুরোদ কি আর শিক্ষামন্ত্রীর আছে? কাজেই অস্বীকার করাই নিজের অযোগ্যতা ঢাকার একমাত্র উপায়। এটা চরম অসততা। ভণ্ডামি।"

দেশের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবেন, এমন বেশিরভাগ অভিভাবকই বর্তমানে শিক্ষামন্ত্রীর প্রতি ক্ষুব্ধ।এর অনেক কারণ আছে। সবচেয়ে বড় কারণ, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা স্বীকার না করা ও ঠেকাতে না পারা। অনেকেরই অভিযোগ, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে দেশের শিক্ষার গলায় ফাঁস পরিয়ে গোটা জাতিকে অথর্ব বানানোর চক্রান্ত চলছে। যারা লেখাপড়া করে শিক্ষা অর্জন করতে চায় তেমন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বর্তমানে ভয়ানক হতাশ।

একজন পরীক্ষার্থীর বক্তব্য, "অনেক খেটেখুটে যে পরীক্ষা দিয়েছি, নিয়মমতো পড়াশোনা করেছি, এখন আমি যদি 'এ' পাই এবং একজন পরীক্ষার্থী ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে 'এ প্লাস' পায়, তাহলে আমি পড়াশোনায় উৎসাহ পাব কীভাবে? ছোটবেলা থেকে যে শুনে এসেছি, সৎ পথে থেক, সৎ কাজে সিদ্ধি লাভ হয়, এ বিষয়টাই তো ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। এসব কথার জবাব কে দেবে?"

ছোট ছোট শিশুদের হাতে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন ধরিয়ে দিয়ে পরীক্ষা দিতে পাঠানো হচ্ছে, সেই ছোট ছোট শিশুদের অন্যায় করতে শেখানো হচ্ছে। পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের নজির আছে বলে আমাদের জানা নেই। একটা দেশের মেরুদণ্ড পুরোপুরি ভেঙে দেওয়ার এর চেয়ে পরিপূর্ণ কোনো পদ্ধতি আছে কী? প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা থেকে শুরু করে গেল কয়েক বছরে এমন কোনো পরীক্ষা নেই যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি! অথচ আমাদের শিক্ষামন্ত্রী কী ভয়ানক নির্বিকার!

একটা ত্রুটিমুক্ত এবং ভালো পরীক্ষার আয়োজন যদি করা না যায়, তাহলে মন্ত্রী হিসেবে এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে? এর পরও পদে থাকার নৈতিক সমর্থন মেলে কী?

মন্ত্রী বা সরকার চাইলে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা সম্ভব। এ ব্যাপারে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল সম্প্রতি বলেছেন, "আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না, তাহলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না। তার মানে ওই সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয় নাই।"

(http://bangla.bdnews24.com/ctg/article1290148.bdnews)

অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের এই কথার কী জবাব দেবেন মিক্ষামন্ত্রী?

বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর আমলেই শিক্ষায় সবেচেয়ে বেশি নৈরাজ্য চলছে। কোনো স্থিরতা নেই। নিত্যনতুন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ ঘোষণাই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থী সবাই ক্ষুব্ধ। সবার মুখে একটাই কথা, দেশের শিক্ষার সর্বনাশ হচ্ছে। আর এই সর্বনাশটা সূচিত হচ্ছে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর হাত দিয়ে।

বর্তমানে শিক্ষার মান সর্বনিম্ন পর্যায়ে। সবচেয়ে সর্বনাশ হয়েছে মূল্যায়ন পদ্ধতি বা পরীক্ষাব্যবস্থার। পরীক্ষার ফলাফল বা পাস-ফেলকে কোনো ধরনের যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছাড়া আমরা রাজনৈতিক সরকারের সফলতা-ব্যর্থতার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে।

বিভিন্ন ধরনের অলিখিত নির্দেশ, ইশারা-ইঙ্গিতের মারফত দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে যেমন করে হোক পাসের হার বাড়িয়ে দিতে হবে। সম্ভব হলে শতভাগের খুব কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। অতএব ফেল করানো যাবে না। সর্বোচ্চ গ্রেডের ছড়াছড়ি থাকতে হবে, দেখতে-শুনতে যাতে ভালো লাগে। আগে শিক্ষার্থীরা গোপনে নকল করত। শিক্ষকরা ব্যস্ত থাকতেন নকল ধরতে। আর এখন শিক্ষার্থীরা নকল থেকে দূরে থাকতে চান। কিন্তু শিক্ষকরা নকল নিয়ে হাজির হন শিক্ষার্থীদের কাছে। প্রয়োজনে অন্য স্কুলে কেন্দ্র পড়লে সেখানে টাকা-পয়সা দিয়ে পরীক্ষকদের কিনে ফেলেন। সেরা স্কুল হওয়ার দৌড়ে যেসব স্কুল তাদের কথা তো ভিন্ন। লাখ লাখ টাকা নিয়ে তারা মাঠে নামেন। শিক্ষার্থীদের উত্তর বলে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামেন শিক্ষকরা।

শিক্ষামন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছায় শিশুদের জন্য পিএসসি ও জেএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা চালু করা হল। এর ফলে জাতির মেরুদণ্ডে আঘাত এল আরও বেশি করে। এখানেই শেষ নয়, যে কোচিং-বাণিজ্য শিক্ষাকে গ্রাস করছিল, তা আরও বেশি চাঙ্গা হয়ে উঠল। শিশুরা শিখল কীভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে পরীক্ষা দিয়ে 'গোল্ডেন জিপিএ-৫' পেতে হয়। কীভাবে নিজের পায়ে কুড়াল মেরে জীবনকে ধ্বংস করতে হয়।

শিক্ষকদের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, পাবলিক পরীক্ষাগুলোর খাতা দেখার সময় কোনো প্রশ্নের উত্তর কতটুকু লিখলে কী পরিমাণ নম্বর দিতেই হবে সেই বিষয়ে উপর মহল থেকেই ওনাদের কাছে লিখিত নির্দেশ আসে। এমনকি তাতে গুণগত মান বিচারের কোনো সুযোগও থাকে না, লিখে পাতা ভরালেই নাকি নম্বর দিয়ে পাস করানোর নির্দেশ আছে। সেই নির্দেশ না মানলে 'শো কজ' বা কারণ দর্শানোর নোটিশের সামনে পড়তে হয়। তার মানে সরকার পাসের পরিমাণ নিয়েই চিন্তিত, মান নিয়ে নয়। ব্যাপারটা যদি সত্যিই এরকম হয় তাহলে শিক্ষার সাফল্য নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হবার কিছু আছে কি?

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ সমাপনী পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরীক্ষাকেন্দ্রে ব্ল্যাকবোর্ডে উত্তর লিখে দেওয়া হয়। কোনো কোনো কেন্দ্রে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পরস্পরের খাতা মিলিয়ে দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ জীবনের শুরুতেই কোমলমতি একজন শিক্ষার্থীকে অনৈতিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ফেলা হচ্ছে। এতে তাদের স্পর্শকাতর মনোজগৎ যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রতিবেদনে আরও ভয়াবহ তথ্য আছে। তাদের তথ্যমতে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোচিং বেআইনি হলেও সমাপনী পরীক্ষা চালুর পর তা বেড়েছে। শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য গত বছর দেশের ৮৬ দশমিক ৩ শতাংশ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে হয়েছে। আর ৭৮ শতাংশ সরকারি বিদ্যালয়ে কোচিং ছিল বাধ্যতামূলক। (৭৮ শতাংশ সরকারি বিদ্যালয়ে কোচিং বাধ্যতামূলক, প্রথম আলো, ২০ আগস্ট ২০১৫)

গত ৬ বছরে শিক্ষামন্ত্রী অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কখনও কোনো কোনো সিদ্ধান্ত একদিনের মধ্যে পরিবর্তন করেছেন। অনেক সিদ্ধান্ত সিদ্ধান্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে, বাস্তবে রূপ পায়নি। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে একটি 'জাতীয় শিক্ষানীতি' তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন নেই।

নোটবই, কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ করতেও আইন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুরই প্রয়োগ নেই। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছে মতো টাকা আদায় করছে। নিয়োগ-বদলি-এমপিওভুক্তিকরণ সবখানে চলছে দুর্নীতির মচ্ছব। কোথাও কোনো পরিবর্তন নেই। তা হলে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এতগুলো বছরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কোন পরিবর্তনটা আনলেন?

পাঠদান-পদ্ধতি নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে, কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি ও সামাজিক চাহিদা অনুযায়ী কোনো কার্যকর পদ্ধতির উদ্ভাবন চোখে পড়ছে না। শিক্ষাব্যবস্থা জ্ঞানমুখী না হয়ে ক্রমেই সনদমুখী হয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানচিন্তা, দর্শনচিন্তা, সমাজ ও পরিবেশ নিয়ে চিন্তাভাবনা একটা নির্দিষ্ট মাত্রাতেই আটকে আছে। উল্টো যেন অন্ধকারকেই শিক্ষার মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।

দেশের মৌলবাদীচক্রের দাবি অনুযায়ী সবার অগোচরে পাঠ্যবই পরিবর্তন করা হয়েছে। যাচ্ছে তাই ভুল, অপ্রাসঙ্গিক নানা বিষয় তাতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নিখাদ সাহিত্য ও ভাষা শিক্ষার বইয়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে তুলে আনা হয়েছে একেবারে ধর্মীয় বিষয়। বাদ পড়েছে 'হিন্দু' ও 'নাস্তিক' লেখকদের লেখা। নতুন শিক্ষানীতির আলোকে তৈরি কারিকুলামের ভিত্তিতে নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের তিন বছরের মাথায় এ পরিবর্তন আনা হয়েছে।

শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, "নানামুখী চাপের কারণে পরিবর্তন করতে হয়েছে। এটা নিয়ে কথা না বলাই উত্তম।" ('দৈনিক ভোরের কাগজ' পত্রিকায় প্রকাশিত 'প্রতিক্রিয়াশীলদের খপ্পরে পাঠ্যবই' শীর্ষক প্রতিবেদন, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬)

কথা না বলা কেন 'উত্তম' হবে? তাহলে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তনের কারণ অনুসন্ধানের জন্য তদন্ত কমিটি করা হয়েছে কেন? সেকি কেবল 'আইওয়াশ'?

বর্তমান সরকারের আমলে দেশে পাসের হার বাড়ছে, শিক্ষায় অংশগ্রহণ বাড়ছে, এটাই কি সাফল্য? শিক্ষার অধিকার মিলেছে, শিক্ষা মিলেছে কি? শিক্ষাদানের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষাবঞ্চনার পালা চলছে। মাতৃভাষা, অংক ও ইংরেজিতে নিজের শ্রেণি-উপযোগী দক্ষতা তৈরি হয়নি সিকিভাগ পড়ুয়ারও। এমন পরিস্থিতিতে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী কী বলবেন?

"সব কিছু ঠিকঠাকমত চলছে" বলে পদ আকড়ে থাকবেন? নাকি ১২ ভূতে মিলে ১২টা বাজানোর প্রক্রিয়া থেকে শিক্ষাকে মুক্ত করতে না পারার ব্যর্থতা নিয়ে এবার সরে পড়বেন?