বাড়িভাড়া বৃদ্ধি ও নগরবাসীর ভোগান্তি

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 3 Jan 2017, 08:03 AM
Updated : 3 Jan 2017, 08:03 AM

শহরমুখী অভিবাসন বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাড়িভাড়া এবং বাড়িওয়ালাদের খেয়ালখুশি মাফিক ভাড়া বৃদ্ধির প্রবণতা। সাধারণ কর্মজীবী মানুষের উপার্জনের অর্ধেক চলে যাচ্ছে বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে।

রাজধানী ঢাকাতে ২০১৬ সালে বাড়িভাড়া বেড়েছে গড়ে ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ, নিত্যপণ্যের তুলনায় এ বৃদ্ধির হার দেড় থেকে দ্বিগুণ। নিম্ন ও মধ্য আয়ের লোকজনের জন্য প্রাণান্তকর অবস্থা; একেবারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তাই বাড়িভাড়া একটি বড় ধরনের নাগরিক সমস্যা হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে।

'কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ' (ক্যাব)-এর হিসাবে ঢাকা শহরে বাড়িভাড়া বিগত ২৫ বছরে বেড়েছে ৩৮৮ শতাংশ। ক্যাবের হিসাবে রাজধানীতে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষ বসবাস করে ভাড়াবাড়িতে।

বেশি ভাড়া বেড়েছে টিনশেডের বাড়িতে; প্রায় ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। বস্তিতে বেড়েছে প্রায় ৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ। তারপর আছে গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি। স্বল্প ও মধ্য আয়ের লোকজনদের যাদের নিজস্ব নিবাস নেই, তাদের জীবনযাত্রা দুঃষহ হয়ে উঠেছে। শহরে থাকা হয়ে উঠেছে নিতান্তই কঠিন, অথচ থাকতে হবে। স্বল্প আয়ের জনগণ অত্যন্ত বিব্রত ও বেসামাল হয়ে পড়েছে। অনেকে ভাবছে পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে কোথাও গিয়ে কোনোভাবে থাকবে। কিন্তু তারও উপায় নিতান্তই সীমিত, পরিবার ছাড়া বিবাহিতদের ভাড়া পাওয়া আরও কঠিন। ভাড়াটিয়াদের সব তথ্য দিতে হবে সংশ্লিষ্ট থানায়।

স্বল্প আয়ের লোকজন চোখের জল ফেলছে, কিন্তু প্রতিকার পাচ্ছে না। বাড়ির মালিকেরা সংঘবদ্ধ, তাদের বাড়ি নির্মাণে অধিক ব্যয়ের কথা তুলে ধরছে গণমাধ্যমে, আদালতে এবং সুধীমহলে। কিন্তু ভাড়াটিয়ারা লজ্জায় মুখ খুলছে না, নিষ্ফল অভিযোগ করছে এখানে-সেখানে; কোন কর্তৃপক্ষ এর প্রতিকার দেবে, জানা নেই অনেকের।

প্রচলিত আইন হচ্ছে 'প্রিমিসেস রেন্ট কন্ট্রোল অ্যাক্ট, ১৯৯১' (Premises Rent Control Act, 1991, Act No- 3) যার অধীনে একটি 'স্টান্ডার্ড রেন্ট' নির্ধারণের নিয়ম প্রচলিত আছে। কিন্তু কোন কর্তৃপক্ষ তা নির্ধারণ করবে বা কীভাবে এ জাতীয় বিরোধের মীমাংসায় উপনীত হতে হবে, এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার দুর্ভিক্ষ চলছে, সুরাহার কোনো উপায় নেই। এই আইনে বাজার মূল্যের ১৫ শতাংশের অধিক ভাড়া দেওয়ার বিধান নেই। কিন্তু কোথাও তার প্রয়োগ হচ্ছে না দেখে ভুক্তভোগীরাসহ মানবাধিকার সংস্থা ও কর্মীরা এর বিরদ্ধে সোচ্চার।

তাই দেখা যায়, ২০১৫ সালের ২ জুলাই মাননীয় বিচারপতি বজলুর রহমান এবং মাননীয় বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস একটি ভোক্তা অধিকার সংস্থার আবেদনের প্রেক্ষিতে ৬ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণের লক্ষ্যে সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিশন গঠনের সরকারকে নির্দ্দেশ দেন। তার কোনো প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়নি।

অনেকে মনে করেন, বাড়িভাড়া সংক্রান্ত বিষয়াবলী হচ্ছে জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব। জেলা প্রশাসনের পক্ষে এ মহানগরীতে এ জাতীয় বিশাল অধিক্ষেত্র বিস্তৃত একটি আইন বলবৎ করা বা তার নিয়মিত তদারকি করা অথবা এ আইনের আওতায় অভিযোগ গ্রহণ করে তার সুরাহা করা এক জটিল কর্মকাণ্ড। তদুপরি 'মেট্রোপলিটন সিটি' হওয়ার পর জেলা প্রশাসকের এখতিয়ার কতটুকু আছে মহানগরীতে তাও বিবেচ্য। এ জন্য কোন মন্ত্রণালয় বা অধিদফতর দায়ী থাকলে এ ব্যাপারে কোনোকিছু দৃশ্যত উল্লেখ নেই।

এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য হচ্ছে, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেমন: কোনো ভাড়াটিয়া যদি ভাড়া দিতে না চায় অথবা কোনো মালিক যদি কোনো সুপ্ত কারণে ভাড়া গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করে, অথবা কিছু পরিমাণ ভাড়া ব্যাংক অথবা কিছু ভাড়া নগদ নিতে চায় তখন কীভাবে সুরাহা হবে। ভাড়াটিয়ার ঘর থেকে বের হওয়া বা চলাচলের পথ সুগম না হয় এবং এ নিয়ে যদি বিরোধ বাঁধে, তবে এ বিরোধ মীমাংসার পদ্ধতি কী হবে। এ ব্যাপারে আইনে উল্লেখ আছে, কিন্তু প্রয়োগের ব্যাপারে আরও স্পষ্টতার দাবি রাখে।

এসব ছাড়াও বাড়ির মালিক যদি প্রিমিয়াম বা সালামি দাবি করে অথবা অনেক বছরের ভাড়া অগ্রিম দাবি করে অথবা ভাড়ার চুক্তি বহাল থাকা অবস্থায় ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করতে জোর করে এবং বেআইনি পন্থা অবলম্বন করে, তখন কী হবে। এ ছাড়া বিলম্বে ভাড়া পরিশোধ করলে বা অনাবশ্যকভাবে বিলম্ব করলে, জরিমানা দিতে হবে কি না, যদি দিতে হয় তবে কত হারে তা হবে, এ জাতীয় বিষয়াবলীর সুরাহার পথ ও পন্থা বলতে হবে।

এসব কারণে দাবি উঠেছে এই আইনের অধীনে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করা, কিন্তু তা হচ্ছে না। অনেকে বলছেন বাড়ির মালিকেরা ক্ষমতাশালী, রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাই তাদের কণ্ঠস্বর অনেক উঁচুতে।

কিছুদিন আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে 'ভাড়াটিয়া পর্ষদ' নামক একটি সংগঠন অনেক লোকের স্বাক্ষর নিতে শুরু করে। তারা এ ব্যাপারে ১৫টি দাবিও সরকারের কাছে উত্থাপন করে। দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, বাড়িভাড়া আইন সহজতর ও অধিক গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করতে হবে।

তাদের অভিমত বাড়িভাড়ার বিষয়টি এখন একটি সামাজিক সমস্যা নয়, একটি বৃহৎ জাতীয় সমস্যা হিসেবে রূপ লাভ করেছে।

দ্বিতীয়ত, তারা উল্লেখ করেছে, প্রত্যেক ভাড়াটিয়াকে বাড়ির মালিককে ভাড়ার রসিদ দিতে হবে।

বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ এ কারণে যে, এর সঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়টি জড়িত, যাকে বলা যেতে পারে সুশাসনের অঙ্গ। তদুপরি, বাড়ির মালিক এ জন্য আয়কর পরিশোধ করেন কি না অথবা সরকারের রাজস্ব ফাঁকি ও অবৈধ অর্থের উৎস জড়িত আছে কি না, এর সঙ্গে তা দেখার প্রয়োজন আছে। তদুপরি যিনি বাড়ির ভাড়া গ্রহণ করছেন তিনিই বাড়ির মালিক কি না, এ বিষয়টিও সম্পৃক্ত আছে। তবে আইনের ১৩ নং অনুচ্ছেদে বাড়ি ভাড়ার রসিদ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হলেও অনেকেই তা সবক্ষেত্রে প্রতিপালন করছে না বলেই এ বিরোধ ব্যাপক আকার ধারণ করছে দিনের পর দিন।

এ ছাড়াও প্রচলিত আইনে 'রেন্ট কন্ট্রোলার'-এর কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু প্রত্যেক ওয়ার্ডে রেন্ট কনট্রোলার আছে কি না, থাকলে কোথায় তার অবস্থান অনেকেই জানেন না। সরকার বা কর্তৃপক্ষ জনগণকে অবহিত না করলে জনগণ জানবে কেমন করে? ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রেভিনিউ অফিসার একবার এ জাতীয় প্রশ্নের জবাবে জানান যে, সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব বিভাগ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। তিনি সঠিক বলেছেন।

অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং যোগাযোগের সুবিধাজনক অবস্থানে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির কোনো হিসাব নেই, দরাদরিও নেই। ছেলে-মেয়েদের স্কুল বা কর্মস্থলের কাছাকাছি বাড়ি হলে কোনো দরকষাকষির সুযোগও গ্রহণ করে না আগ্রহী ভাড়াটিয়ারা। অবস্থার শিকার হয়ে বেশির ভাগ ভাড়াটিয়া অধিক মূল্য দিতেও রাজি থাকে। অন্যতম কারণ হচ্ছে, চলাচলের দুর্যোগ ও বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা পাওয়া।

কিন্তু কী হারে বাড়িভাড়া বাড়তে পারে এবং কোন স্থানে কত ভাড়া হতে পারে, এ ব্যাপারে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করতে হবে সরকারকে। বাড়ির মালিকেরা বলছে, বাড়ি তৈরির খরচ বেড়েছে অনেক। রক্ষণাবেক্ষণও ব্যয়বহুল। কোনো প্রকার মেরামতের প্রয়োজন হলে অনেক খরচ। ভাড়াটিয়ারা ভুলেও বাড়ির যত্ন নেয় না।

পক্ষান্তরে ভাড়াটিয়ারা বলছে, বাড়ির মালিক নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করে, কিন্তু কোনো সার্ভিস দেয় না। অনেক সময় পরিচ্ছন্নতার বিষয়টির প্রতিও সঠিক নজর দেয় না বাড়ির মালিক।

খেয়াল রাখতে হবে, বর্তমানে প্রচলিত 'প্রিমিসেস রেন্ট কন্ট্রোল অ্যাক্ট, ১৯৯১' জারি হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে। জনগণের অভিযোগ বা তাদের অভিমত এ আইনে স্থান পেয়েছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে না। তদুপরি, কাদের স্বার্থে বা তদবিরে এ আইন তখন প্রণীত হয়েছিল তা-ও বোঝা যাচ্ছে না সঠিকভাবে।

এ ছাড়া বিগত কয়েক বছরে নাগরিক জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে, নগরমুখী অভিবাসন বেড়েছে ব্যাপক হারে, বাড়ছে বস্তি, সঙ্গে অসামাজিক কর্মকাণ্ড। তাই এখন আর বিলম্ব নয়, বিষয়টিকে দেখতে হবে নগর জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভাবনায় রেখে, সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘব করার লক্ষ্যে।

বাড়িভাড়া-সংক্রান্ত বর্তমান আইনের অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। বাড়িভাড়া বিষয়ক আইন ও বিধিমালার পুনর্বিন্যাস করে জবাবদিহিতার একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে জরুরিভাবে। সুশাসনের অর্থ শুধু রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ নয়। যেসব বিষয় আইনশৃঙ্খলার জটিলতা সৃষ্টি করে সেসবও নির্মূল করতে হবে।

সরকারকে দৃশ্যমান করতে হবে– সরকার জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর; কথায় নয়, কাজে।