বন্ধু ওবায়দুল কাদেরকে অভিনন্দন

আবদুল মান্নান
Published : 30 Oct 2016, 03:40 AM
Updated : 30 Oct 2016, 03:40 AM

নানা জল্পনাকল্পনা পেছনে ফেলে অবশেষে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু ওবায়দুল কাদের বাংলাদেশের বৃহত্তম ও প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অভিষিক্ত হলেন। খবরটি যখন আমার কাছে পৌঁছাল তখন আমি পেশাগত কাজে দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে। যাঁর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চার আনা দামের ক্যাপস্টন সিগারেট ভাগাভাগি করতাম, সেই বন্ধু কাদের এখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। কাদেরকে অভিনন্দন।

বেশ অনেক দিন আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির অতীত নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছিলাম, বাংলাদেশের ছাত্রলীগের সোনালি দিন সম্ভবত ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে শেষ হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে আলোর ঝলকানির মতো এনামুল হক শামিম বা বাহাদুর ব্যাপারির মতো ছাত্রনেতারা এসেছেন, তবে সোনালি যুগের ছাত্রলীগের ছাত্র রাজনীতি এখন ইতিহাসের অংশ। এই সময়ের ছাত্রলীগ আর একজন শেখ হাসিনা বা তোফায়েল আহমদ জন্ম দেয় না। লেখাটি পড়ে সাবেক এক ছাত্রনেতা টেলিফোনে আমার সঙ্গে বেশ দুর্ব্যবহারই করেছিলেন তাঁর নাম উল্লেখ করিনি বলে। সেই ছাত্রনেতা একদা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এক-এগারোর পরের ভূমিকার জন্য সেই নেতা বর্তমানে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত।

অন্যদিকে সামনে নানা চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে একসময়ের ছাত্রনেতা ওবায়দুল কাদের এখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে যে কয়েকজন ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধরে রাখতে পেরেছিলেন ওবায়দুল কাদের তাঁদের একজন। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অসামান্য অবদান রাখার জন্য দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ওবায়দুল কাদেরকে মূল্যায়ন করেছেন। এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ।

যে কাউন্সিলে কাদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন সেই কাউন্সিল নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। পূর্বের কোনো কাউন্সিল এত জাঁকজমকপূর্ণ ছিল না, যেমনটি এবার দেখা গেছে। নেতাকর্মীদের এমন স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এর আগে কোনো কাউন্সিলে তেমন একটা দেখা যায়নি। কাউন্সিল উপলক্ষ্যে সারা ঢাকা শহর বর্ণিল সাজে সেজেছিল। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশি অতিথিও এসেছিলেন। তাঁরা দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কোনো রকমের বিশৃঙ্খলা ছাড়াই কাউন্সিলের বিশাল আয়োজন শেষ হয়েছে।

বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের নাম প্রস্তাব করে তাঁর উদারতার সাক্ষর রেখেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, দলের প্রতি তাঁর অানুগত্য এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি তাঁর আস্থা প্রশ্নাতীত। দলের পদ নিয়ে কারো মনোমালিন্যের কোনো খবর এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

আমন্ত্রিত হয়ে যেতে না পারলেও খবর নিয়ে জেনেছি শুরু এবং শেষ পর্যন্ত সব নেতা-নেত্রীর মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় ছিল। এই কাউন্সিলের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আবার প্রমাণ করেছে চেষ্টা করলে তারা অনেক কঠিন কাজও সহজ করতে পারে। প্রয়োজন শুধু সবার সম্মিলিত প্রয়াস এবং চাটুকারদের কাছ থেকে দূরে থাকা। ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ এখনও অপ্রতিরোধ্য।

এরই মধ্যে দলের সব কমিটির সব সদস্যের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এবার দলে বেশ কিছু নতুন প্রজন্মের সম্ভাবনাময় নেতাকে স্থান দেওয়া হয়েছে; নতুন-পুরাতনের সম্মিলন ঘটেছে। এদের মধ্যে অনেকেই পূর্বের কমিটিতে কোনো না কোনো পদে ছিলেন। বিগত দিনে সবাই সমানভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন, তা কিন্তু নয়। তবে এবারও তেমনটি ঘটলে দলের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ, দলের সভাপতি পরোক্ষভাবে বলেই দিয়েছেন, এই কমিটি নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০১৯ সালের নির্বাচন লড়বে। সেই নির্বাচনে লড়ার জন্য এখন থেকেই নতুন নেতৃত্বকে কাজ শুরু করে দিতে হবে।

বন্ধু কাদের ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এসেছেন। তিনি একজন পোড়-খাওয়া মানুষ। কাদের যখন ছাত্র রাজনীতি করেছেন তখন ছাত্রলীগের পক্ষে রাজনীতি করাটা মোটেও সহজ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুহসিন হলের ছাত্র সংসদে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে হল সংসদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কাদের ১৯৬৮ সালে ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তখন মোনেম খানের এনএসএফ ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। নির্বাচনের আগের রাতে এনএসএফ সমর্থক ছাড়া হল থেকে সবাইকে বিতাড়িত করা হয়।

ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি প্রার্থী খোন্দকার মোশাররফ হোসেন যে কোনোভাবে হলে লুকিয়ে থেকে যান। ১৯৬৮ সালে মুহসিন হল থেকে ছাত্রলীগের একমাত্র খোন্দকার মোশাররফ হোসেন ছাড়া অন্য কারো বিজয় লাভ করা সম্ভব হয়নি। সেই খোন্দকার মোশাররফ হোসেন বর্তমানে ড. খোন্দকার মোশাররফ হোসেন, বেগম জিয়ার একান্ত আস্থাভাজন মানুষ। নির্বাচনের পর অন্য ছাত্রদের হলে ফিরতে প্রায় ছয় মাস সময় লেগেছিল। সেদিনের সেই কাদের কাঁধে অনেক বড় দায়িত্ব নিয়ে এখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

শামসুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুর রাজ্জাক, সাজেদা চৌধুরী, জিল্লুর রহমান, আবদুল জলিল, সৈয়দ আশরাফ এঁরা সবাই বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এঁদের জুতা এখন ওবায়দুল কাদেরের পায়ে। পূর্বসূরিরা তাঁদের দায়িত্ব পালনকালে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। প্রথম সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ও সর্বশেষ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ ছাড়া সবাই জেল খেটেছেন। শামসুল হক ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলীম লীগ প্রার্থী পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে পরাজিত করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ভাগ করে ন্যাপের জন্ম দিলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। তাজউদ্দীনের মেয়াদকালে সত্তরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে।

সাজেদা চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, আবুল জলিল, জিল্লুর রহমান– এঁরা সবাই জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসনের নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। সৈয়দ আশরাফ বেগম জিয়ার 'পেট্রোল বোমা' ও হেফাজতের 'ঢাকা দখল' সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন। এঁদের সততা নিয়ে কেউ কখনও কোনো অভিযোগ উত্থাপন করেনি। এঁরা চাটুকারমুক্ত থেকেছেন। দলকে সামনের দিকে নিয়ে গেছেন, কঠিন সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে দ্বিধা করেননি। তাঁদের সব চেয়ে বড় গুণ ছিল তারা সবাই বিনয়ী ছিলেন। অন্যকে শ্রদ্ধা করতে জানতেন। সে কারণেই তাঁরা অন্যদের শ্রদ্ধা পেয়েছেন।

সৈয়দ আশরাফ আর ওবায়দুল কাদের একই বয়সী। সম্ভবত একই দিনে জন্ম। অন্তত উইকিপিডিয়া তাই বলে। সৈয়দ আশরাফ কিছুটা নিভৃতচারী ছিলেন। প্রয়োজন না হলে তেমন একটা মিডিয়ার সামনে আসতেন না। নীরবে কাজ করে গেছেন। সেই বিচারে নুতন সাধারণ সম্পাদক বেশ মিডিয়াবান্ধব।

ওবায়দুল কাদেরের সামনে সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ২০১৯ সালের নির্বাচন। এ জন্য প্রয়োজন দল গুছিয়ে সুসংহত করা এবং দলে গত এক দশকে যেসব আগাছা ঢুকেছে তা কার্যকরভাবে ছেঁটে ফেলা। এই আগাছা বেশি ঢুকেছে ছাত্রলীগে যা নতুন সাধারণ সম্পাদক প্রায়ই বলে থাকেন। রোগটা সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। এখন চিকিৎসাটা শুরু করতে হবে।

ছাত্রলীগে অনেক নিবেদিত কর্মী আছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এই নিবেদিত কর্মীরা ওই আগাছাদের জন্য মূল দলের নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছুতে পারে না। তাদের মেধা বা কর্মক্ষমতা কখনও কাজে লাগে না। এর সঙ্গে দলে গত দশ বছরে যোগ হয়েছে বেশ কিছু হাইব্রিড, মূলত জামায়াত-বিএনপি সমর্থক সুবিধাবাদী। এরা অনেকেই আওয়ামী লীগে ঢুকে পরেছে নিজেদের দুষ্কর্ম আড়াল করার জন্য। এরা দলের জন্য 'পঞ্চম বাহিনী'র ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না।

সতর্ক না হলে এই আগাছা আর হাইব্রিডরাই ২০১৯ সালের নির্বাচনে দলের জন্য বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি বয়ে আনবে। এরা প্রত্যেকই চাটুকার; ধান্ধাবাজি এদের পেশা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জমি দখল অনেকের নেশায় পরিণত হয়েছে। এদের খপ্পর থেকে দলকে রক্ষা করা জরুরি।

দলের 'বিলুপ্তি' ঠেকাতে বিএনপি আগামী নির্বাচনে নিশ্চয়ই অংশগ্রহণ করবে। তবে এই মুহূর্তে বিএনপির যে অবস্থা তাতে তারা নির্বাচনে তেমন একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে এটাও ঠিক প্রতিপক্ষকে কখনও ছোট করে দেখতে নেই। তাদের দিকে দৃষ্টি অবশ্যই রাখতে হবে। তবে ঘরের শত্রুগুলো প্রথমেই চিহ্নিত করে তাদের ছাঁটাই করতে হবে।

বাংলাদেশে দল নিরপেক্ষ ভোটারের সংখ্যা মোট ভোটারের প্রায় ৩০ ভাগ। অনেকেই নির্বাচন আসলে প্রকাশ্যে বলেন, "আওয়ামী লীগকে ভোটটা দিতাম কিন্তু দলের নামে কিছুসংখ্যক তস্কর যেভাবে চারিদিকে দুর্বৃত্তপনা করছে তাদের তো ভোট দেওয়া যায় না।"

নতুন সাধারণ সম্পাদকের পক্ষে এই দুর্বৃত্তদের দমন করা তেমন একটা কঠিন নয়; যেহেতু তিনি রাজপথের রাজনৈতিক একজন কর্মী থেকে দেশের বৃহত্তম দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের ২০তম কাউন্সিল দলকে তো বটেই দলের সভাপতি শেখ হাসিনাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের মন্তব্য "বিদেশে থেকে দলের পদ আঁকড়ে থাকা ঠিক না", তাঁকে শুধু মহিমান্বিতই করেনি, তাঁর দূরদর্শিতাও প্রমাণিত হয়েছে। জয় তারেক রহমান হতে চাননি।

শেখ হাসিনার সমালোচকরা প্রায়ই বলেন, তিনি দেশে পরিবারতন্ত্র কায়েম করছেন। তারা বেগম জিয়া আর লন্ডনে তাঁর 'পলাতক' পূত্র তারেক রহমান সম্পর্কে তেমন কিছু বলেন না। জয়ের মন্তব্যের পর আশা করি এসব সমালোচকের মুখ বন্ধ হবে।

শেখ হাসিনার বৃহষ্পতি যে এখন তুঙ্গে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন দেখার বিষয় তাঁর নতুন সাধারণ সম্পাদক তাঁর প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পারেন। ওবায়দুল কাদেরকে যতটুকু চিনি একটু সতর্ক থাকলে এবং চেষ্টা করলে তিনি দলের সভাপতি ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিরাশ করবেন না।

বন্ধু ওবায়দুল কাদেরের জন্য রইল নিরন্তর শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।

২৭ অক্টোবর ২০১৬