হিমালয় দেখেছি বটে দেখা হল না বঙ্গবন্ধুকে

মুসা ইব্রাহীম
Published : 23 May 2016, 11:59 AM
Updated : 23 May 2016, 11:59 AM

১.

সত্তরের দশকে ১৯৭৮ সালে আমার জন্ম। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে বেড়ে উঠলেও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি ছিল অনেকটাই স্বাধীনতাবিরোধী বা স্বৈরশাসকদের অনুকূলে। শৈশবের কথা ততটা মনে নেই। কিন্তু কৈশোরের কথা বেশ ভালোই মনে পড়ে। সে সময়ে মানুষের মুখে মুখে স্বাধীনতাবিরোধীদের কথা খইয়ের মতো ফুটত। উঠতে-বসতে তাদের গুণগান প্রচারিত হত। যেন বাংলাদেশ হওয়াটাই আসলে ভুল হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তান থাকলেই মানুষ বেঁচে যেত– স্বাধীনতাবিরোধীদের বক্তব্যের সারাংশ ছিল এটা।

অনেকে ছিল আবার আরেক কাঠি সরেস। সময়টা তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারকে নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যার পরের সময় হওয়ায় 'শেখ সাব' বলে সম্বোধন করে তারা বলতেন, ''শেখ সাবে দেশটা স্বাধীন কইরা আমাদের দিলটা কী?''

উত্তরে অনেকে বলতেন, ''দেশ ভাগ করা ছাড়া আর কিছু তে তো উনি এক্সপার্ট ছিলেন না।''

ছোট হওয়ায় এসব কথার অর্থ তখন বুঝতাম না। কিন্তু এখন বুঝতে পারি, বঙ্গবন্ধু এ দেশের জন্য কত বড় মাপের একজন নেতা ছিলেন। কেনই-বা তাঁকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বিশেষণে ভূষিত করা হয়! কেনই-বা কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, "আমি হিমালয় দেখিনি। কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনিই হিমালয়।"

আপনা মাংসে হরিণা বৈরী। কাজেই দেশের-জাতির-মানুষের যতই ভালো চান না কেন, উদারতাই কাল হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর। যে মানুষটি আমাদের স্বাধীনতার রূপকার, তাঁকেই কি না আমরা হত্যা করেছি নৃশংসভাবে!

২.

"এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।" আমার আব্বা মোহাম্মদ আনছার আলীর কাছ থেকে শুনেছি, তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই অগ্নিঝরা ভাষণ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত হয়ে মূল মঞ্চের একবারে কাছে বসে শুনেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনতে চাইলে আব্বা এই ঘটনা সব সময় সগর্বে উল্লেখ করেন। শুনে আমার রোম দাঁড়িয়ে যায়। কল্পনায় তখন বঙ্গবন্ধুর সেই তর্জনী-উঁচানো ঐতিহাসিক ছবি ভাসতে থাকে। মনে করতে থাকি, রেসকোর্স ময়দানে যেন আব্বার সঙ্গে আমিও হাজির হয়েছি, যেন নিজ কানে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ শুনছি।

মার্চ মাস ছিল পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে বাঙালির অসহযোগ আন্দোলনের মাস। এই মাসের শুরুর দিন থেকে টানা অসহযোগ আন্দোলনে দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ২৫ মার্চ দুপুরের মধ্যেই লোকজনের মধ্যে কানাঘুষা– ঢাকা থেকে সেনাবাহিনীর লোকজন রংপুর, রাজশাহী, যশোর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা সেনানিবাসে পরিদর্শন করে ফের ঢাকায় ফিরেছে। আর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সব কিছু এড়িয়ে গোপনে করাচি চলে গেছে। তখন সবাই বলাবলি করছিল যে, আজ একটা কিছু ঘটবে।

ইতিহাস বলে, ২৫ মার্চ দুপুর ১২টায় দলবলসহ ইয়াহিয়ার সেনানিবাসে যাওয়ার খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। প্রত্যেককে তিনি নিজ নিজ জেলা ও এলাকায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক তৎপরতা পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন উপস্থিত নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে জীবনশঙ্কার কথা জানালে তিনি বলেছিলেন, ''আমাকে হত্যা করে লাভ নেই। ওরা তো বার বার আমাকে কারাগারে নিয়েছে। আমাকে নির্যাতন করেছে। ওদের লাভ হয়নি। আমাকে হত্যা করেও ওদের লাভ হবে না। কারণ আমার মতো লক্ষ মুজিবের জন্ম হবে বাংলাদেশে।"

এই ছিল বঙ্গবন্ধুর দর্শন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়ানক ন্যাক্কারজনক দিনটি ছিল ২৫ মার্চের কালোরাত। এদিন মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত মানুষের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম গণহত্যা সম্পন্ন করে। ঢাকাসহ দেশের অনেক জায়গায় মাত্র এক রাতেই হানাদাররা নির্মমভাবে হত্যা করে প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক বাঙালিকে। এই নির্বিচারে হত্যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন স্তব্ধ করা এবং বাঙালির জাতিসত্তা নিশ্চিহ্ন করা। কিন্তু এতেই যেন তেতে থাকা বাঙালি ফুঁসে ওঠে। দেশের আনাচে-কানাচে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।

আব্বা স্মৃতিচারণ করে বলছিলেন, "আমরা কয়েকজন মতিঝিলের কাছে একটা মেসে থাকতাম। মাস শেষে ব্যাংক থেকে মাইনে নিয়েই ভুতুড়ে ঢাকা ছেড়ে সবাই চললাম গ্রামের দিকে। কমলাপুর থেকে ট্রেনে চেপে পরদিন পৌঁছেছিলাম লালমনিরহাটে। সেখান থেকে আরেক ট্রেনে মোগলহাট। এরপর পায়ে হেঁটে গ্রামের বাড়ি গন্ধমরুয়ায়। গ্রামের সবাই ধরে নিয়েছিল ২৫ মার্চে আমিও মারা গেছি। কিন্তু আল্লাহ সহায় ছিলেন, আমাদের কিছু হয়নি।''

''এর পরপরই গ্রামের দশ-বারোজন তরুণ পরিকল্পনা করলাম যুদ্ধে যাব। বড়দের কাউকেই আমরা কিছু বলিনি। কারণ বাপ-চাচারা জানলে আমাদের যেতে দিবে না। তাই একদিন দিনের বেলা সবাই খালি গায়ে লুঙ্গি পরে বের হয়ে পড়লাম। যাতে কেউ সন্দেহ না করে। ধরলা নদী সাঁতরে পার হয়ে ভারতে ঢোকার আগেই গ্রামের একজন দেখে ফেলেছিল। অবশ্য তিনি গ্রামে জানানোর আগেই আমরা ধরলা নদীর ওপারে চলে গেছি। দিনহাটার রাস্তা ধরে গেলাম গীতালদহ রেলস্টেশনে। শিলিগুড়িগামী ট্রেনে উঠলাম সবাই। উদ্দেশ্য সেখানে ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দিয়ে যুদ্ধের ট্রেনিং নেওয়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই টিটি হাজির হল। টিকেট চাইতেই আমি বললাম, 'আমরা জয় বাংলার লোক।' শুনে টিটি আর কিছু না বলে চলে গেল।"

৩.

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ, নির্যাতিত দুলাখ মা-বোন এবং যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, সবাইকে সশ্রদ্ধ সালাম। তাদের কষ্টের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। সার্বভৌমত্ব পেয়েছি। নিজেদের পরিচয় একটি মানচিত্র, নিজেদের লাল-সবুজ পতাকা পেয়েছি। এই বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক পত্রিকার খবরে প্রকাশ: ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) দেওয়া হিসাব অনুসারে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অগ্রসরমান বাংলাদেশে এবারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঠিকই ৭ শতাংশে পৌঁছাতে যাচ্ছে।

সব কাজেই কিছু কমতি থাকে। তবে গ্লাসে অর্ধেক পানি থাকলে সেই গ্লাস 'অর্ধেক খালি' বলাতেই যেন লোকজনের আনন্দ। গ্লাস যে অর্ধেকটা পূর্ণ রয়েছে, সে কথা বলতে চোখ ব্যথা করে। মুক্তিযুদ্ধে যারা বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিলেন, তারা এখন কী বলবেন? তাদেরকে অনুরোধ জানাই, পশ্চিম পাকিস্তান আর আজকের বাংলাদেশের উন্নয়নের সূচকগুলোয় একটু চোখ বুলিয়ে আসতে।

এই বাংলাদেশে অনেক কিছুই ঠিকঠাক চলে না। না চললেও শিক্ষা, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্যখাতসহ সব ধরনের সেবাখাত সঠিক পথে এনে জনসেবামুখী করার দায়িত্ব কিন্তু আমরা তরুণরা এড়াতে পারি না। সরকার সব কিছু করে দিবে, আর আমরা বসে বসে দেখব, এমন সময় মনে হয় আর নেই। এখন কাজের সময়।

৪.

আমাদের এভারেস্টে যেতে হবে, বাংলাদেশের পতাকা এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে দিতে হবে, বাংলাদেশকে এভারেস্টজয়ী দেশে পরিণত করতে হবে– এ কথা যখনই বলেছি, হাতেগোনা দুয়েকজন বাদে সবাই একে হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কেউ কেউ আমাদেরকে 'পাগল' সাব্যস্তও করেছিলেন। আবার প্রায় সমতল দেশের একজন বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত এভারেস্টে যেতে চায়, এটাও অনেকের অবিশ্বাসের কারণ ছিল। তাদের সরাসরি প্রশ্ন ছিল এমন-– "দেখে তো ডালভাত খাওয়া একজন মানুষই মনে হচ্ছে আপনাকে। পারবেন?"

প্রশ্ন শুনে ভাবতে বসেছি, মানুষ চিন্তাভাবনায় কেন এতখানি দেউলিয়া হবে? মনে হয়েছে, যে কোনো কাজে যে জাতির এত প্রশ্ন, এত অবিশ্বাস, সেই জাতি কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছে? এই সাহসের যোগান হয়েছিল কোথা থেকে? সবাই দেশকে স্বাধীন করার জন্য একাট্টা হয়েছিলেন কীভাবে?

উত্তরটা পেয়েছিলাম এভারেস্টে পর্বতের তিব্বত রুটে বেস ক্যাম্পে বসে।

আমাদের দলটা ছিল হাতের পাঁচ আঙ্গুলের মতো। কাঠমান্ডুর কোমল অরিয়াল, শেরপা সর্দার সোম বাহাদুর তামাং, শেরপা কৈলাস তামাং ও লাকপা নুরু এবং আমি– এই পাঁচজন ছিলাম একটা হাতের পাঁচ আঙ্গুল। যে কোনো একটা আঙ্গুল ছাড়া হাত যেমন অসম্পূর্ণ, তেমনি এই যে কোনো একজনকে ছাড়া আমাদের দল অসম্পূর্ণই থাকত। যাক সে কথা।

সতের হাজার ফুট উচ্চতায় বেস ক্যাম্পে যখন শরীরকে উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার কসরৎ করছি, সে সময়ে সোম বাহাদুর কথাপ্রসঙ্গে একদিন বলছিলেন: "মুসা, এই অভিযানে আমরা তোমার সঙ্গে এসেছি মানে হল, আমরা ষোল কোটি মানুষের এমন একটা দেশের জন্য এখানে এসেছি, যাদের কেউ এর আগে কখনও এভারেস্ট অভিযানে যায়নি। কাজেই তুমি সফল হলে পুরো বাংলাদেশ সফল হবে।"

কথাটা শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকলাম। কখনও এভাবে ভাবিনি। পরে তাঁবুতে বিশ্রামের সময় ভাবছিলাম, এভারেস্ট অভিযানে টিমওয়ার্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে দলের সবাই একই ঐক্যতানে ভাবতে পারা বিশাল ব্যাপার। সবার চাওয়া একটাই হওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার। এটাও ভাবছিলাম, "তাহলে বঙ্গবন্ধু কত বড় মাপের একজন নেতা ছিলেন! যাঁর এক ডাকেই পুরো দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন! সবাই জয় বাংলার লোক হয়ে গিয়েছিলেন!"

৫.

২২ মে, ২০১০, শনিবার। বেলা প্রায় আড়াইটার দিকে একদল অভিযাত্রীর সঙ্গে ২৭ হাজার ফুট উচ্চতায় ক্যাম্প থ্রিতে দেখা। তাদের একজনের সঙ্গে কথোপকথনে জানতে পারলাম, তারা কিছুক্ষণ আগে ২৯ হাজার ৩৫ ফুট উঁচু এভারেস্ট চূড়া জয় করে ক্যাম্প থ্রিতে নেমে এসেছে। জিজ্ঞেস করছিলাম, সে কি একাই এসেছে? না কি তার দলে আরও কেউ আছে? জবাবে সেই অভিযাত্রী যে উত্তর দিয়েছিলেন, তা শুনে চোখ কপালে উঠল। সে বলছিল: "নো, সি, দিস ইজ মাই ডটার, দিস ইজ মাই সান। উই আর হেয়ার ফর হলিডে ভ্যাকেশন'' (না, দেখ, এই আমার মেয়ে, আর এটা ছেলে। আমরা এখানে ছুটি কাটাতে এসেছি)।

তার মানে পিতা ছুটি কাটাতে ছেলে এবং মেয়েকে নিয়ে এভারেস্ট অভিযানে এসেছে এবং তারা তিনজনই সে মুহূর্তে এভারেস্ট জয় করে নেমে এসেছে। তাদের অভিনন্দন জানিয়ে ভাবতে শুরু করলাম, অসাধারণ একটা ব্যাপার! এ তো চিন্তাই করা যায় না যে, বাবা তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে এভারেস্ট অভিযানে এসেছে। আর বাংলাদেশে এটা শুনলে নির্ঘাত পাগল বলবে। কিন্তু আমাদেরও এমন ভিন্ন আঙ্গিকে ভাবনার সময় এসে গেছে।

পর্বতারোহণের সব সরঞ্জাম পরে নিয়ে সন্ধ্যাবেলা শুরু হল চূড়ান্ত অভিযান। সর্বশেষ আরোহণ। সাতাশ হাজার ফুট থেকে যেতে হবে ঊনত্রিশ হাজার পঁয়ত্রিশ ফুট উচ্চতায়। পুরো এলাকা ডেথ জোনের মধ্যে। কিংবদন্তী পর্বতারোহী শেরপা তেনজিং নোরগে যে এলাকা সম্পর্কে বলেছিলেন, 'নো বার্ডস ক্যান ফ্লাই, অন দ্যাট হাই'। অর্থাৎ, সেখানে প্রকৃতি এতটাই বিরূপ যে, পাখিও সেখানে ওড়ে না। আমরাও আরোহণ করছি মাথায় হেডল্যাম্প লাগিয়ে, পিঠে রুকস্যাকে অক্সিজেন বোতল ভরে, মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে। ফিক্সড রোপে চললেও আরোহণটা অনেক সময় নার্ভের পরীক্ষা নিয়ে নিচ্ছে।

প্রায় ছয়শ ফুট চড়াই পার হওয়ার পর এভারেস্ট রিজে যখন গিয়ে পৌঁছেছি, কিছুক্ষণ পরই একটা গুহার মধ্যে নীল বুটঅলা এক মানুষকে শুয়ে থাকতে দেখলাম। দেখে মনে হয় যেন ঘুমাচ্ছেন। তবে পরিস্থিতি বলে দেয়, তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত। অর্থাৎ, স্বপ্নপূরণ করতে এসে বেচারাকে নির্মম ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। এ সময় শেরপা কৈলাসের কথায় সম্বিত ফিরলে ফের আরোহণ শুরু হয়।

এর বেশ খানিকটা পর ফার্স্ট স্টেপ। আর প্রায় ত্রিশ ফুট খাড়া সেকেন্ড স্টেপের ওভারহ্যাং পার হতে গিয়ে তো আমার অক্সিজেন টিউবটাই ফুটো হয়ে গেল। আল্লাহর রহমতে সে যাত্রায় রক্ষা পেলাম। কিন্তু থার্ড স্টেপ ছিল আরও ভয়াবহ। খাড়া পাথুরে দেয়ালে চার আঙ্গুল চওড়া খাঁজ তৈরি করা হয়েছে প্রায় ত্রিশ ফুট দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার জন্য। সেখানে আবার দেখি যে এক পর্বতারোহীর প্রাণহীন দেহও শূন্যে ঝুলছে।

সব মিলিয়ে এই সর্বশেষ আরোহণটা ছিল বিশাল মনস্তাত্ত্বিক চাপ। এভাবে টানা প্রায় সাড়ে নঘণ্টা হিমশীতল রুক্ষ পাথর আর তীব্র ঠান্ডা বরফের মধ্যে আরোহণ শেষে বাংলাদেশ সময় ভোর পাঁচটা পাঁচ মিনিটে গিয়ে পৌঁছেছিলাম এভারেস্ট চূড়ায়।

আর পাঁচটা ষোল মিনিটে যখন বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা ওড়ালাম, ভাবছিলাম যে সেই মুহূর্তেই যদি বাংলাদেশে উড়ে যাওয়া যেত, সবাইকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলা যেত যে, আমি পেরেছি, বাংলাদেশ পেরেছে, তার গর্বের লাল-সবুজ পতাকা সেখানে উড়ছে– তাহলে শান্তি পেতাম। ২০১০ সালের ২৩ মে থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে ৬৭তম এভারেস্টজয়ী দেশ। স্বাধীন হওয়ার পর ৩৯টি বছর সময় লেগেছে বাংলাদেশের এমন একটি পরিচয় পেতে। তাতে কী? বেটার লেট, দ্যান নেভার।

হিমালয় দেখেছি বটে, আফসোস, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হল না।