জঙ্গিবাদ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমাচার

কাজী আহমদ পারভেজ
Published : 8 August 2016, 06:20 AM
Updated : 8 August 2016, 06:20 AM

৪ আগস্ট দিবাগত রাতে এক টিভি চ্যানেলে আলোচনার একপর্যায়ে বলা শুরু করেছিলাম, কেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার জন্য বেশি ঝুঁকিতে থাকে। প্রথম যে কারণটা ব্যাখ্যা করছিলাম তা হল, তাদের বিচ্ছিন্নতা (আইসোলেশন)। কী কী কারণে তাদের বেশিরভাগই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আর দু'দশটা শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি বিচ্ছিন্নতায় ভোগে, সেটাই বলা শুরু করেছিলাম। তবে ওই অনুঠানের সময়-স্বল্পতার কারণে আলাপটা আর শেষ করা যায়নি। কথা আছে, আগামী কোনো একদিন এই প্রসঙ্গে আবার আলাপচারিতায় অংশ নেওয়ার।

আমার জন্য অবাক করা অভিজ্ঞতা ছিল, পরদিন, অর্থাৎ ৫ তারিখ সকালের সংবাদপত্রে চোখ বুলানোর সময়। দেখলাম, সবার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও একই মনোভাব পোষণ করেন। তাঁর মতেও, বিচ্ছিন্নতাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জঙ্গিবাদে ঝুঁকে পড়ার মূল কারণ। অবশ্য উনি এই বিচ্ছিন্নতার পিছনে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, আমি কিন্তু আমার অংশ নেওয়া টিভি অনুষ্ঠানে তা থেকে ভিন্ন ব্যাখ্যাই দিচ্ছিলাম। এখানে আমার সে-সম্পর্কিত অভিমত পূর্ণাঙ্গভাবে জানাব।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিচ্ছিন্নতার পিছনে যে কারণগুলি চিহ্নিত করেছেন তা হল:

১) মাতৃভাষা চর্চ্চা না-করা; ২) ইতিহাস না-পড়া বা না-জানা; ৩) সামাজিক-সংস্কৃতির শিক্ষা না থাকা।

তিনি আরও অভিমত দিয়েছেন যে, এসব কারণে ঘটা বিচ্ছিন্নতাই শিক্ষার্থীদের হয় জঙ্গিবাদ অথবা মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে ফেলছে। আমি বিনয়ের সঙ্গে স্যারের এই মন্তব্যের কিছু দুর্বলতা চিহ্নিত করার দুঃসাহস দেখাতে চাচ্ছি।

যে বয়সে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে, ততদিনে সে মাতৃভাষা চর্চা করেনি, ইতিহাস পড়েনি অথবা সামাজিক-সাংস্কৃতিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল, এই অনুমানগুলি মেনে নেওয়া কঠিন। হতে পারে, জাতীয় পাঠ্যক্রম অতিক্রম করা শিক্ষার্থী, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থী বা মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, এই তিন ক্ষেত্রে শিক্ষাগ্রহণের গভীরতায় ফারাক রয়েছে। কিন্তু সেগুলোয় এমন অনতিক্রম্য কোনো ফারাক আছে– যা তা তাদের বিচ্ছিন্নতার কার্যকাণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে– এমনটা আমার কখনও মনে হয়নি।

এটা আরও বলতে পারি এ কারণে যে, অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েই উপরের সবগুলা না হলেও অনেকগুলা বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোর্স পড়ানো হয়। মূলপাঠ্য বিষয়ের পাশাপাশি ক্রেডিট কোর্স হিসেবে বাংলা, সোশিওলজি বা সোশ্যাল সায়েন্স, বাংলাদেশ স্ট্যাডিজ, ভ্যালু অ্যান্ড ইথিকস ইত্যাদি বিষয়ের দুই বা ততোধিক কোর্স বেশিরভাগ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই করে থাকে। তাই জ্ঞানের অভাবে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, এটা মানা আমার জন্য কঠিন।

যে কারণগুলো এই বিচ্ছিন্নতার পিছনে বেশি দায়ী বলে আমার মনে হয় তা হল:

১) বিভিন্নতা বা ভ্যারাইটি: প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নানা ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থী এসে জড়ো হয়। এই ব্যাপারটাই আমার দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্নতার মূল উৎস। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এদের মধ্যে যেমন অনেক আলালের ঘরের দুলাল আছে, আবার আছে 'বাপে-তাড়ানো, মায়ে-খেদানো' হতদরিদ্র কেউ। আছে খুব নামিদামি প্রতিষ্ঠানের অতি-ভালো ফলাফলধারী, আবার আছে অতিসাধারণ প্রতিষ্ঠানে পড়া সাধারণ ফলাফলধারীও। শহরে জন্ম নেওয়া বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থী যেমন আছে, শহরে না-থাকারাও আছে। মূলধারার বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীর সঙ্গে রয়েছে ইংলিশ মিডিয়াম ও মাদ্রাসায় পড়া শিক্ষার্থী। আছে সারাজীবন বিজ্ঞান পড়া শিক্ষার্থী, আবার কখনও বিজ্ঞান না পড়ারাও। এছাড়াও ধর্মীয়, এলাকাভিত্তিক ভিন্নতা তো রয়েছেই।

কথা উঠতে পারে, এরকম ভিন্নতা তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও আছে, সেখানে কি এই ভিন্নতা বিচ্ছিন্নতার উৎস হিসেবে কাজ করছে না?

হ্যাঁ, তা তো কিছুটা করছেই। কিন্তু দুইটা কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রকট নয়। আর সেখানে বিচ্ছিন্নতা কিছু থাকলেও সেটা তেমন একটা চোখে পড়ার মতো নয়। আসুন জেনে নিই, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বিচ্ছিন্নতা প্রতিরোধক কারণগুলির কথা।

ক) প্রথমটা হল, ভিন্নতার ক্ষেত্রসমূহে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটা মেইন স্ট্রিম থাকে। ভিন্নতা-সম্পন্নরা সেখানে এতটাই মাইনরিটি যে তারা নিজেদের বৈশিষ্ট্য ধরে না রেখে বরং ওই মেইন স্ট্রিমের অংশ হয়ে উঠতে সচেষ্ট হয়। শুরু থেকেই এটা ঘটে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগের এই প্রবণতার দরকার পড়ে না। কারণ, বেশিরভাগ ভিন্নতার ক্ষেত্রেই তারা সংখ্যাধিক্যের কারণে নিজেদের আইডেনটিটি ধরে রেখে দৈনন্দিন কার্যক্রম চালাতে পারে।

খ) দ্বিতীয় কারণটি রিসোর্স-সম্পর্কিত। ভিন্নতা ভাঙার জন্য শিক্ষার্থীদের মেলামেশার ও অ্যাকটিভিটির যে সুযোগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য থাকে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেলায় অনেক সময় তা থাকে না।

স্থান সংকুলান না হওয়ায় বেশিরভাগ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এমনভাবে ক্লাস-রুটিনগুলো করে থাকে যেন শিক্ষার্থীরা ক্লাসের বাইরে ন্যূনতম সময় ক্যাম্পাসে কাটায়। এতে সহপাঠীদের সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে অন্যদের ভিন্নতার সঙ্গে পরিচিত হওয়া, সেগুলো মেনে নেওয়া, নিজের ভিন্নতা সহজ করে দেখা-– এসব সুযোগ খুব একটা হয় না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এই পরিস্থিতি অনেক বেশি শিক্ষার্থী-বান্ধব।

২) জঙ্গি-বান্ধব শিক্ষকদের প্রভাব: আগে থেকেই যারা জঙ্গিবাদে দীক্ষাপ্রাপ্ত, তাদের পক্ষে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সংশ্লিষ্ট হওয়া যতটা সহজ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ততটা নয়। আবার এরা একবার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়িয়ে গেলে তাদের জন্য বিচ্ছিন্নতায় ভোগা শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করে তাদের যে কোনো র‌্যাডিক্যালাইজেশনে উৎসাহ দেওয়া, উদ্বুদ্ধ করা এবং সেটাতে ধরে রাখা ওই শিক্ষকদের জন্য ফ্যাসিলিটিগত কারণে অনেক সহজ।

৩) প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে রিসোর্স ও স্থানের অপ্রতুলতা: আগেই বলেছি, এই এক কারণেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কাছে কাম্য থাকে এটাই যে, শিক্ষার্থীরা যেন যথাসম্ভব কম সময় ক্যাম্পাসে থাকে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য কো-কারিকুলাম অ্যাকটিভিটি ও এর মাধ্যমে আইস-ব্রেকিংএর ইচ্ছা ও সামর্থে ঘাটতি দৃষ্টি এড়ায় না।

এটা অনস্বীকার্য যে, বেশিরভাগ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানের চর্চার জন্য নয়; বরং ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই স্থাপিত হয়েছে কোনো না কোনো বড় ব্যবসায়ীর পৃষ্ঠপোষকতায়। তারপরও দিনের শেষে, মূলত এটা একটা জ্ঞানচর্চা ও মানুষ গড়ার কারখানা। ওই ব্যবসায়ীরা তাদের কারখানার ত্রুটিপূর্ণ পণ্য স্ক্র্যাপ হিসেবে বেঁচে দিলে ক্ষতি নেই, কিন্তু মানুষ গড়ার কারখানায় সে সুযোগ নেই। তাই আমাদের ভাবতে হবে, এসব প্রতিকুলতার কুপ্রভাব আমরা কীভাবে অতিক্রম করতে পারি।

আমার সুপারিশ হল:

১) বিভিন্নতা যেহেতু দূর করা যাবে না, এগুলো মাথায় রেখে প্রতি সেমিস্টারে এমনভাবে অদল-বদল করে গ্রুপগুলো তৈরি করতে হবে যেন সবাই ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সহপাঠীদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পায়। আর এর মাধ্যমে অন্যদের প্রতি থাকা মানসিক প্রতিবন্ধকতা তারা দূর করতে পারে।

২) শিক্ষক নির্বাচনের সময় কেবলই ডিগ্রি, রেজাল্ট ও সাশ্রয়ের চিন্তা না করে, এসবের পাশাপাশি মানসিক উদারতার বিষয়টি ধর্তব্যে রাখা হয়। কেউ র‌্যাডিকাল ভাবনা-চিন্তার অধিকারী, এটা জানা গেলে দ্রুত যথপোযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

৩) কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটি বাড়ানো উচিত। এ জন্য নিজস্ব স্থানের অপ্রতুলতা থাকলে প্রযোজনে ভাড়া করা ফ্যাসিলিটির কথা ভাবতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষার্থী যেন কোনো না কোনো সহশিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আসে, সেটা নিশ্চিত করা দরকার। প্রযোজনে এ জন্য ন্যূনতম বা বিনামূল্যে কিছু ক্রেডিটের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।

এখানে যা যা বললাম, সেসব কেবলই ভাবনা-চিন্তার সূত্রপাত। বিষয়গুলি নিয়ে আরও খোলাখুলি ও বিস্তারিত আলাপ হবে, সে আশাবাদ রাখছি।