প্রসঙ্গ: সিডও সনদে সংরক্ষণ

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 11 Oct 2014, 06:41 AM
Updated : 11 Oct 2014, 06:41 AM

First comes love, then comes marriage
Then comes name with a baby carriage.
I wish you love, I wish you joy.
I wish you first a baby boy.
And when his hair begins to curl
I wish you then a baby girl.

[পাশ্চাত্যে প্রচলিত ছড়া]

বাংলাদেশের ফেনী জেলার একটি ইউনিয়নের নাম কালীদহ। ওই গ্রামের মায়েদের সন্তান ক'জন জিজ্ঞেস করা হলে তারা অবলীলায় শুধু ছেলেশিশুর সংখ্যাটাই বলেন। মেয়েশিশুদের তারা গণনার মধ্যে আনেন না।

[ "নারী চিত্র: বাংলাদেশ", সেলিনা হোসেন]

কী পাশ্চাত্য কী প্রাচ্য, সর্বত্র নারীর অবস্থা ও অবস্থানে পার্থক্য ঠিক কতখানি– এই দুটো উদাহরণ থেকে খানিকটা বোঝা যেতে পারে। সর্বত্রই একটি ছেলেকে যতটা স্বাগত জানানো হয় ততটা কি হয় মেয়েকে? এখনও?

"কেউ নারী হয়ে জন্মায় না। তাকে নারী করে তোলা হয়…" নারীবাদের বেশিরভাগ সমর্থক সিমন দ্য বুভেয়ারের এই অসামান্য পর্যবেক্ষণের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন না। নারী-পুরুষ হয়ে জন্মানোটা প্রাকৃতিক নিয়মের ফলাফল। কিন্তু সমাজ, সভ্যতা বহুযুগ ধরে মেয়েশিশুকে ফ্রক পরিয়ে, পুতুল খেলতে দিয়ে, ঘরকন্নায় ব্যস্ত রেখে, ঘরের কোণে আটকে রেখে ধীরে ধীরে নারীতে পরিণত করে তোলে।

নারী-পুরুষের সমান অধিকার আদায়ের সংগ্রাম জারি রেখে সমান অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার সংঘবদ্ধ আন্দোলনের ইতিহাস খুব প্রাচীন নয়। গত শতকের বিশের দশকে আমেরিকার নারীরা ভোটাধিকার অর্জন করে। এর ধারাবাহিকতায় ষাটের দশকে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে নারী সমাজে ব্যাপক সচেতনতার সৃষ্টি হয়। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান নারী-পুরুষের সমঅধিকারের দাবিতে বিশ্বের নানা প্রান্তে আন্দোলন গড়ে তোলে।

ক্লারা জেটকিন, যিনি তৎকালীন জার্মান সমাজতান্ত্রিক দলের নারী শাখার অন্যতম নেত্রী, ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে প্রথম নারী দিবস পালনের কথাটি উত্থাপন করেন। তিনি প্রস্তাব দেন যে, প্রত্যেক দেশে নারীর অধিকার আদায়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিবস থাকার প্রয়োজন আছে। ওই সম্মেলনে ১৭ দেশ থেকে আসা শ'খানেক নারী ক্লারা জাটকিনের এই প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছিলেন।

এর ভিত্তিতেই গত শতাব্দীর প্রথম দিকে, ১৯ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হলেও পরে, ১৯১০ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার জন্য প্রস্তাব গৃহীত হয়। এরপর, ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্ব নারী সম্মেলন। এই সম্মেলনে ১৯৭৬-১৯৮৫ সময়কাল ''নারী দশক'' হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

অন্যদিকে জাতিসংঘ নারীর রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালটি ''আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ'' হিসেবে ঘোষণা করে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর 'সিডও সনদ' বা নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসন সনদ পরিগৃহীত হয়। এ সনদকে বলা হয় 'উওম্যানস বিল অব রাইটস'। এতে ৩০ টি ধারা রয়েছে। এর ১ থেকে ১৬ নম্বর ধারা পর্যন্ত নারী -পুরুষের সমতা-সংক্রান্ত নীতিমালা বর্ণিত আছে।

বাংলাদেশে নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনরত সংগঠনগুলোর অব্যাহত চাপের মুখে সরকার ১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর সিডও সনদ স্বাক্ষর করে। তবে দুঃখের বিষয়, স্বাক্ষরকালে ৩ টি ধারার ৪ টি উপধারা সম্পর্কে সংরক্ষণমূলক নীতি অবলম্বন করে বাংলাদেশ। ধারাগুলো হচ্ছে– ২, ১৩.১ (ক), ১৬.১ (গ), (চ)।

২ নম্বর ধারাতে বর্ণিত আছে– বৈষম্য বিলোপের লক্ষ্যে রাষ্ট্র কর্তৃক যথাযথ নীতি ও পদ্ধতি গ্রহণ। সনদের ২ ধারার সাতটি উপধারায় সংবিধান ও অন্যান্য আইনে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের নীতি গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন, বৈষম্য নিষিদ্ধ করার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসহ আইনগত ও অন্যান্য পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা আছে। এছাড়া রয়েছে সমানাধিকারের আইনগত সুরক্ষা প্রতিষ্ঠায় আদালত, ট্রাইব্যুনাল এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থার মাধ্যমে যে কোনো বৈষম্যমূলক কাজের বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা নিশ্চিত করা, নারীর প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করে বিদ্যমান এমন আইন, বিধান, সংশোধন বা বাতিল করার জন্য আইন প্রণয়নসহ উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং এমন সব ফৌজদারি বিধিবিধান বাতিল। ধারা ১৩ .১(ক) পারিবারিক কল্যাণের অধিকার।

১৬.১ (গ) ধারায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার ব্যাপারে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়। আর এই ধারা (চ) অনুচ্ছেদে অভিভাবকত্ব, সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়কত্ব ও পালক সন্তান গ্রহণ অথবা জাতীয় আইনে যেখানে অনুরূপ ধরনের ধারণা বিরাজমান রয়েছে সে সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার ও দায়িত্ব, সব ক্ষেত্রেই সন্তানের স্বার্থ হবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত চারটি অনুচ্ছেদ সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের আন্দোলনে নতুন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এর প্রেক্ষিতে নারী সংগঠনগুলোর ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে ২ ও ১৬.১ (গ) অন্য দুটি ধারার ওপর থেকে আপত্তি তুলে নেওয়া হয় ১৯৯৭ সালে।

লক্ষ্যণীয় যে, ২টি ধারার সংরক্ষণসহ সিডও সনদের স্বীকৃতি মূল সনদের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। জাতিসংঘের নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডওর গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধারা থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করার জন্য আইন কমিশন সরকারকে সুপারিশ পাঠিয়েছে ২০১৩ সালে। এর বিপরীতে সরকার এখন পর্যন্ত এ সুপারিশ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি এবং কমিশনকেও এ বিষয়ে কিছু জানায়নি।

আইন কমিশনের সর্বশেষ সুপারিশে বলা হয়েছে, ধারা ২ পুরোটা কোন অর্থে কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী তার ব্যাখ্যা দেয়নি বাংলাদেশ। অন্য কোনো মুসলিম রাষ্ট্র পুরো ২ ধারাটি কোরআন-সুন্নাহবিরোধী বলে চিহ্নিত করে তা প্রত্যাখ্যান করেনি। এই সনদের সিগনেটরি অন্যান্য দেশ, জার্মানি, বেলজিয়াম, সুইডেন, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস এই শর্ত সংরক্ষণের বিরোধিতা করে আপত্তিও জানিয়েছে। ধারা ১৬ (১) গ বিষয়ে বলা যায়, এ ধারা সম্পূর্ণভাবে কোরআন ও সুন্নাহভিত্তিক শরীয়াহবিরোধী বলা যাবে না। কেননা দেশে প্রচলিত আইনেই নারীর অনেক অধিকার রয়েছে।

বর্তমানে কমিশনের সদস্য শাহ আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, ১৯৯৬ সালের আইন কমিশন আইন অনুযায়ী কোনো বিষয়ে কমিশন সুপারিশ দিলে সরকার প্রতি বছর সংসদের প্রথম অধিবেশনে কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন সংসদে পেশ করবে। তবে কমিশনের পক্ষ থেকে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আইন মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠানো হলেও এ দুটি মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অবস্থান হচ্ছে, ''সিডও সনদ বিষয়ে আইন কমিশনের সুপারিশ আমরা পেয়েছি। তবে তা এখনও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। চার বছর পরপর প্রতিবেদন পাঠানোর বাধ্যবাধকতায় আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ সিডও কমিটির কাছে বাংলাদেশকে প্রতিবেদন পাঠানোর কথা। সরকার সে প্রতিবেদন তৈরির কাজ করছে। সংরক্ষণ প্রত্যাহারের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।''

অন্যান্য বারের মতো সরকার সর্বশেষ প্রতিবেদনেও (২০১০) সিডও কমিটির কাছে সংরক্ষণ প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এবারও সরকার বলেছে, সংরক্ষণ প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনা করছে। অন্যদিকে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে জেনেভায় জাতিসংঘ সিডও কমিটির ৪৮তম অধিবেশনে সরকারের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি করণীয় সম্পর্কে সিডও কমিটি সমাপনী সভায় বরাবরের মতো বাংলাদেশ সরকারকে সংরক্ষণ প্রত্যাহারের তাগিদ দিয়েছে।

পারিবারিক বিষয়ে সমন্বিত আইন না থাকায় মুসলিম আইন, খ্রিস্টান আইন ও হিন্দু আইন ইত্যাদি ধর্মীয় আইন দ্বারা ওই সব ধর্মের অনুসারীরা তাদের পারিবারিক বিষয়াদি পরিচালনা করে এবং প্রতিটি ধর্মীয় পারিবারিক আইনেই নারীর প্রতি চরম বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। ১৬ ধারার সংরক্ষণ এরূপ বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে উৎসাহিত করেছে বলে মনে করা হয়।

অন্যদিকে, সিডও সনদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা হচ্ছে ২ নম্বর ধারাটি। ১৬ এবং ২ নম্বর– এই ধারা দুটো অনুমোদন না করার ক্ষেত্রে শাসক শ্রেণির যুক্তি হচ্ছে, এগুলো ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে। অন্যান্য অনেক মুসলমান অধ্যুষিত দেশ সিডও সনদের সম্পূর্ণ অনুমোদন দিলেও, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ (যেহেতু ইসলামিক রিপাবলিক নয়) কেন সংরক্ষণ ব্যতীত অনুমোদন দিতে পারছে না সেটাই আশ্চর্যজনক। বাংলাদেশ তো আর শরীয়াহ আইন দ্বারা পরিচালিত নয়। আমাদের সংবিধানের ১০ , ১৯, ২৭, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদ হসমূহ শোষণমুক্ত এবং নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের কথা বলে।

সিডও সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও অবস্থা পর্যালোচনামূলক দায়িত্বের অংশ হিসেবে প্রতি ৪ বছর পরপর সিডও কমিটির কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। পরবর্তী প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় বাংলাদেশ সরকার হয়তো সংরক্ষণ সংক্রান্ত নীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তার অবস্থান নতুন করে বিবেচনা করতে পারে– এমনটিই আশা করছেন সিডও নিয়ে কাজ করা সংগঠনসমূহ। সে ক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থেই কার্যকর হবে এই সনদ।

বিপুল ঢক্কা নিনাদে নারী দিবস, সিডও সনদের বার্ষিকী পালনের আয়োজনের জৌলুসের পাশাপাশি নারীর অবস্থান ও অবস্থা পরিবর্তনের আন্তরিক প্রয়াস কাম্য। কেননা লিঙ্গবৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রধানতম হাতিয়ার।

এম এম খালেকুজ্জামান: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।