ভাদ্রের তাল কি অকালে পাকছে?

জায়েদুল আহসান পিন্টু
Published : 25 August 2011, 12:53 PM
Updated : 25 August 2011, 12:53 PM

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে একটা গুরুতর অভিযোগ এনেছেন। তিনি বলেছেন, "শেখ হাসিনার সরকার জরুরি ভিত্তিতে রাস্তাঘাট সংস্কার ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দিন-রাত কাজ করে চলেছে। কিন্তু এরপরও কিছু কিছু সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল রং মিশিয়ে অতিরঞ্জিত খবর পরিবেশন করে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছে,যাতে শেখ হাসিনাকে হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।"

শেখ হাসিনা শুধু দেশের প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি দেশের সবচেয়ে বড় আর পুরনো রাজনৈতিক দলের প্রধান। তাকে হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা – এমন অভিযোগ শুনে গণমাধ্যমের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে আমাকে নড়েচড়ে বসতে হলো।

সবার আগে মাথায় যে প্রশ্নের উদয় হলো সেটি হলো : কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যমের পক্ষে এরকম একটি ক্ষেত্র তৈরি করা সম্ভব। সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যর পরের অংশে কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তিনি কিসের কথা বলছেন। তিনি বলেছেন 'এখানে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে, যাতে আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়।'

বুঝতে পারলাম, সংবাদ মাধ্যম বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ সরকারের ব্যর্থতা তুলে যেসব সংবাদ পরিবেশন করেছে, তাতে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে ক্ষমতাসীন সরকারের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এরকম একটি দূরত্ব সৃষ্টির চিন্তা মাথায় রেখে সংবাদ পরিবেশন করা এবং তারও পেছনে আরেকটি গূঢ় উদ্দেশ্য রেখে দেওয়া – একে সুদূর কষ্টকল্পনা বলেই মনে হলো।

এ পর্যায়ে গণমাধ্যম ও ক্ষমতাসীন দলের সম্পর্কের বিন্যাসের একটা অতি সুপরিচিত প্যাটার্ন আমার মাথায় উঁকি দিলো। আমার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, একটা সরকার যখন জনগণের স্বপ্ন পূরণ থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যেতে থাকে, তখন মিডিয়া তাদের আক্রমণের টার্গেটে পরিণত হয়। এটা অতীতে সব সরকারের সময় আমরা ঘটতে দেখেছি। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো প্রাচীন ও বড়ো রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদক, যিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন, তিনি যখন এরকম সুদুরপ্রসারি একটি ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলেন গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে, তখন এটাকে ওই প্যাটার্নের অংশ হিসেবে না দেখে আরো সিরিয়াসলি নিতে হয়। আমি বলবো, গণমাধ্যমের এই অভিপ্রায় যদি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে স্পষ্ট হয়ে থাকে, তবে তার উচিৎ হবে খোলসা করে বলা, কোন্‌ গণমাধ্যম এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। দেশ ও রাষ্ট্রের স্বার্থেই এটা তার করা উচিৎ। আর তিনি যদি তা না করেন, তাহলে বলবো, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচারের ক্ষেত্রে তিনি অন্য সরকারগুলোর চেয়ে একটু তাড়াহুড়োই করে ফেলেছেন।

গণমাধ্যম সরকারের আক্রমণের লক্ষ্যে সবচেয়ে বেশি পরিণত হয়েছিল সম্ভবত গত সরকারের সময়। আমাদের মনে আছে, বিএনপি জামাতের শিল্পমন্ত্রী জামাতের আমীর মতিউর রহমান নিজামী বলেছিলেন, বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার কথার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। আর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় জজ মিয়ার তথাকথিত জবানবন্দি নিয়ে মিডিয়া প্রশ্ন তোলায় গালমন্দ করেছিলেন। শিশির ভট্টাচার্যের সাড়া জাগানো আষাঢ়ে গল্পের আসরের কার্টুন নিয়েও তিনি বলেছিলেন, মিডিয়ার কারণে তদন্ত ঠিক মতো করা যাচ্ছে না। বিএনপির পুরো আমলটাই দেখেছি কথায় কথায় মিডিয়াকে দোষ দেওয়া হতো। তখনও যতো দোষ, নন্দ ঘোষের ছিল। সারা দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার, ক্রসফায়ার, জিনিসপত্রের দাম বাড়া এসবই নাকি মিডিয়ার বানানো। ২০০৫ সালের শেষ দিকে আমি তখন ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের চিফ রিপোর্টার, যতোদূর মনে পড়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর নিমন্ত্রণ করে তার কার্যালয়ে (কয়েকজন সহকর্মীসহ) আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, গ্রেনেড হামলা নিয়ে আমরা যা লিখছি তা ঠিক নয়, জজ মিয়াই ঠিক বলেছেন, আমাদের লেখালেখির কারণে নাকি তাদের তদন্ত ব্যহত হচ্ছে। বলাবাহুল্য, আমরা তার বক্তব্য মেনে নেই নি। আমরা নিজেদের অনুসন্ধানের যথার্থতার ব্যাপারে স্থিরবিশ্বাসী ছিলাম। জজ মিয়া নাটক এখন প্রহসনমূলক আষাঢ়ে তদন্তের প্রকৃষ্ট উদাহরণে পরিণত হয়েছে। ওই প্রতিমন্ত্রী এখন ওই মামলাতেই গ্রেপ্তার।

আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করে আমি পুলক অনুভব করলাম। সৈয়দ আশরাফ যেদিন গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তুলছেন, তার একদিন আগে অর্থাৎ ২১ আগস্ট, ২০১১ বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভি আহমেদও গণমাধ্যমের ওপর একচোট নিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, তারেক রহমানকে নিয়ে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে মিডিয়া বাড়াবাড়ি করছে। তারেক রহমানকে জড়িয়ে যেসব রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে, তা নাকি সাংবাদিকতার নীতিবহির্ভুত। তিনি আরো অভিযোগ করেছেন, কোনো একটি মহলের উদ্দেশ্য পূরণের অভিপ্রায়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

গণমাধ্যম সরকারের আক্রমণের শিকার হয়ে থাকে, হবে – এটা নতুন কিছু নয়। যে গণমাধ্যম সরকারের ব্যর্থতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সেটি সরকারের নেকনজরে থাকার কোনো কারণ নেই। আমি বলবো, গণমাধ্যম এ জন্যে বরং গর্বই করতে পারে। কিন্তু তাই বলে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগ!

আমি বলবো, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়তো একটু বেশি বলে ফেলেছেন। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সরকারগুলো তাদের মেয়াদের শেষদিকে গণমাধ্যমের ওপর খাপ্পা হয়ে উঠতে থাকে। আওয়ামী লীগ সরকার এখন তার মেয়াদের মধ্য পর্যায়ে। কিন্তু এখনই কি সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো? আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, এবার গ্রাফটা যেন অন্যরকম আচরণ করছে। ভাদ্রের তাল কি অকালে পেকে যাচ্ছে?

জায়েদুল আহসান পিন্টু
: সাংবাদিক ও গবেষক।