শহীদ খালেদ মোশাররফবিরোধী ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার প্রসঙ্গে

মাহজাবিন খালেদ
Published : 7 Nov 2016, 02:17 PM
Updated : 7 Nov 2016, 02:17 PM

মহান মুক্তিযুদ্ধের অসমসাহসী দেশপ্রেমিক এক সমরনায়ক শহীদ মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীরোত্তম। তিনি দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন ২নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ও কে ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে। স্বাধীনতার পরও তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৫ আগস্টের ভোরে ঘাতক চক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনা এবং মুজিব হত্যাকারীদের ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করার উদ্যোগ নেন শহীদ মোশাররফ। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হন। শুধু তাই নয়, নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে সহকর্মী হায়দার ও হুদাসহ জীবন দিতে হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের এ সমরনায়ককে।

এর চেয়েও দুঃখজনক বিষয় হল, তাঁর মতো একজন দেশপ্রেমিক, আদর্শবাদী ও নীতিনিষ্ঠ সমরনায়ককে জীবন দিতে হয় বিদেশি দালাল বা অনুচর হিসেবে, এর চেয়ে ভয়াবহ দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না। অবশ্য এই মাটিতে বহু দেশপ্রেমিক সংগ্রামী ও জনপ্রিয় নেতাকে পাকিস্তান আমলে বিদেশি অনুচর বা ভারতীয় দালালের তকমা বহন করতে হয়েছে। এ অপবাদ দেওয়ার হাত থেকে বাদ যাননি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কমরেড মনি সিংহসহ অনেককেই।

১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ও সহযোগিতায় সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও ভারত-বিরোধিতা ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষ করে এই বাংলার মানুষ যখন তাদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে, তখনই পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য ভারতবিরোধী যিকির তোলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়েছে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় পাকিস্তানি শাসকচক্র বলেছে, ভারতীয় দালালরা পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্ট করার জন্য ভাষা আন্দোলনের নামে হৈচৈ শুরু করেছে। এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার দিনও নুরুল আমিনসহ অনেক মন্ত্রী বলেছেন, হিন্দু ভারতের দালালরা এসব করছে।

১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বাতিল করে দেওয়া হয় ভারতীয় দালাল তকমা লাগিয়ে। যুক্তফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে বৃদ্ধ বয়সেও পাকিস্তানের সরকার হয়রানি করে ভারতের দালাল তকমা দিয়ে। এ সময় বঙ্গবন্ধুসহ যুক্তফ্রন্টের অনেক নেতাকেও ভারতীয় দালাল হিসেবে আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানীকে ভারতীয় দালাল তকমা থেকে রেহাই দেয়নি পাকিস্তানি শাসকরা।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেন। উক্ত ছয় দফার দাবিতে আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন যখন ব্যাপক আকার ধারণ করে, তখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দেওয়া হয় ভারতীয় ষড়যন্ত্র ও ভারতীয় দালাল তকমা লাগানোর জন্য।

আইয়ুবের বিদায়ের পর ক্ষমতায় আসেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তিনি ক্ষমতায় বসেই সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে। উক্ত নির্বাচনের সময়ও পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী ও তাদের দালাল জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের নেতারা আওয়ামী লীগকে ভারতীয় দালালদের দল বলে ভোট দিতে নিষেধ করেছে দেশবাসীকে। তারা সেদিন বলেছে, আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে এদেশ হিন্দুস্তান হয়ে যাবে। এ রকম স্লোগানও দিয়েছে, 'জয় বাংলা, জয় হিন্দু, লুঙ্গি থুইয়া ধুতি পিন্দ'।

নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালে ভয়াবহ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশকে হানাদারমুক্ত করার জন্য। এ সময় পাক সরকার ও তাদের দালাল জামায়াত, মুসলিম লীগ, রাজাকার ও আলবদরের খুনিরা মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় দালাল ও ভারতীয় অনুচর বলে প্রচার চালিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাসহ হিন্দু, মুসলিম ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হত্যা করেছে এসব অভিধায় আখ্যায়িত করে।

স্বাধীনতা-পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত মুসলিম লীগসহ পাকিস্তানি দালালরা বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা-কর্মীদের ভারতীয় দালাল তকমা লাগিয়ে পাকিস্তানি কায়দায় হৈচৈ শুরু করে। তারা অনবরত প্রচার করতে থাকে যে, আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের গোলাম হিসেবে বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করবে। এ ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীরা সংগঠিত হয়ে শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়। সেই অপশক্তিই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুশতাক-জিয়া ক্ষমতা দখল করে। খন্দকার মুশতাক ক্ষমতায় বসেই তার সহযোগী ও সহকর্মী খুনিদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মতোই স্বাধীন বাংলাদেশকেও হত্যা করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। অর্থাৎ তারা ত্রিশ লাখ শহীদের সঙ্গে বেইমানি করে স্বাধীন বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানের একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হয়।

এই বেইমান বিশ্বাসঘাতক খুনিচক্রের স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিহত করা এবং ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের বিচারের জন্য মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের নেতৃত্ব দিয়ে সংগঠিত করেন মহান মুক্তিযুদ্ধের ২নং সেক্টরের কমান্ডার ও কে ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীরোত্তম। তিনি ঘাতকদের বিরুদ্ধে চূডান্ত অভিযান পরিচালনা করেন ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর রাত বারটার পরে অর্থাৎ ৩ নভেম্বরের প্রথম প্রহরে। এ অভিযানে তিনি খুনিচক্রের অন্যতম শিরোমণি তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াকে গৃহবন্দী করেন এবং মুশতাককে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিতাড়িত করেন।

এ সময় তিনি মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি লাভ করে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় খুনি মুশতাকের পরিবর্তে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ৬ নভেম্বর শপথ গ্রহণ করেন বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েম। এভাবেই মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীরোত্তম বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এবং মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ পুনরুদ্ধারের জন্য অগ্রসর হন।

কিন্তু বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য তাঁর এই ঐতিহাসিক সফলতা মুশতাক, জিয়া ও তাহেরের নেতৃত্বে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি অল্প সময়েই নসাৎ করে দেয়। সে দিনটিই হল ৭ নভেম্বর। খালেদ মোশাররফের দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার চালিয়ে সৈনিকদের সংগঠিত করে ঐ চক্র। বিশেষ করে এই সময় জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ১২ দফা দাবির পাশাপাশি খালেদ মোশাররফের কর্মকাণ্ড ভারতের তৎপরতা বলে প্রচার চালাতে থাকে।

মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফকে ভারতীয় চর অভিধায় অভিযুক্ত করার পেছনে স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী ও জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সঙ্গে কয়েকজন সাংবাদিক যুক্ত ছিলেন। সেদিন অপপ্রচার চালিয়ে সৈনিকদের বিভ্রান্ত করে বিপথে নামাতে এদের অবদান সবচেয়ে বেশি। তারা সেদিন প্রচারণা চালায় এ মর্মে যে, খালেদ কারাবন্দী তাজউদ্দিন আহমেদ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ক্ষমতায় বসিয়ে পুনরায় বাকশাল কায়েম করবেন। বাকশালীদের মাধ্যমে দেশকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হবে। ভারত ও খালেদ বাকশালীদের সাহায্য করছেন।

পুরো ব্যাপারটাই ছিল একটা মিথ্যা প্রচারণা মাত্র। খালেদ মোশাররফ ভারতপন্থী ছিলেন এবং তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে সরকার গঠন করতে চেয়েছিলেন, এ কথা বিশ্বাস করার পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পাল্টা অভ্যুত্থান শুরু হয় ২ নভেম্বর রাতে। তাজউদ্দিনকে দিয়ে সরকার গঠন করতে চাইলে ঐ দিনই আওয়ামী লীগ নেতাদের জেল থেকে মুক্ত করে সরকার গঠন করতে পারতেন তিনি। তিনি তা করেননি, বরং ৩ নভেম্বর ভোরে জেলহত্যার ঘটনা ঘটার ত্রিশ ঘণ্টা পর বিষয়টি তাঁর কর্ণগোচর হয়।

মূলত সবই ছিল খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র। আর এই ষড়যন্ত্রে সক্রিয় ও জঘন্যভাবে যুক্ত ছিল স্বাধীনতাবিরোধী ও পাকিস্তানপন্থীরা। ২ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের ভেতরের সত্যি ঘটনাগুলো এখনও প্রকাশিত হবার অপেক্ষায়। সেদিনের ঘটনার তদন্ত হলে খালেদ মোশাররফসহ অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারীরা মুক্তি পাবেন অপপ্রচারের কালিমা থেকে।

সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে জেলহত্যা তদন্তের জন্য জুড়িসিয়াল কমিশন গঠিত হয়েছিল। রহস্যময় কারণে জিয়া তার সাড়ে পাঁচ বছরের শাসনামলে কমিশনকে তদন্ত করতে দেননি। আজ পর্যন্ত কোনো তদন্ত রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়নি। জিয়ার তা হতে না দেওয়ারই কথা। কারণ তিনি নিজেই ১৫ আগস্ট এবং ৩ ও ৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডসহ দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের অন্যতম মূল হোতা।

আজকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের তথা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। কাজেই দেশবাসী আশা করে ৭ নভেম্বরের ঘটনা তদন্ত করে তা প্রকাশ করা হোক জাতির সামনে। সেই সঙ্গে দোষীদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। আরও চাইব যেন ৭ নভেম্বরকে কলংকিত দিন হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা ও সৈনিক হত্যা দিবস ঘোষণা করা হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে।

মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসীসহ দেশবাসী আরও প্রত্যাশা করে যে, প্রধান সেনাপতি হিসেবে আর্মি অনার বোর্ডে শহীদ মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীররোত্তমের নাম সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।