দুর্গাপূজা কেন বাঙালী হিন্দুদের প্রধান উৎসব

স্বামী স্থিরাত্মানন্দ
Published : 2 Oct 2011, 02:15 PM
Updated : 2 Oct 2011, 02:15 PM

দর্শন, পৌরাণিক কাহিনী, আনুষ্ঠানিকতা–এ তিন মিলেই ধর্ম। বেদের উপনিষদসমূহ, ব্রহ্মসূত্র ও গীতা–এগুলি সনাতন ধর্মের দর্শন। এ দর্শনকে সহজ করে পৌরাণিক কাহিনীতে যেমন রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত–এসব পুরাণে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। সসীম জীব অসীম ঈশ্বরকে লাভ করে জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হবে। এটাই প্রত্যেক জীবের অন্তরের আকাংখা। এজন্য ধর্মকে সে গ্রহণ করে।

আধ্যাত্মিক সাধনা হল ভাব সাধনা। ঈশ্বরের অনন্ত ভাব। একটা ভাবকে অবলম্বন করে সাধককে এগিয়ে যেতে হয়। এ ভাবগুলি হল–শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর। সন্তান বাৎসল্য–রাম ও কৌশল্যা, গোপাল ও যশোদার মধ্যে দেখা যায়। মাতৃভাব সাধনা–সন্তানভাব কন্যাভাব–গৌরীভাব। এ ভাব বাঙালি সমাজের নিত্যদিনের ঘটনা। বাঙালী সমাজের সামাজিক, পারিবারিক, স্নেহমধুর বেদনাবিধুর ভাব অবলম্বনে সাধক সমাজে খুব সমৃদ্ধ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে। আধ্যাত্মিক সাধনাও একে অবলম্বন করে আছে। মা মেনকার মেয়ে উমার প্রতি স্নেহের প্রকাশ বাঙালি খুব আপন করে নেয়, খুব প্রাণ দিয়ে বুঝতে পারে। কন্যার শ্বশুর বাড়ি যাবার অনুভূতি মায়ের আকুতি–এসব দেখে বাঙালি সমাজ অভ্যস্ত। এসব ভাবের সাথে ধর্মকে এক করে নিয়ে জীবন থেকে ধর্ম যে আলাদা নয়, এসব ধারণা হয় বলে বাঙালি হিন্দু সমাজ দুর্গাপূজায় মেতে ওঠে। বাঙালি মায়ের মনকে জীবন্ত করে তুলেছেন সাধক কবি। বলছেন—'যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী, উমা নাকি বড় কেঁদেছে।' বাঙালি মা হিমালয়-পত্নী মেনকার অন্তরে বিকশিতা। তিনি হিমালয়কে বারে বারে অনুরোধ করছেন, মেয়ে উমাকে কৈলাশ থেকে নিয়ে আসার জন্যে। হিমালয় আজ নয় কাল করে করে মেনকাকে ভুলিয়ে রেখেছেন। মা মেয়েকে স্বপ্নে দেখেছেন উমা 'মা মা' বলে কেঁদেছে মায়ের কাছে আসবে বলে। বাঙালি মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় মা আর মেয়ের চোখের জলকে নিয়ে মাতৃস্নেহের পরাকাষ্ঠা। যশোদার  গোপালের বিরহে, কৌশল্যা রামের বিরহে ঠিক একই অবস্থা। এ কাহিনী পড়ে ভগবানের লীলা চিন্তা করে তাঁর বাৎসল্য রসের আস্বাদন করে সাধক ধন্য হন। সেই এক ভাবই মেনকার অনুরোধ হিমালয়কে। উমাকে নিয়ে আসার জন্য করুণ মিনতি, অনুযোগ। বাঙালির ঘরে জগজ্জননী মেয়ে হয়ে স্নেহরস আস্বাদন করেন। বাঙালিও হয় ধন্য তার সাধারণ জীবনের সাথে ধর্মজীবনের সহজ সম্পর্ক স্থাপন করে।  মেয়ে আবার বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর ঘরে যাবে–সেখানেও তার সন্তান রয়েছে–তাদের দেখতে হবে–মেয়ে মা হয়ে দায়িত্ব নিয়েছে–মা খুশি। উমার মাহাত্ম্য, জগজ্জননীর মাহাত্ম্য কি মেনকা জানেন না? জানেন। মায়ের কাছে সন্তান সন্তানই। উমাপতি ভোলানাথ মুষ্ঠির ভিখারী ছিলেন। গৌরীর ভাগ্যে কাশীতে তিনি এখন বিশ্বেশ্বর হয়েছেন। আর উমা হয়েছেন অন্নপূর্ণা–অন্নদায়িনী। জীবের জীবিকা নির্ধারণ করছেন। মা দেখছেন মেয়ের ঐশ্বর্য।

মার্কণ্ডেয় পুরাণের চণ্ডীতে মহামায়া দুর্গার পূজা বিশেষভাবে প্রকাশিত। অসুরদলনে, দুঃখ-দুর্গতি নাশে মা দুর্গার পূজা দেব-মানবের অবশ্য করণীয়। দুর্গাপূজায় লাভ ভোগ ও মুক্তি–যে যা চায় সে তাই পায়। (স্বর্গাপবর্গদে দেবি নারায়ণি নমোহস্তুতে)। রাবণ বিনাশে অকাল বোধনে দুর্গাপূজা করেছিলেন স্বয়ং রামচন্দ্র। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন দুর্গার স্তব করতে যুদ্ধ জয়ের জন্য। আর ভাগবতে যোগমায়া দেবী দুর্গার আবির্ভাব ও তাঁর পূজার কথা বলে দিয়েছেন স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু। দুর্গতিনাশিনী দুর্গা আরাধনায় তুষ্ট হয়ে সাধককে কাম-ক্রোধ-লোভের নরকের দরজা থেকে মুক্ত করে দেন। অধর্মের প্রকাশ–দম্ভ, দর্প, অভিমান, ক্রোধ, খারাপ ব্যবহার–এগুলিকে গীতায় আসুরিক ভাবের প্রকাশ বলে বলা হয়েছে। দুর্গাপূজায় সিদ্ধ হলে সাধক মায়ের কৃপায় দৈবী সম্পদে অর্থাৎ অভিমানশূন্যতা, নিরহঙ্কারিতা, অহিংসা প্রভৃতি গুণে ভূষিত হন। এ মহামায়ার প্রভাব থেকে মানুষ সহজে মুক্ত হতে পারে না। কেবল তাঁর শরণাগত হলে সংসারের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া যায়। এ কথাই চণ্ডীতে বলা হয়েছে (চণ্ডী ১১/৫৪-৫৫)।  গীতায়ও এরকম শরণাগতির কথা বলা হয়েছে– দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া। মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে ॥

মা দুর্গার ঐশ্বর্য আবার প্রকাশিত হয় পৌরাণিক কাহিনীর মাধ্যমে। সৃষ্টির প্রথমে বিষ্ণুর নাভিকমল থেকে ব্রহ্মা বেরিয়ে সৃষ্টি শুরু করবেন। এমন সময় বিষ্ণুর কর্ণমল থেকে দম্ভরূপী অসুর মধু-কৈটভ ব্রহ্মাকেই আক্রমণ করতে উদ্যত। বিষ্ণু যোগনিদ্রায় আচ্ছন্ন। ব্রহ্মার স্তবে বিষ্ণুর আখিপল্লব থেকে আবির্ভুতা হয়ে মহামায়া বিষ্ণুকে জাগ্রত করে দিলেন। অসুর মধুকৈটভ বধ হল, সৃষ্টি রক্ষা হল। ওদিকে মহিষাসুর স্বর্গরাজ্য দখল করে দেবতাদের দিল তাড়িয়ে। দেবতারাও মহামায়ার আরাধনা করে তুষ্ট করলেন। ব্রহ্ম-শক্তি মহামায়া মহিষাসুর নিধন করে দেবতাদের অধিকার রক্ষা করলেন। ভোগাকাংখী দর্পী অসুর শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করে মহামায়া সৃষ্টিকে রক্ষা করলেন। দম্ভ-অহঙ্কার, কাম-ক্রোধ, লোভের বশবর্তী হয়ে মানুষ দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত হয়, কষ্ট পায়। মাতৃরূপ মহামায়ার পূজায় এসব আসুরিকভাব থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ পরম আনন্দ লাভ করতে পারে। সুরথ রাজার মত নির্বিঘ্নে সংসারের ঐশ্বর্যও ভোগ করতে পারে, আবার মুক্তিকামী হলে সমাধি বৈশ্যের মত মুক্তিও লাভ করতে পারে। তাই চণ্ডীতে দেবীর স্তবে বলা হয়েছে–স্বর্গাপবর্গদে দেবী নারায়ণি নমো'স্তুতে। – অর্থাৎ, ভোগের স্থান স্বর্গ লাভ করার জন্য এবং মুক্তিলাভের জন্য হে দেবী নারায়ণি, আমি তোমাকে প্রণাম জানাই। শ্রীভগবানকে মাতৃভাবে আরাধনার কথা মার্কণ্ডেয় পুরাণে রয়েছে। গীতাতেও ভগবান বলেছেন–আমি জগতের মাতা। (গীতা-৯/১৭)। বাঙালি সমাজ মায়ের ভালবাসায় মুগ্ধ। ঈশ্বর সকল জীবের মা হয়ে বিরাজ করেন। 'যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।' মাতৃভাবে ঈশ্বরের আরাধনা তাই স্বাভাবিক। সাধক কবি তাই গান গেয়ে থাকেন—'কাজ ফুরালে সন্ধ্যাবেলায় মা করিবে কোলে, আমরা মায়ের ছেলে।'

আগমনী গানে বাঙলার প্রকৃতি প্রতিফলিত–দুর্গাকে বরণ করে নিতে প্রকৃতি সাজছে–দোয়েল ডাকে, কাশফুল ফুটে, শিউলী ঝরছে–মায়ের পূজার সময় হয়েছে–প্রকৃতির এ রূপ শরৎ ঋতুর ঘোষণা দিচ্ছে–অকাল বোধনে রামচন্দ্রের পূজা হয়েছিল–রামচন্দ্র সঙ্কট থেকে মুক্ত হয়ে আমাদের দেখালেন মায়ের পূজা করে আমরা সঙ্কট থেকে মুক্ত হতে পারি। মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব। পশুর যা নেই তা মানুষের আছে। সমৃদ্ধ প্রকৃতির বাংলাদেশে বিবেক জ্ঞান, অন্যের কল্যাণে আত্মনিয়োগ, ধর্মপ্রবণতা বাঙালির  মনের স্বাভাবিক ধর্ম। সভ্যতা-সংস্কৃতির সাথে তাল মিলিয়ে কবি-সাহিত্যিকের মানসপটে ছবির মত ভেসে উঠে শরৎ প্রকৃতি। দোয়েল-শ্যামা ডাক দিয়ে শরতের আগমন বার্তা জানিয়ে দিচ্ছে। নদীর ধারে কাশফুল, প্রভাতের শিশির আর শিউলী ফুল শরৎ ঋতুকে স্বাগত জানাচ্ছে। প্রকৃতির দিকে দিকে জগজ্জননীর প্রকাশ। ধর্মীয় অনুভূতি সে কবিত্বকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। সকলের অন্তরে মায়ের আগমনীর সুর বেজে উঠেছে। শরতে জগজ্জননী দুর্গার আরাধনা হবে, পূজা হবে। বর্ষার পরে ভরা নদী কুল কুল ধ্বনিতে আনন্দে করতালি দিচ্ছে। ঘাস শরতের শিশিরে ভিজে মায়ের পা ধুইয়ে দেবে। আর পা মুছে দেবে ধরণী তার সবুজ আঁচলে। বাঙালির হৃদয়কে টেনে এনেছেন কবি–এ প্রকৃতি বরণ ডালা নিয়ে বরণ করতে প্রস্তুত। গগনকে থালা করে নিয়ে প্রভাতের লাল মিশিয়ে রঙ নিয়ে দিক বালা আলতা গুলে প্রস্তুত। সূর্য চন্দ্র প্রদীপ জ্বালিয়ে আরতি করতে লেগে গেছে।

দুর্গাপূজায় বৈদিক, তান্ত্রিক, পৌরাণিক, আনুষ্ঠানিক, সামাজিক সকল ভাবের সমন্বয়। হিন্দুধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভাব দুর্গাপূজায় শ্রদ্ধাভরে রক্ষিত হয়। গাণপত্য সম্প্রদায়ের মতে গণেশের পূজা, শৈব সম্প্রদায়ের শিবপূজা, সৌর সম্প্রদায়ের সূর্য পূজা, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নারায়ণের পূজা, শাক্ত সম্প্রদায়ের কৌশিকী (জয়দুর্গা) পূজা খুব নিষ্ঠার সাথে সম্পন্ন হয়। এসব দেব-দেবী এক সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মস্বরূপেরই বিকাশ। সাধনার বৈচিত্র্যের মধ্যে এককেই স্মরণ করিয়ে দেয়। একদেশী ভাব, গোড়ামির ভাব থেকে মুক্ত হয়ে সর্বস্তরের সাধকের দুর্গাপূজায় যোগদান তাই একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।

মা দুর্গার ছেলে কার্তিক গণেশ, মেয়ে লক্ষ্মী সরস্বতী–এরা ভাইবোন–বাঙালিরাও তো সকলে ভাইবোন। জগজ্জননীর সন্তান। ভেদ নয়, বিভাগ করে রেখেছেন শ্রীভগবান গুণ ও কর্ম অনুসারে। তাই জ্ঞানচর্চাকারী ব্রাহ্মণ, দেশশাসনকারী ক্ষত্রিয়, ব্যবসায় কাজে নিয়োজিত বৈশ্য আর খেটে খাওয়া মানুষ শূদ্র, সকলেই মায়ের পরিবারে সদস্য-সন্তান।  বৈদিক পুরুষসূক্তমের ভাবটিই এখানে প্রতিফলিত। পরমপুরুষের একই দেহের বিভিন্ন অঙ্গের মত। সকলের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ভক্তিভাবে–আমরা সকলে মায়ের সন্তান–সকলেই আপন। পূজায় তাই সকল স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ–কেউ বাদ পড়বে না। পুরোহিত পুজারী, ফুলের মালা সরবরাহকারী বাগানের মালী, ঘট সরা প্রস্তুতকারী কুম্ভকার, প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরের সকলেরই অংশগ্রহণ এ পূজায়। রাজার দরজার মাটি, বেশ্যাদ্বারের মাটি, গঙ্গার মাটি, পর্বতের মাটি ইত্যাদি নিয়ে সর্বত্র মায়েরই অধিষ্ঠান ঘোষণা করা হয়। পূজায় ব্যবহৃত সকল প্রকারের সকল তীর্থের জল, পুকুরের নদের নদীর ঝরণার–এসব প্রকৃতির সকল স্থানের জল নিয়ে এসে পূজার কাজে লাগানো হয়। এতে এক প্রকৃতির বিচিত্রতাকে স্মরণ করা।

মা আসছেন গণেশকে কোলে করে নিয়ে। গণেশ আদুরে দুলাল, মা ছাড়া কিছু বোঝে না। তার প্রতি মায়ের অগাধ স্নেহ। গণেশ গণ-মানুষের সার্থক প্রতিমা। গণ-মানুষের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি এবং ভালবাসা সমাজকে আনন্দে ভাসিয়ে দেয়। আবার গণমানুষের প্রতি অবজ্ঞা সব অমঙ্গলেরই যেন কারণ। গণেশ সিদ্ধিদাতা। তার পূজাই আগে, গণেশ সর্ববিঘ্নবিনাশকারী। বিদ্যাচর্চা ও ধন উপার্জনের সাথে গণমানুষের উন্নতিবিধান দেশের সমৃদ্ধির উপায় নির্দেশ করে দুর্গাপূজা এক বিশেষ দিককে প্রতিফলিত করে।

নবপত্রিকা–বাংলাদেশের ফসল। নয় প্রকারের শস্য। ধান, যব, কচু, মানকচু, হলুদ, অশোক, বেল, ডালিম–এসব নিয়ে নবপত্রিকা। দুর্গা প্রকৃতিতে সুধাভাণ্ডার খাদ্যশস্য হয়ে ক্ষুধারূপ দুঃখ দূর করেন। উমা দেখে মেনকার আনন্দ–ফসল দেখে কিষাণ-কিষাণীর আনন্দ। ফসলরূপে উমাই ঘরে আসছে। উমা আনন্দের কারণ। নব শস্য হয়ে দুর্গা। দুর্গা মহামায়া এখানে শাকম্ভরী।

দুর্গাপূজায় একত্ব প্রতীতি এবং শান্তি ও সৌহার্দ্য সহজলভ্য। সমাজের বসবাসকারী মানুষ হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টানের সম্প্রীতির সম্পর্ক স্বাভাবিক।  অন্তরের যে সঙ্কীর্ণতা সংঘাতের জন্ম দেয় সর্বজনীন দুর্গোৎসব সে সঙ্কীর্ণতাকে দূর করে সকলকে উদার করে তোলে। বিশৃঙ্খল সমাজ সুধীসমাজের রূপ নেয়। দুর্গামণ্ডপে বাঙালি সংস্কৃতি দেখতে আসা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূতগণের উপস্থিতি এবং বাঙালির আপ্যায়নে অন্তরের স্পর্শ পেয়ে হৃদয়বান বাঙলাদেশকে নতুন করে ভাবতেও শিখিয়েছে।

দুর্গাপূজার ঘটা, পূজায় সাজসজ্জা গরিবদের দুপয়সা উপার্জনের পথও করে দেয়। শারদোৎসবে মেলা বসে। এ মেলায় বাণিজ্য লক্ষ্মীও তাঁর মহিমা প্রকাশ করেন। এ উপলক্ষে মণ্ডপে মণ্ডপে পূজা কমিটির স্মরণিকা গুণিজনের শুভেচ্ছায় সমৃদ্ধ থাকে। আর সাহিত্যিকদের মননশীল জীবনদর্শনের লেখায় থাকে বিভিন্ন ভাবের প্রতিফলন। স্মরণিকায় বাণিজ্যজগতের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন বাণিজ্যকে আর এক ধাপ এগিয়ে দেয়।

বাংলাদেশের প্রকৃতি, মধুর সামাজিক বন্ধন, সামাজিক বৈচিত্র্যের মধ্যে ভক্তিভাবে একত্ব দর্শন, প্রচলিত দেবদেবীর সমাবেশ ও পূজা, চালচিত্র, ঢাক, ঢোল, কাসর, সঙ্গীত, অতিথি আপ্যায়ন, সাহিত্য, বাংলাদেশের উদার সংস্কৃতি, সব নিয়ে শারদীয় উৎসব। দুর্গোৎসব–শারদোৎসব–শরৎ কালের উৎসব। এ উৎসব বাঙালির সংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিশ্বজনীনতায় উন্নীত করেছে। শরৎকালের দুর্গোৎসব শুধু উৎসব নয়, মহা-উৎসব। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, আধ্যাত্মিকতার অনুভূতি, সংস্কৃতি, বৈচিত্র্য, বাণিজ্য, বিদ্যাচর্চা, সামাজিক প্রীতির বন্ধন, হাজার বছরের বাঙালির সমন্বয় ও শান্তির ঐতিহ্যকে প্রকাশ করে এবং শারদীয় উৎসবকে সর্বজনীন উৎসবে পরিণত করেছে, স্বাভাবিকভাবে দুর্গাপূজাকে বাঙালি হিন্দুসমাজের সবচেয়ে বড় উৎসবে পরিণত করেছে। বিশ্বজননীর পূজায় বাঙালি হিন্দুর হৃদয়কে প্রসারিত করে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষকে, সকল দেশের মানুষকে আপন করে নিতে শিখিয়ে উৎসবকে বিশ্বজনীন উৎসবেও পরিণত করেছে।

স্বামী স্থিরাত্মানন্দ: সহ-সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ঢাকা, বাংলাদেশ।