স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার সঠিক ভাষা কী?

Published : 31 Oct 2011, 07:27 PM
Updated : 2 Dec 2011, 01:25 PM

বিডিনিউজ২৪ ডটকমে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা নিয়ে বেশ কিছু ভাল লেখা নভেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়েছে। বলতে গেলে প্রতিটি লেখাই এত ভাল হয়েছে যে সেখানে নতুন যোগ করার কিছু নেই। ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন বাংলাতে সুপাঠ্য বিজ্ঞান বইয়ের অপ্রতুলতার উল্লেখ করে। ফারসীম নিজে একজন বিজ্ঞান-ভাষার কর্মী, তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর লেখা বই ও আর্টিক্‌লগুলো বিজ্ঞানকে ঠিক রেখে সাধারণের কাছে সহজবোধ্য করেছে। এর পরেই ফিরোজ আহমেদ বাঙালি মধ্যচিত্তের হিপোক্রাসি নামে একটি সুন্দর লেখা লিখেছেন। সেই লেখার সারমর্ম করার ক্ষমতা আমার নেই, শুধু এখানে ওনার লেখা থেকে একটি লাইন উদ্ধৃত করছি –
"কিন্তু বিজ্ঞানের এই সার্বজনীনিকরণের জন্য সবার আগে প্রয়োজন জ্ঞানের বিস্তার।"
ফিরোজ আহমেদের এই লাইনটির গুরুত্ব নিয়ে পরে লিখছি। কাজী মাহবুব হাসানের সঙ্গে কথোপকথনে উনি বলছেন,
"নিটশের সাথে আমরা পরিচিত ইংরেজির মাধ্যমে, এইতো ট্রাজেডি। ফলে ইউরোপীয় যে কোন কিছুকে আমাদের ইংরেজের চোখ দিয়েই দেখতে হয়।" আমার কাছে এই পর্যবক্ষণটা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে।
তানভীরুল ইসলাম তাঁর বিজ্ঞান কেন মাতৃভাষায়? প্রবন্ধে বলেছেন, "বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার প্রচারণা চালানো মানে ইংরেজী ত্যাগ করো আন্দোলন নয়।" ফাহাম আব্দুস সালামের প্রবন্ধের নাম ছিল ইংরেজীতে ইংরেজিতে বিজ্ঞানচর্চা যে-কারণে দরকার। খুবই ইন্টারেস্টিং একটি লেখা। আমি যদি কিছুটা বুঝে থাকি উনি বলছেন উচ্চ শিক্ষায় ইংরেজী মাধ্যম যে দরকার সেটা আমরা অনেকেই বলছি। কিন্তু যারা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ইংরেজী মাধ্যমে করেছে তারা এই উত্তরণটা যেমন সহজে করতে পারবে, বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা তেমন সহজে করতে পারবে না। সেই ক্ষেত্রে গ্রামের ছেলেমেয়েরাও কেন ইংরেজ মাধ্যমকে গ্রহণ করবে না? ফাহাম সালাম বলছেন,
"কিন্তু সমস্যা হোলো কে ইংরেজি শিখবে আর কে শিখবে না এটা ঠিক করে দেবে কে? হাজার হাজার বই বাংলায় অনুবাদের চেয়ে একজন ছাত্রকে ইংরেজি শিখিয়ে দিলে যে তার পৃথিবীটা এমনিতেই অনেক বড় হয়ে যাবে এটা বোঝা নিশ্চয়ই রকেট সায়েন্স না।"

বিজ্ঞানের ভাষা ইংরেজি নয় প্রবন্ধে রজিউদ্দীন রতন পৃথিবীকে বোঝার জন্য প্রথম শেখা ভাষার গুরুত্বের কথা বলছেন। তিনি আরো বলছেন,
"আমাদের শিক্ষা আমাদেরকে চিন্তা করতে শেখায় নি। শিক্ষা আমাদেরকে আনন্দ দেয় নি।"
লেখাগুলোর পেছনে যে সব মন্তব্য এসেছে সেগুলোও চমৎকার। কাজী মাহবুব হাসান রজিউদ্দীন রতনের লেখাটির ওপর মন্তব্যে বলেছেন,
"একইভাবে বিজ্ঞানচর্চা করছেন এমন অনেকেও মন্তব্য করেছেন, তারা আসলে কী উপদেশ দেবেন, যারা এদেশে বিজ্ঞান পড়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সেই সব লেখকের মত জায়গা করে নিতে চান তারা কী করবেন? … আমি বলতাম ‍বাংলায় বিজ্ঞানের বই কৌতুহলটা শুধু তৈরি করবে, কিন্তু পৃথিবীর সব জ্ঞান তার জন্য অপেক্ষা করছে আরেকটি ভাষায়, যে ভাষার অংশটুকু শিখতে বিজ্ঞানে অ্যাপটিচিউড আছে এমন কোন বাংলাদেশী ছাত্রর পক্ষে শেখা কোন ব্যাপারই না।"

পি.এইচ.ডি থিসিস
উচ্চশিক্ষার জন্য ইংরেজী মাধ্যম যে প্রয়োজনীয় সেটার সঙ্গে ফাহাম আব্দুস সালাম বা কাজী মাহবুব হাসানের সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন। মাস্টারস বা পিএইচডি থিসিসটি যদি ইংরেজীতে লেখা হয়, সারা পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারের অধিকার থেকে আরম্ভ করে বিদেশী গবেষকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও ভাল জার্নালে থিসিসের পাবলিকেশন সহজ হয়ে যায়। আমার মনে হয় না এখানে যাঁরা বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার কথা বলছেন তাঁরা পিএইচডি থিসিসের কথা বলছেন। তবে এই নিয়ে আমি কোন দৃঢ় মত প্রকাশ করছি না। তুরস্ক ও ইরানে তুর্কী ও ফারসীতে পিএইচডি থিসিস লিখতে আমি দেখেছি। তবে ঐ সমস্ত থিসিসের বিষয়বস্তুকে ইংরেজী জার্নালে পাবলিশ করতে অবশ্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সবাই তো বিজ্ঞান বিষয়ে মাস্টারস বা পিএইচডি লিখছেন না। তাঁদের সবার জন্য প্রয়োজন একটি দৃঢ় জ্ঞানের ভিত্তিভূমি।

দ্বন্দ্ব
এবার দ্বন্দ্বের কথাটা বলি। ফিরোজ আহমেদ বলছেন, বিজ্ঞানের সার্বজনীনকরণের আগে প্রয়োজন জ্ঞানের বিস্তার। এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি ভীষণভাবে একমত। সার্বিকভাবে জ্ঞান অর্জনের একটা পথ বার করতে হবে। কিন্তু জ্ঞানের বিস্তারটা কোন সময় থেকে শুরু করতে হবে? আমি ধরে নিচ্ছি আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক এমন কি ব্যাচলর বা অন্যান্য কারিগরী শিক্ষা মাধ্যমে এই জ্ঞানের বিস্তার ঘটাতে হবে। রজিউদ্দীন রতন বলছেন আমাদের শিক্ষা আমাদের চিন্তা করতে শেখায় না। তার সাথেও আমি একমত। ওদিকে ফাহাম সালাম বলছেন গ্রামে ইংরেজী নিয়ে যাও, তোমরা শহরের কিছু উচ্চবিত্ত ইংরেজীর সুফল পাচ্ছ, বাকি দেশবাসীকে তার ভাগ দিচ্ছ না কেন? কথাটা একদিকে মনে হয় বেশ যৌক্তিক। সৃজনশীল জ্ঞানের বিস্তার ঘটাতে হবে, সেই সৃজনশীলতা কি ইংরেজী মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে? সমস্যাটা এখানেই। ইংরেজী যদি ঐভাবে নিয়ে যাওয়া যেত তাহলে তো কাজই হত।

কেস স্টাডি
আমি পূর্বেই দেশে দুর্বল ইংরেজী শিক্ষার কথা বলেছি। আমার এক ভিয়েতনামী ছাত্রী মাত্র গত বছর মার্কিন দেশে এসেছে। আমার ক্লাসে আসার আগে (বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছর) সে কখনো ইংরেজীতে পদার্থবিদ্যার বই চোখে দেখে নি। কিন্তু তার ইংরেজী চমৎকার। আমি বিশেষভাবে তাকে জিজ্ঞেস করেছি সে এত ভাল ইংরেজী কোথায় শিখল। সে বলল ভিয়েতনামেই, বিশেষ ইংরেজী ক্লাস করে ও ইংরেজী বই পড়ে। কিন্তু ভিয়েতনামের সবাই এই সুযোগটা পায় না। এই ছাত্রীটি পরীক্ষায় খুবই ভাল করছে। ইংরেজীতে পাঠ্যপুস্তক পড়তেও অসুবিধে হচ্ছে না। বরং ভিয়েতনামীতে আগে বিজ্ঞান পড়ে ও আলাদাভাবে ইংরেজীতে পারদর্শিতা অর্জন করে সে ক্লাসের অন্যান্যদের থেকে ভালই করছে। তবে আইরনি হল, শিক্ষার মাধ্যমের ব্যাপারে তার মতামত অনেকটা ফাহাম সালামের মতই! অর্থাৎ ভিয়েতনামের সবার স্কুলে ইংরেজীতে বিজ্ঞান পড়া উচিত! তাকে আমি বলি আমরা যদি গ্রামে ইংরেজী মাধ্যম নিয়ে যাবার জন্য সুপারিশও করি আমাদের "শিক্ষিত" জনশক্তির ক্ষমতা হবে না তাকে কার্যকর করার।

তর্কটা তাহলে সীমাবদ্ধ হোক আমাদের স্কুলগুলোতে শিক্ষার মাধ্যম কী হবে সেটা নিয়ে। এখানে শিক্ষার মাধ্যম বলতে আমি দুটো জিনিস বোঝাচ্ছি। একটা তো হল ভাষা, কিন্তু তার থেকেও যেটা গুরুত্ত্বপূর্ণ সেটা হল উপগঠনগত পরিবর্তন, কাজী মাহবুব হাসান লার্নিং থিওরির কথা বলেছেন। আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নতুন গবেষণা অবলম্বনে জ্ঞান আহরণের নতুন পরিবেশ সৃষ্টি করা।

L1 বনাম L2
শিশুরা ভাষা কীভাবে আয়ত্ত্ব করে সেটা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। আমি এই ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞ, তবে মনে হয় বাঙ্গালী শিশুরা তার মাতৃভাষা বা প্রথম ভাষা যাকে L1 বলা হয় সেটা শিখে ইংরেজী L2কে কীভাবে তাদের মস্তিষ্কে স্থান দেয়। এই বিশেষ বাংলা(L1)/ইংরেজী(L2) প্রক্রিয়াটা নিয়ে গবেষণা কমই হয়েছে। অনেক ভাষাবিদের মতে শিশু থেকে কিশোর বা তরুণে উত্তীর্ণ হবার বয়ঃসন্ধির পরে অর্জিত ভাষাসমূহ সহজে L1 হতে পারে না, সেই ভাষার উচ্চারণে শুধু যে এক্সেন্ট থাকে তাই নয়, L1এর কার্যক্রিয়া সেখানে মস্তিষ্কের বাম দিকের গোলার্ধে ঘনীভূত থাকে, L2 সেখানে মস্তিষ্কের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকে, এবং L2র লিখন থেকে উচ্চারণ ও বোধ সৃষ্টি করতে মস্তিষ্ককে বেশ পরিশ্রম করতে হয়। তবে আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করেছি, তারা দাবি করি যে আমরা ছোটবেলা থেকে যেমন বাংলায় পড়েছি তেমনি ইংরেজীতে শিক্ষা লাভ করেছি। হাজার হলেও প্রাইমারী স্তরেই আমাদের A, B, C, Dর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সমস্যা হল আমাদের শিক্ষকরা আমাদের মতই L1 দোষে দুষ্ট। আমরা ইংরেজী শিখি ইংরেজ বা মার্কিনদের কাছ থেকে নয়, দেশী শিক্ষকদের কাছ থেকে। তাই বাংলা ভাষার গঠন আমাদের ইংরেজী শিক্ষার মধ্যে রয়ে যায়। এটা বিশেষভাবে সত্য বাংলার গ্রামগুলির জন্য। (মার্কিন দেশে আসার পরে আমাকে ইংরেজী নতুনভাবে শিখতে হয়েছে, আমার আক্ষেপ আমি ছোটবেলায় ইংরেজ যার প্রথম ভাষা এমন কারুর কাছ থেকে ইংরেজী শিখি নি।)

লার্নিং থিওরী
আলোচনাটা হচ্ছে শুধুমাত্র বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমের ওপর নয়, তার চেয়ে বড় পরিসরে জ্ঞানের মাধ্যমের ওপরে। আলোচনাটা হওয়া উচিত নিচু ধাপের জ্ঞান আহরণের প্রক্রিয়া কী হওয়া উচিত তার ওপর। জ্ঞান আহরণের বিভিন্ন তত্ত্ব আছে। নতুন সামাজিক তথ্য, নতুন বিজ্ঞান আমাদের শেখাচ্ছে কীভাবে দক্ষতার সাথে জ্ঞান লাভ করা যায়। constructive learning theory বলে শিক্ষার্থীকে সক্রিয়ভাবে জ্ঞানের সন্ধান করতে হবে, শুধু তাই নয় অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে নতুন জ্ঞানের ভিত্তিভূমি প্রস্তুত করতে হবে। অনেকে বলবেন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা সহজ নয়, নিউটনের বলবিদ্যার ওপর একটি ১৫ বছর বয়সী কিশোরীর কী বলার আছে? constructivism বলে একটি নির্দিষ্ট বিজ্ঞানের কাঠামোয় ছাত্রদের নিজেদের থেকে নতুন উদাহরণ, নতুন বোধমূলক ও গাণিতিক প্রশ্ন সৃষ্টি করতে হবে। শুধু নতুন জ্ঞান অর্জন নয়, নতুন জ্ঞান সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবেও ভাবতে হবে। শিক্ষক সেখানে শুধু বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে লেকচার দেবেন না, শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের জ্ঞান অর্জনের পরিবেশ সৃষ্টি করবেন। এর জন্য শ্রেণীকক্ষে বা শ্রেণীকক্ষের বাইরে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের যেমন সহযোগিতার প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার। সেই সহযোগিতার জন্য ভাষার প্রয়োজন। সেই ভাষা দিয়ে শিক্ষার্থীদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। কারণ এই ধরণের শিক্ষা প্রক্রিয়া উন্মুক্ত, সেখানে শ্রেণীকক্ষের বাইরের পৃথিবীও একটা স্কুল। বলাই বাহুল্য সেই যোগাযোগ স্থাপনে ও গঠনমূলক স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনায় অংশ নিতে শিশু ও কিশোরদের প্রথম ভাষা ছাড়া গতি নেই। (এই প্রসঙ্গে আমি বলে রাখি বিশ্বায়ন ইত্যাদির ফলে অনেক শিশু-কিশোরদের L2র ওপর ভরসা না করে উপায় নেই, যেমন তারা যদি পিতা-মাতার সাথে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে, কিন্তু আমি ধরে নিচ্ছি ক.) শিক্ষার জন্য এই সেই সব শিশু-কিশোররা কিছু বাড়তি সুবিধা পায় ও খ.) তাদের সাংস্কৃতিক পরিবেশ ভিন্ন যার ফলে L2তে কাজ করতে তাদের অসুবিধে হয় না।)


ক্লাস কালচার

মানুষ যে সমাজে বাস করে সেই সমাজের ভাষার কাঠামো অবলম্বনে শিক্ষা গ্রহণ করবে–সহজ চিন্তা তো তাই বলে। সমস্যা হচ্ছে সেই ভাষাটা যে কী হবে সেটা আমরা ঠিক করতে পারি নি। না, আমি বাংলা ও ইংরেজীর মধ্যকার দ্বন্দ্বের কথা বলছি না। আমি বলছি বাংলা ভাষার মধ্যের দ্বন্দ্বের কথা। আমরা লিখি এক ভাষায়, মুখে কথা বলি আর এক ভাষায়। বাংলাদেশের মত খণ্ডিত ক্লাস কালচার পৃথিবীর আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ, সঠিক বাংলা ভাষাটা যে কী সে বিষয়ে আমরা একমত হই নি। তাতেও আমি কোন সমস্যা দেখি না, সমস্যাটা হচ্ছে লিখিত ভাষাটাকে আমরা মনের মধ্যে কখনই স্থান দিই নি, তাই বাঙ্গালী তার কথা বলায় নিতান্তই দীন। আমাকে এক বাঙালী বন্ধু বলেছিলেন বাঙালীর সঙ্গে বাংলা ভাষায় কথা বলে কোন আরাম নেই, সে সঠিকভাবে বাংলায় তার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না। এমন কি উচ্চতর ক্লাস কালচারের শিক্ষিত বাঙালী সচেতনভাবে উচ্চ মানের শব্দ এড়িয়ে চলে। আমি এই পর্যন্ত দৈনন্দিন কথোপকথনে স্বতঃস্ফূর্ত, সঙ্কোচ বা সুচিন্তিত এরকম কথা শুনি নি। এই শব্দগুলোকে ইংরেজীতে বলতে তার বাঁধে না, কিন্তু বাংলায় এসব বলতে "শিক্ষিত" বাঙালীর প্রভূত সঙ্কোচ হয়, এগুলো বললে লোকজন হাসবে। আসলেও তাই। ধীরে ধীরে এই অভ্যাস সবার মধ্যেই সঞ্চারিত হয়। এক কালে আমরা খবরের কাগজ বা সংবাদ পত্র বলতাম, এখন বলি পেপার। এক কালে সময়কে সময় বলা হত, এখন বলি টাইম কত? মার্কিন দেশে আমি অমার্কিন প্রচুর বন্ধুকে দেখেছি, গ্রীক, চীনা, ইরানী, তুর্কী যারা ইংরেজীতে দক্ষ, কিন্তু নিজেদের ভাষায় কথা বলার সময় একটি ইংরেজী শব্দেরও প্রয়োগ করে না। তারা কীভাবে তাদের L1 আর L2কে আলাদা করে রাখতে পারে? এর কারণ হচ্ছে তাদের বিদ্যালয়ে তাদের প্রথম ভাষার যথাযথ শিক্ষা দেওয়া যেটা আমরা একেবারেই পাই নি। জগাখিচুরীর গোলকধাঁধায় কোন শিক্ষাই সফল হতে পারে না, এটা আমাদের স্কুলের পাঠ্যপুস্তক দেখলেই বোঝা যায়। তাতে না আছে কোন বোধগম্য ধারণা না আছে বোধগম্য ভাষা।


একটি পদার্থবিদ্যার পাঠ্যপুস্তক

এই মুহূর্তে আমি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক নবম ও দশম শ্রেণীর জন্য নির্ধারিত মাধ্যমিক পদার্থবিজ্ঞান বইটি নিতান্ত কৌতূহলবশতঃ উল্টে-পাল্টে দেখছি। শিশুতোষ বলে যদি কোন কথা থাকে এই বইটির জন্য তা একেবারেই প্রযোজ্য নয়। না, আমি লেখার গুণগত মানের কথা বলছি না, আমি প্রডাকশান কোয়ালিটির কথা বলছি। বইটি যে কাগজে (ও ফন্টে) ছাপা হয়েছে সেটা দিয়ে ঝালমুড়ির ঠোঙ্গা বানানো যেতে পারে, উৎসাহী পড়ুয়া বানানো সম্ভব নয়। এই ধরণের প্রাথমিক পদার্থবিদ্যার বইয়ে অনেক পরিমাণে রেখাচিত্র ও উদাহরণস্বরূপ অনেক ফটো থাকার কথা। ফটো নেই–সেটা না হয় বাদই দিলাম, রেখাচিত্র যে ক'টা আছে সেগুলো এতই নিম্নমানের যে বলার নয়। ২০০৯-এর শিক্ষাবর্ষের এই বইটিতে কি কম্পিউটার দিয়ে ছবিগুলো আঁকা যেত না? আমি জানি অনেক পাঠক বলবেন এগুলো সবই বাহ্য, সুপারফিসিয়াল দোষ। কিন্তু এগুলো সবই সেই শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টির অঙ্গ। বইটি সুযোগ্য পদার্থবিদরা লিখেছেন, কিন্তু বইটিতে বোধমূলক কোন চিন্তার অবকাশ নেই। আমি খুব সহজেই চিন্তা করতে পারছি ১৫/১৬ বছরের কিশোর-কিশোরীর মনে এই রকম একটা জিনিস কেমন বিভীষিকার সঞ্চার করতে পারে। নিঃসন্দেহে এই সব বিষয়ে অনেক কাজ করার বাকি আছে। এই ফোরামে যাঁরা লিখছেন তাঁরা এই নিয়ে ভাবতে পারেন। এমন কি স্কুল-কলেজে ইংরেজীতে বিজ্ঞান শিক্ষায় যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁরাও যোগদান করতে পারেন, কারণ এই পর্যায়ে বাংলার ব্যবহার বেশ কিছুদিন থাকবে।

ব্যক্তিগত স্পৃহা
এই ফোরামে যারা লিখেছেন তাঁদের বাংলা ভাষায় লেখার হাত ভাল। শিক্ষার মাধ্যম যাই হোক না কেন তাঁরা এবং বাংলার আরো অনেকে বাংলায় বিজ্ঞানের ওপর লিখবেন, অনুবাদ করবেন। গান যেমন অনেক সময় মনের আনন্দে আমরা গাই, সেরকম মনের আনন্দেই তাঁরা নতুন নতুন জিনিস বাংলা ভাষায় নিয়ে আসবেন। আমার মনে হয় ফারসীম মান্নান বা কাজী মাহবুব হাসান বাংলাতে যে বিজ্ঞান প্রবন্ধ লিখছেন তা সৃষ্টির তাগিদেই লিখছেন, লাভ ক্ষতির হিসেব করে লিখছেন না। মানুষের জীবনের সৃজনশীলতা এমনই। কোটি কোটি মানুষ যে ভাষাতে কথা বলে তাতে পৃথিবীর সম্পদের অনুবাদ হবে না বা নতুন জিনিস সৃষ্টি হবে না–এটা ভাবাই যায় না। আমি বাংলায় বিজ্ঞান পড়তে চাই সেই আনন্দেই। জাড্য, অপেক্ষক বা সংবেদী এই ধরণের কথাগুলো পড়ে বা ব্যবহার করে এক ধরণের তৃপ্তি হয়, সেটা হতে পারে নিতান্তই ব্যক্তিগত। হয়তো "শিক্ষিত" ও আত্মসচেতন সমাজ গড়তে এই শব্দগুলোর দরকার আছে। এই সঙ্গে এটা আমার একটা বিশ্বাস অন্ততঃ ১২ ক্লাস পর্যন্ত আমাদের শিক্ষার মাধ্যম অবশ্যই বাংলা হওয়া দরকার। কিন্তু সেই বাংলাকে দৃঢ় বাংলা হতে হবে। একই সঙ্গে সেই শিক্ষার্থী যে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য শিখবে সেটাকেও দৃঢ় হতে হবে। ১৮ বছর পর্যন্ত যে শিক্ষা তাই একটি মানুষের সারা জীবনের ভিত্তিভূমি গড়ে দেয়।

পরিশিষ্ট
এই পরিশিষ্টটি মূল আলোচনার বাইরে। উইকিপিডিয়ার মূল পাতাটিতে গেলে এই আন্তর্জাল বিশ্বকোষে কোন ভাষায় ক'টি আর্টিকাল আছে তার একটা পরিসংখ্যান দেওয়া আছে। আমি এখানে সেগুলোকে উল্লেখ করছি, একটু ধৈর্য ধরে সংখ্যাগুলো দেখুন এবং এই সংখ্যার পেছনের কার্যকারণগুলো কী হতে পারে সেটা নিয়ে চিন্তা করুন। উইকিপিডিয়াতে নিবন্ধের সংখ্যায় প্রথম দশটি ভাষা হল

ইংরেজী – ৩.৮ মিলিয়ন বা ৩৮ লক্ষ
জার্মান – ১.৩ মিলিয়ন বা ১৩ লক্ষ
ফরাসী – ১.২ মিলিয়ন বা ১২ লক্ষ
ডাচ – ৮৭০ হাজার
ইতালীয় – ৮৬৩ হাজার
স্প্যানিশ – ৮৪৫ হাজার
পোলিশ – ৮৪৫ হাজার
রুশ – ৭৯৪ হাজার
জাপানী – ৭৭৯ হাজার
পর্তুগীজ – ৭০৫ হাজার

এই তালিকায় যে দুটো ভাষা বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেটা হল ডাচ ও পোলিশ। সারা পৃথিবী জুড়ে হয়তো প্রায় ৬০ মিলিয়ন বা ৬ কোটি পোলিশ ভাষী আছে। আর ডাচ প্রথম ভাষা এরকম লোকের সংখ্যা ২৫ মিলিয়ন বা আড়াই কোটিও হবে না। পৃথিবীতে বাংলা ভাষী মানুষের সংখ্যা ৩০০ মিলিয়ন বা ৩০ কোটি দাবি করা হয়। এবার এশিয়ার চারটি ভাষার উল্লেখ করি।

ফারসী – ১৬৮ হাজার
আরবী – ১৬২ হাজার
হিন্দী – ১০০ হাজার
বাংলা – ২২ হাজার

এবার ওপরের চারটি ভাষার সঙ্গে কয়েকটি ভাষার পরিসংখ্যানের তুলনা না করে পারছি না।

লিথুয়ানিয়ার ভাষায় কথা বলে হয়তো ৩ মিলিয়নের বা ৩০ লক্ষের কিছু বেশী লোক । উইকিপিডিয়ায় এই ভাষায় আর্টিকাল আছে ১৪২ হাজার। এর মানে কী? এতগুলো আর্টিকাল লেখার মত তো তাদের লোকই থাকার কথা নয়। নিশ্চয় শত নিরক্ষরতা, শত দারিদ্র থাকা সত্ত্বেও বাঙালী শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সংখ্যা ৩ মিলিয়ন অন্ততঃ হবে? এটাতো সমগ্র বাংলাভাষীদের ১ শতাংশ মাত্র!

আর চীনারা? এই পরিসংখ্যানে চীনাদের স্থান কোথায়? মাত্র ৩৮৭ হাজার? পর্তুগীজ থেকে নিচে, ভিয়েতনামী থেকে একটু ওপরে? আসলে ব্যাপারটা তা নয়। চীনা ভাষার নিজস্ব হুদং আন্তর্জাল বিশ্বকোষে নিবন্ধের সংখ্যা প্রায় ৪ মিলিয়ন বা ৪০ লক্ষের কাছাকাছি। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বাইদু নামে আন্তর্জাল চীনা অনুসন্ধান যন্ত্রের নিজস্ব বিশ্বকোষে আর্টিকালের সংখ্যাও ৩.৫ মিলিয়ন। তবে হুদং বা বাইদু এই দুটি ওয়েবসাইট বাণিজ্যিক ও চীনা সেন্সরশীপের আওতাভুক্ত।

এই সব পরিসংখ্যান দেবার অর্থ কী? ডাচরা খুব ভাল ইংরেজী বলে। মাত্র ২৫ মিলিয়ন লোক নিয়ে ডাচরা উইকিপিডিয়ায় এতগুলো আর্টিকাল লিখছে কেন? বা লিথুয়ানিয়ানরা? একি সময় নষ্ট নয়? এগুলো তো তারা ইংরেজীতেই পড়তে পারে? এখানে শুধু বলতে পারি মানুষ শুধু লাভের জন্য কাজ করে না। মানুষ নিজের আত্মপ্রসাদের জন্যও কাজ করে। উইকিপিডিয়ায় বিভিন্ন ভাষায় লেখা প্রবন্ধের সংখ্যা সেই আত্মপ্রসাদেরই পরিমাপ। সেই পরিমাপ শুধু যে আমাদের শিক্ষার দৈন্য দশা নির্দেশ করে তাই নয়, আমাদের স্পৃহারও দৈন্য দশা নির্দেশ করে।

দীপেন ভট্টাচার্য : জ্যোতির্বিদ, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, রিভারসাইড, যুক্তরাষ্ট্র।