ইবোলার বিরুদ্ধে লড়াই

ড. জোয়ান লিউ
Published : 3 Sept 2014, 06:13 AM
Updated : 3 Sept 2014, 06:13 AM

ইবোলায় মৃত ১,৪০০ এবং আমাদের সাহায্য প্রয়োজন। আরও চিকিৎসা কেন্দ্র, সমন্বয়মূলক কার্যক্রম, প্রয়োজনীয় রসদ এবং স্বাস্থ্যকর্মী ব্যতীত এই মহামারী দমন করা যাবে না। সম্পূর্ণ পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রচুর স্বাস্থ্যকর্মী মারা যাচ্ছেন। ইতিহাস মতে, অন্য যে কোনো কারণে মৃত্যুর চেয়ে অনেক বেশি লোক ইবোলা মহামারীতে গিনি, লাইবেরিয়া এবং সিয়েরা লিওনে এখনই মারা গেছে এবং তা অপ্রতিহতভাবে এগোচ্ছে। মৃত্যুর হার বর্ধিত হয়ে চলেছে এক জরুরি অবস্থার মধ্যে উদ্ঘাটিত অন্য এক জরুরি অবস্থার দ্বারা।

সহজে প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিৎসা করা যায় এমন সব রোগ, যেমন, ম্যালেরিয়া এবং ডায়রিয়াতেও মানুষ মারা যাচ্ছে; কারণ সংক্রমণের ভয়ে মেডিকেল কেন্দ্রগুলি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কার্যত পতন ঘটেছে। আমি গত সপ্তাহে লাইবেরিয়াতে থাকাকালীন, একদিনে ছয় জন গর্ভবতী মহিলা তাদের সন্তান হারালেন একটি হাসপাতালে তাদের ভর্তি করতে না পারা এবং তাদের জটিলতা সামলাতে না পারার কারণে।

গত দুই সপ্তাহের উপর, কিছু উন্নতির চিহ্ন দেখা গেছে কিন্তু যথেষ্ট সক্রিয়তা নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) এই মহামারীকে "পাবলিক হেলথ এমার্জেন্সি অব ইন্টারন্যাশনাল কনসার্ন" বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং রোগটির সঙ্গে লড়াই করার জন্য অতিরিক্ত তহবিল দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। বিশ্ব ব্যাংক ২০০ মিলিয়ন ডলারের জরুরি তহবিল ঘোষণা করেছে এবং ইউনাইটেড নেশনসের সেক্রেটারি জেনারাল ইবোলার জন্য একজন বিশেষ দূত নিয়োগ করেছেন। কিন্তু ১,৩৫০ টি জীবন শেষই হয়ে গেছে। আরও মৃত্যু রোধ করার জন্য, এই পুঁজি ও রাজনৈতিক উদ্যোগকে কর্মক্ষেত্রে অবিলম্বে কার্যকরী প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত করতে হবে।

আমরা চাই মেডিকেল এবং জরুরি ত্রাণকর্মীরা সংক্রামিত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করুন, মানুষকে প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে শিক্ষিত করে তুলুন এবং চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিতে কাজ করুন। এখনই ফিল্ডে আরও অনেক লোকের প্রয়োজন।

ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস [মেদেসিনস স্যানস ফ্রন্তিএরেস, এমএসএফ]-এর স্বাস্থ্য দল গিনি, সিয়েরা লিওন এবং লাইবেরিয়াতে ৯০০-এর বেশি রোগীর চিকিৎসা করেছেন। এইসব দেশে আমাদের ১,০৮৬ জন কর্মী কার্যরত রয়েছেন এবং আমরা ১২০ শয্যাবিশিষ্ট একটি চিকিৎসা কেন্দ্র খুলেছি লাইবেরিয়ার রাজধানী মনরোভিয়াতে, যা ইতিহাসে ইবোলার জন্য বৃহত্তম কেন্দ্র। কিন্তু এটি এখনই রোগীতে প্লাবিত হয়ে উঠেছে এবং আমাদের অতিরিক্ত সেবা দেওয়ার ক্ষমতাই নেই। এই চ্যুতি অন্যদের পূর্ণ করা দরকার।

সিয়েরা লিওনের কাইলাহানে ২,০০০ মানুষ, যারা ইবোলা রোগীদের সংস্পর্শে এসেছিলেন, অবিলম্বে তাদের খোঁজ নেওয়া দরকার। কিন্তু আমরা তাদের মধ্যে কেবল ২০০ জনকে চিহ্নিত করতে পেরেছি।

স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান এবং দেহ সংগ্রহের কাজ থেমে আছে পরিবহন অথবা তেলের অভাবে। মহামারী বিশেষজ্ঞরা উপকরণগত সহায়তার অভাবে কাজ করতে পারছেন না এবং কখনও ইবোলার সম্মুখীন হয়নি এমন কম্যুনিটির মধ্যে ব্যাপ্তিশীল ভয় স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা বাঁধানোর ক্ষেত্রে প্ররোচিত করছে।

বিশাল সংখ্যক কর্মী নিয়োগ ব্যতীত এই মহামারী থামানো যাবে না। ডাব্লিউএইচওকেই বিশেষত চ্যালেঞ্জটি নিতে হবে। সরকারগুলো, যাদের প্রয়োজনীয় মেডিকেল ও উপকরণগত সংস্থান রয়েছে, আবেদনানুযায়ী তহবিলের ব্যবস্থা করা ছাড়াও তাদের অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং দুর্যোগ ত্রাণ সম্পদ পাঠাতে হবে।

মহামারীটি যথাযথভাবে মানচিত্রায়িত করা, মেডিকেল এবং সর্বসাধারণের ব্যবহার্য সব জায়গায় কার্যকরী সাধারণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করা, নিরাপদ চিকিৎসা কেন্দ্র পরিচালনা, সন্দেহজনক নজির চিহ্নিত করা, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, সক্রিয় সতর্কতা জারি ও রেফারেল পদ্ধতি স্থাপন এবং চূড়ান্তভাবে, মানুষ কীভাবে সংক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে সে বিষয়ে নির্ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত সংস্থান প্রয়োজন।

ভয় মোকাবিলা করা সমানভাবে প্রয়োজনীয়। অন্তরীন এবং কার্ফ্যু কেবলই আরও ভয়ের জন্ম দেবে। মানুষের তথ্য পাওয়ার পথ খোলা থাকা দরকার, না হলে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি অবিশ্বাস কেবলই বৃদ্ধি পাবে এবং সহিংসতার প্ররোচনা দেবে। মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনা এবং অসুস্থদের সেবা দেওয়ার জন্য কম্যুনিটি এবং সরকারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ইবোলার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কিছুটা মানবিকতাও পুনরুদ্ধার করা আবশ্যক।

চিকিৎসক হিসেবে, আমরা প্রশমনসেবার চেয়ে বেশি কিছু দিতে পারিনি কেবলমাত্র বিপুল সংখ্যক সংক্রামিত ব্যাপ্তি এবং উপলব্ধ নিরাময়ের অভাবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় চূড়ান্ত পরিমাপগুলো, যার অন্তর্ভুক্ত হল আঁটসাট প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরিধান করা। এর অর্থ এ-ও যে রোগীদের কষ্ট কমানোর জন্য আমরা তাদের বিছানার পাশে থাকতে পারি না, অথবা পরিবারের সদস্যদের তা করার অনুমতি দিতে পারি না। তাদের অন্তিম মূহূর্তে বহু মানুষ একা মৃত্যুবরণ করছেন।

পরিবারগুলোকে তাদের অসুস্থ পরিজনের সঙ্গে সংযোগ রাখতে দিতে পারার মতো সৃজনশীল সমাধান আমরা খুঁজে বার করতে চেষ্টা করার পাশাপাশি, নিরাপদভাবে ভালোবাসার মানুষদের সমাহিত করার কাজে অন্তত তাদের সহায়তা পাওয়া উচিত। এটা কম্যুনিটিগুলি এবং যারা মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা করছেন তাদের মধ্যে বিশ্বাস পুনরায় গড়ে উঠতেও সহায়তা করবে।

একই সঙ্গে, লাইবেরিয়া এবং সিয়েরা লিওনে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া থেকে প্রতিরোধ করার জন্য অতিরিক্ত সহায়তা প্রয়োজন। বহু বছর ধরে গৃহযুদ্ধের পরে এই দেশগুলি তাদের নাগরিকদের মৌলিক স্বাস্থ্য চাহিদা পূরণের জন্যই লড়াই করছে, এই মাপের একটি গণস্বাস্থ্য এমার্জেন্সির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া তো দূরস্থান। উদাহরণস্বরূপ, সিয়েরা লিওন এবং লাইবেরিয়ায় প্রতি ১০,০০০ মানুষের জন্য যথাক্রমে ০.২ এবং ০.১ জন চিকিৎসক রয়েছেন (ইউনাইটেড স্টেটসের তুলনায় যে হারটি ২৪০ গুণ কম)।

গত সপ্তাহে মনরোভিয়ার সমস্ত হাসপাতাল এক পর্যায়ে এসে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সারা দেশে কোথাও এই মুহূর্তে শল্যচিকিৎসা উপলব্ধ নয়। গর্ভবতী মহিলারা জরুরি ভিত্তিতে সি-সেকশন গ্রহণ করতে পারবেন না। সাধারণ অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্য কেন্দ্র পুনরায় খোলা অথবা প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। অন্যথায় আমরা দ্বিতীয় দফায় এই স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন হব।

এই মহামারী কমিয়ে আনা এবং পুরোপুরি থামানোর জন্য অর্থ এবং বিবৃতির চেয়ে আরও বেশি কিছু প্রয়োজন। ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে প্রতিক্রিয়া বৃদ্ধি হল এই মহামারী দমন করার একমাত্র পদ্ধতি– সীমানা বন্ধ করা এবং বায়ু পর্যটন থামিয়ে দেওয়া নয়।

ইবোলা অথবা আরও কম ক্ষতিকারক রোগগুলি থেকে আগামী বহু সপ্তাহ ধরে মৃত মানুষের সংখ্যা গুণতে থাকার বিষয়টি যদি আমরা কমিয়ে দিতে চাই, তাহলে আজই অর্থপূর্ণ এবং সমন্বিত প্রক্রিয়া প্রয়োজন।

ডা. জোয়ান লিউ: ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস-এর আন্তর্জাতিক প্রেসিডেন্ট।

[লেখাটি মূলত টাইম ডটকম-এ আগস্ট ২১, ২০১৪-তে প্রকাশিত হয়েছিল।]