মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তামাশা বন্ধ হোক চিরতরে

আরিফ রহমান
Published : 5 Sept 2016, 03:34 PM
Updated : 5 Sept 2016, 03:34 PM

সম্প্রতি আলোচনায় ঘুরেফিরে আসছে দুটি আইনের কথা। এর একটি হচ্ছে, 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন- ২০১৬' এবং অপরটি হল, 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- ২০১৬'। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহুল আলোচিত এ আইন দুটি নিয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করব।

আমরা লক্ষ্য করেছি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কর্মকাণ্ড শুরু হওয়ার পর থেকেই দেশের স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মীমাংসিত ব্যাপারগুলো হেয় করার অপচেষ্টায় তাদের সর্বশক্তি দিয়ে লিপ্ত রয়েছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত এমনকি দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরাও ট্রাইব্যুনালের ভেতরে এবং বাইরে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করে আসছে। যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানরা এ দলে রয়েছে।

গত বছরের বিজয় দিবসে বিএনপির নেতা খালেদা জিয়াও ১৯৭১ সালের শহীদের সংখ্যা নিয়ে ধৃষ্টতামূলক মন্তব্য করেন। যদিও আমাদের দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলের বিভিন্ন গণহত্যা-সংক্রান্ত গবেষণায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে যেসব তথ্য বেরিয়েছে তাতে এ বিষয়ে কারও সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। গণহত্যা-সম্পর্কিত বেশকিছু গবেষণার কথা সংকলন করার চেষ্টা করা হয়েছে এই লেখকের 'ত্রিশ লক্ষ শহীদ: বাহুল্য নাকি বাস্তবতা' বইয়ে।

যা-ই হোক, আজকের আলোচিত আইন দুটির প্রয়োজনীয়তা বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে ইলেকট্রনিক মিডিয়া তথা অনলাইনে কী ধরনের অবমাননাকর মন্তব্য বা কথাবার্তা হয়ে থাকে। লেখার শুরুতেই তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আহমেদ শাহ মাসুদ নামের এক ব্যক্তির একটি পোস্টের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক।

কেউ কি কল্পনা করতে পারেন আমাদের দেশে এখনও এমন বাঙালি রয়েছে যারা মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ নিয়ে এরকম বিকৃত রসিকতা করতে পারে? কেউ কি ভেবে দেখেছেন কোনো বীরাঙ্গনা মায়ের কানে যদি এ খবর কোনোভাবে পৌঁছে যায় তাহলে তাঁর কেমন লাগবে?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা নিয়মিত তারা এ ধরনের লেখা অহরহ দেখে থাকেন। বছরখানেক আগে মুক্তিযুদ্ধে নিহত ভারতীয় সৈনিকদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ প্রসঙ্গে সরকারের উদ্যোগ নিয়ে সাংবাদিক অঞ্জন রায় একটি স্ট্যটাস দিয়েছিলেন। ওই স্ট্যাটাস সম্পর্কে বলতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড গোলাম আজমের পুত্র আবদুল্লাহ হিল আমান আজমী তার ফেসবুক ওয়ালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তৎকালীন কতজন সেনাসদস্য নিহত হয়েছিলেন তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। রাজাকারপুত্র আজমীর মতে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে চার হাজার ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার তথ্য আসলে একটি 'তত্ত্ব' ছাড়া কিছুই নয়! এত সেনাসদস্য নাকি কোনোভাবে নিহত হতে পারে না।

শুধু এটুকু লিখেই ক্ষান্ত হননি, আরও লিখেছেন, "বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে 'তিন মিলিয়ন শহীদ' হওয়ার বিষয়টিও একটি কাল্পনিক সংখ্যা!"

আজমী লেখেন:

"১৯৭১এর ৩ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় বাহিনী যে যুদ্ধ করেছে এই (ইস্টার্ন) ফ্রন্টে, তাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তেমন কোনো প্রতিরোধই করেনি, মাত্র ২-১টা ব্যাটল ছাড়া। তাহলে, এই ৪০০০এর তত্ত্ব/তথ্য তিনি কোথায় পেলেন? ১৯৭১এর সেই যুদ্ধ নিয়ে পড়াশুনা করেও কোথাও তো এই সংখ্যা কোনোদিন পাইনি! রায় বাবু কি 'তিন মিলিয়ন'এর মতো কোনো কাল্পনিক নতুন সংখ্যা নতুন প্রজন্মকে গিলাতে চাইছেন?"

তখন সেই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে এই বিতর্ক সেখানেই শেষ হয়নি, আলোচনার আগুনে ঘি ঢালতে নেমে পড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও।

আমরা আগেও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, প্রায় প্রত্যেক রাজাকারের বংশধর অন্তর্জালে সক্রিয় থেকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রোপাগাণ্ডা চালায়। এসবের পেছনে খরচ করা হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। এতে জড়িত আছে ছাত্র শিবির আর আছে এক শ্রেণির 'পেইড মিডিয়া' যারা ক্রমাগত মুক্তিযুদ্ধ, শহীদের সংখ্যা, বীরাঙ্গনাদের সংখ্যা নিয়ে বিদ্বেষপূর্ণ লেখালেখি করে।

এসব লেখার প্রত্যুত্তর যারা করেন তাদেরও আক্রান্ত হতে হয় এই অপশক্তির হাতে। বাকস্বাধীনতার নামে এসব দেশদ্রোহীদের যাচ্ছেতাই বাক্যের ব্যবহার আজও বন্ধ করতে পারিনি আমরা। এর কারণ মূলত একটাই– আমাদের দেশে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো ইতিহাস-বিকৃতি রোধে কোনো আইন নেই।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা বলা আরেকজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কামারুজ্জামানের পুত্র ওয়ামী। নিরন্তর মুক্তিযুদ্ধের অবমামনা ও হেয় করাই তার কাজ। বাংলা ব্লগিংয়ের প্রথম দিকেই মুক্তিযোদ্ধাদের জামায়াত-বিরোধিতার কারণে তাদের 'মেরুদণ্ডহীন মুক্তিযোদ্ধা' বলেছিলেন।

এছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কাদের মোল্লা বলেছিলেন, "কেউ সুন্দরী নারীর লোভে, কেউ হিন্দুর সম্পদ লুণ্ঠন, কেউ ভারতীয় স্বার্থরক্ষায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। কেউই আন্তরিকতা কিংবা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি।"

এই যুদ্ধাপরাধী যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে আরও বলেছিলেন, "দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই এত মাতব্বরি।"

১৯৭১ সালের অপরাধের সাজা হয়তো কাদের পেয়েছেন, কিন্তু ১৯৭১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত একটানা মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের যে অবজ্ঞা-তাচ্ছিল্য তিনি করে গেছেন তার বিচার আমরা করতে পারিনি।

বাংলাদেশ ইসলামিক ইউনিভার্সিটির আইন অনুষদের ডিন এ বি এম মাহবুবুল ইসলাম একবার বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধী হতে হলে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ হতে হয়। কিন্তু আমাদের এখানে যুদ্ধ হয়েছে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে। বাংলাদেশ সেই যুদ্ধের অংশ ছিল না। এ কারণে বাংলাদেশে কখনও যুদ্ধাপরাধী ছিল না।

প্রেস ইন্সটিটিউটের সভাপতি সাদেক খান বলেছিলেন, "একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারাও যুদ্ধাপরাধ করেছে, বিচার করতে হলে দুপক্ষেরই করতে হবে।"

বিএনপির সিনিয়ার নেতা গয়েশ্বর রায়ের কথা তো মনে আছে সবার। তিনি বলেছিলেন:

"পাকিস্তানের যারা বেতন-ভাতা খাইছে, শেষ দিন পর্যন্ত, তারা (শহীদ বুদ্ধিজীবী) নির্বোধের মতো মারা গেল, আমাদের মতো নির্বোধেরা প্রতিদিন তাদের শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ফুল দেয়। না গেলে আবার পাপ হয়। ওনারা যদি এত বুদ্ধিমান হন, তাহলে ১৪ তারিখ পর্যন্ত নিজের ঘরে থাকেন কী করে, একটু বলেন তো। আর তাছাড়া নিজ নিজ কর্মস্থলে প্রতি মাসে পাকিস্তানের বেতন খাইল, এটাও তো কথা বলা যায়, যায় না? পাকিস্তান সরকারের তারা বেতন খাইল, তারা হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধা।"

এসব লেখা বা মন্তব্য পড়লে আমাদের সাধারণ বাঙালিদেরই রক্ত গরম হয়ে ওঠে। আর যারা একাত্তরে নির্যাতিত হয়েছেন, সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার শিকার যারা তাদের কথা বলার কিছু নেই। দেশদ্রোহীদের হাতে মুক্তিযুদ্ধের এমন অবমাননার মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণ প্রজন্মসহ সাধারণ মানুষ আর মুক্তিযোদ্ধা-বীরাঙ্গনাদের দাবির প্রেক্ষিতে আজ আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন- ২০১৬'।

প্রশ্ন উঠতে পারে, আইন করে কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে না তো? মোটেও নয়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই জাতীয় মীমাংসিত বিষয়াদি নিয়ে বিতর্ক তৈরির চেষ্টা হলে আইনের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হতে পারে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর নিধনযজ্ঞ অস্বীকার নিয়ে করা 'Holocaust Denial Law' আর তুর্কিদের হাতে ১৫ লাখ আর্মেনিয়ান নিধন অস্বীকার নিয়ে করা 'Armenian Genocide Denial Law'– যে আইন দুটো শুধু যে জার্মানি আর আর্মেনিয়ায় প্রযোজ্য তা নয়। পৃথিবীর বহু দেশেই 'হিটলার ভালো মানুষ', 'তুর্কিদের হাতে গণহত্যা হয়নি'– এ ধরনের কথা বলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

'National Socialism Prohibition Law' অনুসারে অস্ট্রিয়ায় ন্যাশনাল স্যোশালিস্টদের গণহত্যার ইতিহাস অস্বীকার বা তাদের অপরাধ হালকা করার চেষ্টা বা তাদের কোনো কাজের বৈধতা খোঁজার কোনো চেষ্টা মিডিয়ায় (সব ধরনের) প্রকাশ করা যাবে না। এছাড়া বেলজিয়ামের 'Negationism Law' অনুসারে জার্মানির ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট আমলের গণহত্যার ব্যাপ্তি হালকা করা এবং সমর্থন বা বৈধতাদানের সব চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। চেক রিপাবলিকে এই আইনের নাম 'Law Against Support and Dissemination of Movements Oppressing Human Rights and Freedoms'– নাৎসি বাহিনীর গণহত্যার ইতিহাস অস্বীকার, সন্দেহ, অনুমোদন/স্বীকৃতি বা তাদের কাজের বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

জার্মানি 130 Public Incitement (1985, Revised 1992, 2002, 2005) অনুসারে জনসমক্ষে ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট আমলের অপরাধসমূহ অস্বীকার, সমর্থন বা তাদের অপরাধ লঘুকরণের চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। এ-সংক্রান্ত কোনো সিম্বল বা প্রতীক প্রচার ও প্রদর্শনও দণ্ডনীয় অপরাধ।

লুক্সেমবুর্গ Criminal Code, Act of 19 July 1997 অনুসারে ১৯৪৫ সালের আন্তর্জাতিক ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে ঘোষিত যুদ্ধাপরাধ অস্বীকার, সমর্থন, লঘুকরণের প্রচেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রোমানিয়ায় Emergency Ordinance No. 31 of March 13, 2002 অনুসারে গণহত্যার ইতিহাস অস্বীকার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রেসিস্ট, জেনোফোবিক বা ফ্যাসিস্ট সিম্বল প্রচার দণ্ডনীয় অপরাধ। এমন আইন আরও অনেক দেশে রয়েছে।

আমাদের 'মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন- ২০১৬'এর খসড়ায় কী বলা হয়েছে?

১. ১৯৭১ সালের ১ মার্চ হতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাসমূহ অস্বীকার;

২. মুক্তিযুদ্ধের কোনো ঘটনাবলি হেয় প্রতিপন্ন করিবার উদ্দেশ্যে দেশি বা বিদেশি গণমাধ্যম বা প্রচারমাধ্যমে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রদান বা প্রচার;

৩. ১৯৭১ সালের ১ মার্চ তারিখ হইতে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রচারিত বা প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-সংক্রান্ত দলিলসমূহ এবং উক্ত সময়ের যে কোনো ধরনের প্রকাশনার অপব্যাখ্যা বা অবমূল্যায়ন;

৪. মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা বা জনগণকে হত্যা, ধর্ষণ ও তাহাদের সহায়-সম্পত্তি লুটতরাজ বা তাহাতে অগ্নিসংযোগ-সংক্রান্ত যে কোনো তথ্যের অবনমন; মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত কোনো ঘটনা, তথ্য বা উপাত্ত ব্যঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন;

৫. ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি দখলদার সশস্ত্র বাহিনী, তাহাদের বিভিন্ন সহায়ক বাহিনী, যেমন, রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি ইত্যাদির বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমের পক্ষে কোনো ধরনের যুক্তি প্রদর্শন বা প্রচারণা; মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তিবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ সমর্থন বা উক্ত রূপ অপরাধের বিচার-কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধকরণ।

এ আইনে শাস্তি রাখা হয়েছে ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সঙ্গে অর্থদণ্ড। একই অপরাধ দুবার সংগঠিত হলে সাজাও দ্বিগুণ করা হবে।

আর প্রস্তাবিত 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- ২০১৬'এর দিকে। এ আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে;

"কোনো ব্যক্তি যদি ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আদালত কর্তৃক মীমাংসিত মুক্তিযুদ্ধের বিষয়াবলী বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডা, প্রচারণা বা তাতে মদদ দেয়, তাহলে তার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা তিনি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।"

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি নিয়ে কিছু বিতর্ক তৈরি হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আইনে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' বলতে আসলে কী বোঝানো হয়েছে, সেটি 'মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন- ২০১৬'এর মতো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা উচিত ছিল। কারণ, সাধারণ মানুষ চায়, কোনো সরকার চাইলেই যেন এ আইন নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে। যেমন, 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কাজ' কথাগুলো বিতর্কের সৃষ্টি করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনেকের কাছে অনেক রকম। এর হাজারটা ইন্টারপ্রিটেশান বা মানে তৈরি করা সম্ভব।

জহির রায়হান তাঁর একটি লেখায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সবাই একটি ফুলকে বাঁচাতে যুদ্ধে যায়নি– এই কথাটা আমাদের মনে রাখা দরকার। মুক্তিযুদ্ধ যেহেতু গণমানুষের মুক্তির আন্দোলন, তাই সেখানে একেক জন একেক আদর্শিক অবস্থান থেকে অংশ নিয়েছেন।

এই সভ্য পৃথিবীতে শত বছর আগে ঘটে যাওয়া প্রায় বিস্মৃত গণহত্যা নিয়ে আজেবাজে কথা বলেও পার পাওয়ার সুযোগ নেই। অথচ আমাদের দেশে এখনও মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনারা বেঁচে আছেন, বুদ্ধিজীবীর শার্ট বুকে নিয়ে বেঁচে আছেন তাদের পরিবার-সন্তান। তবুও পুরো মুক্তিযুদ্ধকেই 'অস্বীকার' করে ফেললে কিছু যায় আসে না!

আশা করা যায়, এ দুটি আইন আমাদের রক্ত দিয়ে অর্জিত ইতিহাসের নানাবিধ উদ্ভট ব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্ত করার সব সুযোগ নস্যাৎ করবে। আমরা চাই, বাংলাদেশের মাটিতে থেকে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদদের অবমাননা করে, বীরাঙ্গনা মা-বোনদের অপমান করে কেউ যেন আর মাথা উঁচু করে ঘুরতে না পারে।