বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের বক্তব্য ও নির্মাণশৈলী

নাদির জুনাইদ
Published : 3 April 2016, 10:15 AM
Updated : 3 April 2016, 10:15 AM

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ গণযুদ্ধের পর যে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হল, সেখানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের পুরনো ধারা ও কাঠামো পরিবর্তিত হয়ে নতুন চলচ্চিত্র তৈরি হবে এমন ধারণা করা অযৌক্তিক ছিল না। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী একটি সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর আক্রমণের বিরুদ্ধে এদেশের সাধারণ মানুষের অসমসাহসী প্রতিরোধ আর অনেক ত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয় এই দেশের স্বাধীনতা। মহান এই মুক্তিযুদ্ধের শক্তিশালী উপস্থাপন নতুন দেশের চলচ্চিত্রে দেখা যাবে সে প্রত্যাশাও ছিল স্বাভাবিক।

চিন্তাবিদ ফ্র্যান্তজ ফাঁনো তাঁর 'দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ' গ্রন্থে একটি ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং নিপীড়িত ঔপনিবেশিক সমাজে লেখক এবং শিল্পীদের কাজের মধ্যে তিনটি পর্যায় দেখা যায় বলে মত প্রকাশ করেছিলেন।

প্রথমত, আত্তীকরণ পর্যায় যেখানে ঔপনিবেশিক সমাজের একজন বুদ্ধিজীবী নিজের দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ওপর প্রাধান্য দেওয়ার পরিবর্তে ক্ষমতাশালী শাসকদের পছন্দসই বিষয় নিজের রচনায় নিয়ে আসেন।

দ্বিতীয়ত, স্মৃতিচারণ পর্যায় যখন একজন শিল্পী নিজের দেশের ঔপনিবেশিক শাসন-পূর্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে চিন্তা করতে থাকেন। তার সৃষ্টিতে দেখা যায় এই স্মৃতিচারণের প্রতিফলন যদিও সেই কাজ ঔপনিবেশিক শাসনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো অবস্থান গ্রহণ করে না।

তৃতীয়ত, সংগ্রামী পর্যায় যখন ঔপনিবেশিক সমাজের একজন শিল্পী নিজের কাজের মাধ্যমে অত্যাচারী শাসনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজ দেশের নিপীড়িত মানুষদের সচেতন ও প্রতিবাদী করে তুলতে প্রয়াসী হন।

চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক তেশোম গ্যাব্রিয়েল ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়া তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে নির্মিত বিভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্র ব্যাখ্যার জন্য ফ্র্যান্তজ ফাঁনোর এই বিশ্লেষণধর্মী বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন। গ্যাব্রিয়েল বর্ণনা করেছেন আত্তীকরণ পর্যায়ে একজন চলচ্চিত্রকার উন্নত ও ক্ষমতাশালী দেশের বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্রের অন্ধ অনুকরণের মাধ্যমে ছবি তৈরি করেন। এ ধরনের ছবি নিপীড়িত মানুষের জন্য রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করে না, বরং ছবির হালকা বিনোদনে বিভোর থাকার মাধ্যমে শোষিত মানুষ হয়ে পড়ে প্রতিবাদহীন আর তাই বিদ্যমান শোষণমূলক ব্যবস্থাই টিকে থাকে।

এই পর্যায়ে নির্মিত চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলীতে দেখা যায় চাকচিক্য আর চটক। দর্শককে বিনোদন দিতে পারে এমন কৌশল আর গতানুগতিক ফর্মুলাই কেবল এই ধরনের ছবিতে ব্যবহার করা হয়, প্রাধান্য পায় অর্থনৈতিক মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য। এই পর্যায়ে তৈরি ছবিতে তাই চিন্তাশীলতার ছাপ থাকে না।

স্মৃতিচারণ পর্যায়ের চলচ্চিত্রে উঠে আসে নিজ দেশের সংস্কৃতি আর ইতিহাসভিত্তিক বিষয়। ছবিতে ব্যবহৃত হয় লোককথা আর পৌরাণিক কাহিনি। উঠে আসে সমাজের কিছু সমস্যার বর্ণনা, আর আধুনিকতা ও পুরনো ঐতিহ্যের মধ্যে সংঘাতের বিবরণ। এই ধরনের ছবি তাই উন্নত দেশে তৈরি হওয়া বিনোদনধর্মী ছবির অন্ধ অনুকরণ না হয়ে বক্তব্যের দিক থেকে অনেকটাই আলাদা হয়ে ওঠে। তবে কিছুটা দেশজ প্রভাব এই পর্যায়ে তৈরি ছবিতে দেখা গেলেও নির্মাণশৈলীর নতুনত্ব খুব বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় না। আত্তীকরণ পর্যায়ে ব্যবহৃত অনেক গতানুগতিক চলচ্চিত্র কৌশল তাই এই পর্যায়ের ছবিতেও চোখে পড়ে।

গ্যাব্রিয়েলের মতে, সংগ্রামী পর্যায়ের চলচ্চিত্র তৈরি করা হয় দর্শকদের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য। এই ধরনের ছবির নির্মাতারা নিজ দেশের মানুষের দুঃখ সম্পর্কে সচেতন, এবং সমাজে টিকে থাকা অন্যায় আর শোষণের বিরুদ্ধে নিজেদের কাজের মাধ্যমে তারা প্রকাশ করেন তীব্র প্রতিবাদ। নিজ সমাজের মানুষের সংগ্রামের কাহিনি হয়ে ওঠে ছবির বিষয়বস্তু। চলচ্চিত্র কেবল বিনোদন যোগানোর মাধ্যম নয়, তা হয়ে ওঠে অন্যায় টিকিয়ে রাখা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার।

এই ধরনের ছবি যেহেতু নতুন ধরনের বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করে, তাই প্রথাবিরোধী চলচ্চিত্র কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে দর্শককে চিন্তা করতে বাধ্য করা হয়। আশা করা হয় এমন চিন্তার মাধ্যমেই দর্শকের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। নিজ দেশের চলচ্চিত্রের জন্য স্বতন্ত্র একটি নির্মাণশৈলী সৃষ্টির প্রচেষ্টাও চোখে পড়ে।

তৃতীয় বিশ্বের চলচ্চিত্র নিয়ে গ্যাব্রিয়েলের এই তাত্ত্বিক কাঠামোটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র বিশ্লেষণের জন্য প্রাসঙ্গিক। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি নির্মিত হয়েছে নতুন সমাজে, তাই এই ছবিসমূহ বক্তব্য ও নির্মাণশৈলীর দিক থেকে গতানুগতিকতামুক্ত হবে সেটাই প্রত্যাশিত। যে প্রশ্ন বিশ্লেষণ করতে হয় তা হল, আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রকৃতার্থে সংগ্রামী পর্যায়ের ছবির অনুরূপ হয়ে উঠতে কতটা সফল হয়েছে? নাকি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলী আটকে থেকেছে গতানুগতিকতার গণ্ডিতেই আর নির্মাণের উদ্দেশ্যেও প্রাধান্য পেয়েছে বাণিজ্যিক লাভের লক্ষ্য?

মুক্তিযুদ্ধের ছবির আলোচনায় প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করতে হয় মুক্তিযুদ্ধের আগের বছর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জহির রায়হান নির্মিত 'জীবন থেকে নেয়া' (১৯৭০) ছবিটির কথা। বাঙালি চলচ্চিত্রকার হয়েও জহির রায়হান ১৯৬০এর দশকে বিনোদনধর্মী উর্দু ছবি তৈরি করেছেন। তাঁর এই ছবিসমূহ অবশ্যই ছিল আত্তীকরণ পর্যায়ের ছবি। তবে পশ্চিম পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকারের বাঙালিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আর বৈরী আচরণের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে অসন্তোষ বেড়ে ওঠার সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি চলচ্চিত্রকাররাও ক্রমশ স্মৃতিচারণ পর্যায়ে চলে যান।

আমরা দেখেছি তখন জহির রায়হান, সালাউদ্দিন, খান আতাউর রহমান, দিলীপ সোম প্রমুখ চলচ্চিত্রকার নির্মাণ করেছেন বাংলার লোককাহিনি-ভিত্তিক চলচ্চিত্র। জহির রায়হানও উর্দু ছবির পরিবর্তে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে তৈরি করেছেন 'বেহুলা' (১৯৬৬) যা ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল।

কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিবাদের ফলে ১৯৬০এর দশকে যে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল সে পরিস্থিতি উপস্থাপনের কোনো চেষ্টা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে দেখা যায়নি। হয়তো স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের নিয়ন্ত্রণের কথা চিন্তা করেই বাঙালি চলচ্চিত্রকাররা নিজেদের ছবিতে সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে অনাগ্রহী ছিলেন।

সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সাহসী সমালোচনা প্রথমবারের মতো দেখা যায় 'জীবন থেকে নেয়া' ছবিতেই। রূপকধর্মী এই ছবিতে জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকা, চরিত্রদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক, হাস্যরস, মেলোড্রামা, অতিঅভিনয়, সঙ্গীত প্রভৃতি বাণিজ্যিক ছবির উপাদান অন্তর্ভুক্ত করা হলেও সেগুলো দর্শককে বিনোদন দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়নি। পরিচালক দক্ষতার সঙ্গে এই উপাদানগুলি রূপান্তরের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন পাকিস্তানি শাসনবিরোধী বক্তব্য। দর্শককে রাজনৈতিক চেতনায় অনুপ্রাণিত করা ছিল ছবির মূল উদ্দেশ্য।

এই ছবি তৈরির মাধ্যমে জহির রায়হানের চলচ্চিত্র সফলতার সাথে প্রবেশ করে সংগ্রামী পর্যায়ে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক এক বছর আগে নির্মিত 'জীবন থেকে নেয়া' বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে অসীম গুরুত্বপূর্ণ একটি মর্যাদা অর্জন করেছে। ছবিটি তৈরির আগে তিনি নিজেই উল্লেখ করেছিলেন যে, আমাদের ছবিতে সেই সময় অবধি দেশের রাজনৈতিক জীবন স্থান পায়নি। এই রাজনৈতিক ছবি যখন দর্শকদের মন গভীরভাবে স্পর্শ করে, তখন তিনি বলেছিলেন যে, এমন একটি ছবি তৈরির পর তিনি আর নিচে নামতে পারেন না, পেছনে হাঁটতে পারেন না। এখন থেকে তাঁর কেবল সামনে এগিয়ে যাবার পালা।

জহির রায়হানের এই কথা থেকে এমন ধারণা করা সম্ভব যে, পূর্বে যে ছবিসমূহ তিনি তৈরি করেছিলেন বক্তব্য আর নির্মাণশৈলীর বিচারে সেই সব ছবি তাঁর কাছে 'জীবন থেকে নেয়া' র মতো তাৎপর্যপূর্ণ নয়।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জহির রায়হান নির্মাণ করেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ দুটি তথ্যচিত্র। এর মধ্যে 'স্টপ জেনোসাইড' আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অত্যন্ত প্রশংসিত হয় এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাখে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। তথ্যচিত্রের প্রথম দৃশ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ইয়াহিয়া খানের নিষ্ঠুর আচরণের তীব্র সমালোচনা তুলে ধরা হয়। পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা নৃশংসভাবে যে বাঙালিদের হত্যা করেছে তাদের মৃতদেহের ছবির সঙ্গে দেখানো হয় প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে থাকা বাংলাদেশিদের।

জহির রায়হানের ক্যামেরায় দেখা যায় মর্মস্পর্শী সব দৃশ্য। অশীতিপর এক বৃদ্ধা, যার বয়স আশি থেকে একশর মধ্যে যে কোনো কিছু হতে পারে এবং যিনি সোজা হয়ে হাঁটতেও পারেন না, তাঁকে দেখা যায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বহু কষ্টে পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি সম্পূর্ণ একা, কেউ তার সঙ্গে নেই। ক্যামেরা তাঁর দিকে এগিয়ে গেলে তিনি শুধু একটি কথাই বলেন বার বার– 'সব শেষ, কিছুই আর নেই, কেউই আর নেই।'

ধারাভাষ্যে প্রশ্ন রাখেন পরিচালক: পাকিস্তানি সেনারা কতটা বীভৎস ধ্বংসলীলা চালিয়েছে বাংলাদেশে যে এমন একজন বৃদ্ধাও প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন? তথ্যচিত্রের এক পর্যায়ে দেখা যায় ভারতের মাটিতে বাঙালি শরণার্থী শিবিরে থাকা এক কিশোরীকে। বার বার ক্লোজআপে দেখানো হয় সেই কিশোরীর মুখ। তাকে জিজ্ঞেস করা হয় তার নাম কী, সে কোথা থেকে এসেছে। কিন্তু মেয়েটির ঠোঁট নড়লেও সে কথা বলতে পারে না। বিমূঢ়, হতভম্ব, বেদনার্ত এক ফাঁকা দৃষ্টি দিয়ে কেবল সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।

পরিচালক উল্লেখ করেন, এই করুণ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি যেন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বিপদগ্রস্ত মানুষের কষ্ট আর বেদনাই প্রকাশ করছে। কারণ বাংলাদেশে এখন চলছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মম গণহত্যা। তথ্যচিত্রে আমরা শুনতে পাই চিৎকার, 'গণহত্যা বন্ধ কর।' দেখা যায় মুক্তিবাহিনীর অকুতোভয় গেরিলাদের। যারা দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য যুদ্ধ করছেন। দেখানো হয় মুক্তিযুদ্ধের সাত নম্বর সেক্টরের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী নুরুজ্জামানের সাহসী উচ্চারণ: "আমাদের আছে নৈতিক শক্তি। আমাদের যুদ্ধ করতে হবে এবং আমরা যুদ্ধ করব।"

'স্টপ জেনোসাইড' তাই ছিল সাহসী ও সুনির্মিত। জহির রায়হান নিঃসন্দেহে সে সময় নিজের চলচ্চিত্র নিয়ে সামনের দিকেই এগিয়ে চলেছিলেন এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র তাঁর কাজের মাধ্যমে অর্জন করছিল এক উঁচু মান। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র দেড় মাস পরেই ঢাকার মীরপুরে পাকিস্তানপন্থী বিহারিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পুলিশ আর সেনা সদস্যদের অভিযান চলার সময় তাদের ওপর বিহারিদের অতর্কিত হামলা ঘটে। সেই হামলায় অনেক বাঙালি সেনা সদস্য ও তাদের সঙ্গে থাকা জহির রায়হানও দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাঁর অকালমৃত্যুতে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও সমাজ-সচেতন উঁচুমানের চলচ্চিত্র নির্মাণ-প্রচেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তবে সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন চলচ্চিত্র তৈরি হতে থাকে। চাষী নজরুল ইসলাম তৈরি করেন 'ওরা এগারো জন' (১৯৭২) আর 'সংগ্রাম' (১৯৭৪)। দুটি ছবিতেই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ের বিবরণ তুলে ধরা হয়। দুটি ছবিতেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু ছবি দুটির নির্মাণশৈলী অগতানুগতিক ও আকর্ষণীয় হতে পারেনি। আকর্ষণীয় চলচ্চিত্র ভাষা ব্যবহারের পরিবর্তে প্রথাগত নির্মাণরীতি অনুসরণ করে নির্মিত হয় ছবি দুটি।

অবশ্য এই সময় নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অন্য আরও কিছু চলচ্চিত্রের চেয়ে এই ছবি দুটির মান অবশ্যই ভালো ছিল। চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির উল্লেখ করেছেন এ সময় নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক ছবিতে যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বাঙালি নারীদের ধর্ষিত হওয়ার ঘটনাতে যেন বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে এই পরিচালকরা গতানুগতিক বাণিজ্যিক ছবির মতো যৌনতার উপাদান ব্যবহার করে অনেক দর্শককে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। এমন পরিচালকদের সমালোচনা করে আলমগীর কবির লিখেছিলেন:

"অধিকাংশ চিত্রনির্মাতার কাছে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি মা বোনদের ওপর পাক-সৈন্যদের পাশবিক অত্যাচারের চিত্রই কেবল মুখ্য হয়ে ওঠে। আর সব ছিল গৌণ। নিজ মা-বোনের ইজ্জতের এই লাঞ্ছনায় যারা ব্যবসায়িক উপাদান খুঁজে পায়, তাদের অসুস্থ মানসিকতা আলোচনার অযোগ্য।"

এই নেতিবাচক দিকের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন ছবিতে দেখা যায় অতিমাত্রায় আবেগসর্বস্ব সংলাপ ও অভিনয় এবং অত্যন্ত গতানুগতিক নির্মাণপদ্ধতি যা এই ধরনের ছবির মান খুব দুর্বল করে তোলে।

এ ক্ষেত্রে অন্যতম ব্যতিক্রম ছিল আলমগীর কবিরের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি 'ধীরে বহে মেঘনা' (১৯৭৩)। এই ছবিতে পরিচালক যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। আর বিভিন্ন সময় ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো হয়েছে ১৯৭১এর বিপদসঙ্কুল সময়ে মানুষের দুর্দশার নানা দৃশ্য। ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের স্থিরচিত্র আর ডকুমেন্টারি যা নির্মাণশৈলীতে নতুনত্ব এনেছে। এছাড়া বিভিন্ন চরিত্রের কথোপকথনের মাধ্যমে পরিচালক নতুন সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন বিতর্ক নিয়ে নিজের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।

একটি দৃশ্যে দেখা যায় দুজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন দেশে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পরিণত হয়েছে ছিনতাইকারীতে। কিন্তু দ্রুতই শোনা যায় এমন একজন মুক্তিযোদ্ধার ইন্টারনাল মনোলগ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে দেশ স্বাধীন করল এই দেশ তাকে কী দিয়েছে? তারপরই সে ভাবে, দেশ কি তাকে পুরস্কার দেবে? মাকে বাঁচানোর জন্য সে কি পুরস্কার নিতে পারে? তারপরই সেই মুক্তিযোদ্ধার মনে আবার শুভত্ব ফিরে আসে। সে ছিনতাই করা গাড়ি মালিককে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য রওয়ানা হয়।

এই দৃশ্যের মাধ্যমে অত্যন্ত কার্যকরভাবে পরিচালক শুভবোধ আর দেশপ্রেমের গুরুত্বের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। নান্দনিকভাবে আকর্ষণীয় নির্মাণশৈলী ব্যবহারের কারণে 'ধীরে বহে মেঘনা' হয়ে ওঠে সুনির্মিত।

খান আতাউর রহমানের 'আবার তোরা মানুষ হ' (১৯৭৪) ছবিতেও দেখানো হয়েছে যুদ্ধোত্তর সমাজে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের হতাশা। যারা যুদ্ধ করেছিল সেই দেশপ্রেমিক তরুণরা নতুন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। অথচ এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ মানুষ হয়ে উঠতে থাকে প্রভাবশালী। সামাজিক সমালোচনা পরিচালক প্রকাশ করেছেন, কিন্তু ছবির নির্মাণশৈলী নান্দনিকভাবে উদ্ভাবনী করে তুলতে পারেননি। ছবিটির বিভিন্ন দৃশ্য তাই গতানুগতিকতামুক্ত হতে পারেনি।

চলচ্চিত্র-ভাষার অভিনবত্বের দিক থেকে প্রশংসনীয় ছিল হারুন-অর-রশিদের 'মেঘের অনেক রং' (১৯৭৬)। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার একটি বাঙালি পরিবারের সুন্দর জীবন কীভাবে ধ্বংস করে দেয় তার বিবরণ উঠে এসেছে এই ছবিতে। নান্দনিকভাবে আকর্ষণীয় ক্যামেরা-ভাষা, চলচ্চিত্র-কৌশলের চিন্তাশীল ব্যবহার, চিত্তাকর্ষক সংলাপ আর সাবলীল অভিনয় এই ছবিতে যুক্ত করেছে আধুনিক ছাপ; নির্দেশ করেছে পরিচালকের কাজ ও ভাবনার গভীরতা।

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র-ভাষার উৎকর্ষের দিক থেকে তৈরি গুরুত্বপূর্ণ দুটি ছবি হল মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলীর 'সূর্যদীঘল বাড়ি' আর সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকির 'ঘুড্ডি' (১৯৮০)। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক না হলেও ছবি দুটির বিভিন্ন অংশে পরিচালকরা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয় উপস্থাপন করেছেন চিন্তাশীলতার সঙ্গে।

'সূর্যদীঘল বাড়ি' তে দেখানো হয় ১৯৪৭ সালের ভারতভাগের সময় পূর্ব বাংলার এক গ্রাম। গ্রামের কিশোর হাসু উঁচু এক গাছে উঠে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের পতাকা গাছের ডালে বেঁধে নিচে দাঁড়ানো তার দুই ভাইবোনকে বলে 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ' বলার জন্য। কিন্তু তার ছোট ভাইবোনরা নিখুঁতভাবে 'জিন্দাবাদ' শব্দটি বলতে পারে না। ভারতের দুই পাশে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া পাকিস্তান যে অখণ্ড রাষ্ট্র হিসেবে সফল হবে না প্রতীকীভাবে তাই ইঙ্গিত করে দৃশ্যটি।

'ঘুড্ডি' ছবির সময়কাল আর স্থান মুক্তিযুদ্ধের দশ বছর পরের ঢাকা শহর। ছবির মূল চরিত্র আসাদ একজন মুক্তিযোদ্ধা। শিক্ষিত আর রুচিশীল তরুণ হয়েও এই সমাজে তিনি বেকার। একটি সিকোয়েন্সে দেখা যায় সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে আসাদের বন্ধু ঘুড্ডি যখন স্মৃতিস্তম্ভে ফুল রাখছিল তখন আসাদ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। দৃশ্যটি যেন প্রতীকীভাবে প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের যে অর্জন তা থেকে বর্তমান সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দূরবর্তী অবস্থান। ঘুড্ডি ছবি তোলে স্মৃতিসৌধের। অথচ তার পেছনে দাঁড়ানো আসাদ যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা তা তার জানা নেই। স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধ যেন কেবলই ফ্রেমে আটকানো স্থবির ছবি আর মুক্তিযোদ্ধারা এই সমাজে অপরিচিত, উপেক্ষিত।

ইন্টারনাল মনোলোগে আমরা শুনতে পাই আসাদের ভাবনা:

"আমি আসলে খুঁজছি। একাত্তরের ধ্বংসস্তূপ থেকে খেতাব, প্রতাপ আর ইনডেন্টিংয়ের দরদালানের ভেতর। কী? আমিও তো যুদ্ধ করেছিলাম। এখন মুক্ত?"

মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছরের মধ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব বাংলাদেশে যে পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের খুশি হবার কারণ ছিল না। আসাদের এই প্রশ্ন তাই বেমানান মনে হয় না। যে রাজনৈতিক কাঠামো আর শোষণমূলক মানসিকতার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিলেন, স্বাধীন দেশে সেই পুরনো কাঠামো আর মানসিকতা দূর হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীরা এই সমাজে প্রতিপত্তিশালী হয়েছে। মোরশেদুল ইসলামের স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি 'আগামী' (১৯৮৪) তুলে ধরেছিল এমন পরিস্থিতির সাহসী সমালোচনা।

একটি গ্রামের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ হল ১৯৭১এ পাকিস্তানিদের দোসর এক ব্যক্তি। সেই গ্রামেই বসবাস করেন দুজন মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীন দেশে এই মুক্তিযোদ্ধাদের অসহায়ভাবে দেখতে হয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এক ব্যক্তির দাপট। একটি দৃশ্যে দেখা যায় দারিদ্র্যপীড়িত সেই মুক্তিযোদ্ধাদের একজন জমি চাষ করে দুমুঠো ভাত জোটানোর জন্য একাত্তরের পরাজিত সেই লোকটির পা ধরে মিনতি করছে। এই দৃশ্য অন্য মুক্তিযোদ্ধা নিশ্চুপভাবে দাঁড়িয়ে দেখেন।

পীড়াদায়ক এই দৃশ্য দর্শকদেরও অস্থির করে তোলে। তবে পরিচালক তুলে ধরেন তাঁর প্রতিবাদ। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা একটি শিশু হঠাৎ একটি পাথর তুলে নিয়ে সেই ক্ষমতাবান মুক্তিযুদ্ধবিরোধী লোকটিকে আঘাত করতে উদ্যত হয়। শিশুটি হয়ে ওঠে নতুন প্রজন্মের প্রতীক। পরিচালক প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতাকারীরা যত প্রভাবশালীই হয়ে উঠুক না কেন নতুন সময়ের নাগরিকরা ঠিকই তাদের প্রতিরোধ করবে।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি শক্তিশালী তথ্যচিত্র হল তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ নির্মিত 'মুক্তির গান' (১৯৯৫)। ১৯৭১ সালে লিয়ার লেভিন নামে একজন মার্কিন সিনেমাটোগ্রাফারের তোলা ফুটেজসহ বিভিন্ন দৃশ্য ব্যবহারের মাধ্যমে পরিচালকদ্বয় তৈরি করেন এই তথ্যচিত্র। মুক্তিযুদ্ধের দুষ্প্রাপ্য সব দৃশ্য অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত সুনির্মিত একটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয় স্বাধীনতার অনেক দিন পর। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের দর্শকদের কাছে তা বিপুলভাবে সমাদৃত হয়। নির্মাণশৈলীর দিক থেকে 'মুক্তির গান' অত্যন্ত আকর্ষণীয়।

তথ্যচিত্রটি একদিকে যেমন দর্শকদের মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংহত করে তেমনি স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য আর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন কতটা অর্জিত হয়েছে সে ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করতেও আগ্রহী করে তোলে। তথ্যচিত্রটি শেষ হয় মাথায় গামছা বাঁধা, লুঙ্গি-পরা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের দেখানোর মাধ্যমে যাদের নামও অজানা। ভয়েস ওভারে আমাদের কাছে ভেসে আসে পরিচালকদের প্রশ্ন:

"এই মহৎ আত্মদানের কথা মনে রাখাই কি যথেষ্ট? প্রশ্ন তবু থেকে যায়। আমরা কি পারব তাদের আত্মত্যাগের মর্যাদা রাখতে? আমরা কি পারব তাদের সেই মহান লক্ষ্য সমুন্নত রাখতে?"

দর্শকদের কেবল তথ্য প্রদান নয়, তাদের সচেতনতা ও সক্রিয়তা বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টার মাধ্যমে 'মুক্তির গান' সংগ্রামী পর্যায়ের চলচ্চিত্র হিসেবে সফল হয়ে ওঠে।

তারেক মাসুদের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি 'মাটির ময়না' (২০০২) দেখায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একটি গ্রাম। ধর্ম নিয়ে অযৌক্তিক অনুশাসন, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে পরিচালক যৌক্তিকভাবে মতপ্রকাশ করেন এই চলচ্চিত্রে। পাশাপাশি বিভিন্ন দৃশ্যে কখনও রূপকের মাধ্যমে, কখনও সরাসরি সংলাপে পরিচালক তুলে ধরেন মুক্তিযুদ্ধ-সংশ্লিষ্ট বক্তব্য।

মাদ্রাসার কমবয়সী শিক্ষার্থী রোকন তার শিক্ষককে জানায় উর্দু ভাষা তার ভালো লাগে না। মাদ্রাসার এক শিক্ষক আরেক শিক্ষককে প্রশ্ন করে, "পাকিস্তান কি ইসলাম কায়েম করেছে না মিলিটারি শাসন কায়েম করেছে?"

পাশ্চাত্যের চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত নানা কৌশল যেমন ছবিটিতে ব্যবহার করা হয় তেমনি নির্মাণ-শৈলীতে চোখে পড়ে একটি দেশজ ছাপ। অভিনয়ে আর বক্তব্য উপস্থাপনেও দেখা যায় পরিমিতিবোধ। ফলে অতি-নাটকীয়তা আর মাত্রাতিরিক্ত আবেগ প্রাধান্য দেওয়া বাংলাদেশের অনেক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের চেয়ে 'মাটির ময়না' হয়ে ওঠে অনেক উঁচুমানের ছবি।

১৯৭১ সালে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের যে গেরিলা যুদ্ধ হয়েছিল তার বিবরণ উঠে আসে হুমায়ুন আহমেদের 'আগুনের পরশমণি' (১৯৯৪) ও নাসিরউদ্দিন ইউসুফের 'গেরিলা' (২০১০) ছবিতে। পাকিস্তানি সেনা সদস্য আর তাদের এদেশীয় দোসরদের নৃশংসতা আর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব ও পাকিস্তানিদের সেই নির্মমতার বিরুদ্ধে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের রুখে দাঁড়ানোর বিবরণ ছবি দুটিতে তুলে ধরা হয়েছে। চলচ্চিত্রভাষার দিক থেকে অপ্রথাগত ও উদ্ভাবনী না হলেও দুটি ছবিতেই আমরা দেখতে পাই উঁচুমানের অভিনয় ও সংলাপ এ দুটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।'গেরিলা' ছবিতে যেভাবে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের গ্রাম ও ঢাকা শহরের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে তা আকর্ষণীয়।

তবে যুদ্ধকালীন সময়ে শহরের বিপদসঙ্কুল অবস্থার বর্ণনা তুলে ধরা বিভিন্ন বিখ্যাত ছবি, যেমন রবার্তো রসেলিনির 'রোম, ওপেন সিটি' (১৯৪৫) বা জিল্লো পন্টেকর্ভোর 'দ্য ব্যাটল অব আলজিয়ার্স' (১৯৬৬)এর নির্মাণশৈলীর অভিনবত্বের সঙ্গে এই ছবি দুটির নির্মাণশৈলীর তুলনা করা যায় না। তারপরও বাংলাদেশে তৈরি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবিসমূহের মধ্যে এই দুটি ছবি অবশ্যই প্রশংসা পাবার যোগ্য।

নাসিরউদ্দিন ইউসুফের আরেকটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র 'একাত্তরের যীশু' (১৯৯৩) তুলে ধরেছে ১৯৭১এ পাকিস্তানি বাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব। এই অসহায়ত্বের ছবি উঠে এসেছে জাহিদুর রহিম অঞ্জনের 'মেঘমল্লার' (২০১৪) ছবিতেও।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মমতা প্রদর্শনের সেই ভয়াল সময়ে একজন বাঙালি কলেজ শিক্ষক ও তার পরিবারকে যেভাবে আতঙ্কিত ও অপমানিত হওয়ার মধ্য দিয়ে দিনযাপন করতে হচ্ছিল, সেই অস্বস্তিকর অনুভূতি চলচ্চিত্রকার দর্শকদের মধ্যে সঞ্চারিত করেন সংযত ও শান্ত প্রকাশভঙ্গিতে। আন্ডার-স্টেটমেন্টের প্রয়োগ, ধীর গতি, কিছু নির্দিষ্ট শট দীর্ঘ করে তোলা, প্রাকৃতিক দৃশ্য, শব্দ আর আবহ সঙ্গীতের চিন্তাশীল ব্যবহার প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যের জন্য 'মেঘমল্লার' গতানুগতিক বাংলাদেশি চলচ্চিত্র থেকে ভিন্ন হয়ে উঠেছে। নিরীহ কলেজশিক্ষক নুরুল হুদাকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তার স্ত্রী যখন তাদের ছোট মেয়েটির হাত ধরে উদ্বিগ্নভাবে শহরের পথে হাঁটছিল, মা-মেয়ের অসহায়ত্ব আর উদ্বেগ তুলে ধরা সেই দৃশ্যটি দর্শকের মনে সৃষ্টি করে অস্থিরতা।

তীব্র অপমান ও শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নিরীহ নুরুল হুদা এক সময় হয়ে ওঠেন ভয়হীন, বেপরোয়া। পাকিস্তানি মেজরের উদ্যত পিস্তলের সামনে নিজের দুই হাত বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির চোখে যেন জ্বলতে থাকে আগুন। মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি কোথায় সে তথ্য তার অজানা হলেও পাকিস্তানিদের নৃশংস আচরণ দেখে প্রচণ্ড রাগে নতুন মানুষ হয়ে ওঠা নুরুল হুদা জানান, তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে সব জানেন কিন্তু কিছুই বলবেন না। হাত-বাঁধা নুরুল হুদাকে গুলি করে কাপুরুষের মতো হত্যা করে পাকিস্তানি মেজর। কিন্তু হুদারা পরাজিত হয় না, যেমন পরাজিত হয়নি বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও সুনির্মিত চলচ্চিত্র তাই আমরা অর্জন করেছি গত পঁয়তাল্লিশ বছরে। এই চলচ্চিত্রসমূহের মধ্যে কিছু ছবি সংগ্রামী পর্যায়ের আকর্ষণীয় হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য। কারণ এই ছবিসমূহে বক্তব্যের গভীরতা ও নির্মাণশৈলীর নান্দনিকতা এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে। এই ছবিসমূহ আগামী দিনের চিন্তাশীল চলচ্চিত্রকারদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মতো মহান অধ্যায় নিয়ে শক্তিশালী ছবি নির্মাণ করতে অনুপ্রাণিত করবে।

যে চেতনা ধারণ করে দেশ স্বাধীন করা হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের সে চেতনা যেন প্রকৃতার্থেই সমাজে টিকে থাকে সে ব্যাপারে নতুন সময়ের নাগরিকদের সচেতন করার দায়িত্বটি গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উঁচুমানের ছবি নির্মাণের মাধ্যমে সেই দায়িত্ব কার্যকরভাবে পালন করা সম্ভব।

তথ্যসূত্র:

১. ফ্র্যান্তজ ফাঁনো, 'দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ' (নিউ ইয়র্ক: গ্রোভ প্রেস, ১৯৬৩)

২. তেশোম এইচ গ্যাব্রিয়েল, 'টুয়ার্ডস আ ক্রিটিকাল থিওরি অব থার্ড ওয়ার্ল্ড ফিল্মস্' , জিম পাইন্স ও পল উইলমেন সম্পাদিত "কোশ্নেন্স অব থার্ড সিনেমা" বইয়ে প্রকাশিত (লন্ডন: বিএফআই পাবলিশিং, ১৯৮৯)

৩. মির্জা তারেকুল কাদের, 'বাংলাদেশের চলচ্চিত্র: বিবর্তনের রূপরেখা' , নির্মাল্য আচার্য ও দিব্যেন্দু পালিত সম্পাদিত "শতবর্ষের চলচ্চিত্র" বইয়ে প্রকাশিত (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৯৮)

৪. আলমগীর কবির, 'ফিল্ম ইন বাংলাদেশ' (ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৭৯)

৫. অনুপম হায়াৎ, 'জহির রায়হানের চলচ্চিত্র: পটভূমি বিষয় ও বৈশিষ্ট্য' (ঢাকা: দিব্যপ্রকাশ, ২০০৭)