বাংলাদেশের উন্নয়ন

ড. জামাল নজরুল ইসলাম
Published : 22 May 2011, 06:36 PM
Updated : 22 May 2011, 06:36 PM

১৯৪৭ সনে ঔপনিবেশিকতার অবসান এবং তার আগের পাকিস্তান আন্দোলন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিশেষ একটা উন্নতি হয়নি। আমার ধারণা আমার এই মন্তব্যের সঙ্গে অনেকে একমত হবেন। এমনকি আমাদের প্রিয় বাংলাভাষায় গ্রামাঞ্চলে এং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা প্রসার করতে কি আমরা সক্ষম হয়েছি? শিক্ষার ক্ষেত্রে, চিকিৎসার ক্ষেত্রে, আইন আদালতে  সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে এবং অন্যান্য বহু বিষয়ে আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠী অবহেলিত এবং বঞ্চিত রয়ে গেছে। গ্রামাঞ্চলে, বিশেষ করে সুদূর (শহর থেকে দূরে) গ্রামাঞ্চলে কোন একটি শিক্ষা, চিকিৎসা অথবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কথা  যদি আমরা চিন্তা করি এবং সেখানে মাথাপিছু কত অর্থ খরচ হচ্ছে এটা নির্ণয় করি এবং সেটার সঙ্গে শহরে, বিশেষ করে রাজধানীতে এবং আরো বিশেষ করে অভিজাত এলাকায় অনুরূপ প্রতিষ্ঠানের  মাথাপিছু খরচের তুলনা করি, তাহলে আমার ধারণা একটা বিরাট তফাৎ দেখা যাবে। এখানে কোন 'তন্ত্র', 'বাদ' অর্থাৎ 'ISM-এর কথা হচ্ছে না, বরঞ্চ ন্যূনতম সামাজিক সুবিচারের (Minimum Social Justice) কথা হচ্ছে।  আমার ধারণা, যুক্তরাজ্যের অথবা যুক্তরাষ্ট্রের কোন রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে রক্ষণশীল সদস্যও আমাদের সমাজের ভারসাম্যহীনতা দেখে হতাশ হবেন। বিশ্বে যে কোন রাজনৈতিক ও সমাজব্যবস্থায় এত অসামঞ্জস্য থাকার অবকাশ নেই। যে কোন সরকারকে এককভাবে দোষ দেওয়া ঠিক হবে না, এ পরিস্থিতি বিগত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে চলে আসছে। বলা যায় এর জন্য অবস্থাপন্ন সব ব্যক্তি কমবেশি দায়ী। সম্পদের অভাবও মূল কারণ আমি মনে করি না। আগেও বলেছি, সঠিক মনোভাব থাকলে এবং যথাযথ উদ্যোগ নিলে বর্তমান সম্পদেই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অনেক কিছু করা যায়। দরিদ্র শ্রেণীর প্রতি অবহেলা উপমহাদেশের একটা ব্যাধিস্বরূপ বরে আমি মনে করি।

উদাহরণস্বরূপ, উপমহাদেশের উপজাতিসমূহ যেমন-কোল, ভিল, সাঁওতাল প্রভৃতি প্রায় আদিকাল থেকে অবহেলিত–সে প্রাচীন হিন্দু শাসনামলে হোক বা মুসলমান অথবা বৃটিশ আমল যাই হোক না কেন। শুধু অবহেলিতই নয়, অনেক ক্ষেত্রে তাদের উপর অত্যাচার করা হয়েছে, এমনকি তাদেরকে মানুষ বলে গন্য করা হয়নি। অথচ তারাই উপমহাদেশের আদি বাসিন্দা। কয়েকটি উপজতীয় গোষ্ঠী সম্ভবত বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ১৯৪৭ সনের স্বাধীনতার পরে তাদের অবস্থার যতটা উন্নতি হওয়ার কথা ছিল ততটা হয়নি। তাদের জীবনধারা এবং আদি সংস্কৃতি থেকে তথাকথিত সভ্য সমাজের অনেক কিছু শেখার আছে। এ বিষয়টি সত্যজিৎ রায় তাঁর শেষ চলচ্চিত্র 'আগন্তুক'-এ সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাপী সচেতনতার প্রয়োজন; মূলত এই চেতনার অভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসীরা বিলুপ্ত প্রায়।

এখানে উল্লেখ্য যে, গত দুই দশকে প্রচুর পরিমাণ বিদেশী সাহায্য পাওয়া সত্ত্বেও দারিদ্র-মোচনে বিশেষ সফলতা পাওয়া যায়নি। এটা অর্থের অপচয় এবং অপব্যবহার। সমাজের ভারসাম্যের উপর এর প্রতিকূল প্রভাব সম্পর্কে অনেকে মন্তব্য করেছেন। অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক আনিসুর রহমান এবং ড. ইউসূন এ ব্যাপারে সুচিন্তিতভাবে বিস্তারিত পর্যালোচনা করেছেন। বছর দুয়েক আগে ভারত থেকে বিশিষ্ট ভাষাতত্ত্ববিদ (Linguist) অধ্যাপক ডি.পি. পট্টনায়ক চট্টগ্রামে এসেছিলেন, যিনি ভারত সরকার কর্তৃক 'পদ্মশ্রী' উপাধিতে ভুষিত হয়েছেন। তিনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বহুদিন ধরে জড়িত আছেন। তিনি বললেন, ভারতে বিদেশী সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পসমূহে যে মূল উদ্দেশ্যে অনুদানটি আসে সেটাতে অনুদানের পুরো পরিমাণের মাত্র শতকরা পাঁচ ভাগ ব্যয় হয়। ভারতের প্রশাসনিক এবং ভৌত অবকাঠামো বাংলাদেশের তুলনায় উন্নত। সেক্ষেত্রে ভারতে যদি শতকরা মাত্র পাঁচ ভাগ হয়, আমরা কিছুটা অনুমান করতে পারি বাংলাদেশে কতভাগ ব্যয় হয়। দারিদ্রমোচন কিছু পরিমানে হয়, কিন্তু বিভিন্ন কারণে বিদেশী সাহায্য কতিপয় অবস্থাপন্ন ব্যক্তিবর্গকে আরও ধনী করে তোলে এবং এভাবে সামাজিক ভারসাম্যের উপর তা নেতিভাচক প্রভাব ফেলে। যদি আমরা নিজস্ব সম্পদের উপর নির্ভর করি, তাহলে অপব্যয় কম হবে এবং উৎপাদনের ক্ষমতা বাড়বে। বরঞ্চ কোন কোন ক্ষেত্রে বিদেশী সাহায্যের কারণে উৎপাদনের ক্ষমতা আমরা স্থায়ীভাবে হারিয়ে ফেলছি।

বাংলাদেশের প্রথম সরকারের অর্থনৈতিক পলিসিতে রাষ্ট্রীয়করণ সুচিন্তিতভাবে করা হয়নি, তাতে ভূলত্রুটি অনেক হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে এদেশের শিল্পে সেটার প্রতিকুল প্রভাব পড়েছিল। এটা স্বীকার্য। কিন্তু তাই বলে এখন সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে গিয়ে লাগামহীন ব্যক্তি মালিকানা এবং বাজার অর্থনীতি প্রচলন করতে হবে এটা আমি বিশ্বাস করি না। যে কোন দেশে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তি মালিকানার সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিত এবং সুপরিচালিত সমন্বয়ের অর্থনীতি। যেমন যুক্তরাজ্যে মূলত একটা পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও সেখানে অত্যন্ত উন্নতমানের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তি মালিকানার পরিমাণ নির্ভর করে দেশের ইতিহাস এবং আর্থসামাজিক পরিস্থিতির ওপর। কী ধরনের অর্থনীতি হবে, সেটা এই দেশেরই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন পেশার সদস্য এবং সর্বোপরি দেশের জনগণের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। বিদেশী দাতা অথবা অর্থনৈতিক সংস্থাসমূহ এটা নিয়ন্ত্রণ করলে দেশের সার্বভৌমত্বের ক্ষতি হয় এবং অবশেষে এটা দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। আমার ধারণা কিছু ক্ষেত্রে বিদেশী সংস্থাসমূহ এমন কতকগুলি শর্ত আরোপ করেন যেগুলি অবাস্তব এবং আমাদের আর্থসামাজিক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এটাও আরেকটা কারণ বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভর না করার।

আমাদের আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যাসমুহ আলোচনার মাধ্যমে সমন্বয়ের মনোভাব নিয়ে সমাধান করা প্রয়োজন। মোকাবেলার (Confrontation) মাধ্যমে কোন সমস্যার সঠিকভাবে সমাধান হয় না। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা প্রকাশ্যে পরস্পর সম্পর্কে যে অশ্রদ্ধামূলক মন্তব্য করেন সেগুলি সমাজকে বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করে এবং তা রাজনৈতিক সমস্যাবলীর সমাধানে অন্তরায়স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। (আগেই বলেছি) আমি যুক্তরাজ্যে প্রায় বিশ বছর অবস্থান করেছি, যে কারণে তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা হয়েছে। সেখানে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে প্রায়ই আড়ালে আলাপ আলোচনা হয়। আমার ধারণা সেখানে যখনই সরকার প্রধান কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জরুরি ভিত্তিতে নিতে চান তখন প্রথমদিকেই বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে অন্ততপক্ষে টেলিফোনে আলাপ করেন। এভাবে দেশের স্বার্থ রক্ষা হয়, বিশেষত আগে আলাপ হয়ে যাওয়ার কারণে বিরোধিতার পরিসর সীমিত থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে, যুক্তরাজ্যে শ্রমিক দলের প্রধানমন্ত্রী জেমস ক্যালাহ্যান (James Callaghan) যখন রক্ষণশীল দলের মার্গারেট থ্যাচারের (Margaret Thatcher) কাছে সাধারণ নির্বাচনে হেরে যান, তিনি প্রথমেই বলেন যে আজকে যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন কারণ এদেশে আজকে প্রথমবারের মত একজন মহিলা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন।

যুক্তরাজ্যের ঔপনিবেশিক ইতিহাস যতই খারাপ অথবা জঘন্য হোক না কেন, তাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থা যে উন্নতমানের সেটা অস্বীকার করা যায় না; অবশ্য ইদানীং এর কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা দিচ্ছে। বরঞ্চ আগেকার এই উন্নত অবস্থার কারণেই তারা অন্যত্র প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে, এবং এ ধরনের ব্যবস্থার অভাবের কারণেই আমরা বিদেশীদের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছি এবং কিছু ক্ষেত্রে এখনও হচ্ছি। নিজেদের মধ্যে পরস্পরের বিরোধিতায় লিপ্ত থেকে সেই অবস্থার সংশোধনে বিদেশী সাহায্য নেওয়া জাতির জন্য আদৌ গৌরবজনক ব্যাপার নয়। অবশ্য এটাও বলতে হয় যে, সঠিক রাজনৈতিক পদ্ধতি ও ঐতিহ্যের বিবর্তন হওয়ার সুযোগ আমাদের হয়নি। কিন্তু এই পদ্ধতি ও ঐতিহ্য আমাদেরকেই তো গড়ে তুলেতে হবে। এ সূত্রে ভবিষ্যতের জন্য রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে একটি সমঝোতা অথবা অলিখিত এবং অনানুষ্ঠানিক নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ পরবর্তী নির্বাচনে (যেটাতে সব দল অংশগ্রহণ করবে) যে দলই বিজয়ী হোক না কেন, আগেই এমন একটি সমঝোতা করা যায় যেটাতে সরকার বিরোধী দল ও অন্যান্য দলসমূহের কাছ থেকে কী ধরনের আচরণ অথবা সহযোগিতা চান সেটা ব্যাখ্যা করবেন, এবং পক্ষান্তরে, বিরোধী দলগুলি সরকারের কাছ থেকে কী ধরণের প্রশাসন পদ্ধতি এবং সংসদ পরিচালনায় কেমন নীতি প্রত্যাশা করেন সেটা ব্যক্ত করবেন। এখানে গণপ্রচার মাধ্যমগুলির সঠিক এবং নিরপেক্ষ ব্যবহার ও ভূমিকা অবশ্যই প্রয়োজন। কতকগুলি মূল বিষয়,যেগুলি জাতীয় স্বার্থে বাস্তবায়ন করা অথবা বজায় রাখা প্রয়োজন, বিশেষ করে উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়সমূহ, সেগুলিতে দল নির্বিশেষে মতৈক্য থাকা বাঞ্ছনীয়। আরো প্রয়োজন প্রত্যেকটি সরকারের সংযমের সাথে সরকারি অর্থ ব্যয় করা। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করে, সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা, এমনকি জাঁক-জমক প্রদর্শনের যে প্রচলন, তাতে সংযম আনা প্রয়োজন। এগুলি দেশের জন্য কল্যাণকর হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হতে পারে না। এসব ব্যাপারে সর্বোপরি প্রয়োজন সমন্বয়ের এবং সহযোগিতার মনোভাব।

বিদেশী বিনিয়োগের কথা ইদানিং প্রায়ই বলা হয়; যদি তা বাস্তবায়ন করা যায় এবং এর সঠিক ব্যবহার হয়, তাহলে অবশ্যই আমাদের অর্থনীতির উন্নতি হবে। কিন্তু এখানেও আমাদের সচেতন হতে হবে; এগুলি যদি কতিপয় ধনী ব্যক্তিকে আরও ধনীতে পরিণত করতে সহায়তা করে এবং সেই অনুপাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপকার না হয়, তাহলে সেটা কল্যাণকর হবে না। বিগত অভিজ্ঞতা থেকে এ ব্যাপারে সান্তনা পাবার বিশেষ কিছু নেই। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে মেরুকরণ এবং নির্বাচনকালে উত্তেজনা এমনকি হিংস্রতার সম্ভবত একটি কারণঃ লোকের ধারণা কোন ব্যক্তি নির্বাচিত হলে তিনি নিজের দলের ব্যক্তিদের সুযোগ সুবিধার কথা বেশি চিন্তা করবেন, অন্য দলের লোক অথবা জনসাধারণ তার কাছে সুবিচার পাবে না। এটাই যদি একটা কারণ হয়, তাহলে এ অবস্থার পরিবর্তন করার জন্য প্রয়োজন নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গের দল-নির্বিশেষে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করা। যদি ন্যূনতম সুবিচার সবার জন্য নিশ্চিত করা যায়, তাহলে নির্বাচনে প্রতিযোগিতার তীব্যতা অনেকটা কমবে। বর্তমানে শুধু সাধারণ নির্বাচনেই নয়, কিছুটা এ ধরনের তীব্রতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনগুলিতেও লক্ষ করা যায়। যাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন তাঁদের বোঝা উচিত যে বেশিরভাগ ব্যক্তি রাজনীতিতে ঐভাবে জড়িত হতে চান না; তাঁরা নিজ নিজ পেশায় ভালভাবে কাজ চালিয়ে যেতে উৎসুক, কোন ধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া। এক পর্যায়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অবশ্যই প্রয়োজন, সেটাকে গঠনমূলক করতে হলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই করতে হবে। আমার ধারণা আমাদের গ্রামাঞ্চলেও অনেকক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে রাজনীতিতে জড়িত হতে বাধ্য করা হয়, যে কারণে অশান্তির সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ লোক ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ইসলাম সম্পর্কে গত কয়েক বছর পত্র-পত্রিকায়, পুস্তকে, সভা সমিতিতে এবং বিভিন্ন মসজিদে বহু আলাপ আলোচনা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমি ইতোমধ্যে কিছু বলেছি; আমি বিনীতভাবে আরো কয়েকটা কথা বলতে চাই, যদিও ইসলাম সম্পর্কে আমার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। ভূল-ত্রুটি হলে কোন পাঠক যদি জানিয়ে দেন আমি সবিনয়ে সেটা গ্রহণ করব। পবিত্র হাদিসের কয়েকটি বাণী আমার খুবই ভাল লাগে। যেমন 'দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন কর' (ইতলুবুল ইলমা মিনাল মাহদ ইলাল লাহাদ), এবং 'জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজন হলে চীন দেশে যাও' (ইতলুবুল ইলমা ওয়া  লাও কানা বিস্ সিন)। তৎকালীন চীনদেশের ধর্ম ভিন্ন ছিল। সেখানকার জীবনধারা ও সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল; তা সত্ত্বেও হযরত মুহম্মদ (দঃ) চীনদেশের কথা বলেছিলেন। এটা বলে তিনি যে উদার মনোভাব দেখিয়েছিলেন আমার ধারণা মুসলমানরা সেই উদার মনোভাব পরবর্তীকালে অনেকটা হারিয়ে ফেলেছেন। হযরতের সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর নম্রতা, ভদ্রতা, সততা, মনের উদারতা। যে যুদ্ধগুলি তিনি করেছিলেন সেগুলি নেহাত আত্মরক্ষার জন্য করেছিলেন এবং জয়ী হবার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে সম্পূর্ণভাবে ক্ষমা করেছিলেন। তাঁর দৈনন্দিন জীবনে অনেক কষ্ট সত্ত্বেও তিনি কারো ওপর কোন ধরনের জোর জবরদস্তি করেন নি। বরঞ্চ তাঁর আচরণ ও স্বভাব দিয়ে তিনি মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর জীবন চিরদিন অনুসরণীয় হয়ে থাকবে। বহু বিজয় হলেও পরবর্তীকালে মুসলমানদের মধ্যে ভোগ বিলাসিতা এসে গিয়েছিল এবং যদিও কয়েক শতাব্দী বিজ্ঞানে, দর্শনে এবং জ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ে মুসলমান চিন্তাবিদরা যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন (যে সম্পর্কে ইতিমধ্যে বলেছি) গত কয়েক শতাব্দী ধরে সেটা বিলুপ্ত প্রায়। আল্লামা ইকবাল তাঁর বিখ্যাত জাওয়াব-এ-শিকওয়াতে সুন্দরভাবে মুসলমানদের সমালোচনা করেছেন। আধুনিক যুগে বিভিন্ন দেশে সংখ্যাগরিষ্ট এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী রয়েছে। সমাজে এবং অবশেষে বিশ্বে শান্তি বজায় রাখতে হলে প্রত্যেকটি সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠীকে, তা সে যে কোন ধর্মের অথবা আইডিওলজির হোক না কেন, গুরুদায়িত্ব এবং পবিত্র দায়িত্বস্বরূপ মেনে নিতে হবে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করা। অনেক ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠীর পক্ষে সংখ্যালঘুদের সমস্যা সঠিকভাবে অনুধাবন করা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অবিচারকে সীমাবদ্ধ করা যায় না; একবার কোন একটি গোষ্টীর ওপর অবিচার করলে সেটা অবশেষে সমগ্র সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসে বহু মুনি ঋষির আবির্ভাব হয়েছে যাঁরা এ ব্যাপারে সতর্ক বাণী দিয়ে গেছেন। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে চীনদেশে কনফুসিয়াস বলেছিলেন, যে, সমগ্র মানবজাতি একটি পরিবারের মত। প্রায় একই সময়ে গৌতম বুদ্ধ, যাঁর জন্ম হয় প্রাচীন লুম্বিনীতে যা এখান থেকে কয়েক শত মাইল দূরে অনুরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন। ষাট দশকের প্রথম দিকে পণ্ডিত নেহরু জাতিসংঘে বুদ্ধের একটি বাণী উল্লেখ করে বলেছিলেন যে, প্রকৃত বিজয় সেটা, যেটাতে কোন পক্ষ নিজেকে পরাজিত মনে করে না। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে যদি এ বাণীটা প্রয়োগ করা হত, তাহলে মানবজাতির দুঃখ-কষ্ট অনেকটা লাঘব হত। আমার ধারণা আমাদের দেশেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। মানবজাতির প্রতি উদার মনোভাব এবং সতর্কতার বাণী পবিত্র হাদিসে পাওয়া যায়, যেমন-'কোন শব (জানাজা) তোমার নিকট দিয়ে অতিক্রম করলে তুমি দাঁড়িয়ে যাও, তা ইহুদি, খৃস্টান অথবা মুসলমান যেই হোক'। তৎকালীন আরব দেশে হিন্দুদের বসতি ছিল না, যদি থাকত 'হিন্দু'র কথাও নিশ্চয় উল্লেখ হত, অথবা অন্য ধর্মেরও। নিম্নলিখিত বাণীটি এ শতাব্দীর দুটি ভয়াবহ মহাযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেয়–'মানবজাতি সঠিক পথ পেলে পথভ্রষ্ট হবে না, যদি না তারা বিবাদে জড়িত হয়।'

আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে, দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং আমাদের সামাজিক জীবনে, পরস্পরের উপর প্রভাব বিস্তার করে আত্মমর্যাদা লাভ করার প্রচেষ্টা ও প্রবণতা একটি বদ অভ্যাস হিসেবে বহুকাল ধরে বিরাজ করছে। এটা নিজের উপর আস্থার অভাবের লক্ষণ। জনৈক লেখক ভালই বলেছেন, যখন স্বপক্ষের সমর্থন পাওয়া যায় না তখন বিপক্ষ বিনাশের দিকে মন যায়। মূলত এই প্রবণতা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে উপমহাদেশকে প্রায় দুশ বছর বিদেশীদের গোলামীতে আবদ্ধ রেখেছিল। বিদেশীরা বহুদিন আগে চলে গেছে, কিন্তু সেই দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয় আমরা যথেষ্ট শিখিনি। এ ধরনের আচরণের বহিঃপ্রকাশ প্রায় সময়ে আমাদের রাস্তাঘাটে ও ঘরে ঘরে লক্ষনীয়–দুর্ভাগা রিকসাওয়ালাদের উপর দাপট, চাকর চাকরানীদের উপর কথায় কথায় ক্ষোভ প্রদর্শন এমনকি মারধর করা, এসব নিত্যদিনের ঘটনা। আমাদের চরিত্রের এই দিকটা আমাদের দেশ ও সমাজকে পিছিয়ে রেখেছে এবং এ ব্যাপারে যদি আমরা যথেষ্ট সচেতন না হই, তাহলে ভবিষ্যতেও পিছিয়ে থাকব।

১৯৯২ সনে অমর একুশে বক্তৃতায় (যেটা আমার আগের বই মাতৃভাষা ও চিজ্ঞানচর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে) আমি বলেছিলামঃ "মাঝে মাঝে কয়েকটি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশের দ্রুত শিল্পায়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নতির দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়। যদিও আমরা তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারি, তবুও আমার মনে হয় না এই দেশগুলিকে আমাদের 'মডেল' হিসাবে নেওয়া উচিত। আমাদের জনসংখ্যা এই দেশগুলির চেয়ে অনেক বেশি এবং আমাদের জীবনধারা ও সংস্কৃতি ভিন্ন ধরনের। আমাদের দেশের শিল্পায়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল আমাদের জীবনধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তৈরি করা উচিত।"

ইদানিং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলিতে এমনকি কোরিয়ায়ও যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে সেটা আমার প্রায় পাঁচ বছর আগেকার বক্তব্যকে কিছুটা অর্থবহ করে। আমি আরও কয়েকটা বিষয় উত্থাপন করেছিলাম, যেগুলি বর্তমান অবস্থায় প্রাসঙ্গিক হতে পারে। গ্যাস ও তেল সন্ধানের সূত্রে দেশকে কয়েক ভাগে ভাগ করে কতিপয় বিদেশী সংস্থাকে সংশ্লিষ্ট কাজের অধিকার দেওয়া হচ্ছে। আমার ধারণা, ভবিষ্যতে এটা আমাদের সার্বভৌমত্ব এবং আর্থ-সামাজিক ভারসাম্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেরতে পারে। এ মুহূর্তে তেল ও গ্যাস বিপুল পরিমাণে উত্তোলনের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। এ কাজে সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিতভাবে ধীরে সুস্থে অগ্রসর হওয়া উচিত, যাতে এ বিষয়ে আমাদের নিজস্ব দক্ষ জনশক্তি এবং বিশেষজ্ঞ গড়ে তুলতে পারি। এভাবে কয়েক বছরের মধ্যেই সার্বিক ব্যাপারটা আমাদের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে আসবে। এখানে জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন; রাজনৈতিক দলগুলি এটাকে  'ফুটবল' হিসাবে ব্যবহার করলে কিন্তু ঠিক হবে না। কোন প্রধান রাজনৈতিক দলেরই এ ধরনের ব্যাপারে ভাল একটা 'রেকর্ড' নেই; এঁদের কাউকে 'শুভ্র থেকে শুভ্রতর' বলাটা মানায় না। এখন উচিত আলাপ আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই ধরনের সমস্যাগুলি সমাধানের চেষটা করা।

আমাদের জাতীয় এবং সামাজিক জীবনের আর একটি সমস্যা সম্পর্কেও সচেতন হওয়া প্রয়োজন, যা উপরিউক্ত বিষয়ের সঙ্গে জড়িত। সামাজিক অবিচার এবং আর্থ-সামাজিক বৈষম্য অনেকের মনে হতাশা এবং ক্ষোভের সৃষ্টি করে, যা অনেক ক্ষেত্রে 'গোপন হিংসা'তে পরিণত হয়, এবং অবশেষে, হয়ত সন্ত্রাসে। অন্যথায়, আমরা অভিমানী জাতি কথায় কথায় কিছু ক্ষেত্রে ভুল বুঝেও অভিমান করে থাকি। অভিমানে সীমাবদ্ধ থাকলে কোন ক্ষতি নেই কিন্তু মাঝে মাঝে  এটাও 'গোপন হিংসা'তে রূপান্তরিত হয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'আমি যে  দেখেছি গোপন হিংসা কপট রাত্রি ছায়ে, হেনেছে নিঃসহায়ে।' এই 'গোপন হিংসা' অতীতে বহু দেশে মারাত্মক পরিণাম বয়ে এনেছে। মূলত এটার কারণেই বিংশ শতাব্দীতে দুই মহাযুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রায় পাঁচ কোটি নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। যদি আমরা যথেষ্ট সচেতন না হই, উপমহাদেশেও এ ধরনের পরিণামের সম্ভবনা রয়েছে; এ সূত্রে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে  সম্ভাব্য নিউক্লীয় মোকাবেলা উল্লেখ্য। এ সমস্যাবলীর ও পরিস্থিতির প্রতিরোধ ও সংশোধনের জন্য প্রয়োজন সমন্বয়ের মনোভাব নিয়ে নিয়মিত আলাপ আলোচনা। ইংরেজ কবি উইলিয়ান ব্লেক (William Blake) (১৭৫৭-১৮২৭)-এর বাণী এ সূত্রে স্মরণীয়ঃ
I was angry with my friend
I told my wrath, my wrath did end.
I was angry with my foe :
I told it not, my wrath did grow.

অর্থাৎ আমি বন্ধুর সঙ্গে রাগ করেছিলাম, তাকে বললাম-আমার রাগ শেষ হয়ে গেল। আমি শত্রুর সাথে রাগ করেছিলাম, তাকে বলিনি-আমার রাগ বেড়ে গেল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের চুক্তি সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করি; এটা আমার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। উপমহাদেশের উপজাতিসমূহ সম্পর্কে উপরুল্লেখিত মন্তব্য গত কয়েক বছর থেকে আমার চিন্তায় আছে। এ লেখাটাও প্রায় দুই বছর আগে  লিপিবদ্ধ করেছি। এটার সঙ্গে সদ্য স্বাক্ষরিত চুক্তির কোন সম্পর্ক নেই। বলা বাহুল্য এটা একটা জটিল সমস্যা যার জন্য সর্বোপরি প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সবার সদিচ্ছা ও সমন্বয়ের মনোভাব। অন্ত্রসমর্পণ ও পুনর্বাসন, যা ইতোমধ্যে হয়েছে,  সেগুলি আমি সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে মনে করি। (আমি ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮'র শেষের দিকে লিখছি)। চুক্তিটি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে দীর্ঘদিন লেগে যেতে পারে; এর জন্য প্রয়োজন ধৈর্য, সহনশীলতা এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ। আইনগত, এবং অন্যান্য জটিলতা থাকতে পারে; এমনও হতে পারে যে, কোন কোন উপজাতীয় ব্যক্তি এটা সম্পূর্ণভাবে  গ্রহণ করেন নি। এখানেও বিস্তারিত আলাপ আলোচনা কাজে লাগতে পারে-আড়ালে ও প্রকাশ্যে, খোলামেলা, দলমত ধর্ম গোষ্ঠী নির্বিশেষে। তবে এ চুক্তির কয়েকটি দিক  সম্পর্কে আমি কিছু উদ্বিগ্ন। রাজনৈতিক দলগুলির পরস্পর বিরোধিতা এ  ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যদিও আন্তর্জাতিক  শুভেচ্ছা ও সহযোগিতা আমাদের কাম্য, কোন ভিন্ন দেশ যেন এ পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণগত  কোন প্রভাব বিস্তার না করে সে সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে। কারণ এ ধরনের যে কোন প্রভাবের নেতিবাচক ফল হতে পারে। যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে চান তাঁদেরও এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। (আমার বিজ্ঞান, দর্শন , ধর্ম ও আইডিওলজি' প্রবন্ধটি দেখুন)। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় গোষ্ঠীসমূহ এবং অ-উপজাতীয় জনগোষ্ঠী ব্যাপ্ত অর্থে একই পরিবারের সদস্য। যে কোনভাবেই এ সমস্যা আমাদের মধ্যেই সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। একটি প্রস্তাবের কথা শুনেছি যে, কয়েক শত কোটি টাকা ব্যয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় রাস্তা এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নির্মাণ করা হবে। এ খবরটি আমাকে বেশ উদ্বিগ্ন করেছে। প্রথমত, পাঠককে উপরে উল্লিখিত অধ্যাপক পট্টনায়কের কথা স্মরণ করিয়ে দিই। দ্বিতীয়ত, যদি এ ধরনের 'নির্মাণ' বাস্তবায়ন হয়, আমি বিশ বছর পরের কথা চিন্তা করি। পার্বত্য এলাকায় সারিবদ্ধভাবে উপজাতীয় লোকেরা নিজ নিজ কুটির থেকে বাইরে  এসে কৌতূহল মিশ্রিত ও বিভ্রান্তিকর দৃষ্টিতে দেখছে-আধুনিক সুন্দর রাস্তায় সাহেবরা সুন্দর গাড়ি চড়ে আসছেন ও যাচ্ছেন। এ ভাবে শতকরা ৯৯% ভাগ উপজাতীয় লোকের কোন উন্নতি হবে না কিছু গলফ কোর্স (Golf course) [আঞ্চলিক ছেলেদের ক্যাডি'র (Caddie) চাকরি  দেওয়ার উদ্দেশ্যে] এবং 'উইকএন্ড বাঙলো' (Weekend bungalow) তৈরি হবে যেগুলোতে কিছু 'উপরের তলার' উপজাতীয় ব্যক্তিকে সদস্য করা হবে, যেমন ইংরেজরা কিছু ভারতীয় 'নেটিভদের' ক্লাবের সদস্য করত! উপজাতীয় সংস্কৃতি এবং জীবনধারার ওপর এটা প্রচন্ড ও নেতিবাচক  প্রভাব রাখবে। যদি আমরা উপজাতীয় গোষ্ঠীদেরকে আমাদের কাছাকাছি আনতে চাই, তাহলে তাদের মিশতে হবে, তাদের ভাষা শিখতে হবে, তাদের গান শিখতে হবে, তাদের জীবনধারা ও ইতিহাসের সঙ্গে  পরিচিত হতে হবে, তাদের সংস্কৃতি প্রকৃত অর্থে বজায় রাখার এবং সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করতে হবে, তাদের জন্য শিক্ষার, চিকিৎসার ও আইন-আদালতের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি তাদেরকে আমাদের অঞ্চলে, আমাদের বাসায় সাদরে আমন্ত্রণ করে আনতে হবে; এখানে স্বল্প ব্যয়ে আসা যাওয়ার সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। যাতায়াতের ব্যবস্থার জন্য ব্যয়বহুল বিরাট হাইওয়ের প্রয়োজন নেই, তা সে এলাকার জন্যে উপযুক্তও নয়। এগুলিতে বিরাট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই, তা কাংখিতও নয়।

বিদেশী সাহায্য আমাদের দেশে যেমন বিরাট ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করেছে, সেটা যেন উপজাতীয়দের ওপর আমরা চাপিয়ে না দিই। আমরা এ অবস্থা মোটামুটি সহ্য করছি (আর কতদিন?); তারা সহ্য করতে পারবে না।  একই সাথে, বিদেশী সাহায্য আমাদের দেশে যে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে সেটা প্রতিরোধ করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, নির্বাচনে সহিংসার এটাও একটা মূল কারণ। যে কোন সরকার বিরাট পরিমাণ অর্থ যথেষ্ট জবাবদিহিতা ছাড়া নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। ক্ষমতাসীন অনেকের সদিচ্ছা থাকলেও আমরা যথেষ্ট সচেতন নই।  কিছু উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও এটা সেই 'গোপন হিংসা' সৃষ্টি করতে সহায়তা করে। যা অবশেষে সন্ত্রাসের ইন্ধন যোগাতে পারে। আমি  আগেও বলেছি, যে আমি এক পয়সাও বিদেশী সাহায্য না নেওয়ার পক্ষে। আমার দেশে ফিরে আসার বার বছরের মধ্যে এই প্রত্যয় ও অভিমতটি দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে।

ড. জামাল নজরুল ইসলাম: গণিতবিদ, গবেষক ও পদার্থবিজ্ঞানী।