‘জাহান্নামের খেলা’ এবং আমাদের মুক্তি

দেবপ্রসাদ দেবু
Published : 17 Nov 2016, 03:49 AM
Updated : 17 Nov 2016, 03:49 AM

ধর্মীয় সহিংসতা এখন বিশ্বব্যাপী একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং সেই সঙ্গে 'বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি' হিসেবে পাওয়া 'পলিটিকাল ইসলাম'-এর ভয়ঙ্কর রূপ যখন বিশ্ববাসীকে প্রতিনিয়ত অতিষ্ঠ করে তুলছে আইএস, আল-কায়দা এসব নাম নিয়ে, তখন সেটার 'বাই প্রডাক্ট' হিসেবে স্থানীয়ভাবেও জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান আমরা প্রত্যক্ষ করছি দেশে দেশে। সেই জোয়ারের সঙ্গে মিল রেখে আমাদের দেশেও আবর্জনা থেকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে সাম্প্রদায়িক সমস্যা।

বিষয়টি এমন না যে এই অঞ্চলে আগে কখনও সাম্প্রদায়িক সমস্যা ছিল না। ছিল এবং ভালোমতোই ছিল; কখনও সুপ্ত অবস্থায়, কখনও আধো জাগরণে। এটা অনেকটা "শুকনো কাঠের চেলার মতো শুকনো মাটির ঢেলা, আগুন পেলেই জ্বলবে হেথা জাহান্নামের খেলা"-এর মতো।

সাম্প্রদায়িক মানুষ সুযোগের অপেক্ষায় থাকে 'জাহান্নামের খেলা' শুরু করার জন্য।

ভারত উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস বেশ পুরনো। তবে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, ১৯৪০ সালের আগে যেসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল সেগুলো সংগঠনে কোনো রাজনৈতিক দলের ইন্ধন বা রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল না; সেসব ছিল গোষ্ঠীগত বা সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্বের ফসল। কিন্তু এর পরের হামলাগুলোতে আমরা লক্ষ্য করি রাজনীতি জড়িয়ে পড়েছে প্রবলভাবে। আগে তো বটেই, ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসেও কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়েছিল। এ ছাড়া ১৯২৩ থেকে ১৯২৭ সালে উত্তর প্রদেশে ৯১টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গরু কোরবানি কিংবা মসজিদের সামনে বাজনা বাজানো নিয়ে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। ১৯২৪ সালের সেপ্টেম্বরে কোহাটে দাঙ্গা হয়, মৃত্যুবরণ করে ১৫৫ জন। ১৯২৬ সালের এপ্রিল-জুলাই মাসে মারা যান ১৩৮ জন। ১৯২৬ সালে ঢাকা, পাটনা, রাওয়ালপিন্ডি এবং দিল্লিতেও দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। (সূত্র: মডার্ন ইন্ডিয়া, সুমিত সরকার; মানুষের বিভেদ ও ঐক্য: সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গ, আনু মুহাম্মদ)

এত সব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরও সেই একই হিন্দু-মুসলমান ১৯৩০ সালে ব্রিটিশবিরোধী আইন অমান্য আন্দোলনে একসঙ্গে পথ চলেছে। সেই একই হিন্দু-মুসলমান সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছে, 'কমন শত্রু' হিসেবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থেকেছে।

কিন্তু ১৯৪০ সাল নাগাদ দৃশ্যপটে বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস যখন থেকে বুঝতে পারল ব্রিটিশদের চলে যাওয়া আসন্ন, তখন থেকেই সাম্প্রদায়িক সমস্যাগুলোর রাজনৈতিক ব্যবহার শুরু করে তারা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের চেয়েও ভারত ভাগের ইস্যু কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার ইস্যু তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষায়–

কংগ্রেস এমন ভান করেছিল যেন হিন্দু-মুসলিম সমস্যা বড় কোনো সমস্যা নয়, বৃহৎ অর্থে সবাই ভারতীয়। কমিউনিস্টরাও তখন সঠিক রাজনীতি করতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলে সোভিয়েতের সঙ্গে ব্রিটিশরা একই ফ্রন্টে যুদ্ধে করছিল বলে কমিউনিস্টরা ক্ষণিকের জন্য ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নিজেদের স্থগিত রাখে। ফলে স্বরাজ আন্দোলনের দৃশ্যপটে জনগণের কাছে অধিকতর কাছের হয়ে উঠে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ। ফলে এই দুই দলের রাজনীতিতেই মানুষ সায় দিয়েছে বা মেনে নিয়েছে। ফলে দেশভাগের রাজনীতিও তারা এগিয়ে নিয়েছে নিজের হিসাব মতো।

অন্যদিকে কংগ্রেস কিংবা মুসলিম লীগ যে রাজনীতি করছিল হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে নিয়ে, সেটিতে সায় ছিল না নেতাজী সুভাষ বসুর। তিনি চেয়েছিলেন রাজনীতিতে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে নীতির ভিত্তিতে, ধর্মের ভিত্তিতে নয়। তাই সব ধর্মকে নিয়ে মিলেমিশে প্রার্থনা সংগীতের মতো একটি গানের রিহার্সাল শুনে নেতাজী খুব ক্ষেপে গিয়েছিলেন। তিনি প্রার্থনা সংগীত শুনে বলেছিলেন–

"তোমরা ওদের ধর্মের নামে এক করতে চাও? তাই যদি হয়, তাহলে একদিন ধর্মের নামেই ওরা আবার আলাদা হয়ে যাবে।" (নেতাজীর সঙ্গে: আবিদ হাসান)

আমরা স্মরণ করতে পারি, ধর্ম ও রাজনীতি কিংবা ধর্ম ও রাষ্ট্রকে স্বতন্ত্র যায়গায় রেখে রাজনীতি করেননি বলে মহাত্মা গান্ধী হিন্দু মহাসভাপন্থীদের সুবিধা করে দিয়েছিলেন এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি আকুলতা নিয়ে, কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসা গান্ধীও একসময় হিন্দু মহাসভাপন্থীদের হাতেই জীবন হারিয়েছেন। এই হিন্দু মহাসভাপন্থীদের সৃষ্টিই হয়েছিল ইসলামী জাতীয়তাবাদের 'কাউন্টার' শক্তি হিসেবে।

আমরা দেখতে পাই উপমহাদেশের ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসেবে সেঁটে আছে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টের জঘন্যতম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সেদিন 'ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে' বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু কার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ছিল? কিসের জন্য? ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে? না। না বলেই পাশার দান দেনেওয়ালাদের একজন, খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেছিলেন, "আমাদের সংগ্রাম ইংরেজের বিরুদ্ধে নয়, আমাদের সংগ্রাম হিন্দুদের বিরুদ্ধে।" (স্মৃতিকথা-৭, মোহাম্মদ তোয়াহা, মাসিক সংস্কৃতি, অক্টোবর ২০০০)

এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা মহাভারতের পাশা খেলার মতোই। খেলেছে উপরতলার লোকেরা, বলি হয়েছে সাধারণ মানুষ। বঙ্গভঙ্গ, দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা– সব ক্ষেত্রেই পাশার দান দিয়েছে তারা, ভুগেছে অন্যরা। ধরে নিলাম জিন্নাহ-নাজিমুদ্দিনরা সম্প্রদায়কে জাতি হিসেবে দেখে সম্প্রদায়ের স্বার্থ বড় করে দেখেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন দেখুন তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে–

"নাজিমুদ্দিন সাহেব নেতা নির্বাচিত হয়েই ঘোষণা করলেন, ঢাকা রাজধানী হবে এবং তিনি দলবলসহ ঢাকায় চলে গেলেন। একবারও চিন্তা করলেন না, পশ্চিম বাংলার হতভাগ্য মুসলমানদের কথা।"

এই ছিল তখনকার রাজনীতিতে পাশার দান দেনেওয়ালাদের মনোভাব বা কার্যকলাপ। সম্প্রদায়কে গুরুত্ব দিয়ে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা নিয়ে সেই সম্প্রদায়কেই বিপদে ফেলে আখের গুছিয়ে চলে গেছেন। অর্থাৎ খেলেছেন জিন্নাহ, নাজিমুদ্দিন, গান্ধী; ভুগেছে সাধারণ মানুষ। সেই ১৬ আগস্টের দাঙ্গায় প্রাণ হারায় প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ। ৭২ ঘণ্টায় আহত হয় এক লাখ সাধারণ মানুষ। দাঙ্গা ছড়িয়েছিল বিহার-নোয়াখালী এসব অঞ্চলে। ইংরেজরাও তখন টিপ্পনি কেটেছিল– "'ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে'তে যত মানুষ প্রাণ হারাল, সিপাহি যুদ্ধেও তত মানুষ মরেনি!"

১৬ আগস্টের দাঙ্গার পরে বিদায় নেন লাট ওয়াভেল, আসেন লর্ড মাউন্টব্যাটন। কমিউনিটি বা সম্প্রদায়কে 'জাতি' হিসেবে বিবেচনা করে 'দ্বিজাতি তত্ত্ব' হাজির হয়। ব্রিটিশদের পুরনো পলিসি 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' হয়ে উঠে 'ডিভাইড অ্যান্ড কুইট'। দেশ ভাগ করে তারা 'কুইট' করল।

'মুসলিম জাতি' (বাঙালি নয়) হিসেবে আমরা পড়লাম পাকিস্তানের ভাগে। দেশভাগের পর বহু হিন্দু ভারতে পাড়ি জমিয়েছে, বহু মুসলিম পাড়ি জমিয়েছে পাকিস্তানে। দেশত্যাগী মানুষগুলো সেদিন আরোপিতভাবে হলেও ভেবেছিল– "এই দেশটি আমার নয়!"

দেশবিহীন হল অগণিত মানুষ। তারা না হল ভারতের, না হল পাকিস্তানের; হয়ে গেল রিফিউজি। সেই যে দেশভাগ হল তাতে কি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বন্ধ হয়ে গেল? বয়ে কি চলেনি তা যুগের পর যুগ? যেসব কারণে দেশভাগ হয়েছিল বা ঘটানো হয়েছিল, সেসব কারণ কি এখন বিদ্যমান নেই? বা সেই পরিস্থিতি কি এখন বিরাজ করছে না? কিংবা যে পাকিস্তান আমরা ভেঙে 'সেক্যুলার বাংলাদেশ' গড়েছিলাম ১৯৭১ সালে, সেটা কি টিকে আছে এখনও?

আমরা কি দ্বিজাতি তত্ত্বের সৃষ্টি পীড়নমূলক একটি পাকিস্তান ভেঙে দুটো পাকিস্তান করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যাইনি? কিন্তু পরিহাসের বিষয় 'রিড বাংলাদেশ ফর পাকিস্তান' নামক যে 'রাবার স্ট্যাম্প' চালু ছিল স্বাধীনতার পর, সেই স্ট্যাম্পই বাস্তব আকার ধারণ করে বসে আছে আমাদের সোনার বাংলায়। পাকিস্তানের প্রেতাত্মা খুবলে খাচ্ছে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে। অবচেতনে সেঁটে যাওয়া পাকিস্তানি বাহিনীর গালি– "শালা মালাউনকা বাচ্চা, লুঙ্গি নিকাল"– আজ সচেতনভাবেই গণতান্ত্রিক দেশে মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে!

কিন্তু 'মেকি' সেক্যুলার রাষ্ট্র, 'ভেক ধরা' অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল মুখে কুলুপ আঁটে, শেকল পরে হাতে। ঘোলাটে টিনের চশমা খুলে বোঝার চেষ্টা করে না, কী ঘটছে সমাজে। আজও রাজনীতিতে দান দিতে পটু যারা তারা ঠিকই দান দিয়ে যাচ্ছেন সময়ে সময়ে। কেউ ধর্মীয় রাজনীতির নামে, কেউ 'মদিনা সনদ'-এর নামে, কেউ বা সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটানোর মাধ্যমে। ফলে কিছুদিন পর পরই ঘটে চলে রামু কিংবা নাসিরনগরের মতো ঘটনা। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় আমাদের বাঙালি ঐতিহ্যের সামাজিক কাঠামো।

অবশ্য এই সমাজ দেখার ফুসরত কই আমদের রাজনীতিকদের? তাঁরা ক্রমশ শক্তিশালী করে চলেছেন রাষ্ট্রযন্ত্রকে, লুটেরা পুঁজিকে। দুর্বল হয়ে যাচ্ছে সামাজিক সম্প্রীতি। সম্প্রীতি দুর্বল হলেই বাড়ে সামাজিক সমস্যা। দুর্বল সমাজ কাঠামোর রাষ্ট্রে সরকার চেষ্টা করতে পারে কেবল, সেটা হবে আরোপিত চেষ্টা। আখেরে ফলদায়ক কিছু হবে না। কিন্তু সমাজ শক্তিশালী হলে নিজেই সচেষ্ট হত সামাজিক অনাচার বন্ধে, সমস্যা সমাধানে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন–

"রাষ্ট্রপ্রধান দেশে রাষ্ট্রতন্ত্রের মধ্যেই বিশেষভাবে বদ্ধ থাকে দেশের মর্মস্থান; সমাজপ্রধান দেশে দেশের প্রাণ সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে থাকে।"

আমাদের রাষ্ট্র শক্তিশালী হওয়ায়, রাষ্ট্রপ্রধান দেশ হওয়ায় সামাজিক সমস্যা মাথাচাড়া দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। আবার রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে, ক্ষমতাকে শক্তিশালী করতেই সংবিধানের কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে 'সুপিরিওরিটি' দেওয়া হয়েছে একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে। সুতরাং সমাজে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে 'সুপিরিওরিটি কমপেক্স' থাকবেই।

আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলে মুক্তিযুদ্ধে গেলেও সেটাকে পুরোপুরি ধারণ করতে পারিনি। চেতনে-অবচেতনে আমাদের ধর্মীয় পরিচয়টি সামনে চলে এসেছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময়ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলার চেষ্টা করেছি– পাকিস্তানিরা মুসলমানদের মারছে। কিন্তু বলিনি বাঙালি মারছে। ভাবটা এমন ছিল যে ওরা প্রকৃত মুসলমান নয়, আমরাই প্রকৃত মুসলমান।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর দেওয়া বক্তৃতায় বলেছিলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে "পৃথিবীর দ্বিতীয় মুসলিম রাষ্ট্র।" সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযুক্ত করলেও দেশটাকে আমরা সেভাবেই দেখেছি, যেমনটা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হয়েও আমরা শিক্ষাব্যবস্থাকে এই গণ্ডি থেকে বের করে আনতে পারিনি। আমরা উৎসাহী হয়ে রাষ্ট্র নিয়ে চলে গেলাম ওআইসিতে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন করলাম রাষ্ট্রের উদ্যোগে, চালু রাখলাম ধর্মীয় শিক্ষা। এগুলো বঙ্গবন্ধুই করেছেন।

ধর্মকে বিরাষ্ট্রিকরণ বা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে রাখার বদলে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবেই তোষামোদি শুরু করলাম। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষায়–

আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ দাঁড় করালাম ধর্মের অবাধ চর্চা। কেউ কম তোষামোদি করলে কেউ বেশি করতেই পারে। যেটার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর। প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তি আরও বেশি করে ধর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে তোষামোদি করা শুরু করে। ফলাফল আজকের অরাজক পরিস্থিতি।

বঙ্গবন্ধুর দলও আজ দম নিয়ে, মেরুদণ্ড শক্ত করে বলতে পারে না– "আমরা ধর্মনিরপেক্ষ দল।" বড়জোর অসাম্প্রদায়িকতার ফাঁকা বুলি আওড়াতে পারে, কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষতা ভিন্ন জিনিস।

কিন্তু আমাদের সুযোগ ছিল। দেশের মাটি যথেষ্ট নরম ছিল গড়ে নেওয়ার জন্য, কিন্তু ভুল রাজনীতির যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে সেটা ইতোমধ্যে অনেকখানি শক্ত হয়ে গেছে। সময়ের চোরাগলিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও 'লাইসেন্স' পেয়ে গেছে। প্রায় সবগুলো দল ধর্মকে 'ইউজফুল' হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে প্রতিনিয়ত।

আমাদের উচিৎ ছিল শিক্ষাব্যবস্থা গণমুখী এবং সেক্যুলার করা। আমরা সেটা পারিনি। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বদলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কলকাঠি নাড়ার রাজনীতি, ধর্মীয় রাজনীতি। ব্রিটিশরা কুইট করবে– এই বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পর প্রধান দুটি দল মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস পাশার দান সাজাচ্ছিল ক্ষমতায় যাওয়ার। মুসলিম লীগের নেতারা যেমন চায়নি হিন্দুরা দেশ শাসন করুক, তেমনি হিন্দু নেতারাও চায়নি মুসলিমরা ভারত শাসন করুক। ফলে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদে উৎসাহী হয়ে উঠে দুই দলই।

খেয়াল করবেন, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে কিন্তু পাকিস্তানের কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছিল 'মুসলিম স্টেটস' ('এস' যুক্ত আছে, এই 'এস' নিয়ে পরবর্তীতে অনেক ঝামেলাও হয়েছে)। অর্থাৎ, কেন্দ্রের অধীনে প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা। কিন্তু সেই ধর্মভিত্তিক স্টেটসই পরবর্তীতে দেশভাগের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় উপমহাদেশকে। অর্থাৎ মূল দ্বন্দ্বটা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক ক্ষমতার। সেই ক্ষমতা পাকিস্তান শোষণের হাতিয়ার হিসেবে উন্মত্তভাবে ব্যবহার করেছে বলেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম হয় এবং মুক্তির আশায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া।

সোনার হরিণ আমরা এখনও পাইনি। একটা পাকিস্তানের বদলে দুটো পাকিস্তান গড়ার উদ্দেশ্য না থাকলেও, সেই '৪৭-এর প্রেতাত্মা, সেই পাকিস্তানের প্রেতাত্মাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আজ চারিদিকে। আজও মূল দ্বন্দ্ব ক্ষমতার। রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতার লড়াই থাকবেই, কথা হচ্ছে সেই ক্ষমতা কিসে ব্যবহার হবে? লুটপাট আর শোষণে? নাকি জনকল্যাণে? জনকল্যাণে হলে গোবিন্দগঞ্জ সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়, আদিবাসী নির্যাতিত হওয়ার কথা নয়, অমুসলিমরা অনিরাপদ হওয়ার কথা নয়, সামাজিক বৈষম্য বাড়ার কথা নয়।

আমরা আমাদের সামাজিক বন্ধন, সম্প্রীতি, সংস্কৃতি শক্তিশালী না করে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মীয় পরিচয় শক্তিশালী করেছি। এই যে ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট শক্তিশালী করেছি, এটা কিন্তু ধর্মকে ভালোবেসে বা ধর্মীয় আবেগের বশবর্তী হয়ে নয়, রাজনৈতিক ক্ষমতায় টিকে থাকতে বা ক্ষমতায় যেতে। তাই এই নেতিবাচক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পরিহার না করলে সামাজিক বিরোধ থামবে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম উদ্দেশ্য– নিপীড়নহীন সেক্যুলার রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্নও সফল হবে না। মিলবে না মুক্তি।

সহায়ক গ্রন্থ:

১. 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'– শেখ মুজিবুর রহমান

২. 'বাঙালীর জাতীয়তাবাদ'– সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

৩. 'দ্বিজাতিতত্ত্বের সত্য মিথ্যা'– সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

৪. 'বাঙলা ভাগ হল'– জয়া চ্যাটার্জি

৫. 'ঈশ্বর, পুঁজি, মানুষ'– আনু মুহাম্মদ

৬. 'দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতা এবং সম্প্রীতীর সাধনা'– মফিদুল হক

৭. রবীন্দ্র রচনাবলী

৮. মাসিক সংস্কৃতি।