লক্ষ লক্ষ গোলাম আযম বাংলা ভাই তৈরির নতুন বই!

রণেশ মৈত্র
Published : 18 Jan 2017, 06:11 AM
Updated : 18 Jan 2017, 06:11 AM

শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদকে চিনতাম যেভাবে, তেমনটি তিনি আর নেই বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। মুখ খুললেন বটে কিন্তু মুহূর্তেই আবার মুখে কুলুপ আঁটলেন। শুধুমাত্র এটুকু সাংবাদিকদেরকে ডেকে বললেন, বই-পুস্তকে কদাপি ভুল থাকবে না এমন কথা তিনি কখনও বলেননি। ভুল যা হয়েছে তা অনুসন্ধান করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেগুলি শোধরানো হবে।

কিন্তু নতুন পাঠ্যক্রমে শিক্ষার যে সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হয়েছে তা তিনি নাকচ করে দিয়ে দাবি করেছেন, হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনে নয় বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন ঘটাতেই পাঠ্যক্রমে সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে।

এমন দাবি শুধুমাত্র মিথ্যাচারই নয় বরং সাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার পক্ষে উলঙ্গভাবে সাফাই গাওয়া। যার ফলে মুক্তিযুদ্ধের চিহ্নিত এবং প্রমাণিত শত্রু হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র শিবির, চরমোনাইএর পীরসহ সকল সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির দাবির কাছে সরকারের নতি স্বীকার করার বিষয়টি বোঝা গেল।

মন্ত্রী মহোদয়ের কথাবার্তায় মানুষকে বোকা ও মূর্খ বলে বিবেচনা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সত্য অস্বীকার করেছিল নিজামীর মতো উগ্র সাম্প্রদায়িক বিএনপি নেতৃত্বাধীন মন্ত্রী। বলেছিল, "বাংলা ভাই নামে কোনো কিছুর বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। ওটা মিডিয়ার সৃষ্টি।"

এখন সুস্পষ্ট ভাষায় যদি মন্ত্রী মহোদয়কে প্রশ্ন করি, পাঠ্যপুস্তক থেকে রবীন্দ্রনাথের 'বাংলাদেশের হৃদয় হতে' কেন উধাও হল? কেন এবং কাকে খুশি করার জন্য হুমায়ুন আজাদ, রণেশ দাশগুপ্ত প্রমুখ বরেণ্য সাহিত্যিক, লেখকের লেখাগুলি উধাও করে দেওয়া হল? তাঁরা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা লিখেছিলেন এবং সেগুলি তাহলে এতকাল পাঠ্যবইতে কোন বিবেচনায় স্থান পেয়েছিল?

প্রতি বছর পহেলা জানুয়ারিতে নতুন বই শিশুদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। জনগণের টাকায় এসব বই ছেপে কোমলমতি শিশুদের মধ্যে বিষ ছড়ানোর, কুশিক্ষা দিয়ে তাদের মন কলুষিত করার অধিকার মন্ত্রী বা সরকারকে জনগণ দেয়নি।

বাংলাদেশের ৮৫ জন বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ১০ জানুয়ারি সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে অবিলম্বে ঐ পাঠ্যবইগুলি প্রত্যাহার করে করে নেওয়ার যে দাবি তুলেছেন, বলিষ্ঠ উচ্চারণে সুদূর অষ্ট্রেলিয়া থেকে সেই দাবির সঙ্গে পরিপূর্ণ সংহতি প্রকাশ করে বলছি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-আদর্শের পরিপূর্ণ বিরোধী ঐ সিলেবাস যাঁরা প্রণয়ন করেছেন, যাঁরা তা অনুমোদন করেছেন, যাঁরা তার সাফাই গাইছেন– তাঁরা স্বেচ্ছায় ও ঠাণ্ডা মাথায় পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেকই তা করেছেন। তাই অবিলম্বে তাদের সবার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে সুস্পষ্ট মোকদ্দমা দায়ের করে সকলকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হোক।

মনে রাখা প্রয়োজন যে, দেশ স্বাধীন করা হয়েছিল নিরন্তর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে করতে– অবশেষে একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য। এই নীতিমালা কলুষিত হতে কদাপি দেওয়া যাবে না। তেমন যে কোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে জনগণ সক্রিয়ভাবে মাঠে নামতে বাধ্য হবে।

খবরটি জানতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি যে, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই আন্দোলনে নেমেছে। বস্তুত এ আন্দোলন ধীরে ধীরে অত্যন্ত জনপ্রিয় আন্দোলনে পরিণত হবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস। তাই আশা করব, ছাত্র ইউনিয়ন ও দেশের ছাত্রসমাজ এই আন্দোলন ধাপে ধাপে বেগবান এবং সাধারণ ছাত্র ও অভিভাবক-সম্পৃক্ত আন্দোলনে পরিণত করতে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করবে। ওয়ার্কার্স পার্টির ছাত্র সংগঠন ও জাসদ ছাত্রলীগও যদি এই আন্দোলনে যুক্ত হয়, সে ব্যাপারে সকল সংকীর্ণতা পরিত্যাগ করে– ছাত্র ইউনিয়ন ধৈর্যের সঙ্গে চেষ্টা চালিয়ে যাবে। দূর থেকে এই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে সংহতি স্থাপন করছি।

এছাড়া এই মুহূর্তে সরকার-বহির্ভূত সকল গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল দলগুলির আন্তঃকর্তব্য, ইস্যুটিতে প্রাধান্য দিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নেমে পড়া। শুধুমাত্র ঢাকা শহরে নয়, এ আন্দোলনের বিস্তার দেশব্যাপী ঘটানো অত্যন্ত জরুরি।

আমরা যে যা-ই ভাবি না কেন এবং শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদেরকে যাই বলুন না কেন বাস্তুব হল এই যে, কোমলমতি শিশুদেরকে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে হেফাজতে ইসলাম যে সকল দাবি বারবার জানিয়ে আসছিল, ২০১৭ সালের পাঠ্যপুস্তকে তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বই থেকে মাধ্যমিক স্তরের বইগুলোতে ঐ দাবিগুলির বেশিরভাগই মেনে নেওয়া হয়েছে। এটি একটি সুচিন্তিত চক্রান্ত। দেশকে পাকিস্তানিকরণের দিকে এগিয়ে নিতে নানাবিধ উদ্যোগের মধ্যে এটিকেই বলা চলে ২০১৭ সাল নামক নতুন বছরের শুরুতে সরকারপ্রদত্ত 'নববর্ষের উপহার'।

সরকার যদি এমন একটি সাম্প্রদায়িক শিক্ষাকার্যক্রম সিলেবাসের পরিবর্তনের মাধ্যমে চালু করতে সক্ষম হয় তখন বাস্তবে মাদ্রাসাগুলির সঙ্গে বাংলা স্কুলগুলির মৌলিক পার্থক্য থাকবে না। অবশেষে বাংলা ভাষা ধীরে ধীরে অপসারণ করে আরবি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যমে হিসেবে দাঁড় করানোর দাবিও জোরদার হয়ে উঠবে হেফাজত ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে।

যদিও প্রায়শই জামায়তের নানা পর্যায়ের নেতা-কর্মীদেরকে গ্রেফতারের খবর আমরা পত্রপত্রিকায় দেখে থাকি, ঘটনা কিন্তু এমনই যে, তাদের একজনেরও বিচার বা শাস্তিদানের খবর আদৌ চোখে পড়ে না। এতে ধরে নেওয়া যায় যে, অল্প কিছু দিন জেলখানায় আটক রেখে পরে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। গ্রেফতার-বাণিজ্যও যে ঘটছে না তাই-বা বলা যাবে কেমন করে?

বহু জেলাতেই জামায়াতের হাজার হাজার কর্মী-নেতা ইতোমধ্যে নেতাদের হাতে পুস্পস্তবক উপহার দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে। তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান প্রভৃতি পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ীও হয়েছে। এখন তাদেরকে 'বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সেরা সৈনিক' হিসেবেও আওয়ামী লীগের অনেকে দাবি করেন বলে শুনি।

জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপি যেমন জোটবদ্ধ তেমনই আবার আওয়ামী লীগের সঙ্গেও তার গোপন হৃদ্যতার সম্পর্ক অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। এ কারণেই উচ্চ আদালতের এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা থাকা সত্বেও দলটিকে সরকার কিছুতেই বেআইনি ঘোষণা করছে না। আইন মন্ত্রী তো বহুবার শুনিয়েছেন জামায়তে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণার লক্ষ্যে দলটির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করা হবে। সে কারণে তাদের যাতে দল হিসেবে বিচার করা যায় সেই লক্ষ্যে নতুন একটা আইন প্রণয়ন করে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো হয়েছে। অতঃপর তিনি অনুমোদন দিলে খসড়াটির মন্ত্রিসভায় পেশ করা হবে। সেখানে অনুমোদন পেলেই আইনটি সংসদে পেশ করা হবে।

অন্তত একটি পুরা বছর অতিক্রান্ত হলেও ঐ আইনের কী দশা দাঁড়িয়েছে সে সম্পর্কে সরকারি দলের কারও মুখে টুঁ শব্দটি নেই।

হেফাজতে ইসলাম তো 'এই সরকার ভালো' বলে সার্টিফিকেট দিয়েই বসেছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে যে পাঠ্যবই ২০১৭ সালে সরকার বিলি করেছে তার জন্যে জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম সরকারকে দিব্যি প্রশংসাও করেছে।

এখন এই বিষয়গুলি সকলের এতটাই জানা যে, আর নূতন করে কিছু উল্লেখের বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই।

এবারে দেখা যাক মেয়েদের ক্ষেত্রেই বা এই পাঠ্যবইগুলো কেমন প্রভাব ফেলতে চলেছে। দেখা যাচ্ছে অক্ষর পরিচিতির ক্ষেত্রে 'ও' তে 'ওড়না চাই' লেখা আছে। আগেও না কি ছিল, শিক্ষমন্ত্রী জানিয়েছেন। কিন্তু 'ও' অক্ষরটি চেনানোর জন্য 'ওড়না'র উল্লেখ থাকা কি আদৌ সঙ্গত? ওড়না বাধ্যতামূলক করার কি এটি একটি প্রক্রিয়া? তৃতীয় বছরের অর্থাৎ ৭/৮ বছরের শিশুকন্যাদেরকে মা-বাবার কাছে 'ওড়না চাই' শিখিয়ে তার চাহিদা সৃষ্টির উদ্দেশ্যই-বা কী? আবার ছেলেরাই-বা 'ওড়না চাই' বলবে কেন? 'ওড়না চাই' থেকে শেষ পর্যন্ত 'শ'তে শিক্ষা চাই না, এমন দাবি মেয়েদের দিয়ে তোলানো হবে।

এখন তো দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে যে, প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক কবি, সাহিত্যিকদের লেখা গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা উঠিয়ে দিয়ে 'হিন্দু-নাস্তিকবিরোধী' সাম্প্রদায়িকতার বিষ তাদের মনে ঢুকানোর প্রচেষ্টা চলছে। যার অর্থ বুঝতে কারও আদৌ অসুবিধা হবে না। এগুলি আসলে বিএনপি-জামায়াত সরকার করেছিল। কিন্তু তারপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে যে শিক্ষা কমিশন গঠন করে ঐ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রগতিশীল শিক্ষানীতি প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন কি সরকার-অনুসৃত শিক্ষানীতিতে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের ক্ষেত্রে পরিস্ফুট হচ্ছে?

সামান্য পিছন ফিরে তাকালেই দিব্যি চোখে ভেসে ওঠে নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জ, পাবনার বনগ্রাম, হেমায়েতপুর,রামুর বৌদ্ধবিহার, দিনাজপুরের চিনিরবন্দর, যশোর, সাতক্ষীরার বেদনার্ত দৃশ্যগুলি। ২০০১এর নির্বাচনকালীন ঘটনাগুলিও। বিচার কি হল এ যাবত একটি ঘটনারও? ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা দ্রুত কেন এত কমে যাচ্ছে তা কি সরকারের কোনো মহল সামান্যতম ভাবছেন?

এসব লিখতে লিখতে হয়রান হয়ে গেলাম। কিন্তু জবাবও নেই। আবার ঘটনাগুলি বন্ধ হওয়ার সামান্য লক্ষণটুকুও নেই।

কেন রসরাজ নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া সত্বেও মাসের পর মাস জেলে থাকছে আর কেনই-বা পাবনার চাটমোহরের শিক্ষক একই রকমের ঘটনা ঘটিয়েও থানা থেকেই মুক্তি পেয়ে যায়– এগুলি কি আদৌ দুর্বোধ্য?

পরিণতি ভয়াবহ। এই শিক্ষাক্রম চালু হলে রবীন্দ্রনাথ বাদই দিলাম, আর কোনো নজরুল, কোনো শামসুর রাহমান, রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ জন্ম নিতে পারবেন না। মুক্তচিন্তার দরজা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে।

আর জন্ম নেবে অবাধে লক্ষ লক্ষ গোলাম আযম, বাংলা ভাই। আমাদের যাত্রা কি সেই পথেই? প্রশ্নটি সরকারের কাছে যতটা না তার চাইতে অনেক বেশি করে রাখছি ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী লক্ষ লক্ষ মুসলিম বন্ধুর কাছে। আর কতদিন চুপচাপ বসে থাকবেন তাঁরা। দেশ আফগানিস্তান-সিরিয়ার মতো হওয়ার দিকে দিকে ধাবিত হচ্ছে। তবু কি চোখ বন্ধ করে থাকবেন?