একুশে গ্রন্থ মেলা: সত্য ও সুন্দরের পথে অভিযাত্রা

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 4 Feb 2017, 03:41 AM
Updated : 4 Feb 2017, 03:41 AM

অমর একুশে গ্রন্থ মেলা আমাদের অহঙ্কার। এই গ্রন্থ মেলার সঙ্গে মিশে আছে আমাদের প্রাণের স্পন্দন, মনের আকুতি এবং হৃদয়ের অভিব্যক্তি। এই মেলার মাঝে উদ্ভাসিত হয়ে থাকে আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য। সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের উন্মেষ হচ্ছে আমাদের প্রত্যাশা।

ভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসা এবং চরম আত্মত্যাগের কাহিনি মিশে আছে এই মেলার সঙ্গে। শুধুমাত্র মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আত্মোৎসর্গ করা নয়, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দাবি উঠেছে ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে। তাই প্রতি বছর একুশের বই মেলা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের আত্মত্যাগের ইতিহাস– কণ্ঠে ভেসে আসে 'আ মরি বাংলা ভাষা, তোমার বোলে, তোমার কোলে, কত শান্তি ভালোবাসা'।

পদ্মা মেঘনা যমুনা বুড়িগঙ্গা ধলেশ্বরী মধুমতি নদীপাড়ের মানুষের জ্ঞানচর্চার বই মেলা যেমন অবদান রেখেছে সত্য ও সুন্দরের ভাবনায় উদ্দীপ্ত হতে, তেমনি সৃষ্টি করেছে কবি সাহিত্যিক, লেখক ও পাঠকের মিলনমেলা রূপে গড়ে তুলতে। বাঙালির দেদীপ্যমান বাতিঘর মানুষের মনের অন্ধকার ঘোচাতে বই পড়া বা জ্ঞান আহরণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে প্রকাশ পেয়েছে আমাদের বই মেলা। বই কেনা আর বই পড়ার অভ্যাস অগণিত শিক্ষার্থীকে অনুপ্রাণিত করেছে তা-ই নয়, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভুবন বিকশিত করতে সাহায্য করেছে।

অবাধে বিচরণ করা, আর পছন্দমতো বই কেনার মধ্য দিয়ে পুরো ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী চলছে অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা আর গ্রন্থ মেলা। এসবের মাঝে উৎসারিত হয়ে থাকে পাঠকমহলে ব্যাপক জ্ঞানের চর্চা, প্রকাশকদের দারুণ ব্যস্ততা এবং লেখকদের হৃদয়জুড়ে উৎকণ্ঠা। সময়ের পরিক্রমায় বিপুল সংখ্যক লেখক এবং প্রকাশকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বর্তমানে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থ মেলা এখন আন্তর্জাতিক মেলায় রূপ লাভ করেছে। তাই এই মেলা শুধু অহঙ্কারের অঙ্গন নয়, এ হচ্ছে আমাদের জ্ঞানচর্চার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ এবং দেশাত্ববোধ প্রকাশের দৃশ্যপট।

বর্ধমান হাউসের খোলা মাঠে বটবৃক্ষের নিচে ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাটের মাদুর পেতে পুঁথিঘরের প্রকাশিত মাত্র ৩২টি বই নিয়ে বই মেলার সূচনা করেছিলেন প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সাহা। তিনিই হচ্ছেন বই মেলার অগ্রদূত। বইপড়ার এ আন্দোলন এবং বই কেনার পক্ষে অনেক আকর্ষণীয় বার্তা ও আবেদন সাধারণ প্রর্দশনী হিসেবে বেশ কয়েক বছর চললেও, ১৯৭৬ সালে আরও কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বই মেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে বাংলা একাডেমি চত্বরকে আকর্ষণীয় করে তুলে। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শ্রদ্ধেয় আশরাফ সিদ্দিকী এই মেলার সঙ্গে বাংলা একাডেমিকে সংযুক্ত করে মেলায় নতুন মাত্রা যোগ করেন। ১৯৮৪ সালে বই মেলার নামকরণ করা হয় 'অমর একুশে গ্রন্থ মেলা'। শুরু হয় বই মেলার এক নতুন অভিযাত্রা।

এবার ২০১৭ সালে বই মেলায় স্থান পেয়েছে ৬৬৩টি স্টল যার মধ্যে বাংলা একাডেমির চত্বরে জায়গা পেয়েছে ১১৪টি। অবশিষ্ট ৫৪৯টি স্থান পেয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। মোট ৪০৯টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এবার অংশগ্রহণ করছে। মেলাকে উপলক্ষ করে গত বছর প্রকাশিত হয়েছিল প্রায় ৫ হাজার বই। এবার হবে প্রায় ৭ হাজার এবং বেচাকেনা হতে পারে প্রায় ৩০ কোটি টাকার বই।

তবে লক্ষণীয় যে, মেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রত্যেক বইয়ের উপর কমপক্ষে ৩০ শতাংশ ছাড় দিয়ে থাকে এবং অন্যান্য বইয়ের বিক্রেতারা কমপক্ষে ২৫ শতাংশ হ্রাস মূল্যে বই বিক্রি করে থাকে। অনেক লেখক তাদের পরিচিতি ও স্বজনদেরকে বই উপহার দেয় প্রচুর। এবারও অনেক প্রকাশক অনুরূপভাবে হ্রাসকৃত মূল্যে বই বিক্রি করে ক্রেতাদের আকর্ষণ করবেন। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এবং বিক্রেতারা বিজ্ঞাপনী বার্তা প্রচার করছে অবিরাম। মেলার প্রবেশদ্বারে পোস্টার আর প্রচারপত্রের ছড়াছড়িতে মেলাঙ্গন মুখরিত।

তবে মেলার অপর একটি আর্কষণীয় দিক হচ্ছে মোড়ক উন্মোচন। এত দিন যাবৎ চলে আসছিল মোড়ক উন্মোাচনের প্রধান অঙ্গন 'নজরুল মঞ্চ'। এবার আসছে নতুনত্ব। নিয়ম হচ্ছে, মোড়ক উন্মোচনের পর লেখক কিছু বক্তব্য রাখবেন তার বইয়ের গুণগত মান এবং প্রধান মোড়ক উন্মোচনকারীও বই সম্পর্কে বক্তব্য রাখবেন্। সেখানে থাকেন বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিগণ যারা ছবি তুলে সংবাদপত্রে এবং টেলিভিশনে প্রচার করেন।

এবার নজরুল মঞ্চ নয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হয়েছে একটি মঞ্চ যেখান থেকে মোড়ক উন্মোচন চলবে প্রতিদিন বিকালে নিয়মিত। তবে বাংলা একাডেমির মাইকে নতুন বই প্রকাশ হলে তার ঘোষণা দিয়ে যাওয়া হবে একের পর এক, অবিরাম।

শুধুমাত্র বইয়ের বেচাকেনার কথা বললে মেলার সার্বিক দৃশ্য পরিস্ফুট হয়ে উঠবে না। মূলত বই মেলা হলেও এখানে আছে আরও অনেক বেচাকেনার দৃশ্যপট। যেমন আছে অসংখ্য খাবার দোকান, তেমনি আছে অগণিত ছোট বড় পসরা। শিশুদের খেলার আকর্ষণীয় সামগ্রী, যার মধ্যে আছে বেলুন, ঝুনঝুনি, বাঁশের বাশি থেকে আরম্ভ করে কোনো কিছুরই অভাব নেই। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এক হাতে একটি ছড়ার বই, অপর হাতে একটি বেলুন আর বাঁশি নিয়ে যখন খোলামেলা যানজটহীন রাস্তায় হাসতে হাসতে ছুটে চলে, তখনই মেলার আনন্দ আর উৎকর্ষ প্রকাশিত হয় চোখের নিমিষে। বই মেলা হয়ে ওঠে আনন্দের মেলা।

মেলা ঘিরে শুধু যে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমুহ ব্যস্ততম সময় কাটান তা নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক কাগজ-কালি ব্যবসায়ী, পেশাজীবী মানুষ, প্রুফ রিডার এবং ছাপাখানার অসংখ্য কর্মী। তবে অনেক প্রয়োজনীয় হচ্ছে বই বাঁধাই প্রতিষ্ঠান। বই ছাপা হলে চলবে না, বাঁধাইয়ের কাজ সমাপ্ত না হলে বই আর বাজারে আসবে না। তাই বই বাঁধাই প্রতিষ্ঠান ও তার কর্মী বাহিনী অধিক মাত্রায় ব্যস্ত ও মূল্যবান হয়ে ওঠে। অনেক সময় কাজ চলে সারা রাত ধরে।

তবে বাঁধাই শিল্পে অনেক নতুন প্রযুক্তি এসেছে যা অতি অল্প সময়ে এবং আকর্ষণীয়ভাবে এই শিল্পকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। বাঁধাইয়ের মূল্যও বেড়েছে এবং সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে বইয়ের দাম।

এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ ও অতিপ্রয়োজনীয় ব্যক্তি হচ্ছেন প্রচ্ছদশিল্পী। প্রতিটি বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে ছবি আঁকেন একজন শিল্পী। বাংলাদেশে এমন প্রচ্ছদশিল্পী আছেন যারা প্রচুর নাম করেছেন এবং তাদেরকে নিয়ে চলে রীতিমতো কাড়াকড়ি। তবে আরও অধিক এমন শিল্পী থাকলে প্রকাশনা শিল্প আরও প্রসার লাভ করার সুযোগ পেত। সহজ কথা হচ্ছে, প্রকাশনার এই জগতে প্রচুর কর্মী, অনেক শিল্পী এবং মূল্যবান অনেক ব্যক্তির সম্পৃক্ততা থাকে। তাদের সময় ও স্বল্পতার কারণে অনেক সময় বইয়ের দাম যায় বেড়ে।

এতদসত্বেও, বিদেশে বাংলাদেশের বইয়ের প্রচুর প্রশংসা শুনেছি। যেমন প্রচ্ছদ, তেমনি ছাপা এবং আকর্ষণীয় বাঁধাই। বাংলাদেশের অনেক বই যে কোনো দেশের বইয়ের সঙ্গে তুলনীয় ও উন্নতমানের। তাই অনেক দেশে ব্যাপক প্রশংসা লাভ করেছে। তবে বর্তমানে এমন অবস্থা হয়েছে যে, সারা বছর খুব কম বই প্রকাশিত হয়, প্রকাশকগণ অপেক্ষা করে থাকেন মহান একুশের গ্রন্থ মেলার প্রতি।

অমর একুশে গ্রন্থ মেলায় শুধু বাংলাদেশের শহর ও গ্রামের বইপ্রেমিরা সমবেত হন তা-ই নয়, বিদেশে অবস্থানকারী প্রচুর বাংলাদেশি চলে আসেন মেলায় যোগদান করতে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্প-গুজবে সময় কাটাতে। আবার এই সময় আমেরিকা এবং ইউরোপের প্রচণ্ড বরফে ঢাকা থাকে বলে তারা বেশিরভাগই বাংলাদেশে চলে আসেন বসন্তের মধুর হিমেল হাওয়া উপভোগ করতে। একই সঙ্গে তাদের উর্পাজনের কিছু অর্থ খরচ করে সহপাঠী ও বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দের অংশীদার হতে। এ বছরও প্রায় ২৭ জন বিভিন্ন দেশের কবি-সাহিত্যিক শুরুতেই যোগ দিয়েছেন একুশের গ্রন্থ মেলায়।

অমর একুশে গ্রন্থ মেলা শুধু বই বেচাকেনার মেলা নয়, এ হচ্ছে বাঙালিল আবেগের আর আনন্দের মিলনমেলা। নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়ার মেলা। তাই সকল স্তরের এবং সকল বয়সের মানুষের মিলন ঘটে একুশের বই মেলায়। তবে এ কথা সত্যি যে, বর্তমানে ইন্টারনেটের প্রভাবের ফলে বই পড়ার প্রতি আকর্ষণ যেমন কমে যাচ্ছে তেমনি মুদ্রণশিল্পেও ভাটা পড়েছে। তারপরও অনেকেই মনে করেন, মুদ্রিত বইয়ের আর্কষণ থাকবে চিরকাল এবং গ্রন্থ মেলার পরিধি ও বেচাকেনাও বাড়বে বছরের পর বছর ধরে অধিক হারে।

বই পড়ে জ্ঞানের ভুবনে বিচরণ করলে বিপথগামিতা থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে তা-ই নয়, উগ্রবাদের অনুসরণ থেকে পরিত্রাণ পেতে তরুণ প্রজন্মকে সাহায্য করে। জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের কালো ছায়ামুক্ত বুদ্ধির চর্চার কাছে হয় দূরীভূত। বই পড়ে জ্ঞান অন্বেষণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সত্য ও সুন্দরের বার্তা, জাগ্রত হয় মমত্ববোধ, সৃষ্টি হয় সম্প্রীতির ভাবনা। আর বিকাশ ঘটে অসাম্প্রদায়িক চেতনার।

যা অমর একুশে বই মেলার অমূল্য অবদান।