শান্তির পথে তিন বাধা: সেনা, সেটেলার ও ভূমি-সমস্যা

রাহমান নাসির উদ্দিন
Published : 2 Dec 2015, 07:10 AM
Updated : 2 Dec 2015, 07:10 AM

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষে তৎকালীন সরকার, যারা বর্তমানেও সরকারে আছে এবং পাহাড়ি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্যচুক্তি, যা 'শান্তি চুক্তি' নামে বহুল পরিচিত এবং আঠার বছর পরও সে চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না-হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম আবার অশান্ত হয়ে উঠছে– এ মর্মে বিভিন্ন সংবাদপত্রে বেশ কিছুদিন ধরে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশিত হয়ে আসছে। বেশ কিছুদিন থেকে জনসংহতি সমিতি শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য অসহযোগ আন্দোলনসহ নানান কর্মসূচি দিয়ে সরকারের কাছে তাদের দাবি-দাওয়া পেশ করছে; কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কিছু আশ্বাস ছাড়া বিশ্বাসযোগ্য, কার্যকর ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ না-নেওয়ার কারণে পরিস্থিতি জটিলতর হচ্ছে।

অধিকন্তু, পাহাড়ি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশের বিরোধিতা সত্ত্বেও 'রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়' এবং 'রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ' স্থাপনের জন্য জোর-জবরদস্তির কারণে সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির দূরত্ব বাড়ছে। ফলে, অধিকতর উত্তপ্ত হচ্ছে পাহাড়ের পরিস্থিতি। এ রকম একটি পরিস্থিতি ও প্রেক্ষিতে আজকে, ২ ডিসেম্বর, ২০১৫ পার্বত্য চট্টগ্রাম, বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা এবং রাজধানী ঢাকায় শান্তি চুক্তির আঠারতম বর্ষপূর্তি পালিত হচ্ছে।

স্বাভাবিকভাবেই এ উদযাপনে যতটা আনন্দ ও উচ্ছ্বাস থাকার কথাম ততটা নেই। বরঞ্চ এ বর্ষপূর্তি এখন প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশের রূপ ধারণ করেছে। আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তি নিয়ে যত লেখালেখি করেছি, প্রায় সর্বত্র বলার চেষ্টা করেছি, 'কেবল চুক্তির ক্লজ-বাই-ক্লজ বাস্তবায়নই পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকলের সমঅধিকার এবং সমমর্যদার সহাবস্থান নিশ্চিত করে পূর্ণাঙ্গ শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, যদি না মিলিটারি সমস্যা, ভূমি-বিরোধ এবং সেটেলার সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধানের পাশাপাশি পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠীর এবং সিভিল-মিলিটারি প্রশাসনের সামাজিক মনস্তত্ত্ব, দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাঙালির মেজরিটারিয়ান আইডিওলজির গুণগত পরিবর্তন হয়। কিন্তু আমি এটাও মনে করি যে, শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বাস্তবায়ন পাহাড়ে বিদ্যমান অনেক সমস্যার অটোমেটিক সমাধান করে দেবে। তাই, দ্রুততম সময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়াটা জরুরি।'

অন্যান্য অনেক গৌণ সমস্যা থাকলেও আমি মনে করি পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান সংকটের মূলে রয়েছে তিনটি প্রধান সমস্যা: ভূমি সমস্যা, মিলিটারি সমস্যা ও সেটেলার সমস্যা।

দুই.

একথা অনস্বীকার্য যে, ভূমি-সমস্যার একটি সন্তোষজনক সমাধান না-হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো দিনই সত্যিকার শান্তি আসবে না। বিশেষ করে বাঙালি-পাহাড়ি সংঘাত এবং এ সংঘর্ষের একটি অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে, ভূমি-কেন্দ্রিক এবং ভূমির মালিকানা-কেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব। যেহেতু এখনও পাবর্ত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রধান জীবিকা জুম চাষ, সেহেতু ভূমি তার জীবনধারণের অন্যতম উৎস। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকেই, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বেশ কয়েক বার পার্বত্য ভূমি কমিশন গঠন করা হয়। নতুন নতুন কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত পাঁচ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্তরা হাঁকডাক শুরু করেন। কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই মিন-মিনাতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয় না। এভাবে পার হয়ে গেছে আঠার বছর।

একটি হিসাব মতে, চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার আবেদনপত্র জমা দেওয়া হয়েছে কমিশনে ভূমি-বিরোধ সংক্রান্ত জটিলতা দূর করার জন্য। যাচাই-বাছাই করে প্রায় দুই হাজার আবেদনপত্র বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য হচ্ছে, এখন পর্যন্ত একটিরও নিষ্পত্তি হয়নি। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১এর ১৩ টি সংশোধনীসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন, ২০১১ (সংশোধিত ২০১২) ২০১৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ৩০ জুলাই অনুমোদন করে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যা পরবর্তী পার্লামেন্টের অধিবেশনে তোলার কথা ছিল। অদ্যাবধি তারও সুরাহা হয়নি।

অন্যদিকে বাঙালি সেটেলাররা এ সংশোধনীর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করায় পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি হয় ২০১৩ সালে যার রেশ এখনও কাটেনি।

ভূমি সমস্যার সমাধান না-হওয়ার কারণে ৯০ হাজারেরও বেশি পাহাড়ি আদিবাসী 'অভ্যন্তরীন উদ্বাস্তু' হিসেবে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। প্রায় ১২,২২৩ পরিবারের ৬৪,৬১১ পাহাড়ি আদিবাসী ভারতের ত্রিপুরা থেকে ফিরে আসা 'প্রত্যাগত উদ্বাস্তু' হিসেবে বর্তমানের পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থান করছেন। কিন্তু এখনও নিজভূমি থেকে বিতাড়িত। এত বিপুল সংখ্যক লোককে কীভাবে এবং কোথায় পার্বত্য চট্টগ্রামে জায়গা করে দেওয়া হবে, সে বিষয়েও সরকারের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা নেই।

অন্যদিকে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানান অজুহাতে ভূমি-দখলের মধ্য দিয়ে জুম চাষের জমি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে; ফলে অসংখ্য পাহাড়ি আদিবাসী জুম চাষ করবার জন্য পর্যাপ্ত জমি পাচ্ছেন না। তাছাড়া, পার্বত্য চুক্তির 'খ' খণ্ডের ৩৪ (ক) ধারা অনুযায়ী 'ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা' বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন থাকার কথা। কিন্তু চুক্তির আঠার বছর পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে যথাযথভাবে হস্তান্তর করা হয়নি। অথচ তিন পার্বত্য জেলার ডিসিরা ১৯০০ সালের পার্বত্য শাসন বিধি অনুযায়ী ভূমির নামজারি, অধিগ্রহণ, ইজারা ও বন্দোবস্ত প্রদানের প্রক্রিয়া নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছেন।

একটি স্বাধীন-সার্বভৌম তথা উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশে ১৯০০ সালের আইন প্রয়োগের মাধ্যমে একটি ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা জারি রাখা হয়েছে। ফলে, পাবত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী মানুষের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। তাছাড়া, বনায়ন, সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ, সেনা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন ও সম্প্রসারণ এবং পর্যটনের নামে হাজার হাজার একর জমি অধিগ্রহণের ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা তীব্রতর করছে। তাই, এর দ্রুত ও কার্যকর সমাধান না-করা পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আসবে না।

তিন.

পার্বত্য চুক্তিতে সুষ্পষ্টভাবে 'বাঙালি সেটেলারদের পার্বত্য অঞ্চল থেকে পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে' এ রকম ধারা নেই। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরকারী দুই পক্ষের মধ্যে এ বিষয়ে একটি মতৈক্য হয়েছিল যে, পর্যায়ক্রমে সেটেলারদের অন্যত্র পুনর্বাসিত করা হবে। চুক্তি স্বাক্ষরের আঠার বছর পরও এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি।

অধিকন্তু ১৯৭৯-৮১ সালে পর্যায়ক্রমে যে চার লক্ষ বাঙালি সেটেলারকে অভিবাসিত করা হয়, তাদের সংখ্যা গত সাড়ে তিন দশকে বেড়ে এখন প্রায় দ্বিগুণ। তাদের অনেকে অর্থে, বিত্তে, ক্ষমতায় এবং রাজনৈতিক সংযোগের বিবেচনায় অনেক শক্তিশালী। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপির ক্ষমতার রাজনীতি। ফলে, নানান রকমের ক্ষমতা-কেন্দ্রের আসকারায় এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালি সেটেলাররা নিজেরাই একটি গণনাযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছে 'সমঅধিকার আন্দোলন' নামে একটি সংগঠন গঠন করে।জনপ্রিয় জনশ্রুতি অনুযায়ী এ সংগঠনকে সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে স্থানীয় সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসন। গত তিন দশকের পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈরী ইতিহাসের যাবতীয় হত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও সংঘাত বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, অধিকাংশ ঘটনার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে বাঙালি সেটেলারদের সম্পৃক্ততা রয়েছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পাবর্ত্য অঞ্চলে অনেক বাঙালির সঙ্গে– যারা সেটেলার নন এবং দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন– পাহাড়ি অনেক আদিবাসীর সুন্দর ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে যাদের মধ্যে রয়েছে নানান ধরনের ব্যবসায়িক ও যৌথ মালিকানার কার্যক্রম। দীর্ঘদিনের পারষ্পরিক আদান-প্রদানের ভেতর দিয়ে, নানান সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্থায়ী বাঙালিদের অনেকের সঙ্গেই রয়েছে পাহাড়ি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সুসম্পর্ক।

সমস্যা রয়ে গেছে সেটেলার বাঙালিদের মধ্যে। তাদের সামাজিক মনোজগতে, যাদের অনেকেই পাহাড়ি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলেমিশে বসবাসের (ইন্টোগ্রেশন করবার) কোনো চেষ্টাই করেননি। ফলে, সে বৈরী সম্পর্ক যথাযথভাবে বিবেচনায় না-নিয়ে সহাবস্থানে সবক দিয়ে আখেরে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে না। তাই, সেটেলারদেরকে পর্যায়ক্রমে অন্যত্র পুনর্বাসন করার যে অলিখিত সিদ্ধান্ত তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারকেই যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। তাছাড়া, সেটেলার বাঙালিরাও এদেশেরই মানুষ। রাষ্ট্রের পলিসির অংশ হিসেবে তাদেরকে 'গিনিপিগ' বানিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের অভিবাসন করানোর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র যে 'গুনাহ' করেছিল, তাদের যথাযথভাবে অন্যত্র পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকে তার কাফফারা দিতে হবে। তাহলে বিদ্যমান অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বিশেষ করে, ভূমি সমস্যার উল্লেখযোগ্য সমাধান আশা করা যাবে।

চার.

পূর্বের 'অপারেশন দাবানলের' পরিবর্তে ১ সেপ্টেম্বর, ২০১১ থেকে 'অপারেশন উত্তরণ' নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে কার্যত যে সেনা শাসন জারি আছে, তা শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার আরেকটি অন্যতম বাধা বলে অনেকে মনে করেন। আমি ২০১৪ সালের এই দিনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে লিখেছিলাম:

''একবিংশ শতাব্দীর রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপনায় সেনা শাসনকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি বিপ্রতীপ বিন্দুতে প্রতিস্থাপন করে বিবেচনা করা হয়, কেননা সেনা শাসনের অধীনে মানুষের মৌলিক, মানবিক এবং শাসনতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষিত হয় না।… পাবর্ত্য চট্টগ্রামে কার্যত অফিসিয়াল কোনো সেনা শাসন নেই; কিন্তু মানুষের নিত্যদিনের জীবনে সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত উপস্থিতি (excessive presence) এবং পাবর্ত্য চট্টগ্রামে 'সিকিউরিটি'র নামে অতিরিক্ত তল্লাশির ব্যবস্থাপনা মানুষকে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে বাস করবার পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছে। তাই, পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ধরনের প্রত্যক্ষ সেনা শাসন জারি আছে বললে খুব একটা অত্যুক্তি হয় না।''

পার্বত্য চট্টগ্রামের সেনাবাহিনী জাতীয় এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষায় যে ভূমিকা রাখছে, তার পাশাপাশি কোনো কোনো ক্ষেত্রে চরমভাবে মানবাধিকারও লঙ্ঘন করছে যা বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তাই, এ কথা অপ্রিয় হলেও সত্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সত্যিকার শান্তি প্রতিষ্ঠায় অতিরিক্ত সেনা উপস্থিতি একটি বড় সমস্যা। চুক্তির 'খ' খণ্ডের ঘ ১৭ (ক) অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান সকল অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প পর্যায়ক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ক্রমান্বয়ে তুলে নেওয়ার কথা থাকলেও চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে পাঁচ শতাধিক সেনা ক্যাম্পের মধ্যে ১৯৯৭-১৯৯৯ মেয়াদকালে ৭০ টি এবং ২০০৯-২০১৩ মেয়াদকালে ৩৫ টি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে, জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দের দাবি অনুযায়ী প্রত্যাহৃত অনেক অস্থায়ী ক্যাম্প পুনর্বহাল করা হয়েছে।

চুক্তির শর্তানুযায়ী, সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিডিআর যা বর্তমানে বিজিবি), ৬ টি স্থায়ী সেনানিবাস (বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, আলিকদম, রুমা, দিঘীনালা) ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা থাকলেও, আঠার বছরে মাত্র ১০৫ টি ছাড়া বাকি সবই পার্বত্য অঞ্চলে বিদ্যমান আছে। ফলে, অতিরিক্ত সেনা উপস্থিতি পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা হিসেবে কাজ করছে বলে অনেকে মনে করেন।

পাঁচ.

পরিশেষে বলব, সেনা, সেটেলার এবং ভূমি সমস্যা শান্তি প্রতিষ্ঠার পেছনে অন্যতম বাধা হলেও তিন মাত্র বাধা নয়। অন্যান্য অনেক বিষয়াদিরর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, পাহাড়ি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে আমাদের সামাজিক মনস্তত্ত্ব এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির গুণগত এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনা। কেননা, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার এবং যথাযথ মর্যাদার বিষয়টি সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে উপলব্ধি করতে হবে। কেবল চুক্তি করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এ জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্ন মানুষকে সম্মান করবার সামাজিক মনস্তত্ত্ব এবং একটি বহুত্ববাদী সমাজ-ভাবনার রাষ্ট্রীয় দর্শন।