আজাদের হাতের এক টুকরো কাগজ ও মিশর-তিউনিসিয়ার ইতিহাস

আরিফ জেবতিক
Published : 4 August 2015, 08:20 PM
Updated : 4 August 2015, 08:20 PM

গায়ে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট ও পায়ে চটি; কাঁধে একটি ব্যাগও রয়েছে তাঁর। খুবই সাধারণ খেটে-খাওয়া চেহারার এই যুবক ঢাকা শহরে এসেছেন এক অসাধারণ কাজ করতে। তিনি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন একটি প্ল্যাকার্ড; সেখানে লেখা, 'ন্যায়বিচার চাই'। ২ আগস্ট, রোববার সকাল ৯টার দিকে গণভবনের ফটকের উত্তর পাশে 'ন্যায়বিচার চাই' প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের এই মরিয়া চেষ্টা সাধারণ কাজ নয়, সাহসের কাজ। দলহীন, গোত্রহীন, সহায়সম্বল ও প্রতিপত্তিহীন আজাদ নামের এই যুবক সেই অসাধারণ কাজ করতে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার সাদিপুর ইউনিয়নের পঞ্চমীঘাট থেকে চলে এসেছেন একা। ডিজিটাল প্রিন্টের এই যুগে যেখানে তস্য মহল্লার ফ্ল্যাট মালিক সমিতির উপ-সম্পাদকও নিজের ছবি দেওয়া দুটো ডিজিটাল প্রিন্টের ব্যানার গলির মোড়ে ঝুলিয়ে নিজের প্রতিপত্তির জানান দেন, সেখানে আজাদের পক্ষে এক টুকরো সাদা কাগজে নিজ হাতে 'ন্যায়বিচার' চাই লেখার বাইরে কিছু করা সম্ভব হয়নি।

আজাদের আর কিছুই করার নেই। তাঁর মতো অনেক গরিব মানুষের কয়েক বিঘা জমি ভূমিদস্যুরা দখল করে নিচ্ছে; স্থানীয় সব অনুনয়-বিনয় শেষ করে আজাদ শেষ পর্যন্ত মরিয়া চেষ্টা করছেন প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের। রাজনৈতিক প্রতিপত্তি নেই, মিডিয়ায় যোগাযোগ নেই, এ রকম একেবারেই সাধারণ একজন মানুষের পক্ষে গণভবনের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা এক সাহসী বিপ্লব।

গণভবনের সামনে কেন, জানতে চাইলে আজাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আমি গরিব মানুষ। আমাদের কথা কেউ শোনে না। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার কথা পৌঁছে দিতে চাই। তিনি যদি চান, তাহলে আমিসহ গ্রামের গরিব মানুষরা উপকৃত হব।"

কতদিন এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন, জানতে চাইলে আজাদ বলেন, "তিনি (প্রধানমন্ত্রী) যতদিন শুনবেন না, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকব। প্রয়োজনে এখানে অনশন করব।"

পরে অবশ্য পুলিশ তাঁকে সরিয়ে দিলে তিনি কোনো বাধা সৃষ্টি না করে ভদ্রভাবেই সরে যান।

আমি খুব খুশি হতাম যদি দেখতাম প্রধানমন্ত্রী আজাদকে ডেকে নিয়ে তাঁর অভিযোগগুলো শুনেছেন এবং প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করেছেন। বিষয়টি অনেক মানবিক হত। কিন্তু আজাদ ন্যায়বিচার পাননি, বরং পরের দিন র‌্যাব তাদের বাড়িতে গিয়ে হানা দিয়েছে। তাঁরা আজাদকে বেদম মারধর করে তাঁর ভাই ও চাচাকে ধরে নিয়ে গেছে। আজাদ অভিযোগ করেছেন, ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করায় তাঁকে আর তাঁর পরিবারকে নির্যাতন করছে র‌্যাব।

র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান অবশ্য জানিয়েছেন, যাকে ধরা হয়েছে সে একজন ইয়াবা ব্যবসায়ী! এতদিন জানতাম ইয়াবা মূলত শহর এলাকার বড়লোক-মধ্যবিত্তদের মাদক, একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামে ইয়াবার এমন রমরমা ব্যবসা আছে এবং ভূমিদস্যুদের নির্যাতনের শিকার আজাদের ভাই এই ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত বলে ধরা পড়লেন, এটি ঘটনা হিসেবে বেশ কাকতালীয়। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ র‌্যাবের অতীত ইতিহাস যেখানে সুবিধাজনক নয়, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগসাজস করে ৭ জন জলজ্যান্ত মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার ইতিহাস খুব দূরে নয়, তখন আজাদের ভাইয়ের ব্যাপারটি প্রশ্নের উদ্রেক করে বৈকি।

আমাকে তাড়িত করেছে সাংবাদিকের কাছে দেওয়া আজাদের কথাগুলো। তিনি আকুল হয়ে বলছেন, ‌"সবাই যখন নিরব ছিল, আমি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছি। এটাই কি আমার অপরাধ? আমি তো কিছু করিনি, শুধু চেয়েছি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার কথা পৌঁছে দিতে। আমি এখন কী করব ভাই? আমি কি ঢাকায় চলে আসব? আমি গরিব বলে কি প্রতিবাদও করতে পারব না?"

আজাদের এই উক্তি ছোট করে দেখলে সরকার ভুল করবেন।

আমার ধারণা, গত কয়েক বছর ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে জামায়াত-শিবিরের মরিয়া চেষ্টায় রাজপথে যে নৃশংস তাণ্ডব হয়েছে, তা মোকাবেলা করতে গিয়ে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মানসিকতায় একটি বড় পরিবর্তন ঘটতে পারে। তারা আগের তুলনায় আরও বেশি মারমুখী হতে পারেন, একটি যুদ্ধাবস্থা মোকাবেলা করলে এ রকম মানসিক বিবতর্নের সম্ভাবনা সমাজবিজ্ঞানীরা উড়িয়ে দেবেন না।

জামায়াত-শিবিরের দেশব্যাপী নৃশংসতা, হেফাজতের ঢাকা-তাণ্ডব, বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা অবরোধে পেট্রোল বোমার আক্রমণে শতাধিক মানুষ হত্যা– এসব নানা কারণে মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষদের মাঝে র‌্যাব-পুলিশের সকল কার্যক্রম চুপচাপ মেনে নেওয়ার একটি প্রবণতা আমি খেয়াল করেছি। মানুষ যে কোনো মূল্যে নিরাপত্তা চায় এবং সেই নিরাপত্তা অর্জন কীভাবে হবে, সেটির দায়িত্ব তারা সরকারের কাঁধে চাপিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে চায়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে পুরোপুরি দায়িত্বশীল থাকে, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। কোনো ধরনের সন্ত্রাসী-ভূমিখেকো-মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কোথাও তাদের কোনো যোগসাজস যাতে না থাকে, সেটি কঠোরভাবে নজরদারি করার এখনই সময়। বিরোধী দলের তাণ্ডব মোকাবেলার অভিজ্ঞতা আর অর্জিত শক্তি সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলে কিছু হবে না, এ রকম মানসিকতা যদি কোথাও জন্মাতে থাকে, সেটি অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিতে হবে। আর সাধারণ মানুষের কথা শুনতে হবে, তাদের জন্য নূন্যতম ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

এখানে সাম্প্রতিক বিশ্বের দুটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই।

প্রথম ঘটনাটি ২০১০ সালের, মিশরের। খালেদ সায়ীদ নামের এক তরুণের নেশা ছিল কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, বসেছিলেন স্থানীয় এক সাইবার ক্যাফেতে। সেখানে হানা দেয় পুলিশ। খালেদ সাঈদের উপর নেমে আসে নির্যাতন। সেই বীভৎস নির্যাতনে মারা যান তরুণটি। পুলিশ দাবি করে, তাঁর পকেটে গাঁজা পাওয়া গেছে (মিশরে সম্ভবত ইয়াবার প্রচলন নেই), তাই তাঁকে গ্রেফতার করতে গিয়েছিল তারা এবং তিনি মারা যান।

মিশরের সাধারণ মানুষ এই গপ্পো বিশ্বাস করেনি। খালেদ সায়ীদের পোস্টমর্টেমের ছবি ভাইরাল হয়ে যায় ইন্টারনেটে। হাজার হাজার মানুষ তাঁর ছবি প্রোফাইল পিকচার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। ফেসবুকে তৈরি হয় 'উই আর খালেদ সায়ীদ' নামের গ্রুপ। লাখো মানুষ নিজেদেরকেও খালেদ সায়ীদ দাবি করে সেই পাতায় যুক্ত হন। মিশরে তখন ক্ষমতাসীনদের পুলিশি নির্যাতন মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেক সাধারণ মানুষই তাই নিজেকে খালেদ সায়ীদের মতো নির্যাতিত ভাবছিলেন, ক্ষমতার পেষণে নিষ্পেষিত অনুভব করছিলেন।

খালেদ সায়ীদের মৃত্যুর জন্য মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক সরাসরি দায়ী ছিলেন না, কিন্তু এর দায় চুকাতে হয় তাকেই। দীর্ঘ ৩০ বছরের ইস্পাত-কঠিন শাসনের যে নিশ্চয়তা আর নিরাপত্তাবোধে ছিলেন তিনি– ছোটবেলায় এতিম হয়ে যাওয়া দলহীন, গোত্রহীন খালেদ সায়ীদের লাশের ছবি সে দেয়ালে ফাটল ধরায়। সে এমনই এক ফাটল, যেটি দিয়ে লাখো জনতা হোসনি মোবারকের ৩০ বছরের শাসন তুলোর মতো উড়িয়ে দেয়। সেই যে রাজনৈতিক অস্থিরতা মিশরে তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে আজও দেশটির মুক্তি ঘটেনি।

দ্বিতীয় ঘটনাটিও একই বছরের, তিউনিশিয়ায়। ২৬ বছর বয়সী মোহামেদ বোয়াজিজি ছিলেন মফস্বল শহরের রাস্তার ধারের এক গরিব সবজিওয়ালা। এক মহিলা পুলিশ তাঁর সবজির ঝুড়িটি ছিনিয়ে নেয়। প্রতিবাদ করলে তাঁর মা-বাপ তুলে গালিও দেয়। এর আগেও পুলিশ তাঁর সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছিল। তরুণ বোয়াজিজি ন্যায়বিচার দিতে গেলেন স্থানীয় পৌরসভায়; সেখানে সবাই তাঁকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল।

ক্ষুব্ধ তরুণ বোয়াজিজি এক ঘণ্টা পর ফিরে গেলেন সেই পৌর অফিসে, দুঃখে অভিমানে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিলেন তিনি। বোয়াজিজির ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ ঐ ছোট শহরের সাধারণ মানুষকে ক্ষিপ্ত করে তুলল। তারা পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এলেন। ব্লগ আর ফেসবুকের পাতায় পাতায় সেই ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল দ্রুত। ১৯ দিন পর হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে হেরে গেলেন বোয়াজিজি। কিন্তু তিনি রচনা করে গেলেন এক আগুনমুখো বিদ্রোহের। যার আগুনে পুড়ে ছাই হল প্রেসিডেন্ট বেন আলির মসনদ। সেই বিক্ষোভ ঠেকাতে কোনো শক্তি প্রয়োগ বাদ রাখেননি প্রেসিডেন্ট, কিন্তু সাধারণ মানুষের বিক্ষোভের স্রোতে সব নির্যাতনই তু্চ্ছ হয়ে গেল, কচুরিপানার মতো ভেসে গেল তার ১৩ বছরের শক্ত শাসন।

মিশর আর তিউনিশিয়ার এই ঘটনাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, আপাতদৃষ্টিতে দলহীন-গোত্রহীন, একেবারেই সাদামাটা সাধারণ মানুষের শক্তি অস্বীকার করার উপায় নেই। এরা বিচ্ছিন্ন, দুর্বল, ভীত-সন্ত্রস্ত, কিন্তু এদের বুকের ভেতরও আছে রাগ-ক্ষোভ-অভিমান। ন্যায়বিচার না পাওয়ার সেই ক্ষোভ যদি একের পর এক জমতে থাকে, তাহলে এক স্ফুলিঙ্গই সেই বারুদে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।

আশা করব নারায়ণগঞ্জের সুদূর সাদিপুর ইউনিয়নের পঞ্চমীঘাট এলাকার প্রতিবাদী সেই তরুণ আজাদের আকুতি বিফলে যাবে না। রাষ্ট্র ও সরকার তাঁর যৎসামান্য ভূমিটুকু রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে। যে 'ন্যায়বিচার'এর আশায় তিনি এই রাজধানী শহরের ফুটপাতে একা দাঁড়িয়ে থেকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন, সেই দৃষ্টি তিনি আকর্ষণে সমর্থ হবেন। গভীরভাবে আশা করে আছি, পরের বার আজাদের বাড়িতে র‌্যাব নয়, বরং 'ন্যায়বিচার' আগে গিয়ে পৌঁছাবে।

তা যদি না হয়, তাহলে সে বড় অন্যায় হবে। এই অন্যায়গুলো যদি জমতে থাকে, তাহলে তার মূল্য চোখ-কান বন্ধ রাষ্ট্রকেই একদিন চুকাতে হবে। আমি চাই না আমার দেশে একজন খালেদ সায়ীদ কিংবা বোয়াজিজির জন্ম হোক।

সাধারণ মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভ অস্বীকার করে রাষ্ট্র দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারবে না এই বোধ সবার মাঝে জাগ্রত থাকাটাই মঙ্গল। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বিশ্ব ইতিহাসে এ রকম প্রমাণ আমাদের চোখের সামনেই যখন রয়ে গেছে।

আরিফ জেবতিক: সাংবাদিক, ব্লগার।