ক্ষুদ্রঋণ: দশটি মন্তব্য

এম এম আকাশ
Published : 6 Oct 2009, 08:47 AM
Updated : 22 March 2011, 04:49 PM

১. আমি একটি পুরনো প্রবাদ দিয়ে শুরু করতে চাই "এক বিন্দু পানি বিশাল হ্রদে পড়লে তা হারিয়ে যায় এবং তার নিজত্ব বিলুপ্ত হয়, যদি সেটা পদ্ম পত্রে পড়ে তাহলে তা ঝকমক করে ওঠে, যদি সেটা ঝিনুকের বুকের গভীরে স্থান পায় তাহলে তা মুক্তায় পরিণত হয়। জলবিন্দু সবসময়ই জলবিন্দু কিন্তু সঙ্গ গুণে এক এক সময়ে সে এক এক অভিব্যক্তি ধারণ করে।"

২. ক্ষুদ্রঋণ সর্বরোগহরা কোন দাওয়াই নয়, নয় কোন মহাপাজি শয়তান! সবটাই নির্ভর করবে পরিপ্রেক্ষিত এবং পরিস্থিতির উপর, সরলভাবে দেখলে, "ক্ষুদ্রঋণ" হচ্ছে একটি বহু পুরাতন বিষয়। এটি হচ্ছে ক্ষুদ্র অংকের ঋণ। চলতি ভাষায় অণুঋণ। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই আত্মকর্মসংস্থান ভিত্তিক ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদন এবং আত্মপোষনশীল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাহিদা মিটানোর জন্যই এই ঋণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু মানব চরিত্র এরকম যে, ক্ষুদ্র্র চাহিদাগুলো পরিপূরণ হয়ে গেলে সে স্বাভাবিকভাবে আরো বড় ঋণ নিয়ে আরো বড় কিছু করতে চাইবে। মানুষের চাহিদা শুধু খাদ্য গ্রহণ ও বর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, তার চাহিদা বিচিত্র এবং বহুগামী। সুতরাং গবাদি পশুমার্কা দারিদ্র্য রেখাটি অতিক্রম করাই তার একমাত্র লক্ষ্য নয়, নীতি-নির্ধারক শাসক শ্রেণী যতই তা তাকে বুঝানোর জন্য চেষ্টা করে থাকুন না কেন। প্রতিটি ক্ষুদ্র্রঋণ গ্রহীতার মধ্যে আছে ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ হওয়ার তাগিদ। অর্থনীতির পোশাকি ভাষায় যাকে বলা হয় Need for graduation from micro to macro. কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাজারে অসম প্রতিযোগিতা, আকস্মিক দুর্ঘটনা, অসুখ-বিসুখ, ব্যক্তির নানা "শকের" দরুন ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতার এই স্বপ্ন বর্তমানে এক শ' জনে আট জনের বেশি পূরণ করতে পারছে না (অর্থনীতিবিদদের গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য)। সুতরাং অনিশ্চিত নিরাপত্তাহীনতা ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাকে সর্বদাই তাড়া করে ফিরছে।

৩. সুতরাং ক্ষুদ্রঋণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা হচ্ছে- এটি একটি স্বল্পদীর্ঘ উন্নতির মই, এই মই বেয়ে খুব অল্পই উপরে ওঠা যায়। এবং যে কোন সময় পা ফসকে পড়ে যাওয়ার আশংকা থাকে।

৪. ক্ষুদ্র্রঋণের সমর্থকরা দাবি করে থাকেন যে, ক্ষুদ্র্রঋণ গ্রহীতারা তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ পুনঃবিনিয়োগের মাধ্যমে ক্ষুদ্র্র থেকে বৃহতে পরিণত হতে পারবেন।

আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, এই ক্ষুদ্র্রঋণ গ্রহীতারা বৃহৎ ঋণ গ্রহীতাদের তুলনায় দ্বিগুণের চেয়ে বেশি সুদে নেয়া ঋণ প্রায় সম্পূর্ণ পরিশোধই শুধু করেন নি (ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের হার ৯৮% ভাগের বেশি) উপরন্তু খেয়ে না খেয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা সঞ্চয় করেছেন। ২০০৮ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ৪৫৩টি ক্ষুদ্র্র ঋণদাতা এনজিওর ২ কোটি ৫১ লাখ সদস্য ঋণ গ্রহীতার সঞ্চিত সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩ হাজার ৬ শ' ৪০ কোটি টাকা! কিন্তু আমরা সবাই জানি এই বিশাল সঞ্চয়ের উপর তাদের প্রকৃত মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ খুব সামান্যই কার্যকর হয়েছে। সুতরাং ছোট থেকে বড় হওয়ার ক্ষমতা তাদের থাকলেও সেই ক্ষমতা কার্যকরী হওয়ার পূর্ব শর্ত হচ্ছে সঞ্চয়ের উপর তাদের কোন না কোন ধরনের সামাজিক বা সমবায় মালিকানার প্রতিষ্ঠা।

৫. বর্তমানে তাদের উদ্বৃত্ত পুঁজি নিয়ন্ত্রণের ভার নিয়েছেন এনজিও প্রতিষ্ঠাতারা ও কর্মচারিবৃন্দ। এখানেই সমস্যার গোড়া নিহিত। কম খেয়ে (under consumption) এবং বেশি কাজ (over work) করে ক্ষুদ্র্রঋণ গ্রহীতারা উদ্বৃত্ত তৈরি করেছেন ঠিকই কিন্তু সেই উদ্বৃত্ত বৃহৎ আয়তনে ব্যবহারের জন্য যে ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং অনুকূল পরিবেশ দরকার তা আমরা এখন পর্যন্ত তাদের জন্য নিশ্চিত করতে পারিনি তদুপরি ঐ উদ্বৃত্তের ব্যবহারের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতাও সর্বাংশে নিশ্চিত করা যায়নি। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবি কানভুর বিশ্ব ব্যাংকের একটি গবেষণা প্রকল্পের অধীনে প্রায় ৬০ হাজার দরিদ্র লোকের জীবন্ত কণ্ঠস্বর রেকর্ড করেছিলেন, সেখানে একটি প্রশ্নের উত্তরে দরিদ্র লোকদের সাধারণ উত্তর ছিল "এনজিওরা বিপদের সময় আমাদের নানাভাবে সাহায্য করে ঠিকই, কিন্তু আমাদের কাছে তাদের কোন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই।

৬. ক্ষুদ্র ঋণ বিরোধী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী অর্থনীতিবিদরা দাবি করেছেন যে ক্ষুদ্র্রঋণ ম্যানেজার অথবা সামাজিক উদ্যোক্তাবৃন্দ গরিবের সৃষ্ট উদ্বৃত্তের সিংহভাগ নিজেরা নিয়েছেন, উচ্চ আয় উপভোগ করেছেন, খ্যাতি এবং বিলাসের অধিকারী হয়েছেন। শাসক শ্রেণীও এতে খুশিই হয়েছে। কারণ এর ফলে দারিদ্র্যকে দূর করা সম্ভব না হলেও ম্যানেজ করা সম্ভব হয়েছে এবং স্থিতিশীলতা রক্ষা করা গেছে। একথা কেউ যদি নাও মানেন অন্ততঃ এটুকু তাকে স্বীকার করতেই হবে ক্ষুদ্র ঋণের গতানুগতিক কৌশল ব্যবহার করে ধনী- দরিদ্রের আপেক্ষিক ব্যবধান শ্রেণী বিভক্ত সমাজে কখনোই কমানো সম্ভব নয়।

৭. একটু থেমে অপেক্ষাকৃত সংযত ক্ষুদ্রঋণের সমর্থকেরা বলতে চেষ্টা করেন যে, ক্ষুদ্রঋণ তো অন্ততঃ দরিদ্রদের আরও দরিদ্র হওয়া থেকে রক্ষা করেছে, রক্ষা করেছে তাদেরকে রক্তচোষা মহাজনের কবল থেকে। কম হলেও তাদের আয় বৃদ্ধি করেছে। ভোগের উঠা-নামা কমিয়ে তা মসৃণ করেছে। বৃদ্ধি করেছে তাদের সামাজিক মূলধন, মানবিক মূলধন, বস্তুগত সম্পত্তি এবং এভাবে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ উন্মোচিত করেছে। এসব দাবি সত্য কি মিথ্যা অথবা কতটুকু সত্য কতটুকু মিথ্যা তা ঘরে বসে বলা যাবে না। এটি প্রত্যক্ষ তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে কেস বাই কেস নির্ধারণ করতে হবে।

৮. এমনকি আমরা যদি উপরের ইতিবাচক অবদানগুলোর কথা স্বীকার করে নেইও তারপরও প্রশ্ন উঠবে যতটুকু উপকার এখন সম্ভব হচ্ছে তার চেয়ে বেশি উপকার অর্জন করা কি যায় না? সেখানেই প্রশ্ন আসে খুঁজে দেখার। ক্ষুদ্র ঋণের অসংখ্য মডেলের মধ্যে কোন্ মডেলটি সবচেয়ে বেশি কার্যকর এবং দরিদ্রবান্ধব?

৯. ভারতের ক্ষুদ্র্রঋণ মডেল হচ্ছে "দরিদ্রদের স্ব সাহায্যকারী গ্রুপ"। এই মডেলে যে কোন সীমিত সংখ্যক দরিদ্র মানুষ স্বেচ্ছায় একত্রিত হয়ে একটি গ্রুপ গঠন করেন এবং প্রথমে কিছুদিন নিজেরা নিজেদের সঞ্চয় জমান। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকগুলোতে এসব সঞ্চয় হিসাব খোলার সুযোগ ভারত সরকার তাদের দিয়েছেন। একটি নির্দিষ্ট মাত্রার সঞ্চয় জমা হলে ভারত সরকার স্বয়ং সেই তহবিলে ম্যাচিং ফান্ড হিসাবে সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করেন। এরপর গ্রুপ বসে সিদ্ধান্ত নেয় ঐ ফান্ড থেকে কে ঋণ নেবে ; কে বা কারা একত্রে কাজ করবে এবং কীভাবে এবং কী শর্তে ঋণ পরিশোধিত হবে। এই মডেলে কোন মধ্যস্বত্বভোগী নেই। দরিদ্ররা নিজেদের জন্য নিজেদের দ্বারা, নিজেদের সংগঠন গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালনা করছেন। এখানে বিদেশি সাহায্য নেই এবং দরিদ্ররা এখানে কোন লক্ষ্যবস্তু নয় (target group), তারা নিজেরাই নিজেদের কর্তা, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় "আমরা সবাই রাজা, আমাদের এ রাজার রাজত্বে"।

১০. বাংলাদেশে বিভিন্ন এনজিও এবং গ্রামীণ ব্যাংক তাদের নিজস্ব মডেলে ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতাদের সাথে বহুদিন যাবৎ কাজ করে চলেছে। আমার মতে তাদের প্রধান ব্যর্থতা এই যে, তারা ক্ষুদ্র্রঋণ গ্রহীতাকে নায়কে বা কর্তায় (subject) পরিণত করতে পারেননি। হয়তো এক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যর্থতার মাত্রা অপেক্ষাকৃত কম। কারণ অন্ততঃ আইনগতভাবে এই ব্যাংকের মালিকানা দরিদ্রদের হাতে ন্যস্ত। অন্ততঃ নোবেল প্রাইজ পাওয়ার অনুষ্ঠানে সুফিয়া বেগমের যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল যদিও এখন তাঁর কী অবস্থা তা দেশবাসী জানেন না।

এম এম আকাশ:  অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক।