মর্যাদা-শ্রেণীর উচ্চাভিলাষ

Published : 29 August 2011, 06:20 PM
Updated : 29 August 2011, 06:20 PM


সিভিল সোসাইটিকে রাষ্ট্রের একটি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীর সাথে গুলিয়ে ফেলার প্রবণতাটি বিশেষত মার্কিন এবং স্নায়ু যুদ্ধের কালে উদ্ভূত। হেগেল থেকে মার্ক্স হয়ে গ্রামশি পর্যন্ত সিভিল সোসাইটির যেসব সংজ্ঞায়ন ঘটেছে, তাতে জনপ্রতিনিধিদেরকে সিভিল সোসাইটির অংশ ভাবা যায়। কিন্তু এখনকার প্রচারিত সংজ্ঞায় সিভিল সোসাইটি/সুশীল সমাজ/নাগরিক সমাজ সবগুলোর অনুবাদই করা যায়: মর্যাদা-শ্রেণী(Status class)। মর্যাদা শ্রেণী কী?

বাংলাদেশে তাকেই সিভিল সোসাইটি বলে যাকে ম্যাক্স ওয়েবারের তুলনামূলক অজনপ্রিয় কায়দায় 'স্টেইটাস ক্লাস'[1] বলে ডাকা যায়। অর্থাৎ এই 'শ্রেণী'টির মৌল পুঁজি হচ্ছে সামাজিক মর্যাদা। রাষ্ট্রে তাদের অর্থনৈতিক জোর এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকুক বা না থাকুক, মর্যাদা বজায় থাকে। এই সরল প্রস্তাব মানলে, সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজের বিরোধপূর্ণ সংজ্ঞায়ন এড়িয়ে তাদেরকে 'মর্যাদা-শ্রেণী' ডাকায় আপত্তি নাই।

নির্বাচিত সরকারের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের মর্যাদা শ্রেণী যারপরনাই ক্ষুব্ধ। সমাজের উচ্চপর্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত, চিন্তাবান ও সংবেদনশীল এই অংশটি সরকারের যেকোনো অকার্যকারিতায় ক্ষুব্ধ হবেন এটা স্বাভাবিক। আবার যখন দেখা যায়, এই মর্যাদা শ্রেণীর সিংহভাগ দক্ষিণার উৎসই নাগরিক মধ্যবিত্ত তখন এও প্রত্যাশিত যে তারা নাগরিক মধ্যবিত্তের গড় মনোভাবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ আচরণই করবেন।

মর্যাদা-শ্রেণী কেবল সামাজিক মর্যাদায় তুষ্ট না থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষাকেও ধারণ করে। তাই প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার, যেটির ক্ষমতার উৎস এবং বৈধতার ভিত্তি সর্বস্তরের জনগণ, সেটির সঙ্গে এই বিশেষ স্তরের নাগরিকেরা দ্বান্দ্বিক অবস্থানে থাকে। কৌতূহলের বিষয়, মর্যাদা-শ্রেণী তার রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা পূরণে নির্বাচনের বৈধ পথ পাড়ি দিতে আগ্রহী হয় না। এবং সততার পরিচয় না দিয়ে, নিজের স্বার্থ উদ্ধারের অভিযানকে এটি 'আমজনতার লড়াই', 'সাধারণ মানুষের সংগ্রাম' ইত্যাদি বলে চালিয়ে দেয়।

অথচ আমজনতা বা সাধারণ মানুষ কোনো নাটকীয় নেতৃত্বের হস্তক্ষেপ ছাড়াই প্রতিদিনকার জীবনে নিজের মতন লড়াই করে যায়। এবং সময় মতন নিজস্ব তরিকায় নিজেকে জানান দিতেও পারে। বাংলাদেশেই কানসাট বা ফুলবাড়িতে এমন জানান দেয়ার ঘটনা ঘটেছে, বেশি দিন হয় নাই। সুতরাং মর্যাদা-শ্রেণীর সরকারের সাথে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা স্রেফ 'মর্যাদার লড়াই' হয়েই থাকে। বিপ্লবে উত্তীর্ণ হয় না।

যোগাযোগ ও নৌমন্ত্রীর অপসারণের দাবিতে শহীদ মিনারে ঈদ উদযাপনে বাংলাদেশের মর্যাদা শ্রেণী কর্মসূচি দিয়েছে। এক ধরনের গান্ধীবাদী মোড়কও জড়ানো হয়েছে এই কর্মসূচিতে। গান্ধীবাদীরা এটি নাও মেনে নিতে পারেন কারণ, যে গান্ধিবাদ আত্মোপলব্ধির ওপর জোর দেয় তাতে 'অপসারণে'র চেয়ে 'পদত্যাগ' অনেক বেশি সঙ্গত দাবি। মানুষের আন্তরিক পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত গান্ধিবাদ আপোসহীন। কেবল ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে 'খারাপ লোক' খারাপই থেকে গেলে গান্ধিবাদ সন্তুষ্ট হবে না[2]। উপরন্তু, নিজকে দায়ী করার যে প্রায় ক্যাথলিক ধাঁচের প্রায়শ্চিত্তবোধ সহিংস ভারতে মহাত্মা গান্ধীকে তাড়া করত সেটার থেকেও অনেক দূরে মর্যাদা-শ্রেণীর এই কর্মসূচি। এমনকি আত্মসমালোচনার উল্লেখযোগ্য উপস্থিতিও নাই এই শ্রেণীটির অন্তর্জগতে[3]। কিন্তু গান্ধিবাদী হওয়ার দায় মর্যাদা-শ্রেণীকে কেউ চাপান নাই। গান্ধিবাদ সর্বরোগের ঔষধও–এমন দাবিও করা যায় না।

আমরা বড়জোর এই দাবি করতে পারি যে, অপসারণের দাবির মাধ্যমে সরকারকে 'বাধ্য করার' মধ্যেই মর্যাদা-শ্রেণীর জিৎ। অপসারণের সিদ্ধান্তের ভেতর না।

এই রচনায় আমরা দেখার চেষ্টা করব সার্বজনীনতার দাবি নিয়ে হাজির হওয়া এধরণের কর্মসূচিগুলো কীভাবে আসলে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীরই তাকত[4] প্রদর্শনের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহৃত হয়, এবং দিনশেষে উন্মুক্ত করে দেয় অবৈধভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সুযোগকে।


তথাকথিত ১/১১-র পরে বাংলাদেশের মর্যাদা-শ্রেণীর ক্ষমতার বাসনা আর বিমূর্ত নাই। ২০১১তে এসেও তাদের এই বাসনার খোলতাই ঘটছে। বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সরকারের বেশ কিছু ব্যর্থতার 'সদ্ব্যবহার' করে প্রস্তাবিত বা মঞ্চস্থ নানা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে স্পষ্টতর হচ্ছে এই বাসনা। চারটি প্রধান ধাপের প্রস্তাব করা যেতে পারে। (না বললেই না, এই চারটি ধাপই রাষ্ট্রে সামরিকতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় একইভাবে কার্যকর)

এই ধাপগুলোর বর্ণনা দেয়া যাক:

ধাপ ১: সর্বাগ্রে নিজের মর্যাদা দৃঢ়তর করা
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করে। যাবতীয় মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হওয়ার আগে মর্যাদা নিয়ে ভাববার অবকাশ রাষ্ট্রের নাগরিকদের থাকে না। কিন্তু মর্যাদাশ্রেণী স্বীয় মর্যাদা নিশ্চিত করতে সক্রিয় থাকে। এর পেছনে থাকে সুক্ষ্ম বা স্থূল ধরণের শ্রেণীবিদ্বেষ।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি কলামের কিছু অংশ পাঠ করা যাক। এখানে প্রশিক্ষিত চালকের যৌক্তিক দাবি প্রকাশ করতে গিয়ে ছত্রে ছত্রে বেরিয়ে পড়েছে কদর্য শ্রেণীবিদ্বেষ।

'‌কে কবি বা নৃত্যশিল্পী হবে বা হবে ব্যবসায়ী, আইনজীবী, শ্রমিক বা নির্বাহী, তাদের চেয়ে একটা রাষ্ট্রকে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন থাকতে হয় চালকদের নিয়ে, বিশেষ করে ট্রাক আর বাসের চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে। আগের পেশাগুলোর তুলনায় একজন চালক নিতান্তই সামান্য মানুষ, কিন্তু দুর্ঘটনাজনিত অসংখ্য মৃত্যু, দুর্ভাগ্য আর চোখের পানি এড়াতে একটা রাষ্ট্রকে এটা অনন্যোপায় হয়েই ভাবতে হবে। …
এদের অধিকাংশই শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত, প্রশিক্ষণহীন, নিজের বা অন্যদের জীবনের মূল্য বোঝার ক্ষমতাবিবর্জিত একধরনের মূঢ় মানুষ; যারা সচেতনভাবে নয়, অবোধ ও হিতাহিতবোধশূন্যতার কারণেই ওই দুর্ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে। …ন্যূনতম কতটুকু শিক্ষা থাকলে একজন মানুষ নিজের জীবনের মূল্য বুঝতে শুরু করে? আমার ধারণা, ন্যূনতম এসএসসি পাস করলে। …' [5]

ধাপ ২: নিজকে 'সাধারণ মানুষে'র 'নিঃস্বার্থ' প্রতিনিধি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা
প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রে সুশীল সমাজ (অর্থাৎ মর্যাদা-শ্রেণী) কোনো প্রণিধানযোগ্য প্রতিষ্ঠান না। জনপ্রতিনিধিমাত্রই ভোটে জিতে আসেন, অথবা দুয়েকটি ক্ষেত্রে সংসদ কর্তৃক মনোনীত হন। বিশুদ্ধ গণতন্ত্রে নিজের প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া রাষ্ট্রক্ষমতা প্রয়োগে আর কোনো বৈধ উপায় নাই। কিন্তু, তারা নিজেদের গণমানুষের প্রতিনিধি হিসাবে জাহির করতে চান। যদিও প্রখর ব্যক্তিবাদী অর্থনীতির গ্রাহক হয়েও 'আমরা' তাদের প্রিয় শব্দ। তারা চেষ্টা করতে থাকেন আরো অনেককেই এই 'আমরা'র ভেতর টেনে আনার। দাখিল করেন তাদের 'নিঃস্বার্থ' হবার নানা প্রমাণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল লিখেছেন:'সারা দেশে আরও বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের কিছু মন্ত্রীর সমালোচনা করা হচ্ছে। তাঁদের অনেকে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে নাগরিক সমাজ ও পেশাজীবীরা রয়েছেন, যাঁরা আগে কখনো প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করেন নি। রয়েছেন এমনকি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানও, সরকারের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে যাঁরা আর কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা থাকার কথা নয়।'[6]

শেষের ইটালিক অংশটা কৌতুহলোদ্দীপক, এর অর্থ দাঁড়ায় লেখক মনে করছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হওয়াটা একধরণেরে 'ব্যক্তিগত পাওয়া'।

ধাপ ৩: শক্তি প্রদর্শন/প্রদর্শনীর মাধ্যমে সম্ভ্রম 'জিতে নেয়া'
মর্যাদা-শ্রেণী প্রযোজিত 'প্রতিবাদ' কর্মসূচি প্রায়শই একধরণের 'শোডাউনে'র রূপ নেয়। দৃশ্যমান হয়ে ওঠে তাদের ক্ষমতার বাসনা। জনগণের দাবি আদায়ের কর্মসূচির নামে এই শক্তি প্রদর্শনী শুরু হয়। কিন্তু শেষ হয় কেবল নিজেদের আধিপত্যের নিশ্চয়তা নিয়ে। ফলে অপ্রাসঙ্গিক থেকে যায় দাবি পূরণ হওয়া না হওয়ার আদি বিষয়টি। এই শক্তি প্রদর্শনীর একটি 'সফল' ইভেন্টের উদাহরণ হতে পারে ভারতের ডানপন্থী পুঁজির[7] পৃষ্ঠপোষকতায় সেদেশের সুশীল সমাজ নেতা আন্না হাজারের কথিত অনশন কর্মসূচি।

আন্না হাজারে ও তার সঙ্গীদের দাবি তারা এই রাউন্ডে বিজয়ী হয়েছেন। তারা দাবি করছেন আন্নারা যা চেয়েছেন সরকার তা পূরণ করেছে। কিন্তু মূল সত্য কি তাই? স্মরণ রাখা যায় আন্নার প্রথম দাবি ছিল আগস্টের ভেতর তার প্রস্তাবিত বিল পাশ। না হলে তিনি অনশন চালিয়ে যাবেন। স্পষ্টতই এখন সেটি হচ্ছে না। এরপর তিনি দাবি করেন, তার প্রস্তাবিত বিল সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির কাছে যাবে না। স্পষ্টতই এখন সেটি যাচ্ছে। উপরন্তু, এবং তাই না, সরকারি দলের আনা বিলটিও কিন্তু বাতিল করা হয় নাই। সুতরাং আন্নার দাবি পূরণ হয়েছে বলা সঙ্গত না, বরং তিনি কার্যত 'জয়ী' হওয়ার লক্ষ্যে দাবি বদলিয়েছেন মাত্র। মনে রাখতে হবে, যে দুর্নীতিবিরোধী জনগণের কথা বলে আন্না এই প্রতিবাদনাট্যের আয়োজন করেন, সেই জনগণের দাবি কিন্তু পূরণ হওয়া থেকে অনেক দূরে। কেবল আন্না-আইকন আরেক দফা পোক্ত হয়। মর্যাদার তালগাছ নিয়ে বাড়ি ফেরে আন্নাবাহিনী।

এই স্বার্থান্ধ শ্রেণীপরতার সমর্থক বাংলাদেশের মর্যাদা-শ্রেণীর ভেতরেও বিদ্যমান, আশ্চর্য কী। কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হোসেন গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছেন:'ভারতে নাগরিক আন্দোলনের নেতা আন্না হাজারের জয় হয়েছে। মনমোহন সিংয়ের সরকার তাঁর সব দাবি মেনে নিয়ে সংসদে লোকপাল বিল এনেছে, আগের বিল সংশোধন করেছে। সর্বদলীয় বৈঠক করে একটি সমাধানে এসেছে। আবার আন্না হাজারে ইস্যুতে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে বিরোধী দলও রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করে নি। এরই নাম গণতন্ত্র।'[8]

অর্থাৎ এধরনের বিক্ষোভের সুযোগে বিরোধীদলের পক্ষে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার পরিস্থিতি অন্তত সৃষ্টি করা সম্ভব। এছাড়াও নির্বাচনী সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিপরীতে 'সর্বদলীয়' ফর্মুলা এবং সংসদের বিপরীতে সরকারি সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপে সংসদ-সিভিল সোসাইটির বহুকথিত সংলাপের ধারণা এই বাক্যগুলোয় লুকিয়ে থাকে।

ধাপ ৪: রাজনৈতিক ক্ষমতার একচেটিয়া মালিকানার দাবি
দাপট প্রদর্শনের এই ইভেন্টগুলোতে প্রথমে ক্ষমতার ধরন পরিবর্তনের কথা বলা হয়। যেমন 'রাজনৈতিক সংস্কৃতির বদল', 'হানাহানির রাজনীতি পরিহার', 'খাইখাই পলিটির পরিবর্তন' ইত্যাদি। কিন্তু ক্ষমতার ধরন পরিবর্তনের অর্থ কেবল ক্ষমতার ধরনেরই পরিবর্তনে সীমিত থাকে না। রূপ নেয় স্রেফ ক্ষমতার মালিকানা বদলের চেষ্টায়। এবং এক পর্যায়ে, প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের বদলে গোষ্ঠীতন্ত্রের জয়জয়কার ঘোষিত হয়, প্রচ্ছন্নভাবে হলেও।

সুতরাং উপরিতলের একটি বা দুটি ইস্যুতে কর্মসূচি শুরু হলেও, শেষ পর্যন্ত মূল গভীরের অভিপ্রায়টি বেরিয়ে আসে। প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন:'আমরা সরকার বা কারও প্রতিপক্ষ নই। আমরা দেশের সাধারণ নাগরিক। এই দেশের রাজনীতিবিদেরা ঘুমিয়ে আছেন। আমরা তাঁদের ঘুম ভাঙাতে চাই। আর সে কারণেই আমরা ঈদের দিন শহীদ মিনারে গিয়ে প্রতিবাদী অবস্থান নেব।'[9]

প্রশ্ন আসতেই পারে, নির্দিষ্ট মন্ত্রীর অপসারণের দাবির সাথে পাইকারিভাবে রাজনীতিবিদদের সম্পর্ক কী? মর্যাদা-শ্রেণী উর্দিবাদী রাজনীতিবিতৃষ্ণ সমাজ পেতে চায় কি? মন্ত্রীর অপসারণের দাবিতে একাগ্র না হয়ে রাজনীতিবিদদের 'ঘুম ভাঙানোর' মতন ঢালাও কর্মসূচিতে কী হাসিল হবে?

একই সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেন:'নাগরিকদের এই উদ্যোগ তো নতুন কিছু নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ছিলাম। এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে আমরা ছিলাম।'…
'রাজনীতিবিদেরা একদল ক্ষমতায় যাবে, আরেক দল বিরোধী দলে। এদের মাঝখানে থাকবে নাগরিক সমাজ। ছাত্র, শিক্ষক, শিল্পী সবাই এই দলে। আধুনিক গণতন্ত্রে এই নাগরিক সমাজ গণতন্ত্রের সম্পূরক শক্তি।'[10]

মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল 'নাগরিক সমাজ'। সাধারণ মানুষও নিয়েছিল। আবার 'দেশের সাধারণ নাগরিক' = 'নাগরিক সমাজ' এই সমীকরণও মেনে নিলে, নাগরিক সমাজের বাইরে আর কোনো সাধারণ নাগরিক থাকে না (ঠিক গ্রিক নগররাষ্ট্রের মতন, যেখানে নগরপ্রাচীরের ভেতরের বাসিন্দারাই – তাও দাস, নারী ও ইমিগ্র্যান্ট বাদে – নাগরিক)। কিছুটা দ্বিধার সন্ধান প্রবীণ এই প্রাবন্ধিকের কথার ভেতরেই কিন্তু পাওয়া যায়। এবং এ থেকে নাগরিক সমাজের 'সার্বজনীনতা'র দাবী প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

নাগরিকসমাজের এই অসার্বজনীনতার বিষয়টি স্বীকৃত হয় সৈয়দ আবুল মকসুদেরই সত্যভাষে। তিনি স্বীকার করে নেন, নাগরিক সমাজ গণতন্ত্রের 'সম্পূরক' শক্তি। অর্থাৎ গণতন্ত্রে ঘাটতি থাকে। ধরে নিই ঘাটতিসহ গণতন্ত্রটি যখন উৎপাদিত হচ্ছিল (ধরা যাক নির্বাচনের সময়) তখন তাতে নাগরিক সমাজের কিছু করার ছিল না। এখন গণতন্ত্রের মূল উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রমব্যয়েতে মেরামতির কাজেই নাগরিক সমাজের আগ্রহ।

মেরামতি ছাড়াও নাগরিক সমাজের একটা সালিশী করবার আকাঙ্ক্ষাও থাকে। তারা সরকার ও বিরোধীদলের 'মাঝখানে' থাকে (সঞ্চালকের ভূমিকায়? বানরের রুটিভাগের উপকথা স্মর্তব্য)। বস্তুত নাগরিকসমাজের কর্মসূচিকে 'রাজনৈতিক' বলে চিহ্নিত না করতে পারাটাও একধরনের রাজনীতিবিমুখতার পরিচয় দেয়। এবং এতে দুটি ঘটনা ঘটে। প্রথমত, সংসদীয় গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে অরাজনৈতিক শর্টকাটে[11] জন্ম হয়। দ্বিতীয়ত, জনগণের প্রকৃত অভ্যুত্থানের পথ রুদ্ধ করা এই অরাজনৈতিক শর্টকাট পরিণত হয় অগণতান্ত্রিক শক্তির চোরাই রাস্তায়।

একই সাক্ষাৎকারে পরের দিকে পাই:'ভারতে একজন আন্না হাজারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলেছেন। সরকারবিরোধী দল সবাই মিলে তাঁর দাবি গ্রহণ করেছে। এটিই গণতন্ত্র।'[12]…

ভারতে উচ্চাভিলাষী সিভিল সোসাইটি আর মিডিয়ার গাজোয়ারি ব্ল্যাকমেইলিংয়ে সেদেশের আইনসভা নমনীয় হতে বাধ্য হয়েছে এতে উল্লসিত হয়ে ই-প্রত্যয় যোগে 'এটিই গণতন্ত্র' বলে ওঠার বিপদ এরই মধ্যে অনেকটা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কেবল এটুকুই বলা চলে, এটিই গণতন্ত্র না বলে এটাও গণতন্ত্র বললে হয়ত গণতন্ত্রের পক্ষে কিছুটা স্বাস্থ্যকর হত।


এটিই গণতন্ত্র বলার ভেতরে বস্তুত গণতন্ত্রের প্রতিই মর্যাদা-শ্রেণীর তীব্র অসহনশীলতার খোঁজ পেতে পারেন কেউ।
ভোটের রাজনীতি নিশ্ছিদ্র গণতন্ত্র নিশ্চিত করে না। কিন্তু ভোটের রাজনীতি গণতন্ত্রের মৌল উপাদান। এই উপাদানটি সরিয়ে নিলে গণতন্ত্র থাকে না। গণতন্ত্র নিশ্ছিদ্র করতে হলে ভোটের রাজনীতিকে সারিয়ে তোলার বিকল্প নাই। কিন্তু মর্যাদা-শ্রেণী কখনো কখনো 'বিকল্পধারার' কর্মসূচি দিয়ে মানুষেরই প্রদত্ত ভোটের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। একই সাথে ব্যক্ত করে নিজের ক্ষমতার বাসনা। মানুষের ভোটের বিরুদ্ধে যাওয়ার অর্থ মানুষের ভোটের ক্ষমতার বিরুদ্ধে যাওয়া। এটি না দিয়েও দাবি আদায় করা যায়। যদিও কঠিন পথ।

রাষ্ট্রে রাজনৈতিক সমাজ বা পলিটির সাথে শ্রেণীনির্বিশেষে নাগরিকের কথা বলার বৈধ মাধ্যম সংসদ। সংসদ নির্বাহীবিভাগকে দিয়ে জনগণের ইচ্ছা কার্যে পরিণত করায়। মন্ত্রী নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বে ও সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। সংসদ সদস্যরা এরই মধ্যে সংসদে দাঁড়িয়ে একাধিক মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেনও। নিজেদের এই দাবি পূরণ করতে সংসদ সদস্যদেরই চাপ দিয়ে যেতে হবে। একই সাথে ভোটাররা নিজের এলাকার জনপ্রতিনিধিকে বাধ্য করাবেন নিজের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে।

জনগণ টু সরকার ভায়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী সিভিল সোসাইটির রুটটি সংক্ষিপ্ত, বিপজ্জনক ও পরিহার্য–একথা যারা মানবেন তারা নিজে জনপ্রতিনিধিদের তাদের ভোটারদের কাছে দায়বদ্ধ করে তোলার জন্যই কাজ করে যাবেন। এবং কার্যকর গণতন্ত্রের লক্ষ্যে অন্যকেও অনুরোধ জানাবেন, প্রকৃত 'পথের বাধা'টি সরিয়ে নিতে।

তথ্যসূত্র
[1] জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার ১৯২১ সালে প্রকাশিকত 'Economics and Society' গ্রন্থের "Class, Status, Party" শীর্ষক অধ্যায়ে এটি বিশদ করেছেন।
[2] গান্ধী নিপীড়কের মনে পরিবর্তনপ্রত্যাশী ছিলেন। তাকে প্রতিহত করার মধ্যে বিজয় খুঁজতেন না। ১৯৪০ সালের ৬ জুলাই হরিজন প্রত্রিকার একটি প্রবন্ধে তিনি লেখেন: "I would like you to lay down the arms you have as being useless for saving you or humanity. You will invite Herr Hitler and Signor Mussolini to take what they want of the countries you call your possessions…You will give all these but neither your souls, nor your minds. If these gentlemen choose to occupy your homes, you will vacate them. If they do not give you free passage out, you will allow yourself, man, woman, and child, to be slaughtered, but you will refuse to owe allegiance to…"
(Jack, Homer. Gandhi Reader, pp.345-6)
[3] ব্যতিক্রম হিসেবে মুহম্মদ জাফর ইকবাল যিনি এই কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়েছেন তার প্রবন্ধে আত্মসমালোচনার চেষ্টা দেখি:"আমার একজন সহকর্মী নিজের সিট থেকে উড়ে গিয়ে জানালার কাচে পড়েছেন। মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে। আমরা গাড়ি থেকে নেমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোনো একটা গাড়ি থামানোর চেষ্টা করছি আমাদের আহত সহকর্মীকে বাঁচানোর জন্য। দামি পাজেরো গাড়ি গতি কমিয়ে দুর্ঘটনায় টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া গাড়িটাকে একনজর দেখে হুশ করে বের হয়ে যায়, থামে না। শেষ পর্যন্ত থামল একটা ট্রাক। ট্রাক ড্রাইভারের পাশে বসিয়ে রক্তাক্ত সহকর্মীকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।
(মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ঘুরে দাঁড়ানোর সময়, দৈনিক প্রথম আলো, ২৬-০৮-২০১১)
[4] 'ক্ষমতা' শব্দের বদলে। যেহেতু ক্ষমতা শব্দের অন্যবিধ তাত্ত্বিক অর্থ আছে এবং সেটি এই রচনায় ব্যবহৃতও।
[5] আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, 'নৌপরিবহনমন্ত্রী ও তাঁর 'অশিক্ষিত' ড্রাইভার', দৈনিক প্রথম আলো, ২৭-০৮-২০১১
[6] আসিফ নজরুল, 'ব্যর্থ মন্ত্রীদের অপসারণ কেন জরুরি', দৈনিক প্রথম আলো, ২৭-০৮-২০১১
[7] Arundhati Roy, 'I'd rather not be Anna', The Hindu, 21-08-2011
[8] সোহরাব হোসেন, 'ভারতের আন্না, বাংলাদেশে ঈদযাত্রীদের কান্না' দৈনিক প্রথম আলো, ২৯-০৮-২০১১
[9] এবিসি রেডিওকে দেয়া প্রাবন্ধিক লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদের সাক্ষাৎকার অবলম্বনে ২৮-০৮-২০১১ তারিখের দৈনিক প্রথম আলোতে ছাপা হওয়া 'আমরা রাজনীতিবিদদের ঘুম ভাঙাতে চাই' শিরোনামের রিপোর্ট
[10] ঐ
[11] ভারতের লোকসভায় কংগ্রেসের সদস্য রাহুল গান্ধী, ২৬-০৮২০১১ তারিখে আন্না হাজারের আন্দোলন সম্পর্কে শ্রদ্ধা পোষণ করেই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন: "… individual dictates, no matter how well intentioned, must not weaken the democratic process. This process is often lengthy and lumbering. But it is so in order to be inclusive and fair. It provides a representative and transparent platform where ideas are translated into laws. A tactical incursion, divorced from the machinery of an elected Government that seeks to undo the checks and balances created to protect the supremacy of Parliament sets a dangerous precedent for a democracy.
[12] সৈয়দ আবুল মকসুদের সাক্ষাৎকার (দ্র.৯)

অনিন্দ্য রহমান : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।