ভাষাগত আদর্শের নিরিখে বাধ্যতামূলক ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার অযৌক্তিকতা

রেজাউল করিম ফকির
Published : 6 Feb 2017, 01:25 PM
Updated : 6 Feb 2017, 01:25 PM

বাংলাদেশে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা দুটি উপব্যবস্থা নিয়ে গঠিত। এটি শিশু শ্রেণি থেকে শুরু করে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা স্তর পর্যন্ত সাধারণ ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জন-উপযোগী বাধ্যতামূলক উপব্যবস্থা এবং শিক্ষার সকল স্তরে একাডেমিক বিষয় ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার ঐচ্ছিক উপব্যবস্থার সমন্বয়ে গঠিত। এই ইংরেজি ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থায় দেশের প্রত্যেক বিদ্যালয়গামী শিশু বাধ্যতামূলকভাবে ইংরেজি শিখে এবং তাদের সকলেই ইচ্ছানুযায়ী শিক্ষার যে কোনো স্তর থেকে ইংরেজি মাধ্যমে একাডেমিক বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়।

এ প্রসঙ্গে এখানে উল্লেখ্য যে, ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য প্রয়োজন ভাষা-পরিকল্পনা যা ভাষানীতির উপর ভিত্তি করে প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। আর ভাষানীতি প্রণয়ন করা হয়ে থাকে কতকগুলো ভাষাগত আদর্শ কেন্দ্র করে। যে ভাষানীতির কোনো আদর্শিক ভিত্তি থাকে না, সে ভাষানীতির আলোকে কোনো ভাষা-পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তার ভিত্তিতে ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করলে, সে ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থা জাতির জন্য সুফল বয়ে আনে না।

বাংলাদেশে যে ইংরেজি ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে তা কোনো ভাষানীতির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এটি ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত ব্যবস্থার কেবলই অনুকরণ ও প্রসারণ মাত্র। এই ব্যবস্থার জন্য যে আসলেই কোনো আদর্শ বা নীতি প্রয়োজন, সে সম্পর্কে সাধারণের বা সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও উপলব্ধি বা উদ্বেগ নেই। তার মানে দেশে ইংরেজি ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে, অথচ তার আদর্শগত ও নীতিগত ভিত্তি নেই।

এখানে বিভিন্ন ভাষাগত আদর্শের আলোকে বাংলেদেশের ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালোচনা করা হল যেন বর্তমানে প্রচলিত বাধ্যতামূলক ইংরেজি ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থা কতটুকু যৌক্তিক তা পরিস্ফূট হয়।

উল্লেখ্য যে, ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নে মোট চারটি সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শ রয়েছে। এগুলো হল, আত্তীকরণ, ভাষিক বহুত্ববাদ, দেশীয়করণ ও আন্তর্জাতিকায়ন। যে কোনো রাষ্ট্রের ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় যে ভাষানীতি প্রয়োজন, তা এ চারটি সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শের কোনো-না-কোনোটির উপর প্রতিষ্ঠিত। আগেই উল্লেখ করেছি যে, বাংলাদেশে যে ইংরেজি ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে, তা ভাষাগত আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়– তা ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারিত রূপ বিশেষ। ভাষাগত আদর্শের পর্যায়ে এটি কখনও আলাচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়নি।

ভাষাগত আদর্শবিহীন এই বাধ্যতামূলক ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা বুঝতে হলে বাধ্যতামূলক ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা যেসব দেশে চালু রয়েছে সেসব দেশের সে শিক্ষাব্যবস্থার আদর্শিক ভিত্তির আলোকে বিবেচনা করতে হবে।

পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের বাধ্যতামূলক ইংরেজি ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে মিল রয়েছে ব্রিটিশশাসিত সাবেক ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রসমূহের ইংরেজি ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থার। এশিয়া ও আফ্রিকার এ সমস্ত দেশের মধ্যে রয়েছে পাপুয়া নিউগিনি, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, উগান্ডা ইত্যাদি যেগুলোতে বাধ্যতামূলক ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। এ সমস্ত রাষ্ট্রের ভিন্নভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে একক কোনো সংজ্ঞাপনের ভাষা না থাকায় চরম ভাষাগত বিশৃঙ্খলা বিরাজিত রয়েছে। যার ফলে এ সমস্ত দেশের রাষ্ট্রীয় ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার পথে।

এ সমস্ত দেশসমূহ তাই ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার প্রাক্কালে রাষ্ট্রের ঐক্যরক্ষার স্বার্থে ব্যক্তিগত, দাপ্তরিক ও রাষ্ট্রীয় কাজে ইংরেজি প্রচলনের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং শিক্ষাব্যবস্থায় বাধ্যতামূলক ইংরেজি ভাষা-শিক্ষা চালু করে। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে দেশাভ্যন্তরীন উপজাতীয় ভাষার পরিবর্তে ইংরেজিতে প্রাধান্য দেয়। ফলে এ সমস্ত দেশে বর্তমানে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ইংরেজি চালু হয়েছে। ভাষাগত বিভিন্নতার কারণে যে বিভেদ রয়েছে তা সাময়িকভাবে তিরোহিত। কিন্তু এ সমস্ত দেশ কার্যত ইংরেজি ভাষাগত উপনিবেশের নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

বহুভাষাভাষী জনগোষ্ঠীসম্পন্ন এ সমস্ত সাবেক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দেশসমূহে বাধ্যতামূলক ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন করা হয়েছে একটি ভাষানীতির উপর ভিত্তি করে। যার সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শিক ভিত্তি হল, আত্তীকরণ, দেশীয়করণ ও আন্তর্জাতিকায়ন। আত্তীকরণ, দেশীয়করণ ও আন্তর্জাতিকায়ন এমন একটি ইংরেজি ভাষানীতি সমর্থন করে যা ইংরেজি ভাষা সর্বস্তরে চালুর যৌক্তিক ভিত্তি তৈরি করে।

আত্তীকরণ হল এমন একটি সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শ যা বহুভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর দেশে সবাইকে ইংরেজি ভাষা গ্রহণে বাধ্যতা আরোপ করে, যেন দেশের প্রত্যেক মানুষ একটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় ঐক্যবদ্ধ হয়।

দেশীয়করণ হল এমন একটি ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শ, যা ইংরেজি ভাষা দেশীয় ভাষা হিসেবে আপন করে নেওয়ার নীতি সমর্থন করে।

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিকায়ন এমন একটি ইংরেজি ভাষানীতি সমর্থন করে, যা ইংরেজিতে দাপ্তরিক কাজে চালুর নীতি সমর্থন করে।

এভাবে আত্তীকরণ, দেশীয়করণ ও আন্তর্জাতিকায়ন– এ তিনটি সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শ মিলে পাপুয়া নিউগিনি, কেনিয়া, নাইজেরিয়া ও উগান্ডা ইত্যাদি দেশে সেদেশের নিজস্ব ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা আপন করে নেওয়ার ভাষানীতির ভিত্তি তৈরি করে। কিছুটা ব্যতিক্রম হলেও ভারত ও সিঙ্গাপুরে যে ইংরজি ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে, তা মূলত প্রচ্ছন্নভাবে আত্তীকরণ, দেশীয়করণ ও আন্তর্জাতিকায়ন– এ তিনটি সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শপুষ্ট ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থা।

উপরের আলোচনায় আমরা লক্ষ্য করেছি যে, একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের জন্য যে ভাষাগত ঐক্য প্রয়োজন তার আদর্শিক ভিত্তি হল আত্তীকরণ, দেশীয়করণ ও আন্তর্জাতিকায়ন। পাপুয়া নিউগিনি, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, উগান্ডা, ভারত ও সিঙ্গাপুর প্রভৃতি সাবেক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দেশ ঐক্যবদ্ধ জাতি নির্মাণের উদ্দেশ্যে— আত্তীকরণ, দেশীয়করণ ও আন্তর্জাতিকায়ন নামক তিনটি সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শের সমর্থনে প্রণীত ভাষানীতির ভিত্তিতে– ইংরেজি ভাষা সর্বস্তরে চালুর প্রচেষ্টা হিসেবে বাধ্যতামূলক ইংরেজি ভাষা-শিক্ষা চালু করে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার শত শত বছর পূর্বে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রক্রিয়ার অনুসরণে একটি একক ভাষাভিত্তিক ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে সুগঠিত হয়েছে। এই ভাষাগত ঐক্য সাধিত হয়েছে যখন বাংলা অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষাভাষী অস্ট্রিক জনগোষ্ঠী সংস্কৃতের অপভ্রংশ নিজেদের ভাষা বলে গ্রহণ করে একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীতে আত্তীকৃত হয়। সংস্কৃতের অপভ্রংশেরও দেশীয়করণ ঘটে। ভাষাটি ততদিনে নাম ধারণ করে 'বাংলা'। ভাষাটির আন্তর্জাতিকয়ান ঘটে যখন বাংলার নবজাগরণের যুগে পণ্ডিতদের প্রচেষ্টায় এটির কাঠামো ও অবয়ব সংস্কৃতের উপাদান দ্বারা আরও পরিপুষ্ট হয়।

কাজেই যেখানে পাপুয়া নিউগিনি, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, উগান্ডা, ভারত ও সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশ ঔপনিবেশক শক্তি থেকে মুক্তিলাভের পর ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের জন্য ইংরেজি ধার করেছে– সেখানে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষা কেন্দ্র করে পূর্বকাল থেকেই একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত অবস্থায় রয়েছে। যে কারণে আমরা ইংরেজি ভাষার অভাবে জাতীয় অনৈক্যের আশঙ্কায় নেই।

এই একই কারণে আত্তীকরণ, দেশীয়করণ ও আন্তর্জাতিকায়ন নামক তিনটি সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক আদর্শ সাবেক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দেশসমূহে বাধ্যতামূলক ইংরেজি ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থা চালুর নীতি সমর্থন করলেও, এগুলো বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক ইংরেজি ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থা চালুর যৌক্তিক ভিত্তি তৈরি করে না।

আমাদের দেশে তাই বাধ্যতামূলক ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা বাতিল করে বিশ্বায়ন আদর্শের ভিত্তিতে একটি ভাষানীতি প্রণয়ন করা দরকার। এরপর এর আলোকে একটি ইংরেজি ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। তা করা হলে দেশ পাবে একটি যুগোপযোগী টেকসই ইংরেজি ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থা।

এমনটি করা সম্ভব হলে বাংলাদেশ মুক্তি পাবে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত সর্বপ্রকার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কুফলের হাত থেকে।