‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যু: প্রাইভেট ক্লিনিকে অবহেলা ও ভুল চিকিৎসা

ফরিদা আখতার
Published : 22 August 2011, 03:15 PM
Updated : 22 August 2011, 03:15 PM

আমি অবাক হয়ে লক্ষ করছি এখন মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাইছে। আমরা সবাই জানি মরতে একদিন হবেই। এবং সে মৃত্যু কখন হবে সেটা কেউ বলতে পারে না। এমন নয় যে সবাই একটা পরিণত বয়সে এসে মরবে। যার যেমন হায়াত আছে সেভাবেই তার চলে যেতে হবে, কম বয়স কিংবা বেশি বয়সে, এবং সেটাও স্বাভাবিক হতে পারে।

'স্বাভাবিক' মৃত্যু নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই তবে দারিদ্র, পুষ্টিহীনতা, ধুমপান, পরিবেশ ও খাদ্য দুষণের কারণে সে মৃত্যুও একটু সময়ের আগেই হচ্ছে। কিন্তু তার পাশাপাশি অস্বাভাবিক মৃত্যু যেন একটূ বেশি হাতছানি দিচ্ছে। আমরা সব ভীত হয়ে আছি।

আমার কাছে মনে হচ্ছে অস্বাভাবিক মৃত্যু এখন দেশের অন্যতম বড় সমস্যা। তবে আমাদের দেশে কোন বড় সমস্যা হলে তার সমাধান করতে হলে নাম করা, বিখ্যাত কাউকে বলি দিতে হয়। না হলে, সমস্যার সমাধান হয় না। ইদানীং অস্বাভাবিক মৃত্যুর নানান খবর নানাভাবে পত্র-পত্রিকায় আসছে। সড়ক দুর্ঘটনা, পিটিয়ে মারা, আইন- শৃংখলা বাহিনীর হাতে বন্দুক-যুদ্ধে মরা, সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে মরা, অথবা সালিশের অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করা, কুপিয়ে মারা, স্বামী কর্তৃক স্ত্রী হত্যা এবং ধর্ষণ করে হত্যা তো আছেই। এই সব দেখে মনে হয় আজরাইল ফেরেস্তা ইস্তফা দিয়েছেন। এই দায়িত্ব নিয়েছে মানুষ নিজে। এরা কেউই অসুস্থ্ ছিলেন না, তবু মরে গেছেন।

অসুস্থ হলে মৃত্যুর ভয় সবাই পায়। তাই চিকিৎসা করার জন্য ডাক্তারের কাছে ছোটে। আশা করা হয় সঠিক চিকিৎসা পেলে সুস্থ্য হবে, আর এটাই যদি তার স্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ হয় তাহলে মারা যাবে। এই মৃত্যুতে দুঃখ আছে কিন্তু ক্ষোভ নেই। সেই মৃত্যু মেনে নেয়ার ব্যপারে স্বাস্থ্য সেবা কেমন সেই প্রশ্ন আসে। রোগীর আপনজনেরা যেমন তেমন হাসপাতাল বা ডাক্তার দেখাতে চান না। তাই তো ভাল ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া কঠিন। ভাল ডাক্তার দেখাতে পারবেন এমন সাধ্য বা সামর্থ সবার থাকে না। কিন্তু ভাল বা সাধারণ ডাক্তারের চিকিৎসায় রোগ ভাল হওয়া না হওয়া এক কথা, আর ডাক্তারের অবহেলা বা ভুল চিকিৎসায় মারা যাওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। আমি সেই প্রসঙ্গেই আসতে চাচ্ছি।

চিকিৎসকের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুকে শুধু অস্বাভাবিক মৃত্যু বলা ঠিক নয়, এটা এক ধরণের হত্যাকাণ্ড। ঠিক যেমন বেপরোয়া গাড়ী চালানোর ক্ষেত্রে মৃত্যুকে শুধু অস্বাভাবিক মৃত্যু বলা ঠিক নয়, এটা লাইসেন্স দেয়া হত্যাকাণ্ড।

সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক হত্যাকাণ্ডের পর তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যু এর আগের সব দুর্ঘটনার যাতনাকে নতুন করে জাগিয়ে দিয়েছে। মীরসরাইয়ের ছোট শিশুদের মৃত্যুর যন্ত্রণা থেকে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল, মানিকগঞ্জের ৫ জনের মৃত্যু এবং সেই পাঁচ জনের মধ্যে তারেক ও মিশুক নিহত হয়ে আজ সড়ক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সবাই ভাবছে, খোদ প্রধানমন্ত্রী যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কাজ নজরদারী করছেন।

১৩ তারিখের দুর্ঘটনার শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই ১৫ আগস্ট রাজধানীতে ঘটে গেল আরও একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু বা হত্যাকাণ্ড। বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী ল্যাব এইড প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসায় অবহেলার কারণে মারা গেছেন বলে ১৬ আগস্টের পত্রিকার শিরোনাম হয়। তখনই চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ আসে। বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ হয়, হাইকোর্ট থেকে দায়িত্বশীল তিন ডাক্তারকে তলব করে নির্দেশনা জারী করা হয়। শেষ পর্যন্ত ল্যাব এইড কর্তৃপক্ষ দোষ স্বীকার করে মৃদুল কান্তির পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা জানায়। পঞ্চাশ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেলেই মৃদুল কান্তির পরিবারের দুঃখ মোচন হয়েছে বলা যাবে না। যিনি গেছেন তাঁর জীবনের মূল্য টাকা দিয়ে নির্ধারন করা যাবে না। কাজেই এটা ক্ষতিপূরণ নয়, এটা ল্যাব এইডের অপরাধ স্বীকারের মূল্য। একটি ব্যায়বহুল হাসপাতাল হিসেবে ল্যাব এইড যা আয় করে ৫০ লাখ টাকা দেয়া তাদের জন্য খুব কঠিন কিছু নয়, তাই তারা তড়িঘড়ি দিয়েছে, কারণ ল্যাব এইডে এটাই অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার একমাত্র ঘটনা নয়, আরও অনেক আছে। ভুক্তভুগীরা কিছু প্রতিবাদ করলেও এক সময় থেমে গেছে, কোন প্রতিকার না পেয়েই। যদি সবাইকে ক্ষতিপূরণ দেয় তাহলে তাদের কোটি কোটি টাকা লাগবে। মনে পড়ছে বছর কয়েক আগে নায়ক মান্নার মৃত্যুও ঘটেছে ইউনাটেডের মতো একটি ব্যায়বহুল প্রাইভেট হাসপাতালে। মান্নার স্ত্রী অনেক অভিযোগ করেও কোন সুরাহা করতে পারেন নি। সংবাদ পাঠিকা রাশেদা মহিউদ্দিনও ভুল চিকিৎসায় মারা গেছেন বলে অভিযোগ আছে। তাই ধন্যবাদ জানাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগ ও নাট্যকলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের বিষয়টিকে দৃঢ়তার সাথে তুলে ধরার জন্য। তারা অন্তত একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সম্প্রতি আরেকটি প্রাইভেট হাসপাতালে নবজাতক এক শিশুর মৃত্যু ঘটনা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ধন্যবাদ দেই সংবাদ মাধ্যমকে, তারা বিষয়গুলো জনগনের কাছে তুলে ধরছেন।

আমরা জানি স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে পাবলিক বা সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। দুঃখজনক যে আমলাতান্ত্রিক নিয়ম নীতির কারণে এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে স্বাস্থ্য সেবা একেবারে ভেঙে পড়ছে। ইউনিয়ন থেকে শুরু করে জেলা পর্যন্ত তিনটি স্তরের স্বাস্থ্য সেবা যদি ঠিক মতো দেয়া হোত তাহলে এ দেশের সাধারণ মানুষ অসুস্থ হলে সুস্থ্য হবার আশ্বাস পেতো। কিন্তু সে সুযোগ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে, প্রাইভেট হাসপাতালের আবির্ভাবের পর তা আরও ত্বরিৎ গতিতে ভেঙে পড়ছে। সরকারী হাসপাতালে গিয়ে সেবা না পেলেই প্রায় সব স্তরের মানুষ অসুস্থ্য হলে ছুটছে প্রাইভেট ক্লিনিকে। মনে করছে কিছু টাকা বেশি নিলেও এখানে চিকিৎসা পাওয়া যাবে। তারা সুস্থ্য হয়ে বাড়ী ফিরবে। হায় সেটাও এখন পাওয়া দুস্কর হয়ে যাচ্ছে।

প্রাইভেট হাসপাতালের ভাল ভাল বিজ্ঞাপন দেয়া হয় পত্রিকায় এবং টেলিভিশনে। আর সরকারী হাসপাতালের দুর্দশা দেখানো হয় খবরে। সরকারী হাসপাতালে অবহেলা নিয়ে কথা বলা যায়, কারণ তারা জনগণের অর্থে চলে, জবাবদিহিতার প্রশ্ন আছে , কিন্তু প্রাইভেট হাসপাতালও কি জনগনের অর্থে চলছে না? কোন এক ব্যবসায়ী তার অর্থ বিনিয়োগ করেছেন বিল্ডিং ও মেশিনপত্র কেনার জন্য, কিন্তু রোগীরা সেবা নিচ্ছে কাড়ি কাড়ি পয়সা খরচ করে। তারা যতো দামী মেশিন আনবে রোগীকে তত বেশি টাকা দিতে হবে। অর্থাৎ এক সময় রোগীর পয়সা দিয়েই মেশিনের দাম তোলা হবে। এখানে সম্পর্ক শুধু ক্রেতা ও ভোক্তার। পছন্দ হলে নেবে না হলে নেবে না। সেবার প্রশ্ন এখানে নেই।

পছন্দ হবার জন্যে চিকিৎসার মান যাই হোক না কেন, রোগীদের এবং তাদের সাথে আসা পরিবার পরিজনের জন্য ভাল চকচকে রুম, টেলিভিশন, বসার ব্যবস্থা সব থাকে। বাইরে রোগী অপেক্ষা করলে সে বসে বসে টেলিভিশন দেখতে পারে। রোগের ব্যথা ও কষ্ট যাই থাকুক এই সুযোগটা তাদের দিলে ভুলিয়ে রাখা যায়। অনেক সময় কেবিনের সুন্দর ব্যবস্থা দেখে আবাসিক হোটেল নাকি হাসপাতাল তাই বুঝতে কষ্ট হয়।

প্রাইভেট হাসপাতালের চকচকে ভাবের ভিড়ে ভুল চিকিৎসার ঘটনা লুকিয়ে রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না, কারণ এর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এতোই বাড়ছে যে একটি-দুটি করে পত্রিকার বিভিন্ন পাতায় খবর হয়ে ছাপা হচ্ছে। শুধু ঢাকায় নয় দেশের সবখানে প্রাইভেট হাসপাতাল আছে এবং সাথে আছে অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার চিত্র। কয়েকটি তুলে ধরছি। ঢাকায় গুলশানের মা ও শিশু ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছেন মেঘলা। এই ক্লিনিকের চিকিৎসকেরা মেঘলার সন্তান প্রসবের সময় অপারেশন করতে গিয়ে তার জরায়ু কেটে ফেলেছেন। রোগী দীর্ঘ ২২ দিন মৃত্যুর সাথে লড়ছেন বলে বিভিন্ন পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল (আমার দেশ, যায় যায় দিন ও কালের কন্ঠ ১৮ মে, ২০১১, যুগান্তর, ১৯ মে, ২০১১)। কালিয়াকৈরে পদ্মা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেণ্টারে সুচিন্দ্র সরকারের স্ত্রী শেফালী রাণী (২৭) এসেছিলেন ৪ মাসের সন্তান গর্ভপাত করাতে। চিকিৎসকেরা তাকে বাচ্চা নষ্ট করা যাবে কিনা কোন সু-পরামর্শ না দিয়ে পর পর ৩টি ট্যবলেট খেতে দেন, বিকালের দিকে পেটের বাচ্চা নার্স দিয়ে টেনে ছিড়ে ছিড়ে বের করে রাতেই বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়। পরে তার পেট ফুলে যায় এবং ২৩ দিন কুমুদিনী হাসপাতালে চিকিৎসার পর মারা যায় ( ইত্তেফাক, ১ আগস্ট, ২০১১)। সাধন চন্দ্র দাসের কথা আমরা অনেকেই টেলিভিশনের খবরেও দেখছি। মাত্র ২০ বছর বয়সী সাধনের নাকের ভেতরের মাংস (পোলিব) বৃদ্ধির কারণে অপারেশন করাতে আসে। সেনা বাহিনীতে চাকুরী নিতে চায় বলে সে এই সাধারণ অপারেশন করতে চেয়েছে। কিন্তু অপারেশনের ৩৫ দিনেও জ্ঞান ফিরে নি সাধনের। ঘটনাটি ঘটেছে ৩ জুলাই রংপুর শহরের রোজ প্রাইভেট ক্লিনিকে। কর্তব্যরত এনেসথেওলজিস্ট মাত্রাতিরিক্ত চেতনানাশক প্রয়োগ করায় সাধনের জ্ঞান ফিরছে না। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয় (ইত্তেফাক, ১০ আগস্ট, ২০১১)। নেত্রকোনা জেলা শহরের প্রাইভেট ক্লিনিক নেত্রকোনা নার্সিং হোম-এ ডাক্তারের অবহেলায় নবজাতক শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। নমিতা সরকারকে (২০) গাইনী বিশেষজ্ঞ সফল সিজার করে বাচ্চা প্রসব করান, কিন্তু শিশুটির শ্বাস কষ্ট দেখা দিলে ডাক্তার ডেকে আনার জন্য শত অনুরোধ করেও তাকে আনা সম্ভব হয় নি। ভোরে নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে নেয়ার পথে শিশুটি মারা যায় (যায় যায় দিন ১৪ মার্চ, ২০১১)।

এমনি ঘটনার দীর্ঘ তালিকা পাওয়া যাবে। দেশের কোন স্থানই বাদ নেই। একটু পর্যালোচনা করলেই দেখা যাচ্ছে নারী (প্রসবের সময় চিকিৎসা করতে গিয়ে), নব জাতক শিশু এবং তরুণ বয়সের ছেলে মেয়েরা মারা যাচ্ছে। এগুলো কি শুধুই অস্বাভাবিক মৃত্যু(বা অপমৃত্যু) নাকি হত্যাকাণ্ড? প্রায় ক্ষেত্রেই খবর হয়েছে, মামলা বা ভাংচুর হয়েছে বলেই। নইলে হয়তো পত্রিকার মাধ্যমে জানা যেতো না। স্বাস্থ্য আন্দোলনের পক্ষ থেকে আমরা যখনই জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ও দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে সভা করেছি তখনই অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের ব্যক্তিগত উদাহরণ দিয়েছেন প্রাইভেট হাসপাতালের অবহেলা এবং ভুল চিকিৎসা নিয়ে। এ নিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কিছু করার তাগিদ এসেছে বার বার। ১৯৮২ সালে প্রণীত বেসরকারী স্বাস্থ্য সেবা অধ্যাদেশ ১৯৮৪ সালে হালনাগাদ করা হয়, কিন্তু এরপর ২০০০ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত হালনাগাদের পদক্ষেপ নেয়া হলেও সেগুলো আলোর মুখ দেখে নি ( সমকাল, ৫ এপ্রিল, ২০১১)। কাজেই নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই চলছে এই ব্যবসা।

ল্যাব এইড ৫০ লাখ টাকা দিয়েছে বলে আলোচনা শেষ করা যাবে না, বরং আর দেরী না করে এই ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে। আর কোন অস্বাভাবিক মৃত্যু বা হত্যাকাণ্ড দেখতে চাই না। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কাজের মতোই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও কি একটু সক্রিয় হতে পারে না?