একজন রঘুরাম ও ভারতের অর্থনীতির গতিশীলতা

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তসুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
Published : 27 June 2016, 07:46 AM
Updated : 27 June 2016, 07:46 AM

ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর পদ থেকে রঘুরাম রাজনকে 'তাড়ানোর' পেছনে বিজেপির 'সঙ্ঘ'বদ্ধ প্রয়াসই কাজ করেছে। এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে দেশজুড়ে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে প্রথম সারির শিল্পপতিদের দৃঢ় বিশাস, রাজনকে বিতাড়নের জন্য বিরাট মূল্য দিতে হতে পারে ভারতকে। পাছে দ্বিতীয়বারের জন্য তাঁর পুনর্নিয়োগের বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে, তাই অনেক দিন ধরেই এমন একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হচ্ছিল যাতে ক্ষুদ্ধ ও অপমানিত হতে হতে তিনি নিজেই সরে দাঁড়ানোর পথ নেন। বাস্তবে ঘটলও তাই। রাজন জানিয়ে দিলেন, রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নরের পদ ছেড়ে তিনি আবার অধ্যাপনা ও গবেষণার কাজে ফিরে যাবেন।

রাজন যখন দায়িত্ব নেন তখন ইউপিএ ২ সরকারের মাঝপথ। ভারতসহ গোটা বিশ্ব ভয়াবহ আর্থিক মন্দায় আক্রান্ত। সেই অবস্থায় সেই মন্দার পঙ্কিল আবর্ত থেকে ভারতের অর্থনীতিকে কিছুটা তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর পরিকল্পনাই ছিল প্রধান সহায়, বিশেষ করে দুটি ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য উল্লেখ করার মতো।

প্রথমত, ভারতীয় মুদ্রার আন্তর্জাতিক বিনিময় মূল্যের ক্রমশ অবনমন তিনি অনেকটাই আটকাতে পেরেছিলেন। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলির দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা 'গো অ্যাজ ইউ লাইক' ধাঁচের কাজকর্মের বদলে তাদের একটা শৃঙ্খলায় আনার রাস্তায় হেঁটেছিলেন তিনি।

কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তাঁর প্রথম সংঘর্ষ বাধে ব্যাংক সংযুক্তিকরণ ইস্যুতে। কেন্দ্রীয় সরকার চাইছিল ভারতীয় স্টেট ব্যাংকের সঙ্গে আরও পাঁচটি ব্যাংককে এবং আরও ২১টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে একত্র করে আরও পাঁচটি ব্যাংক, অর্থাৎ মোট ছটি ব্যাংক করতে। মোদি সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন রঘুরাম রাজন।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলির টাকা এতদিন ধরে যেভাবে হরির লুঠ হচ্ছিল, রাজন তাতে বাধ সাধেন। নন-পারফর্মিং অ্যাসেট ঘোষণার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকার অনাদায়ী ঋণ কার্যত মওকুফ করিয়ে দিয়ে এক শ্রেণির অসাধু শিল্প ও বাণিজ্য লবির উদরপূর্তির যে ব্যবস্থা চলছিল, রাজনের প্রবল বাধায় সেটাও আটকে যায়। ফলে তাঁকে সরিয়ে দিতে অনেক স্বার্থান্বেষী যে আগ্রহী হবে তাতে আর সন্দেহ কী?

এদিকে রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর পদে রঘুরাম রাজনের জায়গায় কে আসছেন তা নিয়ে তৈরি হয়েছে জল্পনা। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বলেছিলেন, রাজনের উত্তরসুরীর নাম শীঘ্রই ঘোষণা করা হবে। মোদি সরকারের মন্ত্রী-আমলাদের মতে, এই পদের জন্য এগিয়ে রয়েছেন স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার চেয়ারপারসন অরুন্ধতী ভট্টাচার্য। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পছন্দের তালিকায় এক নম্বরেও রয়েছেন অরুন্ধতী।

এদিকে রাজনের বিদায়ে কার্যত সুনামির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বাজারে। শেয়ার বাজার নিয়ে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে, শেয়ার, ঋণপত্রসহ গোটা বাজারে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে আর্থিক মন্দার আগাম আভাস দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের তৎকালীন এই প্রধান।

অরুন্ধতীর পাশাপাশি উঠে এসেছে আরও কয়েকটি নামও। রিজার্ভ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর উর্জিত প্যাটেল, প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর সুবীর গোকর্ণ, অর্থনীতিবিদ রাকেশ মোহন, সেবির চেয়ারম্যান ইউ কে সিনহার পাশাপাশি উঠে আসছে ডি রাজাগোপালনের মতো অপরিচিত নামও।

এদিকে কেন্দ্রীয় সরকারি আমলাদের একটা বড় অংশই মনে করছেন, রঘুরাম রাজনের মতো হাই-প্রোফাইল অর্থনীতিবিদের জায়গায় অপরিচিত বা অখ্যাত মুখ দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের একটা বড় অংশের মত হল, রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর হয়ে সুদ-নীতি ঠিক করতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ লাগে না। প্রাক্তন আমলা বা পেশাদার অর্থনীতিবিদরাই এই কাজ সামলে দিতে পারেন।

উল্লেখ্য, বেশ কিছুদিন ধরেই কেন্দ্রীয় সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন এই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও চিন্তাবিদ। নরেন্দ্র মোদির সাধের 'মেক-ইন-ইন্ডিয়া', অসহিষ্ণুতা বিতর্ক এবং আর্থিক বৃদ্ধির হারে ভারত সত্যিই বিশ্বসেরা কিনা এই সব প্রশ্ন তুলে নরেন্দ্র মোদি, সুব্রাহ্মণ্যয়াম স্বামীসহ বিজেপি এ আরএসএস নেতাদের বিষনজরে পড়েছিলেন তিনি। নির্মলা সীতারামন, পীযুষ গোয়েলের মতো মন্ত্রীরা প্রকাশ্যেই রাজনের সমালোচনা করেছিলেন।

এদিকে রাজনের উত্তরসূরী স্থির করার আলোচনার মধ্যেই রিজার্ভ ব্যাংকের গর্ভনরের মেয়াদ অন্তত পাঁচ বছর করার দাবি উঠেছে। নতুন গর্ভনরের দৌড়ে থাকা রাকেশ মোহনই সেই দাবি তুলে বলেছেন, ঐ পদে স্থায়িত্বের প্রয়োজন। গর্ভনর ও ডেপুটি গর্ভনরকে অন্তত পাঁচ বছর করে সময় দেওয়া উচিত।

অন্যদিকে, শাসক দলের তালে তাল না মেলানোয় রঘুরাম রাজনের পদত্যাগের সিদ্ধান্তে অশনি সঙ্কেত দেখছেন দেশের বুদ্ধিজীবী মহলের একটা বড় অংশই। তাদের মতে, মোদি সরকারের মন জুগিয়ে চলতে না পারার জন্যই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরে যেতে হয়েছিল নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকেও।

রাজনের বিরুদ্ধে সামনে থেকে যুদ্ধ শুরু করেন সুব্রাহ্মণ্যয়াম স্বামী। তিনি বলেন, সুদ নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাজনের অতি-সতর্ক মনোভাব দেশের অর্থনীতিকে কার্যত তলিয়ে দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে 'রে রে' করে নেমে পড়েন বিজেপি ও আরএসএস্এর নেতারা। রাজনের বিদায় নিশ্চিত করে সুব্রাহ্মণ্যয়াম স্বামী বলেছেন যে, আরও ২৭ জন আমলাকে সরাতে চান তিনি। তাঁর মতে, এই আমলারা সোনিয়া গান্ধীর অনুগত এবং প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম অকারণে এদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে গেছেন।

২০০৮ সালে রাজনের মতো একজন প্রথম সারির অর্থনীতিবিদকে রিজার্ভ ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়ে এসেছিলেন আরেক প্রাক্তন অর্থনীতিবিদ-প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। সে সময় দেশের অর্থমন্ত্রী ছিলেন পি চিদম্বরম।

রাজন-বিতাড়ন পরিকল্পনার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আনন্দ মাহিন্দ্র, দীপক পারেখ, এন আর নারায়ণমুর্তি, কিরণ মজুমদার শ এবং মোহনদাস পাইয়ের মতো প্রথম সারির শিল্পপতিরা। তাঁরা বলেছেন, বর্তমান সরকার রঘুরাম রাজনের গুরুত্বই বোঝে না। এর ফলে ভারতের অর্থনীতি যে এক বিরাজ ক্ষতির মুখে পড়তে চলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম বলেছেন, রাজনের চলে যাওয়া একই সঙ্গে দুঃখ এবং হতাশার। কিন্তু মোদি সরকারের আমলে এমনটা হওয়ারই ছিল।

রিাজার্ভ ব্যাংক থেকে রঘুরাম রাজনকে সরে যেতে হচ্ছে শুনে তীব্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন অমর্ত্য সেনও। তিনি বলেছেন, রাজনের মতো একজন অর্থনীতিবিদ-চিন্তাবিদকে হারাতে হল। এ সংবাদ একই সঙ্গে বেদনাদায়কক এবং উদ্বেগজনক।

রঘুরামকে রিজার্ভ ব্যাংক থেকে সরাতে কার্যত আদা-জল খেয়ে লেগেছিলেন বিজেপি নেতা সুব্রাহ্মণ্যয়াম স্বামী। আর তাকে যোগ্য সঙ্গত করে গিয়েছেন মোদি-ঘনিষ্ঠ নেতা-মন্ত্রীরা। কে এই সুব্রাহ্মণ্যয়াম স্বামী? এক সময় হার্ভার্ডে আংশিক সময়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন সুব্রাহ্মণ্যয়াম। বিতর্কিত কথাবার্তা বলে উত্তেজনা ছড়ানোর জন্যই তিনি বিশেষভাবে পরিচিতি। বিশ্ব থেকে মুসলিমদের উৎখাত করার ডাক দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খুইয়েছিলেন সে চাকরিটি।

জরুরি অবস্থার সময় আরএসএসএর প্রথম সারির নেতা হিসাবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেই সময় থেকে কংগ্রেসসহ বিরোধীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করাই ছিল তার একমাত্র কাজ। নরেন্দ্র মোদির সুপারিশে রাষ্ট্রপতির অনুকূল্যে তিনি এবার রাজ্যসভায় এসেছেন। তারপর থেকেই তিনি মোদি সরকারের সমস্ত কাজে হস্তক্ষেপ শুরু করেন। ১৯৯১ সালে চন্দ্রশেখর মন্ত্রিসভায় তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। সে সময় তিনি সোনিয়া গান্ধীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলেন। আর এখন তার একমাত্র কাজ হচ্ছে গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধাচারণ করা!

রাজন চলে যাচ্ছেন এ খবরে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় চার শতাংশ। রাজন কী চেয়েছিলেন? তিনি চেয়েছিলেন ভারতের বিজেপিপন্থী শিল্পপতিরা যাঁরা ব্যাংক থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে শোধ করছিলেন না, তাদের থেকে টাকা আদায় করতে। সেখানেই আরএসএসএর সঙ্গে তাঁর স্বার্থের সংঘাত ঘটে। সুপণ্ডিত এই অর্থনীতিবিদ ঋণখেলাপী ব্যবসায়ীদের নাম একটি মুখবন্ধ খামে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে দিয়েছেন। আর এই সরকারই কালো টাকা উদ্ধারের দাবি করে থাকে!

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রঘুরাম রাজনের বিদায়ে ভারতে তো বটেই, বাংলাদেশসহ গোটা উপমহাদেশে ব্যাপক প্রভাব পড়তে চলেছে। এদেশে এখন এটাই সবচেয়ে বড় চর্চা যে, রাজনের করে দেওয়া তালিকা প্রকাশ করা হবে কিনা। সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাজন বলেছিলেন, এদেশের ঋণখেলাপীদের নাম তিনি প্রকাশ করে দেবেন।

তাঁর এই মন্তব্যের পরেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, রিজার্ভ ব্যাংক থেকে তাঁর বিদায় কেবল সময়ের অপেক্ষা।