পরিত্যক্ত বিমানবন্দর সরিয়ে নিলে সমস্যা কী?

ইকবাল হাবিব
Published : 16 Oct 2011, 03:47 PM
Updated : 16 Oct 2011, 03:47 PM

স্বাধীনতা উত্তর একটি দেশের রাজধানী হিসাবে ঢাকা নগরীর বেড়ে ওঠা তার পূর্বেকার ৩৫০ বছরের চেয়ে ভিন্নতর। প্রশাসন, বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতের রাজধানীকেন্দ্রিক কার্যক্রমের ফলে অতিমাত্রায় অভিবাসন ও সেই সাথে অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা বিস্ফোরণে নগরীর বৃদ্ধির ধারায় অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর পরিসর ৩৬ বছর সময়ের মধ্যে বৃদ্ধি পায় ১৮ গুণ আর জনসংখ্যা প্রায় ২৫ গুণ।

এই পুরো কার্যক্রমটিই আবার ঘটছে অপরিকল্পিত নগরায়ন আঙ্গিকে। এই বৃদ্ধির ধারায় ধারণ করার মত ছিল না কোন 'মহাপরিকল্পনা' বা 'নকশা', কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকী বা পর্যবেক্ষণ। ফলে 'রূপকল্প' বা 'ভিশন'বিহীন এ যাত্রায় নগরীটি কালক্রমে মহা যানজট, জলজট ও জনজটের শহরে পরিণত হয়। এর অযুত সম্ভাবনা বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার চাপে আর অনিয়ন্ত্রিত কার্যক্রমের যাতাকলে পিষ্ঠ হয়ে নিঃশেষিত প্রায়।

এর চারপাশের নদী খাল-বিল, ঝিল, পুকুর, উদ্যান ইত্যাদি বিলীনের পথে। গত দশক থেকে যখন পরিকল্পিত নগরায়ণ ব্যবস্থায় এ নগরকে সন্নিবেশিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়, সেই প্রয়াসও যথাযথ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার অভাবে স্থগিত প্রায়।

আর তাই সমতার ভিত্তিতে সম্পদ আর সম্ভাবনা বণ্টনের অভাব এবং সেই সাথে জল-স্থল, উড়াল ও রেলপথের সমন্বয়ে একটি সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে এ শহর এখন অযুত সম্ভাবনা নিয়েও বসবাসের অযোগ্য হওয়ার পথে।

দ্রুত বেড়ে ওঠা এ নগরী বুড়িগঙ্গার পাড় থেকে লালমাটির উঁচু বসবাসযোগ্য ভূমিরূপের ট্র্যাক ধরে দক্ষিণ থেকে উত্তরে যাত্রা শুরু করে। আর এ যাত্রা পথেই মাঝখানে এই ১৯৮৮ সালে পরিত্যক্ত ঘোষিত বিমানবন্দর আর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার কারণে দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে পশ্চিমে আগারগাঁও-শ্যামলী হয়ে মিরপুর পর্যন্ত বিস্তৃত হয় আর পূর্বে মহাখালী বনানী হয়ে উত্তরা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

ফলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দু'ধারায় নগরীর বিজয় সরণি এলাকা থেকে একটি বিপজ্জনক প্রবৃদ্ধি ঘটতে শুরু করে যা নগর উন্নয়নের বিবিধ কার্যক্রমকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। ফলে অসহনীয় যানজট আর জলজটের শিকার হতে শুরু করে নগরীর উত্তরাঞ্চলের এক বিরাট জনগোষ্ঠী। আর এভাবেই সম্ভাবনাময় উত্তরমুখী যাত্রাটি স্থবির অচলায়তনের জন্ম দিয়েছে। এধারায় সাম্প্রতিককালের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নগর উন্নয়ন কার্যক্রমের অসহায় স্থগিতকরণ এখানে উল্লেখ করতে চাই:

. গত দুই দশকে যানজট নিরসনে শাহীন কলেজের সামনে থেকে আসা পশ্চিমমুখী সড়কটি ১৯৮৮ সালে পরিত্যক্ত রানওয়ের তলা দিয়ে সুড়ঙ্গ পথে আগারগাঁও বালক বিদ্যালয়ের দক্ষিণ কোণে রোকেয়া সরণির সাথে যুক্ত করার দীর্ঘদিনের প্রস্তাবকে বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অসংখ্য গাছ বিনাশ করে একটি জটিল 'লুপ রোড' করে দাবিটিকে ভবিষ্যতে অযৌক্তিক করার প্রয়াসও নেয়া হয়েছে।

. গত এক দশক ধরে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন কর্তৃক উপহারকৃত স্থায়ী দেশীয় পণ্য প্রদর্শনী কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাবটিও দীর্ঘদিনের অবজ্ঞাভরে বিভিন্ন অজুহাতের মাধ্যমে অনুমোদন-পুনরায় অনুমোদনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে 'প্রায় বাতিল' করা হয়েছে।

. বিমান বাহিনীর মতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনাল স্থাপনা তথা কৌশলগত সম্পদ (স্ট্রাটেজিক অ্যাসেট)। মূলত একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে স্বল্পতম দূরত্বে এই আন্তর্জাতিক এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অননুমোদিত রানওয়েটি ঘনবসতির এই নগরীর উর্ধ্বমুখী বিনির্মাণ কার্যক্রম বিনা প্রয়োজনেই টুটি চেপে ধরে রেখেছে, এখানে অবস্থানকারী তিনটি স্কোয়াড্রোনের দুটি হেলিকপ্টার স্কোয়াড্রোন যা মূলত 'রোটারি ইঞ্জিন' নির্ভর বলে দীর্ঘ রানওয়ের তেমন প্রয়োজন হয় না।

অপরটি অর্থাৎ 'স্পেশাল ফ্লাইং ইউনিট' দুটো সি-১৩০ বিমান পরিচালনা করে যা স্বল্প দূরত্বের রানওয়ে উপযোগী এবং কদাচিৎ এই রানওয়ে ব্যবহার করে।

অথচ এর কারণে বিশেষত উড্ডয়ন-অবতরণ অ্যাপ্রোচ ফানেল সংরক্ষণের নামে নকশানুযায়ী, বিশাল নগর এলাকায় আজ উর্ধ্বমুখী উন্নয়ন স্তব্ধ। এতে করে ঘন নির্মাণের বিপরীতে 'সবুজ প্রাঙ্গন তৈরি করে উচ্চতর কাঠামো বিনির্মাণের কৌশল' অবলম্বনের মাধ্যমে নগর বিনির্মাণে সবুজায়নের যে প্রস্তাব ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও ড্যাপের মাধ্যমে কার্যকর করার ধারা সেটি সম্পূর্ণ বাধাগ্রস্ত হয়ে আছে।

উপরন্তু, বিমান বাহিনী থেকে এ বিমানবন্দরে প্রশিক্ষণ বিমান, জেট বিমান পরিচালনা করা হয় বলে অগ্রহণযোগ্য দাবি করে এই উন্নয়ন প্রতিবন্ধি অবস্থাকে সংহত করায় লিপ্ত। এ প্রসঙ্গে বিমান বাহিনী ও সেনাকল্যাণ ট্রাস্ট কর্তৃক এই সম্পর্কিত 'সিএআর-৮৪' এর নিয়ন্ত্রণকে উপেক্ষা করার দুটো উদাহরণ পেশ করছি, যথা- ফ্যালকন টাওয়ার (উচ্চতা ১১০ ফুট) এবং সদ্য তৈরি ট্রাস্ট ব্যাংক টাওয়ার (উচ্চতা ১৭০ ফুট)।

অতএব (বিমান বাহিনীর ভাষায়) শুধুমাত্র জরুরি আর পরিবহন বিমান অবতরণের দোহাই দিয়ে উচু ভবন তো দূরস্থ, যানজটের নিরসনে সাহায্যপ্রাপ্ত একটি গণপরিবহন ব্যবস্থা 'মেট্রো রেল' ও এর গুরুত্বপূর্ণ রুটও বাতিল করার যুক্তি উপস্থাপন করে সমগ্র উন্নয়নকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছে।

. উড্ডয়ন অবতরণ পথ বা অক্ষ ও অ্যাপ্রোচ ফানেলের যুক্তি উপস্থাপন করে যে ধুম্রজাল তৈরি করা হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন:

ইতোমধ্যে অনুমোদিত নভোথিয়েটারটি ৭২ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট একটি কাঠামো যা অবতরণ অক্ষের ওপর অবস্থিত। যদিও বিমান বাহিনীর মতে সামান্য 'ল্যাটেরাল ম্যানুওভার' করে উড্ডয়ন অবতরণ এক্ষেত্রে নিয়োজিত হয়। অথচ এর সম্মুখের ৩৪ ফুট কাঠামোর 'মেট্রোপথ' যা বাহনসহ উচ্চতায় ৫৯ ফুট দাঁড়াবে, তার কারণে তথাকথিত 'জেট বিমান ও পরিবহন বিমান' নামতে বাধাগ্রস্ত হবে।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বর্তমান টান ডাউন লাইন সাপেক্ষে নভোথিয়েটারের ডোমটির কোণ বা অ্যাঙ্গেল ২৬ ডিগ্রি ফলে মেট্রোপথ বাহনসহ এর কৌণিক পথের ছায়ায় অবস্থান করে, অর্থাৎ কোন বাড়তি বাঁধা সৃষ্টির সুযোগই নাই। তাছাড়া নতুন 'লুপ রোড' এর 'বৈদ্যুতিক আলোর খুঁটি'গুলো হিসাবে আনলে এই ২৬ ডিগ্রি আরও অনেক বেড়ে যায়।

স্মরণযোগ্য যে, এই মেট্রোকাঠামো কিছু দক্ষিণে সরিয়ে (বিজয় সরণীর সড়ক ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করে) অথবা বুয়েট প্রফেসর সামছুল হক প্রস্তাবিত 'টাচ ডাউন মার্কটি' প্রায় ৯৮০০ ফুট দৈর্ঘ্যের এই রানওয়ের দক্ষিণপ্রান্ত থেকে আরও প্রায় ১০০০ ফুট উত্তর দিকে প্রতিস্থাপিত করলে কাম্য 'অ্যাপোচ অ্যাঙ্গেল' অর্জিত হয়। যেখানে সি-১৩০বি বিমানের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান লকহীড মার্টিনের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী 'টেক অব রান' বা TOR সর্বোচ্চ ৪৭০০ ফুট। কিন্তু কোন ধরনের বিকল্প চিন্তা বা যুক্তির আদান প্রদান ছাড়াই এই সংস্থাটি দৃঢ়তার সঙ্গে নিরাপত্তার মতো সংবেদনশীল ও অস্পর্শ বিষয়ের ধুয়ো তুলে অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটিকে বিকারহীনভাবে বাতিলের পথ প্রশস্ত করেছেন।

. দুর্যোগকালীন সময়ের ব্যবহার আর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিকল্পের যে দাবি তা এক কথার কল্পগাঁথা। গত দশকের ঐতিহাসিক সত্যতা বলছে, এই রানওয়ে কখনই বিকল্প চিন্তায় থাকে নি বরং অনতি দূরের চট্রগ্রামই উড্ডয়ন-অবতরণ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনসিদ্ধ বিকল্প।

আর গত শতকের প্রায় সব দুর্যোগে হযরত শাহজালাল রানওয়েই ব্যবহৃত হয়েছে। তাছাড়া বিমানবাহিনীর দাবিকৃত 'দেশি-বিদেশী বিমান পরিচালনা সুবিধা' এই রানওয়ে ধারণও করে না। আমরা বরং এক্ষেত্রে সরকারের কাছে শাহজালাল বিমানবন্দরের ক্ষেত্রে একটি অতিরিক্ত সমান্তরাল রানওয়ে তৈরির পাশাপাশি তার আধুনিকায়নে দীর্ঘদিনের বিভিন্ন ব্যবহারকারী মহলের দাবিটিকে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করছি।

. প্রতিরক্ষা বিষয় 'আকাশ কৌশল' বা এয়ার স্ট্র্যাটেজির দৃষ্টিকোণ থেকে বিমান বাহিনী এই অতি জনঘন বসতিপূর্ণ রাজধানীর অভ্যন্তরে পরিত্যক্ত বিমান ঘাটিকে 'কৌশলগত স্থানিক গভীরতা' বা স্ট্র্যাটেজিক ডেপ্থ-এর বিবেচনায় অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন।

এ ক্ষেত্রে শাহজালাল বিমানবন্দরের 'ট্যাক্টিক্যাল রিডানডেন্সি' হিসাবে এর গুরুত্বকেও তুলে ধরেছেন। কিন্তু তিনি যা আলোকপাত করেন নি, তা হচ্ছে যুদ্ধকালীন সময়ে 'মানব বর্ম' কৌশলের মতো ঘৃণিত ও সর্বদেশ কর্তৃক বর্জিত কৌশলের অংশ হিসাবেই কেবল এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি কোন দেশের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ও প্রতিরোধ কৌশলের অংশ হতে পারে।

স্মরণযোগ্য যে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ের বিমানবন্দরটি ছিল শহরপ্রান্তে আর ক্রমান্বয় নগরায়ণের ফলে এখন এর অবস্থান ঘনবসতিপূর্ণ নগরীর অভ্যন্তরে। তাই জননিরাপত্তার বিবেচনায় এই বিমানবন্দরটিই স্থানান্তর একান্ত বিবেচনার দাবি রাখে।

সব বিবেচনায় রাজধানীর সমন্বিত উন্নয়নে পরিকল্পিত নগরায়ণ ব্যবস্থার অধীনে নগর সুবিধা, সুষ্ঠু গণপরিবহন ব্যবস্থা নির্ভর চলাচল, আর সুষম ভূমি ব্যবহার বিন্যাস নিশ্চিত করে যানজট-জলজট-জনজট মুক্ত বসবাসযোগ্য ঢাকা মহানগরীর বিনির্মাণে 'পরিত্যাক্ত' পুরাতন বিমানবন্দরসহ সকল সামরিক স্থাপনা নগর অভ্যন্তর থেকে অপসারণের কোন বিকল্প নেই।

জনস্বার্থে গণতান্ত্রিক সরকার অবিলম্বে এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন এবং নগর উন্নয়ন কার্যক্রম ও প্রকল্পের ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের সকল বাধা, অপপ্রচারণা ও জনবিরোধী প্ররোচনার বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকবেন, সেই প্রত্যাশাই সকলের।

ইকবাল হাবিব : স্থপতি এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর যুগ্ম সম্পাদক।